leadT1ad

পাকিস্তান-আফগানিস্তান শান্তি আলোচনা কেন ব্যর্থ হলো

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক
ঢাকা

এই ব্যর্থতা তাৎক্ষণিক যুদ্ধ ডেকে আনছে না, তবে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, সেই ঝুঁকি বাড়িয়েছে। স্ট্রিম গ্রাফিক।

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে চার দিনব্যাপী আলোচনার পর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আলোচনা ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়েছে ২৮ অক্টোবর। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় অনুষ্ঠিত এই বৈঠককে ‘শেষ চেষ্টা’ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। কিন্তু পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অভিযোগের কারণে আলোচনাটি ভেঙে পড়ে।

পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার ঘোষণা দেন যে, আফগান পক্ষের ‘এড়ানো ও কৌশলগত চাল’-এর কারণে সংলাপ ‘কোনো কার্যকর সমাধান আনতে ব্যর্থ’ হয়েছে।

তবে ১৯ অক্টোবর দোহায় হওয়া আলোচনায় যে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, তা এখনো বহাল রয়েছে। নতুন কোনো বড় সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়নি। তবুও এই অচলাবস্থা সীমান্তে পুনরায় সহিংসতা ও আঞ্চলিক অস্থিরতা বাড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে।

পটভূমি: উত্তেজনার দীর্ঘ চক্র

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যা ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে পরিচিত। এই ঔপনিবেশিক সীমারেখা দীর্ঘদিন ধরে বিরোধের উৎস। ২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান কাবুলের ক্ষমতা দখল করলে দুই দেশের সম্পর্কে আরও অবনতি ঘটে। পাকিস্তান, যা একসময় ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকে তালেবানের বড় সমর্থক ছিল, আশা করেছিল এক বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী পাবে। কিন্তু বর্তমানে ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে, আফগানিস্তান পাকিস্তানবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে, যার ফলে পাকিস্তানে হামলা বেড়েছে।

মূল সমস্যা হলো তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি), যা আফগান তালেবানের মতাদর্শের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হলেও আলাদা সংগঠন। ২০০৭ সাল থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে আসছে এই গোষ্ঠী। অভিযোগ রয়েছে, তারা পূর্ব আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই পাকিস্তানে টিটিপির হামলায় ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অক্টোবরের শুরুতে পাকিস্তান আফগানিস্তানে টিটিপি ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়। এর জবাবে তালেবান পাল্টা আক্রমণ চালায়, যাতে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হয়, তাদের মধ্যে ২০ জনের বেশি পাকিস্তানি সেনা ছিল।

এই সহিংসতার পরেই কাতারের দোহায় দুই দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের উপস্থিতিতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির চুক্তি হয়। এরপর ইস্তাম্বুলের বৈঠকের লক্ষ্য ছিল মূল সমস্যাগুলোর স্থায়ী সমাধান খোঁজা। তবে ১৯৮০-র দশকে পাকিস্তানের আফগান মুজাহিদিনদের প্রতি সমর্থন এবং তালেবান সরকারের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের অভিযোগ পারস্পরিক অবিশ্বাসকে গভীর করেছে। ফলে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

আলোচনার মূল বিষয়বস্তু

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা এবং সীমান্তপারের ‘সন্ত্রাসবাদ’ রোধ করা। পাকিস্তান চেয়েছিল, আফগান তালেবান যেন যাচাইযোগ্য প্রতিশ্রুতি দেয়—যে তারা টিটিপির ঘাঁটি ভেঙে দেবে এবং আফগান মাটি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলায় ব্যবহার হতে দেবে না। এর বিনিময়ে ইসলামাবাদ প্রস্তাব দেয় বন্ধ থাকা সীমান্ত পথগুলো পুনরায় খুলে দেওয়ার, যা বন্ধ থাকায় হাজার হাজার ট্রাক ও কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য আটকে আছে।

অন্য আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল আস্থা পুনর্গঠন, যৌথ সীমান্ত টহল এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। চীন, ইরান, রাশিয়া ও মধ্য এশীয় দেশগুলোও তালেবানকে টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উৎসাহ দেয়।

আফগান প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রশাসনিক বিষয়ক উপমন্ত্রী হাজি নাজিব। তারা যুক্তি দেন, পাকিস্তানের নিরাপত্তা সমস্যা মূলত অভ্যন্তরীণ ইস্যু এবং ‘সন্ত্রাসবাদ’-এর সংজ্ঞা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। গত সোমবার আলোচনাসভা প্রায় ১৮ ঘণ্টা ধরে চলে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের পরিচয় প্রকাশ না করায় পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ হয়ে পড়ে।

আলোচনায় ব্যর্থতার কারণ

পাকিস্তান-আফগানিস্তান শান্তি আলোচনার ব্যর্থতা এসেছে অমীমাংসিত অবস্থান, প্রক্রিয়াগত অচলাবস্থা এবং গভীর পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকে। পাকিস্তান চেয়েছিল, আফগান তালেবান যেন টিটিপির (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান) বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়।

কিন্তু আফগান তালেবান এতে রাজি হয়নি। কারণ তারা টিটিপিকে আফগান অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য সমস্যা মনে করে না। কাবুল অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তারা কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে না। আর টিটিপি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আসলে মতাদর্শিক কারণে আফগান তালেবান ও টিটিপির সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা কাবুলের জন্য রাজনৈতিকভাবে কঠিন।

পাকিস্তান অভিযোগ করে, আফগান প্রতিনিধি দল প্রতিশ্রুতিগুলো থেকে সরে এসেছে এবং ‘কাবুলের নির্দেশ’ না পাওয়া পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি। এতে আলোচনা বিলম্বিত হয়েছে। অপরদিকে, আফগান গণমাধ্যম দাবি করে, পাকিস্তানের কোনো ‘পরিষ্কার যুক্তি’ ছিল না এবং তারা বারবার আলোচনার টেবিল ছেড়ে গেছে। দশকের পর দশক প্রক্সি যুদ্ধ ও সাম্প্রতিক সংঘর্ষ থেকে জন্ম নেওয়া গভীর অবিশ্বাসই এক্ষেত্রে মূল কারণ।

তালেবান প্রতিনিধিরা উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে অগ্রগতি থেমে যায়। পাকিস্তান এটিকে সময়ক্ষেপণ হিসেবে দেখে। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায়ও কোনো সাফল্য আসেনি। কারণ পাকিস্তান তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা ফলাফল চায়, আর আফগানিস্তান সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দেয়।

বাইরের শক্তির প্রভাব, বিশেষ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘মধ্যস্থতার ইঙ্গিত’, আলোচনাকে আরও জটিল করে তোলে। আঞ্চলিক শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থ ও প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা আলোচনা ভেস্তে দেয়।

বিশ্লেষক বাকির সাজ্জাদ সৈয়দ বলেন, ‘গভীর অবিশ্বাস ও পরস্পরবিরোধী অগ্রাধিকার’ দুই পক্ষকেই ছাড় দিতে ভয় পাইয়ে দেয়—যেমন ২০০১ সালে তালেবান আল-কায়েদাকে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইহসানুল্লাহ টিপু মেহসুদ যোগ করেন, তালেবান ‘যুদ্ধবীর মানসিকতা’ থেকে চাপ সহ্য করতে অভ্যস্ত, যা পাকিস্তানকে সামরিক পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করতে পারে।

প্রতিক্রিয়া ও তাৎক্ষণিক ফলাফল

আলোচনার ব্যর্থতার পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল কঠোর। তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার ঘোষণা দেন, ইসলামাবাদের ‘ধৈর্যের সীমা শেষ’ এবং সরকার ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের ব্যবস্থা’ নেবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ সতর্ক করেন, ‘চুক্তি না হলে উন্মুক্ত যুদ্ধ শুরু হতে পারে।’

কাবুলের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তবে আফগান রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম পাকিস্তানকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে অভিযুক্ত করেছে। মধ্যস্থতাকারী কাতার ও তুরস্ক দুঃখ প্রকাশ করে জানায়, নতুন ভেন্যুতে আবার আলোচনার সম্ভাবনা আছে।

এদিকে, মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দেন, তিনি ‘আফগানিস্তান-পাকিস্তান সংকট দ্রুত সমাধান করবেন।’ তবে সীমান্ত এখনো বন্ধ রয়েছে, ফলে বাণিজ্য ও মানবিক সহায়তা স্থবির হয়ে পড়েছে।

আগামীর ঝুঁকি ও সম্ভাবনা

এই ব্যর্থতা তাৎক্ষণিক যুদ্ধ ডেকে আনছে না, তবে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে, সেই ঝুঁকি বাড়িয়েছে। যদি তালেবান নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন, তাহলে টিটিপি আরও সাহস পেতে পারে এবং তরুণ যোদ্ধারা যুক্ত হতে পারে।

পাকিস্তান সামরিকভাবে শক্তিশালী হলেও, বিমান হামলার মতো পদক্ষেপ বেসামরিক হতাহতের ঝুঁকি বাড়াবে এবং আফগানিস্তানে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাবকে উসকে দিতে পারে। তবুও কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। সাময়িক যুদ্ধবিরতি এখনো টিকে আছে, এবং কূটনৈতিক ব্যাকচ্যানেল চালু রয়েছে।

তৃতীয় দফা আলোচনা সম্ভাব্য, তবে টিটিপি ইস্যু সমাধান না হলে স্থায়ী শান্তি অধরাই থেকে যাবে। এতে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার স্থিতিশীলতা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে। আপাতত, ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি টিকে আছে—যা প্রমাণ করে, কথার চেয়ে আস্থা গড়াই এখন সবচেয়ে জরুরি।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা, এপি, দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Ad 300x250

সম্পর্কিত