আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস
সমকালীন বাংলাভাষী শিশুরা কি ‘বাল্যশিক্ষা’ পড়ে? মনে হয় না, ডিজিটাল শিক্ষার দুনিয়া বদলে গেছে। তবে একসময় ‘বাল্যশিক্ষা’ই ছিল পূর্ব বাংলায় শিক্ষার এক সাংস্কৃতিক প্রতীক।
এ অঞ্চলের অগণিত মানুষের শিক্ষার সূচনা ঘটেছে বাল্যশিক্ষা দিয়ে। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে জানা যাক ‘বাল্যশিক্ষার সেই স্মৃতিজাগানিয়া ইতিহাস।
সুমন সাজ্জাদ
আশির দশকের মাঝামাঝি। হারিকেনের আলো-জ্বলা এক ছোট্ট শহরে আমরা থাকি। এক সন্ধ্যায় আমার হাতে উঠে এল একটি বই। মলাটে একটি মেয়ে আর একটি ছেলের ছবি। বইটির নাম ‘বাল্যশিক্ষা’। প্রতিবেশী বন্ধুর নানা ছিলেন বইয়ের দোকানের মালিক। ওখানেই বইটি দেখেছিলাম। ওই দোকান থেকে কিনে আনলাম বইটি। তখনো পড়তে শিখিনি। তবে মনে আছে, আমার একটা স্লেট ছিল আর ছিল এক বাকশো চক। বাসা বদলের সময় হারিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত। ফলে ‘বাল্যশিক্ষা’ হয়ে গেল আমার পুস্তক। আম্মা অথবা আব্বা পড়ান সেই বই। মনে গেঁথে গিয়েছিল লেখকের নাম--রামসুন্দর বসাক।
এখনো স্টেশন, লঞ্চঘাট অথবা ফেরিওলার দোকানে পাওয়া যায় ‘বাল্যশিক্ষা’; এটি শুধু বই নয়, পূর্ব বাংলায় শিক্ষার এক সাংস্কৃতিক প্রতীক। এ অঞ্চলের অগণিত মানুষের শিক্ষার সূচনা ঘটেছে বাল্যশিক্ষা দিয়ে। সে অর্থে রামসুন্দর বসাকই পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রথম শিক্ষক, দূর থেকে যিনি বিদ্যার্থীর হাতেখড়ির পথকে প্রশস্ত করতে পেরেছিলেন।
আশিস খাস্তগীরের ‘বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ’ বইয়ে জানিয়েছেন, ‘বাল্যশিক্ষা’ বেরিয়েছিল ১৮৭৭ সালের জুন মাসে। ঢাকা থেকে বইটি ছেপেছিল সুলভ প্রেস। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৭। মূল্য ১ আনা ৫ পাই। প্রথম মুদ্রণে ছাপা হয়েছিল তিন হাজার কপি। প্রকাশের পর পরই বিপুল জনপ্রিয়তা পেল বাল্যশিক্ষা। পূর্ববঙ্গের ইনস্পেক্টর অব স্কুলস আর ঢাকা স্কুল কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর বইটি শিশুদের জন্য স্কুলপাঠ্য বই আকারে ছাপা শুরু হয়। আট মাসের মধ্যে পাওয়া যায় দ্বিতীয় সংস্করণ। এবার মুদ্রিত হয় চার হাজার কপি।
অচিরেই ‘বাল্যশিক্ষা’ পেরিয়ে গেল ঢাকার সীমানা। ছাপা শুরু হলো কলকাতা থেকে। বইটি বিস্তারের এক নিখুঁত হিসাব তুলে ধরেছেন আশিস খাস্তগীর। ১৮৭৮ সালে ছাপা হয়েছিল পঞ্চম সংস্কারণ, মুদ্রণ সংখ্যা ছয় হাজার কপি। ১৮৭৯ সালের সপ্তম সংস্করণে মুদ্রণ সংখ্যা দাঁড়ায় দশ হাজার।
‘বাল্যশিক্ষা’র জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেছে সেকালের মুদ্রণ যন্ত্রালয়গুলো। বইয়ের বাজারে এনেছে নতুন লেখক। একই নামে তারিণীচরণ বসুচৌধুরী লিখেছেন আরেকটি বই। ১৮৮১ সালে দ্বারকানাথ পাল লিখেছেন ‘বাল্যশিক্ষা’। একই নামের বইয়ের আরও লেখক নফরচন্দ্র, বনমালী বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রকুমার রায়। খাস্তগীর ঠাট্টার ছলে লিখেছেন, ‘রামসুন্দরের বাল্যশিক্ষা বিখ্যাত হবার পর আরও তিনজন রাম “বাল্যশিক্ষা” রচনায় এগিয়ে এলেন।’ এই তিন রাম হলেন রামচন্দ্র বসাক, রামচন্দ্র বাণিক্য ও রামচরণ বসাক।
‘বাল্যশিক্ষা’ শব্দবন্ধ যুক্ত করে বাজারে এল নতুন বই চিরঞ্জীব শর্ম্মার ‘বাল্যশিক্ষা-২’, শ্রীনাথ গুহের ‘সরল বাল্যশিক্ষা’ (১৮৮৪), শরৎচন্দ্র দাসের ‘সহজ বাল্যশিক্ষা’ (১৮৯৩), কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্নের ‘নব বাল্যশিক্ষা’ (১৮৯৯)। উনিশ শতকে জনপ্রিয় বইয়ের ক্ষেত্রে এ রকম অনুসরণের প্রবণতা লক্ষ করা যেত। বিশ শতকে বেরিয়েছিল রাসবিহারী মুখটির ‘আদর্শ বাল্য-শিক্ষা’।
বিংশ শতকের বিশের দশকে মুসলমান লেখকেরাও লিখেছিলেন ‘বাল্যশিক্ষা’ নামযুক্ত বই-- মহম্মদ আব্দুর রজকের ‘মক্তব বাল্যশিক্ষা’, ইমদাদ আলীল ‘বালকনূর বা বাল্যশিক্ষা’। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া আল্ হক্ সাহিত্য সমিতি থেকে প্রকাশিত বার্ষিক মুখপত্র ‘আল্হক্ ম্যাগাজিনে’ (১৯২৯) পাওয়া যাচ্ছে বাল্যশিক্ষা প্রকাশ-সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপন, ‘মুস্লিম বাল্যশিক্ষা, সত্বরই প্রকাশিত হইবে।’ প্রকাশিত হয়েছিল কি না, জানি না। এই নামকরণ ও পুস্তক পরিকল্পনা গণমনস্তত্ত্বে ‘বাল্যশিক্ষা’র উপস্থিতির চিহ্নায়ক।
শুধু বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল নয়, ‘বাল্যশিক্ষা’ পাঠ্য ছিল ত্রিপুরার স্কুলগুলোতে। বিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরে যাঁরা এ অঞ্চলের শিক্ষার্থী ছিলেন, তাঁদের অনেকের ভাষ্যেই জানা যায়, সূচনাপর্বে তাঁরা ‘বাল্যশিক্ষা’ ও ‘ধারাপাত’ পড়েছেন।
কিন্তু কোনো ‘বাল্যশিক্ষা’ই রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’কে পেরিয়ে যেতে পারেনি। বিভ্রান্তি এড়াতেই সম্ভবত পরবর্তীকালে কোনো একসময় রামসুন্দর বসাকের বইয়ের নাম বদলে লেখা হয়েছে ‘আদি বাল্যশিক্ষা’। উনিশ ও বিশ শতকে বইয়ের নামের সঙ্গে ‘আদি’ যোগ করে নকল বই থেকে মূল বইকে আলাদা করা হতো। রামসুন্দর বসাকের বইয়ের ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছে।
বইয়ের বাজারে তখনো প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করছে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ (১৮৪৯), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ (১৮৫৫)। দুজনই শিক্ষক। প্রথমজন কবি, দ্বিতীয়জন গদ্যকার। শিক্ষক ও লেখকের যৌথতায় রচিত এই দুই বইয়ের শিক্ষাতাত্ত্বিক প্রভাব ব্যাপক। বিশেষ করে, বাংলা ভাষা শিখন ও শিক্ষাদানে এখনো বই দুটি চিন্তার জোগান দেয়।
মদনমোহন ও বিদ্যাসাগরের বই যখন শততম সংস্করণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’র প্রথম সংস্করণের ধুমধাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বেশ বিস্ময়কর ব্যাপার। বিনয়ভূষণ রায় তাঁর ‘শিক্ষাসংস্কার ও বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘উনিশ শতকের শেষভাগে অনেক শিশুপাঠ্য বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘বাল্যশিক্ষা’ বাদে অন্য কোনো বই ‘বর্ণপরিচয়ে’র মতো বহুল পরিমাণে মুদ্রিত এবং সংস্করণে প্রকাশিত হয়নি।’
বাংলা অঞ্চলের মানুষের স্মৃতিচারণমূলক রচনা ও সাহিত্যে পাওয়া যায় ‘বাল্যশিক্ষা’র উল্লেখ। অদ্বৈতমল্ল বর্মণের ‘তিতাশ একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে এমন বর্ণনা, ‘বাল্যশিক্ষা বই খুলিয়া তাহারা যখন উঠনের মাটিতে হাতি-ঘোড়া আঁকিতে বসিল, বাসন্তীর তখন আনন্দ ধরে না।’ গ্রামের বাজারে যে ‘বাল্যশিক্ষা’ বিক্রি হতো, তার বিবরণও আছে তিতাস পারের আখ্যানে, ‘এক একটা দোকানে এত সামগ্রী। বনমালী পাশে বসিয়া দুই তিনটা সাবানের গন্ধ শুকিয়া বলিল, জলেভাসা সাবান আছে? আছে শুনিয়া গন্ধ শুকিয়া দর করিয়া রাখিয়া দিল। কাচের চুড়ির মধ্যে তিন আঙুল ঢুকাইয়া মাপ আন্দাজ করিল, তারপর রাখিয়া দিল। কিনিল না। কিনিল খালি কয়েকটা বড়শি। এক কোণে কতকগুলি বাল্যশিক্ষা, নব-ধারাপাত বই। অনন্ত ইত্যবসরে বসিয়া পাতা উল্টাইতে শুরু করিয়া দিল। দুইটা গরু নিয়া এক কৃষক চাষ করিতেছে। ছবিটাতে চোখ পড়িতে না পড়িতে দোকানি ঝংকার দিয়া উঠিল। অনন্তর আর দেখা হইল না।’
একসময় অনন্ত পড়তে শেখে। নিরক্ষরের সাক্ষর হয়ে ওঠার গল্প তাই ‘বাল্যশিক্ষা’কে বাদ দিয়ে এগোয় না। অদ্বৈতমল্ল বর্মণ আবার লিখেছেন অনন্তের পড়ালেখার অধ্যায়, ‘শিশুশিক্ষা শেষ করিয়া বাল্যশিক্ষা ধরে। তার সঙ্গে ধারাপাত। ঘোড়ায় চড়িল আবার পড়িল, কথাগুলি নূতন কিন্তু আখরগুলি চেনা। শিশুশিক্ষাতেই এসবই পাওয়া গিয়াছে। এখানে একটা ছবি আছে। লোকটা ঘোড়া ছুটাইয়াছে। পড়িয়া যাওয়ার ছবি নাই। কোন্ সময় পড়িয়া গিয়া উঠিয়া পড়িয়াছে, সেটা দেখিতে পায় নাই বলিয়াই ছবি দেয় নাই। তারপর আসিল যুক্তাক্ষর। এগুলি কঠিন এবং জটিল। কিন্তু এই কঠিনতায় জটিলতায় যে একটা মোহ আছে, অনন্তকে তাহা পাইয়া বসিল। তারা নূতন নূতন রূপ নিয়া তার মানসলোকে আপনা থেকে আসিয়া ধরা দিতে লাগিল।’
একঝলক স্মৃতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁর ‘পিতৃপুরুষ’ বইয়ে, ‘আমি আর ভিতর-বাড়িতে গেলুম না। বড়-কাকা আমার ইজের-জামা-জুতো এনে কাছারি-ঘরে পৌঁছে দিলেন। আমার একটা ‘পসিং শো’-মার্কা টিনের বাক্স ছিল। তার মধ্যে আমার স্লেট, পেনসিল, ধারাপাত, বাল্যশিক্ষা, গুল্তি আর কাঁচের গুলি থাকত। সেটাও তিনি দিয়ে গেলেন।’
কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘স্মৃতির সন্ধানে’ বইয়ে বাল্যশিক্ষার উল্লেখ পাচ্ছি; তাঁর হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের বিবরণটি পড়া যাক, ‘অনুষ্ঠান উপলক্ষে গালিচা সদৃশ একটি ফরাস পাতা হলো। ফরাসে আমাকে পশ্চিমমুখ করে বসিয়ে আমার মুখোমুখি বসেছিলেন আমার নানা, মৌলভি সাহেব এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। একটা কারুকার্যময় বালিশের ওপর রাখা হয়েছিল একটি আমপাড়া, রামসুন্দর বসাকের “বাল্যশিক্ষা” আর একটি হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ। প্রথমে মৌলভি সাহেব আমাকে পড়ালেন, রাব্বি যিদনি ইলমান--অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমাকে জ্ঞান দান করো। তারপর আমার নানা পড়ালেন, হে প্রভু, আমাকে মানুষ করো। আর ব্রাহ্মণ মহাশয় পড়ালেন, তমোসমা জোতির্গময়--হে প্রভু, আমাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও।’
‘সম্প্রদায়নিরপেক্ষ শিক্ষায় আমপারা ও বাল্যশিক্ষার সহাবস্থান ছিল। শিশুশ্রেণির অভিজ্ঞতায় আবারও এসেছে বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত, অঙ্ক, শুভস্কর, হস্তলিপি, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা, ইংরেজি ফার্স্ট বুক আমি নানার কাছে শিখেছিলাম এবং এসব বিষয়ে কিছু পারদর্শীও হয়ে উঠেছিলাম।’
নন্দিত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে বাল্যশিক্ষা হয়ে উঠেছে ‘অন্তঃপুরে’ বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যম। উপন্যাসের সংলাপ থেকে পড়া যাক, ‘এক টুকরা কয়লা আন । আমি অক্ষর দুইটা লিখব । আজ সন্ধ্যায় তোমার জন্যে বাল্যশিক্ষা কিনে আনব।’ এ বিষয়ে লেখকের বিবরণ, ‘জুলেখা এক টুকরো কয়লা এনেছে। শ্বেতপাথরে সেই কয়লার দাগ বসছে না। হরিচরণ উঠে দীড়ালেন। ঘাটে বসে থাকার পরিকল্পনা তিনি বাদ দিয়েছেন। তিনি বাজারে যাবেন। মেয়েটার জন্যে স্তরে পেন্সিল কিনবেন। বাল্যশিক্ষা কিনবেন।’
মঈনুল আহসান সাবেরের লেখায় স্মৃতি উসকে দিচ্ছে ‘বাল্যশিক্ষা’, ‘আবদুস সাত্তার হাসলেন, না, শৈশবের কারো কথাই আমার তেমন করে মনে নেই। তবে শৈশবের কথা মনে আছে । ভোরবেলা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে আছে, জানালায় বা বারান্দায় বসে বাল্যশিক্ষা কিংবা আরো কিছুটা বেশি বয়সের কথা মনে আছে। ওই যে তুমি বললে না, “পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল/কাননে কুসুম কলি সকলে ফুটিল।"’
নানা ধরনের বয়ান ও লেখা এই সত্যকেই হাজির করে যে ‘বাল্যশিক্ষা’ পূর্ববঙ্গের মানুষের ব্যক্তিক ও যৌথ স্মৃতির অংশ। কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্ববঙ্গে স্কুল সন্বলপাঠ্য বই যখন সহজ্যপ্রাপ্য হয়ে ওঠেনি, তখন ‘বাল্যশিক্ষা’ জ্বেলেছিল প্রদীপের সলতে। কিন্তু কেউ হয়তো তখন ভাবেনি, এই সলতেই হঠাৎ লণ্ঠনের মতো জ্বলে উঠবে, পূর্ববঙ্গ ছাপিয়ে সেই আলো পৌঁছে যাবে কলকাতায়। কিন্তু ‘বাল্যশিক্ষা’র কেন এত জনপ্রিয়তা? মান্য বা আদর্শ পাঠ্যবইয়ের দুষ্প্রাপ্যতাই কি কারণ?
সত্যিকার অর্থে, এই ‘কারণ’কে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কলকাতার তুলনায় বহুগুণ পিছিয়ে থাকা ঢাকা বা পূর্ববঙ্গে শিক্ষার বিস্তার ছিল ধীর গতির। ফলে এই অঞ্চলের শিক্ষাবুভুক্ষু মানুষ যখন একটি আদর্শ কাঠামোর বই হাতে পায়, তখন সেটিকে স্বাভাবিকভাবেই লুফে নেয়। পূর্ববঙ্গের লেখক-প্রকাশক কলকাতার বইয়ের বিকল্প হাজির করেছে, এ-ই বা কম কী! বাজার সরগরম করার জন্য বড় ধরনের একটি সাংস্কৃতিক প্রভাবক।
তা ছাড়া, রামসুন্দর বসাকের আদর্শ ছিল কলকাতার মান্য পুস্তকগুলো, যেমন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। আর তাই ঢাকা বা কলকাতার পাঠক কেউ ‘বাল্যশিক্ষা’কে উপেক্ষা করতে পারেনি। কারণ, ‘বাল্যশিক্ষা’ স্বয়ং কলকাতার ডমিন্যান্ট ডিসকোর্সের অধীন--হোক তা বর্ণ পরিকল্পনায়, শব্দচয়নে। সুধীরচন্দ্র রায় এক লেখায় (১৩৬২) দেখিয়েছেন, বাল্যশিক্ষায় ব্যবহৃত ১০৩১টি শব্দের মধ্যে ৭৫৫টি শব্দ তৎসম। শতকরা হিসেবে ৭৩ ভাগের বেশি শব্দ তৎসম। অন্যদিকে বর্ণপরিচয়ে ৬২৭টি শব্দের মধ্যে ৩৭৫টি ছিল তৎসম। তৎসম শব্দের সংখ্যা শতকরা ৫৯ ভাগের বেশি।
তুলনামূলক পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, কলকাতায় বাংলা ভাষা বিষয়ক সংস্কৃতবাদী যে ডিসকোর্স গড়ে উঠেছিল, ‘বাল্যশিক্ষা’ তা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছে। তবে ‘বাল্যশিক্ষা’ তৈরি করেছে পাল্টা আঞ্চলিক ডিসকোর্স, ঢাকাই পণ্য হিসেবে পুস্তক আকারে উপস্থিত হয়েছে কলকাতার বাজারে। কলকাতাপ্রবাসী পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরাও এই পুস্তকের ক্রেতা। আর তাই বলা যায় যে ‘বাল্যশিক্ষা’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অনুকূল প্রতিবেশ পেয়েছিল।
সমকালীন বাংলাভাষী শিশুরা কি ‘বাল্যশিক্ষা’ পড়ে? মনে হয় না, ডিজিটাল শিক্ষার দুনিয়া বদলে গেছে। এসেছে ইউটিউব চ্যানেল, রাইম, বর্ণ শেখার খেলা। আগের শিশুদের গুনতে হতো তেঁতুল বিচি, বাঁশের কঞ্চি, মুখস্ত করতে হতো দিন-মাসের ছড়া, আর্যা। ‘বাল্যশিক্ষা’ সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের সাংস্কৃতিক চিহ্ন।
এই চিহ্ন নিঃসন্দেহে স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের নস্টালজিয়ায়-- যাকে নিয়ে হাহাকার করা যায়, বিস্ময় আকুলতায় আকস্মিক অভিভূত হওয়া যায়। কেননা অনেকেরই মনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল এই বই। বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গে ঐকতানে মিলবার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিয়েছিল স্বস্তা কাগজে ছাপা ছোট্ট এই পুস্তিকা। তার কাছে আমাদের অনেক অনেক ঋণ। আর সেই ঋণের গল্প লেখা আছে বাঙালির মনের ইতিহাসে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
আশির দশকের মাঝামাঝি। হারিকেনের আলো-জ্বলা এক ছোট্ট শহরে আমরা থাকি। এক সন্ধ্যায় আমার হাতে উঠে এল একটি বই। মলাটে একটি মেয়ে আর একটি ছেলের ছবি। বইটির নাম ‘বাল্যশিক্ষা’। প্রতিবেশী বন্ধুর নানা ছিলেন বইয়ের দোকানের মালিক। ওখানেই বইটি দেখেছিলাম। ওই দোকান থেকে কিনে আনলাম বইটি। তখনো পড়তে শিখিনি। তবে মনে আছে, আমার একটা স্লেট ছিল আর ছিল এক বাকশো চক। বাসা বদলের সময় হারিয়ে গিয়েছিল সম্ভবত। ফলে ‘বাল্যশিক্ষা’ হয়ে গেল আমার পুস্তক। আম্মা অথবা আব্বা পড়ান সেই বই। মনে গেঁথে গিয়েছিল লেখকের নাম--রামসুন্দর বসাক।
এখনো স্টেশন, লঞ্চঘাট অথবা ফেরিওলার দোকানে পাওয়া যায় ‘বাল্যশিক্ষা’; এটি শুধু বই নয়, পূর্ব বাংলায় শিক্ষার এক সাংস্কৃতিক প্রতীক। এ অঞ্চলের অগণিত মানুষের শিক্ষার সূচনা ঘটেছে বাল্যশিক্ষা দিয়ে। সে অর্থে রামসুন্দর বসাকই পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রথম শিক্ষক, দূর থেকে যিনি বিদ্যার্থীর হাতেখড়ির পথকে প্রশস্ত করতে পেরেছিলেন।
আশিস খাস্তগীরের ‘বাংলা প্রাইমার সংগ্রহ’ বইয়ে জানিয়েছেন, ‘বাল্যশিক্ষা’ বেরিয়েছিল ১৮৭৭ সালের জুন মাসে। ঢাকা থেকে বইটি ছেপেছিল সুলভ প্রেস। পৃষ্ঠাসংখ্যা ৪৭। মূল্য ১ আনা ৫ পাই। প্রথম মুদ্রণে ছাপা হয়েছিল তিন হাজার কপি। প্রকাশের পর পরই বিপুল জনপ্রিয়তা পেল বাল্যশিক্ষা। পূর্ববঙ্গের ইনস্পেক্টর অব স্কুলস আর ঢাকা স্কুল কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পর বইটি শিশুদের জন্য স্কুলপাঠ্য বই আকারে ছাপা শুরু হয়। আট মাসের মধ্যে পাওয়া যায় দ্বিতীয় সংস্করণ। এবার মুদ্রিত হয় চার হাজার কপি।
অচিরেই ‘বাল্যশিক্ষা’ পেরিয়ে গেল ঢাকার সীমানা। ছাপা শুরু হলো কলকাতা থেকে। বইটি বিস্তারের এক নিখুঁত হিসাব তুলে ধরেছেন আশিস খাস্তগীর। ১৮৭৮ সালে ছাপা হয়েছিল পঞ্চম সংস্কারণ, মুদ্রণ সংখ্যা ছয় হাজার কপি। ১৮৭৯ সালের সপ্তম সংস্করণে মুদ্রণ সংখ্যা দাঁড়ায় দশ হাজার।
‘বাল্যশিক্ষা’র জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেছে সেকালের মুদ্রণ যন্ত্রালয়গুলো। বইয়ের বাজারে এনেছে নতুন লেখক। একই নামে তারিণীচরণ বসুচৌধুরী লিখেছেন আরেকটি বই। ১৮৮১ সালে দ্বারকানাথ পাল লিখেছেন ‘বাল্যশিক্ষা’। একই নামের বইয়ের আরও লেখক নফরচন্দ্র, বনমালী বন্দ্যোপাধ্যায়, চন্দ্রকুমার রায়। খাস্তগীর ঠাট্টার ছলে লিখেছেন, ‘রামসুন্দরের বাল্যশিক্ষা বিখ্যাত হবার পর আরও তিনজন রাম “বাল্যশিক্ষা” রচনায় এগিয়ে এলেন।’ এই তিন রাম হলেন রামচন্দ্র বসাক, রামচন্দ্র বাণিক্য ও রামচরণ বসাক।
‘বাল্যশিক্ষা’ শব্দবন্ধ যুক্ত করে বাজারে এল নতুন বই চিরঞ্জীব শর্ম্মার ‘বাল্যশিক্ষা-২’, শ্রীনাথ গুহের ‘সরল বাল্যশিক্ষা’ (১৮৮৪), শরৎচন্দ্র দাসের ‘সহজ বাল্যশিক্ষা’ (১৮৯৩), কালীপ্রসন্ন বিদ্যারত্নের ‘নব বাল্যশিক্ষা’ (১৮৯৯)। উনিশ শতকে জনপ্রিয় বইয়ের ক্ষেত্রে এ রকম অনুসরণের প্রবণতা লক্ষ করা যেত। বিশ শতকে বেরিয়েছিল রাসবিহারী মুখটির ‘আদর্শ বাল্য-শিক্ষা’।
বিংশ শতকের বিশের দশকে মুসলমান লেখকেরাও লিখেছিলেন ‘বাল্যশিক্ষা’ নামযুক্ত বই-- মহম্মদ আব্দুর রজকের ‘মক্তব বাল্যশিক্ষা’, ইমদাদ আলীল ‘বালকনূর বা বাল্যশিক্ষা’। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া আল্ হক্ সাহিত্য সমিতি থেকে প্রকাশিত বার্ষিক মুখপত্র ‘আল্হক্ ম্যাগাজিনে’ (১৯২৯) পাওয়া যাচ্ছে বাল্যশিক্ষা প্রকাশ-সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপন, ‘মুস্লিম বাল্যশিক্ষা, সত্বরই প্রকাশিত হইবে।’ প্রকাশিত হয়েছিল কি না, জানি না। এই নামকরণ ও পুস্তক পরিকল্পনা গণমনস্তত্ত্বে ‘বাল্যশিক্ষা’র উপস্থিতির চিহ্নায়ক।
শুধু বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল নয়, ‘বাল্যশিক্ষা’ পাঠ্য ছিল ত্রিপুরার স্কুলগুলোতে। বিশ শতকের প্রথম পঞ্চাশ বছরে যাঁরা এ অঞ্চলের শিক্ষার্থী ছিলেন, তাঁদের অনেকের ভাষ্যেই জানা যায়, সূচনাপর্বে তাঁরা ‘বাল্যশিক্ষা’ ও ‘ধারাপাত’ পড়েছেন।
কিন্তু কোনো ‘বাল্যশিক্ষা’ই রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’কে পেরিয়ে যেতে পারেনি। বিভ্রান্তি এড়াতেই সম্ভবত পরবর্তীকালে কোনো একসময় রামসুন্দর বসাকের বইয়ের নাম বদলে লেখা হয়েছে ‘আদি বাল্যশিক্ষা’। উনিশ ও বিশ শতকে বইয়ের নামের সঙ্গে ‘আদি’ যোগ করে নকল বই থেকে মূল বইকে আলাদা করা হতো। রামসুন্দর বসাকের বইয়ের ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছে।
বইয়ের বাজারে তখনো প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করছে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’ (১৮৪৯), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ (১৮৫৫)। দুজনই শিক্ষক। প্রথমজন কবি, দ্বিতীয়জন গদ্যকার। শিক্ষক ও লেখকের যৌথতায় রচিত এই দুই বইয়ের শিক্ষাতাত্ত্বিক প্রভাব ব্যাপক। বিশেষ করে, বাংলা ভাষা শিখন ও শিক্ষাদানে এখনো বই দুটি চিন্তার জোগান দেয়।
মদনমোহন ও বিদ্যাসাগরের বই যখন শততম সংস্করণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন রামসুন্দর বসাকের ‘বাল্যশিক্ষা’র প্রথম সংস্করণের ধুমধাম জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বেশ বিস্ময়কর ব্যাপার। বিনয়ভূষণ রায় তাঁর ‘শিক্ষাসংস্কার ও বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘উনিশ শতকের শেষভাগে অনেক শিশুপাঠ্য বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘বাল্যশিক্ষা’ বাদে অন্য কোনো বই ‘বর্ণপরিচয়ে’র মতো বহুল পরিমাণে মুদ্রিত এবং সংস্করণে প্রকাশিত হয়নি।’
বাংলা অঞ্চলের মানুষের স্মৃতিচারণমূলক রচনা ও সাহিত্যে পাওয়া যায় ‘বাল্যশিক্ষা’র উল্লেখ। অদ্বৈতমল্ল বর্মণের ‘তিতাশ একটি নদীর নাম’ উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে এমন বর্ণনা, ‘বাল্যশিক্ষা বই খুলিয়া তাহারা যখন উঠনের মাটিতে হাতি-ঘোড়া আঁকিতে বসিল, বাসন্তীর তখন আনন্দ ধরে না।’ গ্রামের বাজারে যে ‘বাল্যশিক্ষা’ বিক্রি হতো, তার বিবরণও আছে তিতাস পারের আখ্যানে, ‘এক একটা দোকানে এত সামগ্রী। বনমালী পাশে বসিয়া দুই তিনটা সাবানের গন্ধ শুকিয়া বলিল, জলেভাসা সাবান আছে? আছে শুনিয়া গন্ধ শুকিয়া দর করিয়া রাখিয়া দিল। কাচের চুড়ির মধ্যে তিন আঙুল ঢুকাইয়া মাপ আন্দাজ করিল, তারপর রাখিয়া দিল। কিনিল না। কিনিল খালি কয়েকটা বড়শি। এক কোণে কতকগুলি বাল্যশিক্ষা, নব-ধারাপাত বই। অনন্ত ইত্যবসরে বসিয়া পাতা উল্টাইতে শুরু করিয়া দিল। দুইটা গরু নিয়া এক কৃষক চাষ করিতেছে। ছবিটাতে চোখ পড়িতে না পড়িতে দোকানি ঝংকার দিয়া উঠিল। অনন্তর আর দেখা হইল না।’
একসময় অনন্ত পড়তে শেখে। নিরক্ষরের সাক্ষর হয়ে ওঠার গল্প তাই ‘বাল্যশিক্ষা’কে বাদ দিয়ে এগোয় না। অদ্বৈতমল্ল বর্মণ আবার লিখেছেন অনন্তের পড়ালেখার অধ্যায়, ‘শিশুশিক্ষা শেষ করিয়া বাল্যশিক্ষা ধরে। তার সঙ্গে ধারাপাত। ঘোড়ায় চড়িল আবার পড়িল, কথাগুলি নূতন কিন্তু আখরগুলি চেনা। শিশুশিক্ষাতেই এসবই পাওয়া গিয়াছে। এখানে একটা ছবি আছে। লোকটা ঘোড়া ছুটাইয়াছে। পড়িয়া যাওয়ার ছবি নাই। কোন্ সময় পড়িয়া গিয়া উঠিয়া পড়িয়াছে, সেটা দেখিতে পায় নাই বলিয়াই ছবি দেয় নাই। তারপর আসিল যুক্তাক্ষর। এগুলি কঠিন এবং জটিল। কিন্তু এই কঠিনতায় জটিলতায় যে একটা মোহ আছে, অনন্তকে তাহা পাইয়া বসিল। তারা নূতন নূতন রূপ নিয়া তার মানসলোকে আপনা থেকে আসিয়া ধরা দিতে লাগিল।’
একঝলক স্মৃতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, তাঁর ‘পিতৃপুরুষ’ বইয়ে, ‘আমি আর ভিতর-বাড়িতে গেলুম না। বড়-কাকা আমার ইজের-জামা-জুতো এনে কাছারি-ঘরে পৌঁছে দিলেন। আমার একটা ‘পসিং শো’-মার্কা টিনের বাক্স ছিল। তার মধ্যে আমার স্লেট, পেনসিল, ধারাপাত, বাল্যশিক্ষা, গুল্তি আর কাঁচের গুলি থাকত। সেটাও তিনি দিয়ে গেলেন।’
কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘স্মৃতির সন্ধানে’ বইয়ে বাল্যশিক্ষার উল্লেখ পাচ্ছি; তাঁর হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের বিবরণটি পড়া যাক, ‘অনুষ্ঠান উপলক্ষে গালিচা সদৃশ একটি ফরাস পাতা হলো। ফরাসে আমাকে পশ্চিমমুখ করে বসিয়ে আমার মুখোমুখি বসেছিলেন আমার নানা, মৌলভি সাহেব এবং ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। একটা কারুকার্যময় বালিশের ওপর রাখা হয়েছিল একটি আমপাড়া, রামসুন্দর বসাকের “বাল্যশিক্ষা” আর একটি হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ। প্রথমে মৌলভি সাহেব আমাকে পড়ালেন, রাব্বি যিদনি ইলমান--অর্থাৎ হে আল্লাহ, আমাকে জ্ঞান দান করো। তারপর আমার নানা পড়ালেন, হে প্রভু, আমাকে মানুষ করো। আর ব্রাহ্মণ মহাশয় পড়ালেন, তমোসমা জোতির্গময়--হে প্রভু, আমাকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যাও।’
‘সম্প্রদায়নিরপেক্ষ শিক্ষায় আমপারা ও বাল্যশিক্ষার সহাবস্থান ছিল। শিশুশ্রেণির অভিজ্ঞতায় আবারও এসেছে বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত, অঙ্ক, শুভস্কর, হস্তলিপি, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা, ইংরেজি ফার্স্ট বুক আমি নানার কাছে শিখেছিলাম এবং এসব বিষয়ে কিছু পারদর্শীও হয়ে উঠেছিলাম।’
নন্দিত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসে বাল্যশিক্ষা হয়ে উঠেছে ‘অন্তঃপুরে’ বিদ্যাশিক্ষার মাধ্যম। উপন্যাসের সংলাপ থেকে পড়া যাক, ‘এক টুকরা কয়লা আন । আমি অক্ষর দুইটা লিখব । আজ সন্ধ্যায় তোমার জন্যে বাল্যশিক্ষা কিনে আনব।’ এ বিষয়ে লেখকের বিবরণ, ‘জুলেখা এক টুকরো কয়লা এনেছে। শ্বেতপাথরে সেই কয়লার দাগ বসছে না। হরিচরণ উঠে দীড়ালেন। ঘাটে বসে থাকার পরিকল্পনা তিনি বাদ দিয়েছেন। তিনি বাজারে যাবেন। মেয়েটার জন্যে স্তরে পেন্সিল কিনবেন। বাল্যশিক্ষা কিনবেন।’
মঈনুল আহসান সাবেরের লেখায় স্মৃতি উসকে দিচ্ছে ‘বাল্যশিক্ষা’, ‘আবদুস সাত্তার হাসলেন, না, শৈশবের কারো কথাই আমার তেমন করে মনে নেই। তবে শৈশবের কথা মনে আছে । ভোরবেলা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ানোর কথা মনে আছে, জানালায় বা বারান্দায় বসে বাল্যশিক্ষা কিংবা আরো কিছুটা বেশি বয়সের কথা মনে আছে। ওই যে তুমি বললে না, “পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল/কাননে কুসুম কলি সকলে ফুটিল।"’
নানা ধরনের বয়ান ও লেখা এই সত্যকেই হাজির করে যে ‘বাল্যশিক্ষা’ পূর্ববঙ্গের মানুষের ব্যক্তিক ও যৌথ স্মৃতির অংশ। কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পূর্ববঙ্গে স্কুল সন্বলপাঠ্য বই যখন সহজ্যপ্রাপ্য হয়ে ওঠেনি, তখন ‘বাল্যশিক্ষা’ জ্বেলেছিল প্রদীপের সলতে। কিন্তু কেউ হয়তো তখন ভাবেনি, এই সলতেই হঠাৎ লণ্ঠনের মতো জ্বলে উঠবে, পূর্ববঙ্গ ছাপিয়ে সেই আলো পৌঁছে যাবে কলকাতায়। কিন্তু ‘বাল্যশিক্ষা’র কেন এত জনপ্রিয়তা? মান্য বা আদর্শ পাঠ্যবইয়ের দুষ্প্রাপ্যতাই কি কারণ?
সত্যিকার অর্থে, এই ‘কারণ’কে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কলকাতার তুলনায় বহুগুণ পিছিয়ে থাকা ঢাকা বা পূর্ববঙ্গে শিক্ষার বিস্তার ছিল ধীর গতির। ফলে এই অঞ্চলের শিক্ষাবুভুক্ষু মানুষ যখন একটি আদর্শ কাঠামোর বই হাতে পায়, তখন সেটিকে স্বাভাবিকভাবেই লুফে নেয়। পূর্ববঙ্গের লেখক-প্রকাশক কলকাতার বইয়ের বিকল্প হাজির করেছে, এ-ই বা কম কী! বাজার সরগরম করার জন্য বড় ধরনের একটি সাংস্কৃতিক প্রভাবক।
তা ছাড়া, রামসুন্দর বসাকের আদর্শ ছিল কলকাতার মান্য পুস্তকগুলো, যেমন মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’, বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’। আর তাই ঢাকা বা কলকাতার পাঠক কেউ ‘বাল্যশিক্ষা’কে উপেক্ষা করতে পারেনি। কারণ, ‘বাল্যশিক্ষা’ স্বয়ং কলকাতার ডমিন্যান্ট ডিসকোর্সের অধীন--হোক তা বর্ণ পরিকল্পনায়, শব্দচয়নে। সুধীরচন্দ্র রায় এক লেখায় (১৩৬২) দেখিয়েছেন, বাল্যশিক্ষায় ব্যবহৃত ১০৩১টি শব্দের মধ্যে ৭৫৫টি শব্দ তৎসম। শতকরা হিসেবে ৭৩ ভাগের বেশি শব্দ তৎসম। অন্যদিকে বর্ণপরিচয়ে ৬২৭টি শব্দের মধ্যে ৩৭৫টি ছিল তৎসম। তৎসম শব্দের সংখ্যা শতকরা ৫৯ ভাগের বেশি।
তুলনামূলক পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, কলকাতায় বাংলা ভাষা বিষয়ক সংস্কৃতবাদী যে ডিসকোর্স গড়ে উঠেছিল, ‘বাল্যশিক্ষা’ তা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করেছে। তবে ‘বাল্যশিক্ষা’ তৈরি করেছে পাল্টা আঞ্চলিক ডিসকোর্স, ঢাকাই পণ্য হিসেবে পুস্তক আকারে উপস্থিত হয়েছে কলকাতার বাজারে। কলকাতাপ্রবাসী পূর্ববঙ্গের অধিবাসীরাও এই পুস্তকের ক্রেতা। আর তাই বলা যায় যে ‘বাল্যশিক্ষা’ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার অনুকূল প্রতিবেশ পেয়েছিল।
সমকালীন বাংলাভাষী শিশুরা কি ‘বাল্যশিক্ষা’ পড়ে? মনে হয় না, ডিজিটাল শিক্ষার দুনিয়া বদলে গেছে। এসেছে ইউটিউব চ্যানেল, রাইম, বর্ণ শেখার খেলা। আগের শিশুদের গুনতে হতো তেঁতুল বিচি, বাঁশের কঞ্চি, মুখস্ত করতে হতো দিন-মাসের ছড়া, আর্যা। ‘বাল্যশিক্ষা’ সেই হারিয়ে যাওয়া দিনের সাংস্কৃতিক চিহ্ন।
এই চিহ্ন নিঃসন্দেহে স্থান করে নিয়েছে ইতিহাসের নস্টালজিয়ায়-- যাকে নিয়ে হাহাকার করা যায়, বিস্ময় আকুলতায় আকস্মিক অভিভূত হওয়া যায়। কেননা অনেকেরই মনের দুয়ার খুলে দিয়েছিল এই বই। বৃহত্তর পৃথিবীর সঙ্গে ঐকতানে মিলবার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিয়েছিল স্বস্তা কাগজে ছাপা ছোট্ট এই পুস্তিকা। তার কাছে আমাদের অনেক অনেক ঋণ। আর সেই ঋণের গল্প লেখা আছে বাঙালির মনের ইতিহাসে।
লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক শোয়াইব জিবরান। শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ওই বই সম্পাদনার অভিজ্ঞতাসহ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি নিয়ে স্ট্রিম-এর মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
১ ঘণ্টা আগেখেতে ভালোবাসেন? ঘুরে ঘুরে কিছু কিনতেও মন্দ লাগে না? শহরের ভেতরেই যদি এমন কোনো জায়গা পাওয়া যায়, যেখানে একসঙ্গে পাওয়া যায় খাবার, আড্ডা আর কেনাকাটার আনন্দ—তবে সেটি নিঃসন্দেহে অনেকের কাছেই সেটি প্রিয় গন্তব্য।
১ ঘণ্টা আগেশিক্ষকতা কোনো পেশা নয়, এটা একটি ব্রত—এই শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের কিংবদন্তি শিক্ষকেরা। বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে যেসব শিক্ষক কিংবদন্তি হয়ে আছেন, তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। নিজেদের কাজের মধ্য দিয়ে তাঁরা যেমন জাতি গঠনে ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি আমাদের জন্যও হয়ে উঠেছেন বাতিঘর।
২ ঘণ্টা আগেআজ বিশ্ব প্রাণী দিবস। এই দিবসে সম্রাট জাহাঙ্গীরের বন্য প্রাণীপ্রেম নিয়ে অংশিকা জৈনের লেখা অনুবাদ করেছেন ভূ-পর্যটক তারেক অণু।
১৯ ঘণ্টা আগে