leadT1ad

চলে গেলেন ভাষা আন্দোলনের শেষ সংগ্রামীও

ভাষা সংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিক আর নেই। আজ বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বিদায় হে কিংবদন্তী!

আহমদ রফিক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

রাস্তায় নেমে যখন কেউ দীপ্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে—‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, তখন সেই গানের গহিনে তাকালে দেখা যায়, এক প্রবীণ পুরুণ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে আলো নেই, বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে গেছে পিঠ, কিন্তু কণ্ঠে ঠিকই ধ্বনিত হচ্ছে তেজদীপ্ত হুঙ্কার—‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’। তিনি আহমদ রফিক, আমাদের কালের নায়ক। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সংগ্রামীদের মধ্যে বেঁচে থাকা একমাত্র সংগ্রামী। সেই তিনিও আজ চলে গেলেন!

আহমদ রফিক ছিলেন ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের শেষ জীবন্ত স্তম্ভ। তাঁর কুঞ্জিত চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে ছিল মিছিল, স্লোগান, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আত্মগোপন, ফেরার জীবন… কত রোমাঞ্চকর ইতিহাস। তাই তিনি বলতেন, ‘আমি শুধু একজন অংশগ্রহণকারী নই, আমি ইতিহাসের অংশ।’

ইতিহাসের অংশ হয়ে যাওয়া মানুষটি জন্মেছিলেন ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শাহবাজপুর গ্রামে। কবিরা বলেন, সেখানে নদীর জলও বাংলায় কথা বলে। সেই নদী-জল-হাওয়ায় বড় হতে হতে পরিবারের সঙ্গে একদিন চলে গিয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জে। সেখানে হরগঙ্গা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন আহমদ রফিক। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। কিন্তু ফজলুল হক হলে আবাসিক সুযোগ না হওয়ায় মেজাজ ভীষণ বিগড়ে যায় তরুণ আহমদ রফিকের। তিনি সোজা গিয়ে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সময়টা তখন উত্তাল, ১৯৫২ সাল। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে ঢাকার রাজপথে জ্বলছে দাউদাউ আগুন।

আহমদ রফিক তখন ঢাকা মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তাঁর মূল কাজ ছিল ফজলুল হক হল, ঢাকা হল এবং মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাত্রদের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করা। এভাবেই আস্তে আস্তে তিনি জড়িয়ে পড়েন সভা, মিছিল, মিটিং, পোস্টার, চিঠিপত্র, গোপন বৈঠক—সবকিছুর সঙ্গে।

এই রাজনৈতিক জীবনে ১৯৫৪ সালে তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে পাকিস্তান সরকার। তিনিই ছিলেন ঢাকা মেডিকেল থেকে আন্দোলন করা একমাত্র ছাত্র, যাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আহমদ রফিক তখন নিজের পরিচয় গোপন করে গ্রামের বাড়িতে আত্মগোপনে চলে যান।

এরপর পরিস্থিতি কিছুটা অনুকূলে এলে ১৯৫৫ সালে তিনি আবার ফিরে আসেন ঢাকায়। পড়াশোনা শেষ করে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। কিন্তু চিকিৎসক হিসেবে নিজের পেশা গড়েননি। তিনি বুঝেছিলেন—এই জীবনের ডাক ভিন্ন।

কী সেই ডাক? সেই ডাক শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ শিল্প, সংস্কৃতি, জীবন। এরপর থেকে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও রাজনীতি—এই চারটি স্তম্ভে দাঁড়িয়ে তৈরি করেন নিজের লেখালেখির সাম্রাজ্য।

আহমদ রফিক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া
আহমদ রফিক। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

তাঁর কলমে শুধু ভাষার পক্ষে যুক্তি ছিল না, ছিল আত্মজ ইতিহাসের নড়বড়ে মেঝে মেরামতের ইটপাথর। তাঁর লেখা ভাষা-আন্দোলন: ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব, সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতি ভাবনা প্রভৃতি বই এখন গবেষকদের কাছে অপরিহার্য দলিল।

প্রখ্যাত এই ভাষা সৈনিক নিজেকে বলতেন ‘একজন ক্ষুদ্র মানুষ, ভাষার এক নগণ্য সৈনিক।’
কিন্তু জাতি তাঁকে দেখেছে এক মহীরূহ হিসেবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তিনি শুধু একজন প্রত্যক্ষদর্শীই নন, তিনি নিজেই ইতিহাসের এক পৃষ্ঠার নাম।

প্রবীণ বয়সে এসেও তিনি বাংলা ভাষার প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনা নিয়ে হতাশ ছিলেন। বলতেন, ‘যে ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছি, সেই ভাষা আজ আদালতে নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই, বিজ্ঞানে নেই।’
এই হতাশা থেকেই হয়তো তিনি ২০২৩ সালের এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন—‘বাংলা আজ শুধু আবেগ, দায়িত্ব নয়। আমরা আবেগ ভালোবাসি, দায়িত্ব এড়াই।’

আহমদ রফিক বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক এবং রবীন্দ্রত্ত্বাচার্য উপাধি পেয়েছেন। কিন্তু পুরস্কারের চেয়েও বড় পুরস্কার হলো, ইতিহাসের শরীরে তাঁর ছাপ রক্তের মতো অমোচনীয়।

আজকের প্রজন্ম ভাষা আন্দোলন বোঝে পাঠ্যবইয়ের পাতায়, শহীদ মিনারে, ফেব্রুয়ারির ফেসবুক পোস্টে। কিন্তু আহমদ রফিক বুঝতেন হৃদয়ে, অস্থিমজ্জায়, স্মৃতিতে। তাই আজকের পর থেকে কেউ যখন ‘ভাষার আন্দোলনের শেষ সংগ্রামী’ বলে আহমদ রফিককে স্মরণ করবে—তখন সেটি শুধু এক মানুষকে নয়, বরং এক সময়কে, এক চেতনার দীপ্ত ছায়াকেই স্মরণ করা হবে।

বিদায় হে কিংবদন্তী!

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত