leadT1ad

এআই আমাদের স্মার্ট করছে, নাকি শুধু ‘স্মার্ট’ ভাবাচ্ছে

এআই চ্যাটবট খুলে প্রথম উত্তরটাই আমরা এখন ‘ঠিক’ ধরে নিই। দ্রুত সমাধান আমাদের তৃপ্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু গবেষণা বলছে এই ভরসাই ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের নিজের ভাবনা, যাচাই আর সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা।

এআইয়ের উত্তরেই ভরসা, আমরা কি চিন্তা করা ভুলে যাচ্ছি? ছবি: স্ট্রিম গ্রাফিক

সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে রাফি একটা নোট লিখছিল। সামনে দুটো বই, ল্যাপটপ খোলা, টেবিলে হালকা অগোছালো কাগজপত্র। কিন্তু রাফি বই নয়, এআই চ্যাটবট খুলে রেখেছে। একটা প্রশ্ন টাইপ করল, আর মুহূর্তেই উত্তর পেয়ে গেল। মুখে তৃপ্তির হাসি উত্তর পেয়ে গেছে।

আমি তাকিয়ে বললাম, ‘আরেকবার যাচাই করে দেখবি?’ রাফি মাথা নেড়ে বলল, ‘এআই বলছে ঠিক। মানে ঠিকই।’

এই দৃশ্যটা আজকাল খুব পরিচিত। আমাদের প্রজন্ম অথবা আরও বড় করে বললে, পুরো দুনিয়া এখন উত্তর খোঁজে হাতে থাকা স্মার্টফোনে। উত্তর যত দ্রুত আসে, আমরা তত দ্রুত মনে করি ‘আমরা’ খুব ভালো কাজ করেছি। অথচ গবেষণা বলছে, এই দ্রুততা আসলে আমাদের মাথাকে ধীরে ধীরে কম ব্যবহার করতে শেখাচ্ছে।

এআই আমাদের কাজ দ্রুত করছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরের যে ‘সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি’, সেটাকেই ধীরে ধীরে স্থবির করে দিচ্ছে। সংগৃহীত ছবি
এআই আমাদের কাজ দ্রুত করছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরের যে ‘সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি’, সেটাকেই ধীরে ধীরে স্থবির করে দিচ্ছে। সংগৃহীত ছবি

আমরা আসলে কতটা জানি?

‘ডানিং-ক্রুগার ইফেক্ট’ নামে একটা মনোবৈজ্ঞানিক ধারণা আছে। সহজ ভাষায় যারা কোনো কাজে তেমন ভালো না, তাঁদের অনেকেই নিজেদের নিয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। আর যারা সত্যিকারের দক্ষ, তাঁরা নিজেদের ‘কম জানা লোক’ ভাবতে থাকে।

মানুষ এই ভুল করে সাধারণত নিজের বিচারশক্তির ওপর অতিরিক্ত ভরসা করে ফেলেই। মানে আমরা ভাবি ‘আরে, এটা তো আমি জানি’। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

দশকের পর দশক ধরে এই তত্ত্ব মানুষকে বুঝিয়েছে যে আমরা নিজেদের ক্ষমতা কে খুব ভুলভাবে দেখি। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে এআই এসে সেই পুরোনো চিত্রটাই বদলে দিচ্ছে।

ফিনল্যান্ডের আলটো ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা দেখেছেন মানুষ যখন এআই ব্যবহার করে কোনো সমস্যার সমাধান করে, তখন সবাই নিজেদের দক্ষতাকে অতিরিক্তভাবে বড় করে দেখে। মজার কথা হলো, যারা এআই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, তাঁরাই নিজেদের সবচেয়ে বেশি ‘ওভারএস্টিমেট’ করে।

ফিনল্যান্ডের আলটো ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা দেখেছেন মানুষ যখন এআই ব্যবহার করে কোনো সমস্যার সমাধান করে, তখন সবাই নিজেদের দক্ষতাকে অতিরিক্তভাবে বড় করে দেখে। মজার কথা হলো, যারা এআই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে, তাঁরাই নিজেদের সবচেয়ে বেশি ‘ওভারএস্টিমেট’ করে।

৫০০ মানুষের ওপর এই গবেষণাটি চালানো হয়েছে। প্রশ্ন ছিল উচ্চতর যুক্তিভিত্তিক। অর্ধেককে বলা হলো তোমরা এআই ব্যবহার করতে পারো। অন্য অর্ধেককে বলা হলো নিজেরা ভাবো।

সবাই যখন কাজে হাত দিল, দেখা গেল এআই ব্যবহারকারীরা খুব দ্রুত উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে গেল। তাঁরা ধরে নিল, উত্তর ঠিক। আর কাজ শেষে যখন তাঁদের জিজ্ঞেস করা হলো ‘তোমার পারফরম্যান্স কেমন হলো বলে মনে হচ্ছে?’

তখন বেশিরভাগই বলল, অসাধারণ! কিন্তু আসল স্কোর বলল উল্টো কথা। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো যারা এআই ব্যবহারে বেশি অভ্যস্ত তাঁরা নিজেদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছেন।

কেন এমন হচ্ছে?

গবেষকেরা বলছেন, আমরা অনেকেই এআইয়ের দেওয়া প্রথম উত্তরটাকেই চূড়ান্ত ধরে নিই। এক ধরনের অদৃশ্য ভরসা তৈরি হয়, স্ক্রিনে যা দেখছি, সেটাই ঠিক। ফলে প্রশ্নটাকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করা, বিকল্প ব্যাখ্যা খোঁজা বা উত্তরের ভেতরের যুক্তিটা খতিয়ে দেখা—এসব করার প্রয়োজনই আর অনুভব করি না। মনোবিজ্ঞানে এই প্রবণতাকে বলা হয় ‘কগনিটিভ অফলোডিং’, অর্থাৎ চিন্তা করার দায়িত্বটা নিজের মাথা থেকে সরিয়ে এআইয়ের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া।

না, এআই খারাপ নয়। বিপদ নিহিত আমাদের ভরসার জায়গাটায়। ভুল আত্মবিশ্বাস বাড়ে, আর তার চেয়েও বড় ক্ষতি নিজের বিচারশক্তি, নিজের হিসাব-নিকাশ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।

উত্তরের সঙ্গে সঙ্গেই যেন আমাদের দায়িত্ব শেষ, আর সেটি সত্য কি না তা যাচাই করার অভ্যাস দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে কমে যাচ্ছে নিজের যুক্তি-বিশ্লেষণের ওপর ভরসা, কমে যাচ্ছে সমালোচনামূলক চিন্তার প্রবণতা। যেটাকে গবেষকেরা বলেন ‘মেটাকগনিটিভ মনিটরিং’, অর্থাৎ নিজের চিন্তা-প্রক্রিয়াকে নিজে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা।

আরও একটি দিক হলো এআই ব্যবহার করলে দুর্বল ব্যবহারকারীরা কিছুটা ভালো করে, আর যারা ভালো, তাঁরাও আরও একটু ভালো করে। ফলে দুই প্রান্তের দক্ষতার ফারাক কমে যায়। কিন্তু এই সামান্য উন্নতিই আমাদের ভুল ধারনায় ভরিয়ে দেয়। মনে হয় আমরা ‘দারুণ ভালো’ করছি, অথচ আমাদের বাস্তব পারফরম্যান্স সেই আত্মবিশ্বাসের কাছাকাছিও নয়।

তাহলে কি এআই খারাপ?

না, এআই খারাপ নয়। বিপদ নিহিত আমাদের ভরসার জায়গাটায়। ভুল আত্মবিশ্বাস বাড়ে, আর তার চেয়েও বড় ক্ষতি নিজের বিচারশক্তি, নিজের হিসাব-নিকাশ করার ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। গবেষকেরা সতর্ক করছেন এভাবে চলতে থাকলে আমরা ভুল ধরতে কম পারব, প্রশ্ন তুলতে কম পারব, আর সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করব বারবার। এআই আমাদের কাজ দ্রুত করছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরের যে ‘সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি’, সেটাকেই ধীরে ধীরে স্থবির করে দিচ্ছে।

তবে সমাধান আছে, আর মজার বিষয় হলো সমাধান এআই-ও দিতে পারে। গবেষকরা বলছে যদি এআই আমাদের শুধু উত্তর না দিয়ে, বরং পাল্টা প্রশ্ন করে ‘তুমি কি এই উত্তর নিয়ে নিশ্চিত?’, ‘আর কোন ব্যাখ্যা হতে পারে?’, ‘এটা যাচাই করতে চাও?’—তাহলে ব্যবহারকারী বাধ্য হবে ভাবতে, থামতে, আর নিজের যুক্তিকে কাজে লাগাতে। পাশাপাশি এআইকে শেখানোর যে কোনো প্রশিক্ষণে শুধু টেকনিক্যাল স্কিল নয়, সবচেয়ে জরুরি হবে সমালোচনামূলক চিন্তার অনুশীলন। কারণ ভবিষ্যতের দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় দক্ষতা হবে এআই নয়, বরং নিজের বিচারশক্তির ওপর ভরসা করে গভীরভাবে ভাবতে পারা।

তথ্যসূত্র: লাইভ সায়েন্স

Ad 300x250

সম্পর্কিত