leadT1ad

ইতিহাসের পাতায় ঢাকার অগ্নিকাণ্ড

আজ ঢাকার মিরপুরের একটি পোশাক কারখানা ও পাশের রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় প্রতি বছরই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ঢাকায়। ঢাকা শহরে আগুন লাগা নিয়ে কী বলছে ইতিহাস? বিভিন্ন স্মৃতিকথা ও বইপত্র ঘেঁটে প্রশ্নটির জবাব খোঁজার চেষ্টা।

তারেক আজিজ
তারেক আজিজ
স্ট্রিম গ্রাফিক

১৮৯২ সালের মার্চ মাস। মরমি কবি হাছন রাজার সতেরো বছর বয়সী বড় ছেলে দেওয়ান গণিউর রাজা প্রথমবারের মতো ঢাকা এলেন। ঢাকায় থেকে পড়াশোনা করবার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি চুড়িহাট্টা মহল্লায় ব্যবসায়ী আমিনউদ্দিনের ভাড়া বাসায় উঠলেন। মহল্লাজুড়ে সরু আঁকাবাঁকা গলিপথ আর এর দু–ধারে কাঁচা-পাকা বাড়িগুলো ঠাসাঠাসি করে তৈরি। তিন–চারদিন পর ঘটল এক বিপত্তি। বাসার পশ্চিম দিকে মাইলখানেক দূরের এক মহল্লায় আগুন লাগবার খবর পেলেন তিনি।

আগুন নেভানোর জন্য স্থানীয়দের সঙ্গে ছুটে গেলেন তিনিও। তবে তারা পৌঁছানোর আগেই কয়েকটা বাড়ি পুড়ে গেল। গণিউর রাজা হাওড় অঞ্চলের মানুষ, এমনভাবে এত বাড়িঘর পুড়তে আগে কখনো দেখেননি। ঘটনার ভয়াবহতা তাঁকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছিল যে পরিণত বয়সে ঢাকার স্মৃতি যখন ভ্রমণলিপি আকারে লিখছিলেন, এ ঘটনা উল্লেখ করতে ভোলেননি তিনি।

গণিউর রাজার জন্য এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অভিনব অভিজ্ঞতা হলেও ঢাকাবাসীর জন্য এটি ছিল নিয়মিত ঘটনা। বিশেষত প্রতি শুষ্ক মৌসুমে ঘনবসতি এই শহরের কোথাও না কোথাও আগুন লাগার ঘটনা ঘটত। ১৮৪০ সালে প্রকাশিত টপোগ্রাফি অব ঢাকা বইয়ে জেমস টেলরের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতি বছর এ শহরের তিন থেকে চার শত কাঁচা ঘর অগ্নিকাণ্ডে নিশ্চিহ্ন হতো। আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম পাঁচ দশক পর্যন্ত এমন অনেক অগ্নিদুর্ঘটনার কথা উঠে এসেছে সে সময়ের পত্রপত্রিকা, স্মৃতিকথা, দিনলিপি আর চিঠিপত্রে।

১৯৪৯ সালের নভেম্বরের অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত চকবাজার। ছবি: অমৃতবাজার পত্রিকার সৌজন্যে
১৯৪৯ সালের নভেম্বরের অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত চকবাজার। ছবি: অমৃতবাজার পত্রিকার সৌজন্যে

ঢাকা শহর পোড়ার ইতিহাস

ঢাকার ইতিহাসে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডগুলোর ক্ষয়ক্ষতির পরিধি বুঝতে গেলে এর জনবসতির ধরন ও বিস্তার জানা জরুরি। মুঘল আমলে সুবা বাংলার রাজধানীকালে ঢাকার লোকসংখ্যা প্রায় নয় লাখ ছিল বলে ধারণা করা হয়। মূল নগর তখন বুড়িগঙ্গার তীর ধরে সাত থেকে দশ মাইল পর্যন্ত এবং অভ্যন্তরে প্রায় আড়াই মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন বর্গের আবাসিক এলাকাগুলো শহরের ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছিল। সাধারণ মানুষেরা তখন বসবাস করতেন সহজদাহ্য উপাদান যেমন বাঁশ, খড়, বেত, ছন কিংবা কাঠের তৈরি বাড়িতে।

আঠারো শতকের প্রথমার্ধের যে অগ্নিকাণ্ডগুলোর কথা জানা যায় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৭৩৭ ও ১৭৪৫ সালের অগ্নিকাণ্ড। ১৭৩৭ সালের ২০ মার্চের অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা শহরের বিশাল অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ১৭৪৫ সালে আগুন লেগে পুড়ে যায় কোম্পানির কাঠের গুদামসহ আরো কিছু পণ্যের গুদাম। ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইয়ে ঢাকার বেগমবাজার এলাকার এক অগ্নিকাণ্ডের কথা জানা যায়। ওই এলাকায় মুর্শিদকুলি খানের তৈরি মসজিদের কাছে একটি মাছের বাজার ছিল। ১৭৭৭ সালে বাজারটির দখল নিয়ে সংঘাত বাঁধে। এরপর সংঘটিত এক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যায় গোটা বাজার।

তবে আঠারো শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৭৮৮ সালের মার্চে। ঢাকায় তখন চলছে নায়েবে নাজিমের শাসনকাল। ইংরেজ শাসককে লেখা এক চিঠিতে নওয়াব নুসরাত জং জানান, ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে দমকা বাতাসের কারণে গোটা শহরজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরের দোকানপাট, ঘরবাড়ি কিছুই রক্ষা পায়নি।

তবে আঠারো শতকের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৭৮৮ সালের মার্চে। ঢাকায় তখন চলছে নায়েবে নাজিমের শাসনকাল। ইংরেজ শাসককে লেখা এক চিঠিতে নওয়াব নুসরাত জং জানান, ভয়াবহ সেই অগ্নিকাণ্ডে দমকা বাতাসের কারণে গোটা শহরজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল। শহরের দোকানপাট, ঘরবাড়ি কিছুই রক্ষা পায়নি।

গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ তৈফুরের দেওয়া তথ্যমতে, সেই আগুনে প্রায় ৭০০০ বাড়িঘর পুড়েছিল। পুড়ে ও দম বন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল কমপক্ষে ১০০ মানুষ। এ সময়ে দেশজুড়ে চলছিল দুর্ভিক্ষ। অগ্নিকাণ্ডে গুদামের খাদ্যশস্য সব নষ্ট হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকের তুলনায় তিন-চারগুণ দাম দিয়েও চাল যোগাড় করা সম্ভব ছিল না।

উনিশ শতকে আগুন

উনিশ শতকের পুরোটাজুড়ে অনেকগুলো অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পাওয়া যায়। স্থানীয় সংবাদপত্রের সূত্রে ১৮২৯ সালের মে মাসে ঢাকার নাজিরাবাজারের এক অগ্নি দুর্ঘটনার কথা জানা যায়, যেখানে দুই হাজার কুঁড়েঘরের পাশাপাশি পাকাঘরও পুড়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের পরদিন ১০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এদের ভেতরে সাতজন প্রাণ বাঁচাতে কুয়ার ভেতরে লুকিয়েছিল। আর অন্য তিনজন পাকা বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও ধোঁয়ায় শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা যায়। ভয়াবহ ওই আগুনে শহরের আট হাজার লোক গৃহহীন হয়ে পড়েছিল। দ্য ঢাকা নিউজ পত্রিকায় ১৮৫৮ সালের মার্চ মাসজুড়ে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের খবর ছাপা হয়। বৈরাগিটোলা, সুত্রাপুর ও চাঁদনিঘাটের এসব ঘটনায় প্রায় সাত শ কাঁচাবাড়ি ভস্মীভূত হয়। পত্রিকাটিতে অবিলম্বে কাঁচাঘর বদলে পাকাঘর তৈরির উদ্যোগ নিতে তাগাদা দেওয়া হয়।

অজানা শিল্পীর আঁকা ছবিতে বুড়িগঙ্গা তীরে ঢাকার ঘরবাড়ি, প্যানোরামা অব ঢাকা (১৮৪০)
অজানা শিল্পীর আঁকা ছবিতে বুড়িগঙ্গা তীরে ঢাকার ঘরবাড়ি, প্যানোরামা অব ঢাকা (১৮৪০)

লন্ডনের দ্য হোমওয়ার্ড মেইল পত্রিকার দেওয়া তথ্যে জানানো হয়, ১৮৬০ সালের মার্চে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক এলাকা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই আগুনেরও সূত্রপাত হয় নাজিরাবাজারে এবং দুই ঘণ্টার ভেতরে তা প্রায় পাঁচ মাইল অব্দি ছড়িয়ে শেষ হয় নারিন্দা খ্রিস্টান কবরস্থানে। ছয় হাজার গৃহহীন পরিবারের জন্য সেদিন চাঁদা তুলে সাহায্যের উদ্যোগ নেয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অগ্নিকাণ্ডের পেছনের কারণ জানা যেত না। কিছু দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ছিল কলহ-বিবাদ, দাঙ্গা, আর কিছু ছিল অসাবধানতাবশত। এখানে বলা দরকার যে সেকালে গৃহনির্মাণ সামগ্রীর বিক্রি বাড়ানোর জন্য বাঁশ, কাঠ, খড় বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে গোপনে পাড়ামহল্লায় আগুন লাগানোর অভিযোগ উঠেছিল। ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এতো নিয়মিত ছিল যে লোকেরা তাদের অর্থসম্পদ যা ছিল তা হয় ঘরের মেঝেতে পুতে রাখত, নয়তো চাকাযুক্ত সিন্দুকে ভরে রাখত। আগুন লাগার সংবাদ পেলে সিন্দুকটি সঙ্গে নিয়ে তারা বের হয়ে আসত ঘর থেকে। অনেকে কাপড়ের গিঁটেও টাকাপয়সা বেঁধে রাখত। তবে সিঁধেল চোর আর গিঁটকাটাদের কারণে ভুক্তভোগীদের শেষরক্ষা হতো না বলে জানা যায়।

বিশ শতকেও আগুনের লেলিহান শিখা

বিশ শতকের শুরুতে ব্যাপক সংখ্যায় পাকাবাড়ি নির্মাণ হলেও আগুনের গ্রাস থেকে রক্ষা পায়নি ঢাকা শহরের মানুষ। কাঁচা ঘরবাড়ি, বাজার, দোকানপাটে আগুন লাগা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ঢাকার নবাব পরিবারের দানের তালিকা থেকেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রায় প্রতি বছরই অগ্নি দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য অর্থসাহায্যের কথা উল্লেখ আছে সেখানে। দ্য ইংলিশম্যান পত্রিকার তথ্যমতে, ১৯১৪ সালে রমনার পুরাতন গভর্নমেন্ট হাউজসংলগ্ন বেশ কিছু বাড়িঘর আগুনে পুড়ে যায়। ১৯১৮ সালে মহররমের মিছিলে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। আবার ১৯৪৩ সালের মার্চে নবাব ইউসুফ মার্কেটের ৮০টি দোকান ভস্মীভূত হয়।

তবে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে বিশ শতকের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ছিল ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বরে চকবাজারে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড। অমৃতবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ভোরবেলা কোনো এক চায়ের দোকান থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে ৮০০ দোকান পুড়ে যায়। আর এই পুড়ে যাওয়া সম্পদের অর্থমূল্য ছিল কমপক্ষে দুই কোটি টাকা।

