তিস্তা-তোর্সার উথালপাতাল ঢেউ যেমন এখানে আছে, তেমনই আছে মৈষাল (মহিষপালক), গাড়িয়াল (গাড়িচালক) বা মাহুতের দীর্ঘ প্রবাসে অপেক্ষায় থাকা একাকিত্ব। এই একাকিত্বের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় ভাওয়াইয়ার সেইসব অনবদ্য সৃষ্টি, যা প্রেম, বিরহ এবং মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। রংপুর-কুড়িগ্রামের মাঠঘাট থেকে উঠে আসা এই ভাওয়াইয়া গান আমাদের চেনা প্রেমের সংজ্ঞাকে বেশ কয়েকবার মোচড় দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কীভাবে?
তাহমীদ চৌধুরী
যেকোনো অঞ্চলের লোকগান হলো সে অঞ্চলের সুরের সমষ্টি। আবার, সুর যেহেতু অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত তাই লোকগানগুলো স্ব স্ব অঞ্চলের মানুষের হাসি-কান্না, যাপন আর চিন্তার চলমান দলিলও বটে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেরই রয়েছে নিজস্ব লোকসংগীতের সমৃদ্ধ ধারা। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া তার মাঝে স্বতন্ত্র ও কিছুটা ‘বিপজ্জনক’ স্থান দখল করে আছে। বিপজ্জনক, কারণ এই গান ভাবের কথা বলতে গিয়ে প্রায়শই এমন সব সামাজিক বাস্তবতাকে ছুঁয়ে ফেলে, যেসব সচরাচর ঢাকা থাকে শহুরে ভদ্রতার চাদরে। ভাটিয়ালি যেখানে মাঝির আধ্যাত্মিক আর্তি কিংবা বাউল গান যেখানে স্রষ্টার সন্ধানে মগ্ন, সেখানে ভাওয়াইয়া ইহজাগতিক এবং মানুষের রক্ত-মাংসের আকাঙ্ক্ষার এক স্বচ্ছ প্রতিফলন।
ভাওয়াইয়া গানের জন্ম হয়েছে বৃহত্তর রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি আর আসামের গোয়ালপাড়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। এর সুরের টান আর কথার বাঁধন—দুই-ই তৈরি হয়েছে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিস্থিতি থেকে। তিস্তা-তোর্সার উথালপাতাল ঢেউ যেমন এখানে আছে, তেমনই আছে মৈষাল (মহিষপালক), গাড়িয়াল (গাড়িচালক) বা মাহুতের দীর্ঘ প্রবাসে অপেক্ষায় থাকা নারীর একাকিত্ব। এই একাকিত্বের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় ভাওয়াইয়ার সেইসব অনবদ্য সৃষ্টি, যা প্রেম, বিরহ এবং মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। রংপুর-কুড়িগ্রামের মাঠঘাট থেকে উঠে আসা এই ভাওয়াইয়া গান আমাদের চেনা প্রেমের সংজ্ঞাকে বেশ কয়েকবার মোচড় দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কীভাবে?
ভাওয়াইয়া নামের উৎস নিয়ে দুটি মত প্রচলিত। কারো মতে 'ভাব' থেকে 'ভাওয়াইয়া', যা মূলত ভাবাবেগপূর্ণ গান। তবে শক্তিশালী মতটি হলো, 'ভাওয়া' বা নিচু জলাভূমি অঞ্চলে মহিষ চরাতে গিয়ে মৈষালরা যে গান গাইতেন, তা-ই ভাওয়াইয়া। এই গানের সুরে ও কথায় তাই মিশে আছে মৈষাল (মহিষ পালক), গাড়িয়াল (গাড়ি চালক) ও মাহুতদের (হাতির চালক) জীবনসংগ্রাম, তাদের দীর্ঘ পথের ক্লান্তি আর প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে থাকার যন্ত্রণা।
ভাওয়াইয়ার সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য তার সুরে। উঁচু-নিচু মাটির রাস্তায় গরুর গাড়ি চলার সময় চালকের কণ্ঠে যে স্বাভাবিক কম্পন বা ভাঙন তৈরি হয়, সেই বিষয়টিই এর সুরে ধরা থাকে। এই বিশেষ গায়কী ভাওয়াইয়াকে বাংলার অন্য যেকোনো লোকগান থেকে আলাদা করে। এর দুটি প্রধান অঙ্গ:
দরিয়া: এটি দীর্ঘ, বিলম্বিত লয়ের সুর, যা মূলত বিরহ, একাকিত্ব এবং গভীর বেদনাকে প্রকাশ করে। এর টানা সুর যেন উত্তরবঙ্গের জনশূন্য প্রান্তরের মতোই বিস্তীর্ণ ও হাহাকার ভরা।
চটকা: এটি দ্রুত লয়ের চটুল সুরের গান। এতে দাম্পত্য জীবনের খুনসুটি, সামাজিক রঙ্গরসিকতা বা দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো ঘটনা ফুটে ওঠে।
ভাওয়াইয়ার আরেকটি বিশেষত্ব হলো এর সুরের গ্লাইডিং। গায়ক একটা নোট থেকে আরেকটা নোটে যান ঢেউয়ের মতো করে, সিঁড়ির মতো একেকটা স্টেপে নয়। এটাকে বলে 'মিড়' - যেটা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতেও আছে কিন্তু ভাওয়াইয়ায় এর ব্যবহার একেবারেই আলাদা।
বাংলাদেশের অন্যান্য লোকগানের সঙ্গে ভাওয়াইয়ার মূল পার্থক্য এর জীবনদর্শনে। লালনের গানই যেভাবে আমাদের দেহ ছেড়ে আত্মার জগতে ডুব দিতে বলে, আবার হাসন রাজার গান বলে– ‘লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার’। অর্থাৎ, পার্থিব জীবনের প্রতি এক ধরনের নির্লিপ্তি বা মায়াবাদের ছোঁয়া এই গানগুলোতে স্পষ্ট।
কিন্তু ভাওয়াইয়া ঠিক তার উল্টো। এই গান মাটির পৃথিবীকে এক মুহূর্তের জন্যও ভোলে না। এখানে ঘর আছে, বাড়ি আছে, আছে জলজ্যান্ত সংসার। ভাওয়াইয়া গানে নারীরা অপেক্ষায় থাকে তাদের পুরুষদের জন্য, যারা জীবিকার টানে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো শারীরিক ও মানসিক–দুই-ই। যেমন একটি গানে শোনা যাচ্ছে —
এখানে ‘আউলের বাথান’ বা এলোমেলো সংসার ছেড়ে প্রিয় মানুষটি চলে যাচ্ছে, আর সেই অগোছালো জীবন গোছাতে গিয়েই নারীর জীবন ‘কাউল’ বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এই আকুতি সম্পূর্ণ জাগতিক। এখানে আধ্যাত্মিকতার কোনও ইশারা নেই, বরং আছে বিচ্ছেদের বাস্তব যন্ত্রণা।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ যখন প্রথম এই গানগুলো রেকর্ড করলেন, তখন শহুরে বাঙালিরা প্রথমবার বুঝলো - আরে, গ্রামের মানুষেরা তো বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেম করে!
বাংলার বাকি লোকগানের ধারাগুলো - যেমন বাউল, কীর্তন, জারি-সারি - এদের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক ভাব আছে। এমনকি প্রেমের গানেও দেখবেন কোথাও না কোথাও ঈশ্বরের রেফারেন্স চলে আসে।
ভাওয়াইয়া সেদিক থেকে একদম আলাদা। এখানে প্রেম মানে প্রেম - কোনো রূপক নেই, কোনো আধ্যাত্মিক মেটাফর নেই। ‘মরিয়া গেলাম রে, ও বধু কুড়ানী’ - এই লাইনে মরণ মানে আক্ষরিক অর্থেই মরণ, কোনো সুফি ভাবার্থ নেই।
ভাওয়াইয়ার আত্মা হলো বিরহ। তবে এই বিরহ আধ্যাত্মিক নয়। ভীষণভাবে শারীরিক ও মানসিক। দীর্ঘ সময় ধরে প্রিয়জনের অনুপস্থিতি যে শূন্যতা তৈরি করে, ভাওয়াইয়ার সুর সেই শূন্যতারই হাহাকার। এই গানে অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে। একাকী নারীর রাত জাগা, পথের দিকে চেয়ে থাকা আর বাতাসের কাছে প্রিয়জনের খবর জানতে চাওয়ার আকুতি বারবার ফিরে আসে একাধিক ভাওয়াইয়া গানে।
এখানে বগা (বক) আর বগীর রূপকে ফুটে উঠেছে বিচ্ছিন্ন দুই নর-নারীর আর্তি। বগা যেমন ফাঁদে আটকে অসহায়, তেমনই নারীও তার একাকীত্বের সংসারে বন্দি।
ভাওয়াইয়ার এই যে নির্ভেজাল জাগতিকতা, তার সবচেয়ে সাহসী প্রকাশ ঘটেছে 'পরকীয়া' বা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রেমের চিত্রায়ণে। তবে এখানে এটিকে পাপ বা নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখানো হয় না, বরং দীর্ঘ বিরহের এক স্বাভাবিক ও মানবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরা হয়। স্বামীর পেশার কারণে বছরের পর বছর একাকী থাকা একজন নারীর জীবনে যদি অন্য কোনো পুরুষের ছায়া পড়ে, ভাওয়াইয়া গান তাকে বিচারকের দৃষ্টিতে দেখে না। তবে একে ঠিক শহুরে অর্থে ‘পরকীয়া’ বললে এর সামাজিক গভীরতা হারিয়ে যায়। ভাওয়াইয়া গানের জগতে এই সম্পর্কগুলো একধরনের ‘লোকায়িত’ বা সামাজিকভাবে জ্ঞাত কিন্তু অব্যক্ত বাস্তবতা।
উত্তরবঙ্গের পুরনো সমাজ ব্যবস্থায় গাড়িয়াল, মৈষাল বা মাহুতরা মাসের পর মাস বাড়ির বাইরে থাকতেন। এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা নারীদের জীবনে যে শূন্যতা তৈরি করত, ভাওয়াইয়া সেই শূন্যতারই শৈল্পিক প্রকাশ। এই গানগুলোতে প্রায়শই ‘বন্ধু’ বা ‘গাড়িয়াল ভাই’ সম্বোধন করে যে আকুতি জানানো হয়, তা কেবল সৌজন্যবশত নয়, এর গভীরে লুকিয়ে থাকে একাকিত্ব ও সাহচর্যের আকাঙ্ক্ষা। কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদের কণ্ঠে অমর হয়ে থাকা গানটিতে শোনা যাচ্ছে–
আপাতদৃষ্টিতে এটি পথের দিকে চেয়ে থাকা এক নারীর সাধারণ আর্তি। কিন্তু ‘গাড়িয়াল ভাই’ সম্বোধনের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা ও নির্ভরতার সুর রয়েছে, তা স্বামী-স্ত্রীর গতানুগতিক সম্পর্কের বাইরে এক নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়। এই ‘ভাই’ বা ‘বন্ধু’ প্রায়শই হয়ে ওঠে সেই মানুষটি, যার সঙ্গে একাকী নারী তার মনের কথা ভাগ করে নিতে পারে। তবে শুধু একাকীত্ব, অসহায়তা এইসবই নয় ভাওয়াইয়া গানে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রেমের চিত্রায়ণে ব্যাপক খুনসুটির আলাপও আছে। যেমন, একটা জনপ্রিয় গান নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। গানের নাম ‘হাউশের বিয়ানি’। এখানে (বর-কনের বাবা-মা) বিয়াই ও বিয়ানি গানে গানে তাঁদের সুপ্ত আকাঙ্খা ও আক্ষেপ প্রকাশ করে দিচ্ছে। এটাকে পরস্পরের সাথে ফ্লার্টও বলতে পারি। গানের শুরুতে বিয়ানিকে ডেকে বিয়াই বলছে —
অর্থাৎ বিয়াই তাঁর বিয়ানিকে মনের আক্ষেপ জানিয়ে বলছে, তাঁর স্ত্রী যদি বিয়ানির মতো হত! তো, এই ‘ফ্লার্টে’ ইম্প্রেসড হয়ে যাওয়া বিয়ানি এরপর গানে গানে বিয়াইকে প্রত্যুত্তর করছে—
বিয়ানি বলছেন, আপনার কথা শুনে গুজবাম্প হচ্ছে। আমার পাশে বসে আরও কথা বলেন এবং শেষমেশ বিয়ানিও বিয়াইকে বলছে তাঁর স্বামী যদি বিয়াইয়ের মতো হত! গানটির পরবর্তী অংশে দুজনই যৌথ আক্ষেপে ফিরে এসেছেন কোরাস টানার সময়।
ভাওয়াইয়া গানে এরকম যৌথ কথোপকথনের আদলে বহু গান আছে যেখানে শালী-দুলাভাই, বিয়াই-বিয়ানি, দেবর-ভাবি একে অপরের সাথে নানান খুনসুটি করছে এবং ইঙ্গিতে বা কখনও সোজাসুজি ‘ডিজায়ার’ এক্সপ্রেস করছে। এমনই আরেক গানে শালী তাঁর দুলাভাইকে অনেকদিন পরে পেয়ে বলছে—
দুলাভাই এবার শালীকে বলছে—
পাত্তা না পেয়ে শালী এবার খোঁচা দিতে বলছে—
পয়সার খোঁচা তো দিলই আরও বলে দিল যে পুরুষের পয়সা নাই তাঁর বাঁচার চাইতে মরে যাওয়া ভালো। যাহোক, মোটামুটি ঘায়েল দুলাভাই এবার শালীকে আসল ঘটনা বলা শুরু করলো যে কেন সে সিনেমা দেখতে যেতে চাইছে না। গানে গানে দুলাভাই বলছে —
অর্থাৎ টাকা-পয়সার সমস্যা নাই কিন্তু শালীর সাথে কথা বললে তাঁর স্ত্রী রাগ করে না খেয়ে থাকে—এটাই সমস্যা।
এবার শালী বলছে, উপায় আছে। গানে শালী বলছে—
আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, বাংলাদেশের অডিয়েন্স আসলে এই গানগুলো কীভাবে নেয় বা নিচ্ছে? আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে এখানে উল্লেখিত সবগুলো গানই ইউটিউবে সুলভ। সেখানে কমেন্ট সেকশনে ঢু মারলেই দেখবেন শ্রোতাদের বেশিরভাগই সামাজিক বিচারকের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়নি। এই প্রচন্ড ঘৃণা চাষের যুগে ভাওয়াইয়া গানগুলোর কমেন্ট সেকশন আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারে, বাংলাদেশের সবাই এখনও অসহিষ্ণু মোর্যাল পুলিশ হয়ে যায়নি।
সামাজিক প্রথার নিচে মানুষের আদিম এবং রক্ত-মাংসের অনুভূতিগুলো কীভাবে জীবন্ত থাকে, বহু ভাওয়াইয়া গানে হয়তো এসবই উঠে এসেছে। যেমন পরকীয়াকে ঠিক পাপ বা স্খলন হিসেবে বিচার না করে, ভাওয়াইয়া তাকে দীর্ঘ বিচ্ছেদ, একাকিত্ব এবং পারিপার্শ্বিকতার এক মানবিক ও স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। ভাবলে মনে হয়, ভাওয়াইয়া গান কি সেই ডাকপিয়ন? যে সহজ সুরে কিংবা খুনসুটিতে মনে করিয়ে যায়– মানুষের মনের ভূগোল সামাজিক মানচিত্রের চেয়ে কতটা জটিল, কতটা রহস্যময়!
যেকোনো অঞ্চলের লোকগান হলো সে অঞ্চলের সুরের সমষ্টি। আবার, সুর যেহেতু অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত তাই লোকগানগুলো স্ব স্ব অঞ্চলের মানুষের হাসি-কান্না, যাপন আর চিন্তার চলমান দলিলও বটে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেরই রয়েছে নিজস্ব লোকসংগীতের সমৃদ্ধ ধারা। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া তার মাঝে স্বতন্ত্র ও কিছুটা ‘বিপজ্জনক’ স্থান দখল করে আছে। বিপজ্জনক, কারণ এই গান ভাবের কথা বলতে গিয়ে প্রায়শই এমন সব সামাজিক বাস্তবতাকে ছুঁয়ে ফেলে, যেসব সচরাচর ঢাকা থাকে শহুরে ভদ্রতার চাদরে। ভাটিয়ালি যেখানে মাঝির আধ্যাত্মিক আর্তি কিংবা বাউল গান যেখানে স্রষ্টার সন্ধানে মগ্ন, সেখানে ভাওয়াইয়া ইহজাগতিক এবং মানুষের রক্ত-মাংসের আকাঙ্ক্ষার এক স্বচ্ছ প্রতিফলন।
ভাওয়াইয়া গানের জন্ম হয়েছে বৃহত্তর রংপুর, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি আর আসামের গোয়ালপাড়ার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। এর সুরের টান আর কথার বাঁধন—দুই-ই তৈরি হয়েছে এই অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক পরিস্থিতি থেকে। তিস্তা-তোর্সার উথালপাতাল ঢেউ যেমন এখানে আছে, তেমনই আছে মৈষাল (মহিষপালক), গাড়িয়াল (গাড়িচালক) বা মাহুতের দীর্ঘ প্রবাসে অপেক্ষায় থাকা নারীর একাকিত্ব। এই একাকিত্বের ভেতর থেকেই জন্ম নেয় ভাওয়াইয়ার সেইসব অনবদ্য সৃষ্টি, যা প্রেম, বিরহ এবং মানুষের গোপন আকাঙ্ক্ষার কথা বলে। রংপুর-কুড়িগ্রামের মাঠঘাট থেকে উঠে আসা এই ভাওয়াইয়া গান আমাদের চেনা প্রেমের সংজ্ঞাকে বেশ কয়েকবার মোচড় দিয়ে রেখেছে। কিন্তু কীভাবে?
ভাওয়াইয়া নামের উৎস নিয়ে দুটি মত প্রচলিত। কারো মতে 'ভাব' থেকে 'ভাওয়াইয়া', যা মূলত ভাবাবেগপূর্ণ গান। তবে শক্তিশালী মতটি হলো, 'ভাওয়া' বা নিচু জলাভূমি অঞ্চলে মহিষ চরাতে গিয়ে মৈষালরা যে গান গাইতেন, তা-ই ভাওয়াইয়া। এই গানের সুরে ও কথায় তাই মিশে আছে মৈষাল (মহিষ পালক), গাড়িয়াল (গাড়ি চালক) ও মাহুতদের (হাতির চালক) জীবনসংগ্রাম, তাদের দীর্ঘ পথের ক্লান্তি আর প্রিয়জনদের ছেড়ে দূরে থাকার যন্ত্রণা।
ভাওয়াইয়ার সবচেয়ে বড় স্বাতন্ত্র্য তার সুরে। উঁচু-নিচু মাটির রাস্তায় গরুর গাড়ি চলার সময় চালকের কণ্ঠে যে স্বাভাবিক কম্পন বা ভাঙন তৈরি হয়, সেই বিষয়টিই এর সুরে ধরা থাকে। এই বিশেষ গায়কী ভাওয়াইয়াকে বাংলার অন্য যেকোনো লোকগান থেকে আলাদা করে। এর দুটি প্রধান অঙ্গ:
দরিয়া: এটি দীর্ঘ, বিলম্বিত লয়ের সুর, যা মূলত বিরহ, একাকিত্ব এবং গভীর বেদনাকে প্রকাশ করে। এর টানা সুর যেন উত্তরবঙ্গের জনশূন্য প্রান্তরের মতোই বিস্তীর্ণ ও হাহাকার ভরা।
চটকা: এটি দ্রুত লয়ের চটুল সুরের গান। এতে দাম্পত্য জীবনের খুনসুটি, সামাজিক রঙ্গরসিকতা বা দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো ঘটনা ফুটে ওঠে।
ভাওয়াইয়ার আরেকটি বিশেষত্ব হলো এর সুরের গ্লাইডিং। গায়ক একটা নোট থেকে আরেকটা নোটে যান ঢেউয়ের মতো করে, সিঁড়ির মতো একেকটা স্টেপে নয়। এটাকে বলে 'মিড়' - যেটা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতেও আছে কিন্তু ভাওয়াইয়ায় এর ব্যবহার একেবারেই আলাদা।
বাংলাদেশের অন্যান্য লোকগানের সঙ্গে ভাওয়াইয়ার মূল পার্থক্য এর জীবনদর্শনে। লালনের গানই যেভাবে আমাদের দেহ ছেড়ে আত্মার জগতে ডুব দিতে বলে, আবার হাসন রাজার গান বলে– ‘লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার’। অর্থাৎ, পার্থিব জীবনের প্রতি এক ধরনের নির্লিপ্তি বা মায়াবাদের ছোঁয়া এই গানগুলোতে স্পষ্ট।
কিন্তু ভাওয়াইয়া ঠিক তার উল্টো। এই গান মাটির পৃথিবীকে এক মুহূর্তের জন্যও ভোলে না। এখানে ঘর আছে, বাড়ি আছে, আছে জলজ্যান্ত সংসার। ভাওয়াইয়া গানে নারীরা অপেক্ষায় থাকে তাদের পুরুষদের জন্য, যারা জীবিকার টানে দূর দেশে পাড়ি জমিয়েছে। তাদের আকাঙ্ক্ষাগুলো শারীরিক ও মানসিক–দুই-ই। যেমন একটি গানে শোনা যাচ্ছে —
এখানে ‘আউলের বাথান’ বা এলোমেলো সংসার ছেড়ে প্রিয় মানুষটি চলে যাচ্ছে, আর সেই অগোছালো জীবন গোছাতে গিয়েই নারীর জীবন ‘কাউল’ বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এই আকুতি সম্পূর্ণ জাগতিক। এখানে আধ্যাত্মিকতার কোনও ইশারা নেই, বরং আছে বিচ্ছেদের বাস্তব যন্ত্রণা।
আব্বাসউদ্দীন আহমদ যখন প্রথম এই গানগুলো রেকর্ড করলেন, তখন শহুরে বাঙালিরা প্রথমবার বুঝলো - আরে, গ্রামের মানুষেরা তো বেশ কমপ্লিকেটেড প্রেম করে!
বাংলার বাকি লোকগানের ধারাগুলো - যেমন বাউল, কীর্তন, জারি-সারি - এদের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক ভাব আছে। এমনকি প্রেমের গানেও দেখবেন কোথাও না কোথাও ঈশ্বরের রেফারেন্স চলে আসে।
ভাওয়াইয়া সেদিক থেকে একদম আলাদা। এখানে প্রেম মানে প্রেম - কোনো রূপক নেই, কোনো আধ্যাত্মিক মেটাফর নেই। ‘মরিয়া গেলাম রে, ও বধু কুড়ানী’ - এই লাইনে মরণ মানে আক্ষরিক অর্থেই মরণ, কোনো সুফি ভাবার্থ নেই।
ভাওয়াইয়ার আত্মা হলো বিরহ। তবে এই বিরহ আধ্যাত্মিক নয়। ভীষণভাবে শারীরিক ও মানসিক। দীর্ঘ সময় ধরে প্রিয়জনের অনুপস্থিতি যে শূন্যতা তৈরি করে, ভাওয়াইয়ার সুর সেই শূন্যতারই হাহাকার। এই গানে অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে। একাকী নারীর রাত জাগা, পথের দিকে চেয়ে থাকা আর বাতাসের কাছে প্রিয়জনের খবর জানতে চাওয়ার আকুতি বারবার ফিরে আসে একাধিক ভাওয়াইয়া গানে।
এখানে বগা (বক) আর বগীর রূপকে ফুটে উঠেছে বিচ্ছিন্ন দুই নর-নারীর আর্তি। বগা যেমন ফাঁদে আটকে অসহায়, তেমনই নারীও তার একাকীত্বের সংসারে বন্দি।
ভাওয়াইয়ার এই যে নির্ভেজাল জাগতিকতা, তার সবচেয়ে সাহসী প্রকাশ ঘটেছে 'পরকীয়া' বা সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রেমের চিত্রায়ণে। তবে এখানে এটিকে পাপ বা নৈতিক স্খলন হিসেবে দেখানো হয় না, বরং দীর্ঘ বিরহের এক স্বাভাবিক ও মানবিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে তুলে ধরা হয়। স্বামীর পেশার কারণে বছরের পর বছর একাকী থাকা একজন নারীর জীবনে যদি অন্য কোনো পুরুষের ছায়া পড়ে, ভাওয়াইয়া গান তাকে বিচারকের দৃষ্টিতে দেখে না। তবে একে ঠিক শহুরে অর্থে ‘পরকীয়া’ বললে এর সামাজিক গভীরতা হারিয়ে যায়। ভাওয়াইয়া গানের জগতে এই সম্পর্কগুলো একধরনের ‘লোকায়িত’ বা সামাজিকভাবে জ্ঞাত কিন্তু অব্যক্ত বাস্তবতা।
উত্তরবঙ্গের পুরনো সমাজ ব্যবস্থায় গাড়িয়াল, মৈষাল বা মাহুতরা মাসের পর মাস বাড়ির বাইরে থাকতেন। এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা নারীদের জীবনে যে শূন্যতা তৈরি করত, ভাওয়াইয়া সেই শূন্যতারই শৈল্পিক প্রকাশ। এই গানগুলোতে প্রায়শই ‘বন্ধু’ বা ‘গাড়িয়াল ভাই’ সম্বোধন করে যে আকুতি জানানো হয়, তা কেবল সৌজন্যবশত নয়, এর গভীরে লুকিয়ে থাকে একাকিত্ব ও সাহচর্যের আকাঙ্ক্ষা। কিংবদন্তী শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদের কণ্ঠে অমর হয়ে থাকা গানটিতে শোনা যাচ্ছে–
আপাতদৃষ্টিতে এটি পথের দিকে চেয়ে থাকা এক নারীর সাধারণ আর্তি। কিন্তু ‘গাড়িয়াল ভাই’ সম্বোধনের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা ও নির্ভরতার সুর রয়েছে, তা স্বামী-স্ত্রীর গতানুগতিক সম্পর্কের বাইরে এক নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দেয়। এই ‘ভাই’ বা ‘বন্ধু’ প্রায়শই হয়ে ওঠে সেই মানুষটি, যার সঙ্গে একাকী নারী তার মনের কথা ভাগ করে নিতে পারে। তবে শুধু একাকীত্ব, অসহায়তা এইসবই নয় ভাওয়াইয়া গানে সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য প্রেমের চিত্রায়ণে ব্যাপক খুনসুটির আলাপও আছে। যেমন, একটা জনপ্রিয় গান নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। গানের নাম ‘হাউশের বিয়ানি’। এখানে (বর-কনের বাবা-মা) বিয়াই ও বিয়ানি গানে গানে তাঁদের সুপ্ত আকাঙ্খা ও আক্ষেপ প্রকাশ করে দিচ্ছে। এটাকে পরস্পরের সাথে ফ্লার্টও বলতে পারি। গানের শুরুতে বিয়ানিকে ডেকে বিয়াই বলছে —
অর্থাৎ বিয়াই তাঁর বিয়ানিকে মনের আক্ষেপ জানিয়ে বলছে, তাঁর স্ত্রী যদি বিয়ানির মতো হত! তো, এই ‘ফ্লার্টে’ ইম্প্রেসড হয়ে যাওয়া বিয়ানি এরপর গানে গানে বিয়াইকে প্রত্যুত্তর করছে—
বিয়ানি বলছেন, আপনার কথা শুনে গুজবাম্প হচ্ছে। আমার পাশে বসে আরও কথা বলেন এবং শেষমেশ বিয়ানিও বিয়াইকে বলছে তাঁর স্বামী যদি বিয়াইয়ের মতো হত! গানটির পরবর্তী অংশে দুজনই যৌথ আক্ষেপে ফিরে এসেছেন কোরাস টানার সময়।
ভাওয়াইয়া গানে এরকম যৌথ কথোপকথনের আদলে বহু গান আছে যেখানে শালী-দুলাভাই, বিয়াই-বিয়ানি, দেবর-ভাবি একে অপরের সাথে নানান খুনসুটি করছে এবং ইঙ্গিতে বা কখনও সোজাসুজি ‘ডিজায়ার’ এক্সপ্রেস করছে। এমনই আরেক গানে শালী তাঁর দুলাভাইকে অনেকদিন পরে পেয়ে বলছে—
দুলাভাই এবার শালীকে বলছে—
পাত্তা না পেয়ে শালী এবার খোঁচা দিতে বলছে—
পয়সার খোঁচা তো দিলই আরও বলে দিল যে পুরুষের পয়সা নাই তাঁর বাঁচার চাইতে মরে যাওয়া ভালো। যাহোক, মোটামুটি ঘায়েল দুলাভাই এবার শালীকে আসল ঘটনা বলা শুরু করলো যে কেন সে সিনেমা দেখতে যেতে চাইছে না। গানে গানে দুলাভাই বলছে —
অর্থাৎ টাকা-পয়সার সমস্যা নাই কিন্তু শালীর সাথে কথা বললে তাঁর স্ত্রী রাগ করে না খেয়ে থাকে—এটাই সমস্যা।
এবার শালী বলছে, উপায় আছে। গানে শালী বলছে—
আপনার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, বাংলাদেশের অডিয়েন্স আসলে এই গানগুলো কীভাবে নেয় বা নিচ্ছে? আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে এখানে উল্লেখিত সবগুলো গানই ইউটিউবে সুলভ। সেখানে কমেন্ট সেকশনে ঢু মারলেই দেখবেন শ্রোতাদের বেশিরভাগই সামাজিক বিচারকের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়নি। এই প্রচন্ড ঘৃণা চাষের যুগে ভাওয়াইয়া গানগুলোর কমেন্ট সেকশন আপনাকে আশ্বস্ত করতে পারে, বাংলাদেশের সবাই এখনও অসহিষ্ণু মোর্যাল পুলিশ হয়ে যায়নি।
সামাজিক প্রথার নিচে মানুষের আদিম এবং রক্ত-মাংসের অনুভূতিগুলো কীভাবে জীবন্ত থাকে, বহু ভাওয়াইয়া গানে হয়তো এসবই উঠে এসেছে। যেমন পরকীয়াকে ঠিক পাপ বা স্খলন হিসেবে বিচার না করে, ভাওয়াইয়া তাকে দীর্ঘ বিচ্ছেদ, একাকিত্ব এবং পারিপার্শ্বিকতার এক মানবিক ও স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে উপস্থাপন করে এসেছে। ভাবলে মনে হয়, ভাওয়াইয়া গান কি সেই ডাকপিয়ন? যে সহজ সুরে কিংবা খুনসুটিতে মনে করিয়ে যায়– মানুষের মনের ভূগোল সামাজিক মানচিত্রের চেয়ে কতটা জটিল, কতটা রহস্যময়!
আজ আমাদের সংগীতজগতের ক্ষণজন্মা প্রতিভা হ্যাপী আখান্দের জন্মদিন। হ্যাপীর চলে যাওয়া কেন বাংলা ব্যান্ড ইতিহাসের প্রথম বড় কোনো ধাক্কা? কেমন ছিল মিউজিশিয়ান হ্যাপীর পথচলা?
৮ ঘণ্টা আগেপ্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বদিকে বিস্তৃত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পৃথিবীর সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর দ্বীপসমষ্টিগুলোর একটি। সারা দুনিয়ার পর্যটকদের কাছেও এটি বিশেষ আকর্ষণ। এখানে এমন সব প্রাণীর দেখা মেলে, যাদের অস্তিত্ব পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। গ্যালাপাগোস ভ্রমণ নিয়ে আজকের এই লেখা।
১১ ঘণ্টা আগেএ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন হাঙ্গেরির কথাসাহিত্যিক লাজলো ক্রাসনাহোরকাই। তাঁর বিশেষত্ব কোথায়? কেন তাঁর গদ্যের ভেতর ঘোর আর ঘোরের ভেতর গদ্য?
১ দিন আগেগতকাল প্রয়াত হয়েছেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। কেন তিনি অতীতের বর্তমান এবং একই সঙ্গে আগামী দিনের পাঠকের ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে থাকবেন? লিখেছেন এই সময়ের এক কথাসাহিত্যিক।
১ দিন আগে