leadT1ad

‘বড়ে ভাই, আপ ক্যায়সে হ্যায়’—প্রথম বাংলাদেশ সফরে এসে শেখ মুজিবকে ভুট্টো

তিন দিনের সরকারি সফরে আজ ঢাকায় এসেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন প্রথমবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা সফর করেছিলেন। সেই সফর ছিল নানা ঘটন-অঘটনে ভরা। ভুট্টোর বিমানবন্দরে নামার পর কী ঘটেছিল সেদিন?

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৫, ২০: ১৬
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৭৪ সালের ২৭ জুন প্রথমবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা সফর করেছিলেন। তিন দিনের সেই সফরে তিনি শতাধিক সদস্যের বিশাল প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশে আসেন।

তৎকালীন প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ভুট্টোর সফরকে কেন্দ্র করে তখন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। একই সঙ্গে ঘটেছিল নানা নাটকীয় ঘটনা। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার তখন কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ব্যাপক আয়োজন করে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল। তৎকালীন সংবাদপত্রগুলো সেটিকে ‘অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা' হিসেবে বর্ণনা করেছিল।

‘দ্য বাংলাদেশ টাইমস’ জানায়, বিমান থেকে নামার সময় ভুট্টো সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘বড়ে ভাই, আপ ক্যায়সে হ্যায়’। উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আপনি খুব ভাগ্যবান, আজ বৃষ্টি নেই।’ তারপর জুলফিকার আলী ভুট্টোর বলেন, ‘আল্লাহ সব সময়ই দয়ালু, আমাদের জন্য সামান্য ছায়া দিয়ে রাখেন।’

ঢাকায় ভুট্টোর আগমন, বিমানবন্দরে যা ঘটেছিল

১৯৭৪ সালের ২৭ জুন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের (পিআইএ) বিশেষ একটি উড়োজাহাজে করে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় পৌঁছেন। উড়োজাহাজটি সকাল সোয়া ১১টায় ঢাকায় অবতরণ করার কথা থাকলেও বেলা সাড়ে ১১টার দিকে দুপাশে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে ভুট্টো বিমানবন্দরে পৌঁছান। সে সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে বেশ আয়োজন করে স্বাগত জানানো হয়েছিল বলে ঢাকা ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত জাতীয় পত্রিকাগুলোর খবরে বলা হয়েছে।

বিমানবন্দরে ভুট্টোকে স্বাগত জানাচ্ছেন শেখ মুজিব। ছবি: দৈনিক বাংলা, ২৮ জুন ১৯৭৪
বিমানবন্দরে ভুট্টোকে স্বাগত জানাচ্ছেন শেখ মুজিব। ছবি: দৈনিক বাংলা, ২৮ জুন ১৯৭৪

২৮ জুন ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার খবরে বলা হয়, ভুট্টো ও তাঁর সফরসঙ্গীদের স্বাগত জানানোর জন্য বিমানের সিড়ির পাদদেশে অপেক্ষা করছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। ‘দ্য বাংলাদেশ টাইমস’ জানায়, বিমান থেকে নামার সময় ভুট্টো সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখে হাসিমুখে বলেছিলেন, ‘বড়ে ভাই, আপ ক্যায়সে হ্যায়’। উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আপনি খুব ভাগ্যবান, আজ বৃষ্টি নেই।’ তারপর জুলফিকার আলী ভুট্টোর বলেন, ‘আল্লাহ সব সময়ই দয়ালু, আমাদের জন্য সামান্য ছায়া দিয়ে রাখেন।’

কলকাতার ‘যুগান্তর’ পত্রিকাতে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফর প্রধান শিরোনাম হয়েছিল। খবরে বলা হয়, ভুট্টো অনেকক্ষণ শেখ মুজিবকে আলিঙ্গন করেছিলেন। সে সময় শেখ মুজিবকে তিনি চুম্বন করেন। ২৮ জুন প্রকাশিত ইত্তেফাকের খবরেও বলা হয়েছিল, ‘ভুট্টো মুজিবকে জড়িয়ে ধরেন ও কোলাকুলি করেন।’

ভুট্টো মুজিবকে জড়িয়ে ধরেন ও কোলাকুলি করেন। ছবি: বাংলাদেশ অবজারভার, ২৮ জুন, ১৯৭৪
ভুট্টো মুজিবকে জড়িয়ে ধরেন ও কোলাকুলি করেন। ছবি: বাংলাদেশ অবজারভার, ২৮ জুন, ১৯৭৪

জুলফিকার আলী ভুট্টো যখন বিমান থেকে নামছিলেন তখন ১৯ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ফুলের মালা পরিয়ে তাঁকে বরণ করে নেন।

বিমানবন্দরে তৈরি অভ্যর্থনা মঞ্চে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি ইউনিট ভুট্টোকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এ সময়ে বাজানো হয় দুই দেশের জাতীয় সংগীত। কলকাতার যুগান্তরের প্রথম পাতায় এই দৃশ্য নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশ করেছিল। সেখানে দেখা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তাঁর সফরসঙ্গীরা মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত গাইছেন, আর তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ২৮জুন প্রকাশিত কার্টুন
কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় ১৯৭৪ সালের ২৮জুন প্রকাশিত কার্টুন

গার্ড অব অনারের পর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বিমানবন্দরে আগত অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ‘আজাদ’ পত্রিকার প্রতিবেদনে জানা যায়, সেদিন জাতীয় সংসদের তৎকালীন স্পিকার, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য, উচ্চপদস্থ সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি ভারতীয় হাই কমিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান জেএন দীক্ষিতসহ ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসের প্রধানরাও সেদিন বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে পাকিস্তান থেকে ঢাকা আসার পথে জুলফিকার আলী ভুট্টো সেদিন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন। ‘রেডিও পাকিস্তানে’র খবরে জানানো হয়, শুভেচ্ছা বার্তায় ভুট্টো ইন্দিরা গান্ধীর সুস্বাস্থ্য ও সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। পাশাপাশি ভারতের জনগণের মঙ্গলকামনা করেছেন ও ভারতের অগ্রগতির জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন।

সাংবাদিকদেরও দূরে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। ছবি: বাংলাদেশ টাইমস
সাংবাদিকদেরও দূরে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। ছবি: বাংলাদেশ টাইমস

এমন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই দেখা দেয় এক আবেগঘন মুহূর্ত। ‘দ্য বাংলাদেশ টাইমস’—এর খবরে জানা যায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের পিআইএ কর্মকর্তা ও ক্রু সদস্যরা যখন তাঁদের সাবেক সহকর্মী বাংলাদেশ বিমানের কর্মীদের সঙ্গে দেখা করেন, তখন সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন। আবেগে কারও গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু।

একদিকে ‘অভূতপূর্ব সংবর্ধনা’, অন্যদিকে বিক্ষোভ

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সেদিন গোটা বিমানবন্দর ও ঢাকা শহর ছিল কড়া নিরাপত্তার চাদরে মোড়া। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ‘অভ্যর্থনা’ জানানোর ঘটনাকে পত্রিকাগুলো প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছিল।

দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার খবরের শিরোনাম ছিল ‘ঢাকায় ভুট্টোর আন্তরিক অভ্যর্থনা’। দৈনিক আজাদের প্রথম পাতার প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ‘বিমানবন্দরে ভুট্টোকে বিপুল সম্বর্ধনা’। ‘বাংলার বাণী’, ‘পূর্বদেশ’সহ কলকাতার ‘যুগান্তর’ ও ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’তেও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে সম্বর্ধনার খবর প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল।

ভুট্টোর গাড়িবহর, রাস্তার দুপাশে মানুষের ভিড়। ছবি পূর্বদেশ, ২৮ জুন ১৯৭৪
ভুট্টোর গাড়িবহর, রাস্তার দুপাশে মানুষের ভিড়। ছবি পূর্বদেশ, ২৮ জুন ১৯৭৪

সেদিন নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই কঠোর ছিল যে, সাংবাদিকদেরও দূরে দাঁড়িয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে হয়েছিল। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে শেখ মুজিব ও ভুট্টো একই গাড়িতে বঙ্গভবনের উদ্দেশে রওনা হন। ভুট্টোকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরের বাইরেও অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলেন।

তখন তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত অসংখ্য মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে ভুট্টোকে স্বাগত জানান বলে খবরে প্রকাশ হয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি নাগরিকেরাও ছিলেন বলে তখনকার পত্রিকা সূত্রে জানা যায়। তারা পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে তারা বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকারও চেষ্টা করে। পুলিশের লাঠিপেটার সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়।

সেদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে একজন অবাঙালিসহ ১৬ জনকে পুলিশ আটক করেছিল। ছবি: বাংলার বাণী, ২৮ জুন ১৯৭৪
সেদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে একজন অবাঙালিসহ ১৬ জনকে পুলিশ আটক করেছিল। ছবি: বাংলার বাণী, ২৮ জুন ১৯৭৪

বাংলার বাণীর প্রথম পাতায় এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘বাসস’—এর সূত্রে সেই খবরে জানানো হয়, গাড়িবহর নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে বঙ্গভবনে যাওয়ার সময় একদল পাকিস্তানি নাগরিক তাদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য স্লোগান দিতে থাকে। সে সময় সেখান থেকে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন ঢাকার বিভিন্ন স্থান থেকে একজন অবাঙালিসহ ১৬ জনকে পুলিশ আটক করেছিল।

সেদিন বঙ্গভবনের সামনেও একই ঘটনা ঘটে। ‘বিবিসি বাংলা’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভুট্টো বঙ্গভবনে ঢোকার পর অনেকে ভবনের বাইরে ভিড় করেন। পরে দ্বিতীয় দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁদেরকে লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

সেই সফরে ভুট্টোর বিরুদ্ধে দুদফায় বিক্ষোভের প্রথম দফায় বিক্ষোভ হয়েছিল বিমানবন্দরে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হওয়া ও মুক্তিযুদ্ধে স্বজনহারারা এই বিক্ষোভে অংশ নেন। আনন্দবাজার পত্রিকাতেও ভুট্টোর আগমনে ঢাকায় বিক্ষোভের খবর প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল।

Ad 300x250

৩৪ বছর পর চাকসু নির্বাচনের তফসিল আসছে বৃহস্পতিবার

৭১ ইস্যুতে ইসহাক দারের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নয় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

'ভেজাল লাগাইয়া দিয়া যেভাবে নির্লিপ্ত আছেন, এটা আপনাকে সেভ করবে না'

জামায়াতের আমিরের সঙ্গে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ

নির্বাচন কমিশন একটি দলের পার্টি অফিসে পরিণত হয়েছে: হাসনাত আব্দুল্লাহ

সম্পর্কিত