তবে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে এ শতকের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ছিল ১৯৪৯ সালের ১৪ নভেম্বরে চকবাজারে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড। অমৃতবাজার পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ভোরবেলা কোনো এক চায়ের দোকান থেকে এই আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে ৮০০ দোকান পুড়ে যায়। আর এই পুড়ে যাওয়া সম্পদের অর্থমূল্য ছিল কমপক্ষে দুই কোটি টাকা। ঢাকার দমকলকর্মীরা এই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হয়, পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে দমকল এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।

উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে শুরু করে বিশ শতকজুড়ে আগুন লাগার আরেকটি নিয়মিত ঠিকানা ছিল ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে ছড়িয়ে থাকা পাটের ছোটবড় গুদাম। পূর্ব বাংলার প্রধান রপ্তানি পণ্য তখন পাট। বিশ্ববাজারে চাহিদার ওপর ভিত্তি করে দাম ধরে রাখার জন্য প্রায়শ বিপুল পরিমানে পাট গুদামজাত করতে হতো।

১৮৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার এক পাট গুদামে আগুন লেগে পুড়ে যায় প্রায় ১২ হাজার মণ পাট। দ্য ইংলিশম্যান পত্রিকা জানাচ্ছে, ১৯০৭ সালের ৬ নভেম্বরে সন্ধ্যায় পোস্তগোলার ‘মেসার্স রালি ব্রাদার্স’–এর পাটের গুদামে আগুন লেগে পাঁচটি ছাউনিতে জমিয়ে রাখা প্রায় সব পাট পুড়ে যায়। খবর পেয়ে নিকটস্থ ‘মেসার্স নাহাপিয়েট এন্ড কোম্পানি’ তাদের সংগ্রহে থাকা ফায়ার ইঞ্জিন আর হ্যান্ড পাম্প নিয়ে ছুটে আসে এবং ৬ ঘণ্টা চেষ্টা শেষে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়।

পত্রিকার প্রতিবেদনে অগ্নিদুর্ঘটনার আশংকায় রালি ব্রাদার্স কর্তৃপক্ষের ৫০ হাজার টাকার বীমার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। ১৯৪২ সালের অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা এলাকায় অপর একটি গুদামে আগুন লেগে সব পাট পুড়ে যায়।

দমকল ও অন্যান্য উদ্যোগ

আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে বাংলা অঞ্চলে পথিকৃত হলো কলকাতা। গোটা আঠারো শতকজুড়ে ভিন্ন ভিন্ন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কলকাতার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর প্রেক্ষিতে কলকাতায় ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮২২ সালে। তখন এই ব্যবস্থা ছিল পুলিশের অধীনে, যেখানে কাজ করত দুজন বিলাতি কনস্টেবল, দুই শতাধিক দেশি খালাসি আর ভিস্তিওয়ালা। ১৮৬৫ সালে বিলাত থেকে পাঁচটি ফায়ার ইঞ্জিন আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর তিনটি ছিল ঘোড়ায় টানা আর দুটি টানতে হতো মানুষকে।

১৯০৭ সালে তোলা আলোকচিত্রে ঢাকার পোস্তগোলায় ‘মেসার্স নাহাপিয়েট এন্ড কোম্পানি’র পাটের কারখানা ও গুদাম। আলোকচিত্রী: ফ্রিৎজ ক্যাপ, সংগ্রহ: ওয়াকার এ খান
১৯০৭ সালে তোলা আলোকচিত্রে ঢাকার পোস্তগোলায় ‘মেসার্স নাহাপিয়েট এন্ড কোম্পানি’র পাটের কারখানা ও গুদাম। আলোকচিত্রী: ফ্রিৎজ ক্যাপ, সংগ্রহ: ওয়াকার এ খান

তবে দমকল অর্থাৎ হাতল ঘুরিয়ে কলে দম দিয়ে নিকটস্থ ফায়ার স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগের যে প্রযুক্তি, তা চালু হয় আরো পরে, ১৯১০ সালে।

পণ্যের নিরাপদ গুদামজাত করার বিষয়টি ঢাকার ইউরোপীয় বণিকেরা ভেবেছিল বহু আগে। সতেরো শতকে ফরাসি পর্যটক তাভার্নিয়ের ঢাকায় ওলন্দাজ ও ইংরেজ ফ্যাক্টরির কিছু সুগঠিত দালান প্রত্যক্ষ করেন। টেলর তাঁর টপোগ্রাফি অব ঢাকা বইয়ে উল্লেখ করেন ঢাকায় আধুনিক ফায়ার সার্ভিস চালুর প্রয়োজনীয়তার কথা। সুলভ সমাধান হিসেবে তিনি ঢাকায় প্রচুর কুয়া খননের পরামর্শ দেন।

ইতিহাসবিদ অপধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদের লেখা ‘ঢাকা: ইতিহাস ও নগরজীবন ১৮৪০-১৯২১’ বই থেকে জানা যায়, ১৮৪০ সালে গঠিত ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটি’ ঢাকার অব্যবহৃত কুয়াগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। শুকনো মৌসুমে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেশি থাকায় সরকারি জলাধারগুলোকে সংস্কার করে আরও গভীর করা হয়। শহরের কোথাও আগুন লাগলে পানি সরবরাহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি জলাধার ছিল লালবাগের পুকুর ও আরমানিটোলার দিঘি। দুটোরই প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়। ১৮৪৬ সালে কমিটি সরকারের কাছে একটি অগ্নিবির্বাপক যন্ত্র কেনার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হয়। ওই সময় সরকারের বক্তব্য ছিল, উল্লেখিত যন্ত্রে ব্যবহৃত চামড়ার পাইপ ঢাকার আবহাওয়ায় দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে এবং স্থানীয় কারিগররা তা মেরামত করতে পারবে না।

গণিউর রাজার স্মৃতিকথায় ১৮৯২ সালে দমকল ছুটে আসার কথা থাকলেও ধারণা করা যায়, নিকটস্থ জলাধার থেকে পানি নিয়েই আগুন নেভানোর কাজ সমাধা করত ঢাকাবাসীরা; আধুনিক কোনো অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা তখনো ছিল না। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে ধীরে ধীরে বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠতে থাকে। বিশেষত অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা পাট গুদামগুলো নিজ উদ্যোগে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯০৭ সালের রালি ব্রাদার্সের পাট গুদামের আগুন নেভাতে ‘মেসার্স নাহাপিয়েট এন্ড কোম্পানি’র ফায়ার ইঞ্জিনের কার্যকরী অংশগ্রহণে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিসের অধীনে গোটা বাংলা অঞ্চলে ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা ছিল ২৭৫। ৫০০ থেকে ১০০০ গ্যালনের জলাধার ট্রাকে বসিয়ে এবং এর সাথে ট্রেলার পাম্প যুক্ত করে ফায়ার ট্রাক তৈরি করা হয়। ১৯৫১ সালের সরকারি এক হিসাব জানাচ্ছে, তখন ১৭টি ট্রাক ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে অগ্নিনির্বাপণ সেবায় নিয়োজিত ছিল।

এরপর আরও ৭৪ বছর পেরিয়ে গেছে। দমকল সেবায় যুক্ত হয়েছে নতুন প্রযুক্তির সব উপাদান। এককালে ঢাকাবাসী, এমনকি এর নীতিনির্ধারকদের ধারণা ছিল যে কাঁচা ঘরবাড়ি বদলে পাকা বাড়ি তুললে অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমে আসবে। ঢাকায় এখন কাঁচা স্থাপনার সংখ্যা হাতে গোনা। সুউচ্চ ঝকঝকে সব দালানের এই শহর তবুও অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি মুক্ত হতে পারেনি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত