আজ শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ১৩৫তম তিরোধান দিবস। বাংলাদেশের এই শ্রেষ্ঠ ভাবুককে নিয়ে মাতোয়ারা হয়েছেন দেশি-বিদেশি অনেক গবেষক। তাঁদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অনুবাদক-গবেষক ড. ক্যারোল সলোমন অন্যতম। ২০০৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার আগ অব্দি মার্কিন মুলুকের এই গবেষক লালন নিয়েই মজে ছিলেন। তিনি লালনের গানের যে অনুবাদ করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ নামে সেই বই বেরিয়েছে সাইমন জাকারিয়ার সম্পাদনায়। কীভাবে প্রকাশিত হলো এই বই? বইটি বেরোনোর পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে আবারও লালন কীভাবে জেগে উঠলেন, সেই বৃত্তান্ত থাকল এই লেখায়।
সাইমন জাকারিয়া
ফকির লালন সাঁই যুগের পরিক্রমায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছেন। প্রথমত গানের বাণীর ভেতর দিয়ে প্রকাশিত তাঁর ভাব-দর্শন ও মনুষ্যজ্ঞানের প্রজ্ঞা বিশ্বের নানান দেশের বিদ্বান-পণ্ডিতদের আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, লালন সাঁই প্রবর্তিত সাধকের জীবনাচার, শুভ্র বসন, সাধুসঙ্গের প্রেমময় ঐতিহ্য লালনের প্রতি তীব্রতর আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তাই তো দেশ-কালের গণ্ডি ছাপিয়ে লালন হয়ে উঠেছেন সব মানুষের, সব দেশের, সব ধর্মের।
লালনের চর্চা আজ আর শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের বহু অনুবাদক-গবেষকগণ বিচ্ছিন্ন লালনের গান অনুবাদ করেছেন। যদিও প্রথম দিকে লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসে ‘দি ফিলোসফি অব আওয়ার পিপল’ নামে সভাপতির ভাষণে সেই অনুবাদের আংশিক উপস্থাপন করেন। এরপর মিস এ. জি. স্টক, অ্যাডয়ার্ড সি ডিমোক, জুন মাদানিয়েল, ব্রাদার জেমস, ফাদার মারিনো রিগন, মাসাইয়্যুকি ওনিশি, মাসাহিকো তোগাওয়া প্রমুখ বিভিন্ন ভাষায় বেশ কিছু লালনের গান অনুবাদ করেন। এঁদের মধ্যে ফাদার মারিনো রিগন ১০১টি গান ইতালিয়ান ভাষায় এবং ব্রাদার জেমস ১০৩টি গান ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এঁদের মধ্যে রিগনের অনুবাদের পাশে বাংলা পাঠ মুদ্রিত হলেও জেমসের অনুবাদের সঙ্গে কোনো বাংলা পাঠ মুদ্রিত হয়নি। আর এই দুটি বই-ই বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটের মধ্যে লালন সাঁইয়ের গানের বাংলা প্রামাণ্যপাঠ উপস্থাপন, ইংরেজি অনুবাদ, পাঠান্তর ও গানের ব্যাখ্যা প্রণয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অনুবাদক-গবেষক ড. ক্যারোল সলোমন অনন্য একটি কাজ সম্পাদন করেছেন। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে লালন সাঁইয়ের দর্শন, গান ও ভাবধারার ওপর গভীর গবেষণা চালিয়েছেন, জনসংস্কৃতি সমীক্ষা করেছেন, পাশাপাশি লালনপন্থী খ্যাতিমান সাধক কবি, সংগীতগুরু, শিল্পীদের নৈকট্য লাভের মাধ্যমে একজন অ-বাংলাভাষী হিসেবে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন।
তবে ক্যারোল সলোমন লালনকে নিয়ে যে কাজ করছিলেন, তিনি সেটি সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করে যেতে পারেননি। ২০০৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ ঘটে। কিন্তু আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁর লালনের গানের এই অনুবাদ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক অমূল্য গ্রন্থে। ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ শিরোনামে বইটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি সম্পাদনার মূল দায়িত্ব পালন করেছি আমি। এতে পরে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গবেষক ড. কিথ ই. কান্তু।
ক্যারোল সলোমন উপলদ্ধি করেছিলেন, লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ কেবল শব্দান্তরের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়; এর জন্য সাধকের গভীর দর্শন, সংস্কৃতির পরিভাষা, জনসংস্কৃতির মূল্যবোধ, জীবনাচার প্রভৃতি উপলদ্ধি করার প্রয়োজন। এছাড়া তিনি দেখেছিলেন যে পশ্চিমা জগতে প্রাচ্যের সাহিত্য অনুবাদের ইতিহাসে দেখা যায় একধরনের ‘অর্থবিপর্যয়’—যেখানে মূল লেখকের ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয় ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, রুমির কবিতার ইংরেজি অনুবাদে তাঁর ইসলামি আধ্যাত্মিকতা প্রায় অনুপস্থিত। ফলে তাঁর কবিতা একধরনের বিমূর্ত আধ্যাত্মবাদে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যা তাঁর আসল দর্শনের সঙ্গে মেলে না।
এই পরিস্থিতিতেই ড. ক্যারল সলোমন লালন-গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি চেয়েছিলেন, লালনের গান যেন কেবল ‘মিস্টিক সং’ হিসেবে নয়, বরং তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী চিন্তা, সামাজিক প্রতিবাদ এবং বাউল দর্শনের আসল মর্মে পৌঁছায়। এভাবেই তিনি পশ্চিমা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ‘বাংলার আত্মা’কে।
ড. ক্যারল সলোমন ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড লিটারেচারস বিভাগের অধ্যাপক। তিনি খুব অল্প কয়েকজন বিদেশির একজন, যিনি পিএইচডি করেছিলেন মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্য বিষয়ে। পরবর্তীকালে তিনি বাউল-ফকিরদের জীবন-দর্শন ও লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
বাংলাদেশে তাঁর আগমন শুরু হয় আশির দশকের শেষভাগে। তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন দেশের একাধিক লোকসংস্কৃতি গবেষক, সংগীতশিল্পী ও বাউল সাধকদের সঙ্গে। বিশেষ করে বিজয় সরকার, খোদাবক্স সাঁই, আব্দুল করিম শাহসহ বহু সাধকশিল্পীর সান্নিধ্য গ্রহণ করেন তিনি। এঁদের মধ্যে তিনি খোদাবক্স সাঁই ও অন্যদের কাছ থেকে লালন সাঁইয়ের গানের বহু পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি অডিও রেকর্ডারে লালন সাঁইয়ের বহু গান রেকর্ড করেন। মূলত এসব সংগ্রহের ভিত্তিতে লালনের গানের পাঠভেদ, মৌখিক ইতিহাস, এবং গানের ব্যাখ্যা প্রণয়ন করেন ক্যারল স্যালেমন।
২০০৮ সালে ক্যারল স্যালোমনের শেষ বাংলাদেশ সফরে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয় আমার। তখন ঠিক হয়, পরবর্তী সফরে ক্যারল স্যালেমনের সাক্ষাৎকার নেব আমি। পাশাপাশি ভবিষ্যতের কাজ নিয়েও আলোচনা করব। কিন্তু ভাগ্য ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিল—২০০৯ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যারলের মৃত্যু ঘটে।
২০১২ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে ক্যারলের স্বামী রিচার্ড সলোমনের সঙ্গে দেখা করি। রিচার্ড আমাকে অনুরোধ করেন, ক্যারলের অসমাপ্ত কাজটি সম্পূর্ণ করতে, তাঁর নোট ও গবেষণার উপাদান থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশনা তৈরি করতে। সেই থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় যাত্রা, যা শেষ পর্যন্ত ‘সিটি অব মিররস’ গ্রন্থে রূপ নেয়।
প্রথম পর্যায়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম ক্যারলের কাজের পরিমাণ দেখে। বিশেষ করে ক্যারোল লালন সাঁইয়ের যে গানগুলো অনুবাদ করেছেন তার প্রতিটি তিনি নিজে হাতে-কলমে লিখেছেন। শুধু তাই নয়, তার ওপর বিভিন্ন কালি দিয়ে নোটও লিখেছেন। এটা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বইটিতে ক্যারোলের নিজের হাতের লেখা বাংলা গানগুলোর মূলপাঠের ছবি, ধ্বনিগত রূপান্তর (phonemic transcription) এবং ইংরেজি অনুবাদ—তিনটিই থাকবে।
এই পদ্ধতিই বইটিকে অনন্য করে তুলেছে। কেননা, এটি শুধু লালনের গানের অনুবাদ নয়; বরং একধরনের ‘সাংস্কৃতিক নথি’—যেখানে বাংলা ভাষা ও বাউল দর্শনের স্বরূপ অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
বইটির নাম থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্বিভাষিক পাঠ রয়েছে। যেমন ইংরেজিতে বইটির নাম হলো, ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’; আর বাংলায় নাম রাখা হয়েছে ‘আরশিনগর: লালন সাঁইয়ের গান’। এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে লালন দর্শনের মূল প্রতীক। লালনের গানে মানবদেহকে প্রায়শই ‘আরশিনগর’ বলা হয়—যেখান প্রতিফলিত হয় পরম সত্য। এই আরশিতে যেমন ময়লা বা অহংকারে ঢেকে যায়, তেমনি সাধনার মাধ্যমে তা পরিষ্কার করলে মানুষ নিজের মধ্যেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে।
এই প্রতীকের দর্শনকেই ক্যারোল সলোমনের প্রণীত লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ বইয়ের শিরোনামে ধারণ করেছে। বইটিতে লালনের ১৪৬টি গানের বাংলা প্রামাণ্যপাঠ ও তার অনুবাদ, ক্যারোলোর হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির ছবিসহ ইংরেজি অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি গানের সঙ্গে রয়েছে বিস্তারিত টীকা, ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট। এর মাধ্যমে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন, লালন শুধু ধর্মীয় কবি নন, বরং গভীর মানবতাবাদী এক দার্শনিক; যিনি জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ—সব সীমার বাইরে এক সর্বজনীন মানবধর্মের কথা বলেছেন।
২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ নামের এ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। এতে মূল বক্তা হিসেবেও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, ক্যারোল সলোমনের বইটি প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক গবেষণামহলে লালন সাঁইয়ের গান নিয়ে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা বহু প্রতিষ্ঠানই বইটিকে একটি মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, এটি প্রথম গ্রন্থ, যেখানে লালনের গান, বাংলা পাঠ, উচ্চারণরীতি, এবং ইংরেজি অনুবাদ একই সঙ্গে রয়েছে। এই বইয়ের সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের লালন সাঁইয়ের গান ও দর্শন—সবই এক বিশ্বসম্পদ, যা সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই।
বইয়ের ভূমিকায় বিশ্ববিখ্যাত বাউল গবেষক জিয়ান ওপেনশ লিখেছেন, লালন সাঁই (প্রায় ১৭৭৪–১৮৯০) ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক সাধক, যিনি মানবদেহের মধ্যেই পরম সত্যের সন্ধান করেছেন। তাঁর দর্শনে ঈশ্বর ও মানুষ আলাদা নয়; বরং মানুষ নিজেই ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি। তিনি জাতপাত, ধর্মীয় বিভেদ, ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছেন।
আর প্রসঙ্গকথায় রিচার্ড সলোমনের ভাষ্য হলো, লালনের গানগুলো তাই শুধু সংগীত নয়, এক গভীর দার্শনিক ভাষ্য—যা আজও মানবতাবাদের সবচেয়ে প্রাঞ্জল উচ্চারণগুলোর একটি। ক্যারল স্যালোমনের অনুবাদ এই গভীরতা অনুধাবনের জন্য এক অনন্য জানালা খুলে দিয়েছে পশ্চিমা পাঠকের কাছে।
ক্যারল স্যালোমনের উদ্যোগ প্রমাণ করে, সংস্কৃতির সীমানা ভাষা বা ভূগোল দ্বারা নির্ধারিত নয়। ভালোবাসা, কৌতূহল আর একাডেমিক সততা থাকলে যে কোনো জাতির ঐতিহ্য অন্য জাতির হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে। তাঁর কাজকে তাই বলা যায় এক আমেরিকান গবেষকের ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া এক বাঙালির আত্মার আরশিনগর। এই গবেষকের মৃত্যু যেমন আমাদের শোকাহত করে, তেমনি তাঁর উত্তরাধিকার আমাদের অনুপ্রাণিত করে যে বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমরা যেন আমাদের সংস্কৃতির মর্মে ফিরে তাকাই, তা নথিবদ্ধ করি; এবং সঠিকভাবে উপস্থাপন করি।
শেষে বলব, ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ শুধু একটি বই নয়; এটি এক বহুজাতিক বন্ধনের প্রতীক—যেখানে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি, মার্কিন একাডেমিক গবেষণা, এবং মানবতার সার্বজনীন চেতনা মিলিত হয়েছে।
এই বইয়ের মধ্য দিয়ে লালন সাঁই বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে জন্ম নিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে জেগে উঠেছেন।
লেখক: লোকসংস্কৃতি গবেষক; কবি
ফকির লালন সাঁই যুগের পরিক্রমায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছেন। প্রথমত গানের বাণীর ভেতর দিয়ে প্রকাশিত তাঁর ভাব-দর্শন ও মনুষ্যজ্ঞানের প্রজ্ঞা বিশ্বের নানান দেশের বিদ্বান-পণ্ডিতদের আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়ত, লালন সাঁই প্রবর্তিত সাধকের জীবনাচার, শুভ্র বসন, সাধুসঙ্গের প্রেমময় ঐতিহ্য লালনের প্রতি তীব্রতর আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। তাই তো দেশ-কালের গণ্ডি ছাপিয়ে লালন হয়ে উঠেছেন সব মানুষের, সব দেশের, সব ধর্মের।
লালনের চর্চা আজ আর শুধু বাঙালিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জার্মান, জাপান, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশের বহু অনুবাদক-গবেষকগণ বিচ্ছিন্ন লালনের গান অনুবাদ করেছেন। যদিও প্রথম দিকে লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসে ‘দি ফিলোসফি অব আওয়ার পিপল’ নামে সভাপতির ভাষণে সেই অনুবাদের আংশিক উপস্থাপন করেন। এরপর মিস এ. জি. স্টক, অ্যাডয়ার্ড সি ডিমোক, জুন মাদানিয়েল, ব্রাদার জেমস, ফাদার মারিনো রিগন, মাসাইয়্যুকি ওনিশি, মাসাহিকো তোগাওয়া প্রমুখ বিভিন্ন ভাষায় বেশ কিছু লালনের গান অনুবাদ করেন। এঁদের মধ্যে ফাদার মারিনো রিগন ১০১টি গান ইতালিয়ান ভাষায় এবং ব্রাদার জেমস ১০৩টি গান ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। এঁদের মধ্যে রিগনের অনুবাদের পাশে বাংলা পাঠ মুদ্রিত হলেও জেমসের অনুবাদের সঙ্গে কোনো বাংলা পাঠ মুদ্রিত হয়নি। আর এই দুটি বই-ই বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটের মধ্যে লালন সাঁইয়ের গানের বাংলা প্রামাণ্যপাঠ উপস্থাপন, ইংরেজি অনুবাদ, পাঠান্তর ও গানের ব্যাখ্যা প্রণয়নের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের অনুবাদক-গবেষক ড. ক্যারোল সলোমন অনন্য একটি কাজ সম্পাদন করেছেন। তিনি প্রায় তিন দশক ধরে লালন সাঁইয়ের দর্শন, গান ও ভাবধারার ওপর গভীর গবেষণা চালিয়েছেন, জনসংস্কৃতি সমীক্ষা করেছেন, পাশাপাশি লালনপন্থী খ্যাতিমান সাধক কবি, সংগীতগুরু, শিল্পীদের নৈকট্য লাভের মাধ্যমে একজন অ-বাংলাভাষী হিসেবে অসাধারণ দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন।
তবে ক্যারোল সলোমন লালনকে নিয়ে যে কাজ করছিলেন, তিনি সেটি সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করে যেতে পারেননি। ২০০৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ ঘটে। কিন্তু আমাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তাঁর লালনের গানের এই অনুবাদ প্রকল্প শেষ পর্যন্ত রূপ নেয় এক অমূল্য গ্রন্থে। ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ শিরোনামে বইটি যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। বইটি সম্পাদনার মূল দায়িত্ব পালন করেছি আমি। এতে পরে আমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক গবেষক ড. কিথ ই. কান্তু।
ক্যারোল সলোমন উপলদ্ধি করেছিলেন, লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ কেবল শব্দান্তরের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়; এর জন্য সাধকের গভীর দর্শন, সংস্কৃতির পরিভাষা, জনসংস্কৃতির মূল্যবোধ, জীবনাচার প্রভৃতি উপলদ্ধি করার প্রয়োজন। এছাড়া তিনি দেখেছিলেন যে পশ্চিমা জগতে প্রাচ্যের সাহিত্য অনুবাদের ইতিহাসে দেখা যায় একধরনের ‘অর্থবিপর্যয়’—যেখানে মূল লেখকের ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরিচয় ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, রুমির কবিতার ইংরেজি অনুবাদে তাঁর ইসলামি আধ্যাত্মিকতা প্রায় অনুপস্থিত। ফলে তাঁর কবিতা একধরনের বিমূর্ত আধ্যাত্মবাদে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে, যা তাঁর আসল দর্শনের সঙ্গে মেলে না।
এই পরিস্থিতিতেই ড. ক্যারল সলোমন লালন-গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তিনি চেয়েছিলেন, লালনের গান যেন কেবল ‘মিস্টিক সং’ হিসেবে নয়, বরং তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদী চিন্তা, সামাজিক প্রতিবাদ এবং বাউল দর্শনের আসল মর্মে পৌঁছায়। এভাবেই তিনি পশ্চিমা পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ‘বাংলার আত্মা’কে।
ড. ক্যারল সলোমন ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের এশিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজেস অ্যান্ড লিটারেচারস বিভাগের অধ্যাপক। তিনি খুব অল্প কয়েকজন বিদেশির একজন, যিনি পিএইচডি করেছিলেন মধ্যযুগের বাংলা কাব্যসাহিত্য বিষয়ে। পরবর্তীকালে তিনি বাউল-ফকিরদের জীবন-দর্শন ও লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।
বাংলাদেশে তাঁর আগমন শুরু হয় আশির দশকের শেষভাগে। তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন দেশের একাধিক লোকসংস্কৃতি গবেষক, সংগীতশিল্পী ও বাউল সাধকদের সঙ্গে। বিশেষ করে বিজয় সরকার, খোদাবক্স সাঁই, আব্দুল করিম শাহসহ বহু সাধকশিল্পীর সান্নিধ্য গ্রহণ করেন তিনি। এঁদের মধ্যে তিনি খোদাবক্স সাঁই ও অন্যদের কাছ থেকে লালন সাঁইয়ের গানের বহু পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেন। পাশাপাশি অডিও রেকর্ডারে লালন সাঁইয়ের বহু গান রেকর্ড করেন। মূলত এসব সংগ্রহের ভিত্তিতে লালনের গানের পাঠভেদ, মৌখিক ইতিহাস, এবং গানের ব্যাখ্যা প্রণয়ন করেন ক্যারল স্যালেমন।
২০০৮ সালে ক্যারল স্যালোমনের শেষ বাংলাদেশ সফরে তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা হয় আমার। তখন ঠিক হয়, পরবর্তী সফরে ক্যারল স্যালেমনের সাক্ষাৎকার নেব আমি। পাশাপাশি ভবিষ্যতের কাজ নিয়েও আলোচনা করব। কিন্তু ভাগ্য ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিল—২০০৯ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ক্যারলের মৃত্যু ঘটে।
২০১২ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে ক্যারলের স্বামী রিচার্ড সলোমনের সঙ্গে দেখা করি। রিচার্ড আমাকে অনুরোধ করেন, ক্যারলের অসমাপ্ত কাজটি সম্পূর্ণ করতে, তাঁর নোট ও গবেষণার উপাদান থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকাশনা তৈরি করতে। সেই থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ সম্পাদকীয় যাত্রা, যা শেষ পর্যন্ত ‘সিটি অব মিররস’ গ্রন্থে রূপ নেয়।
প্রথম পর্যায়ে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম ক্যারলের কাজের পরিমাণ দেখে। বিশেষ করে ক্যারোল লালন সাঁইয়ের যে গানগুলো অনুবাদ করেছেন তার প্রতিটি তিনি নিজে হাতে-কলমে লিখেছেন। শুধু তাই নয়, তার ওপর বিভিন্ন কালি দিয়ে নোটও লিখেছেন। এটা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বইটিতে ক্যারোলের নিজের হাতের লেখা বাংলা গানগুলোর মূলপাঠের ছবি, ধ্বনিগত রূপান্তর (phonemic transcription) এবং ইংরেজি অনুবাদ—তিনটিই থাকবে।
এই পদ্ধতিই বইটিকে অনন্য করে তুলেছে। কেননা, এটি শুধু লালনের গানের অনুবাদ নয়; বরং একধরনের ‘সাংস্কৃতিক নথি’—যেখানে বাংলা ভাষা ও বাউল দর্শনের স্বরূপ অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
বইটির নাম থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে দ্বিভাষিক পাঠ রয়েছে। যেমন ইংরেজিতে বইটির নাম হলো, ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’; আর বাংলায় নাম রাখা হয়েছে ‘আরশিনগর: লালন সাঁইয়ের গান’। এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে লালন দর্শনের মূল প্রতীক। লালনের গানে মানবদেহকে প্রায়শই ‘আরশিনগর’ বলা হয়—যেখান প্রতিফলিত হয় পরম সত্য। এই আরশিতে যেমন ময়লা বা অহংকারে ঢেকে যায়, তেমনি সাধনার মাধ্যমে তা পরিষ্কার করলে মানুষ নিজের মধ্যেই ঈশ্বরকে উপলব্ধি করতে পারে।
এই প্রতীকের দর্শনকেই ক্যারোল সলোমনের প্রণীত লালন সাঁইয়ের গানের অনুবাদ বইয়ের শিরোনামে ধারণ করেছে। বইটিতে লালনের ১৪৬টি গানের বাংলা প্রামাণ্যপাঠ ও তার অনুবাদ, ক্যারোলোর হস্তলিখিত পাণ্ডুলিপির ছবিসহ ইংরেজি অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তা ছাড়া প্রতিটি গানের সঙ্গে রয়েছে বিস্তারিত টীকা, ভাষাতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট। এর মাধ্যমে পাঠক সহজেই বুঝতে পারবেন, লালন শুধু ধর্মীয় কবি নন, বরং গভীর মানবতাবাদী এক দার্শনিক; যিনি জাতপাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ—সব সীমার বাইরে এক সর্বজনীন মানবধর্মের কথা বলেছেন।
২০১৭ সালের ৮ নভেম্বর ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ নামের এ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান হয়। এতে মূল বক্তা হিসেবেও উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
এখানে উল্লেখ করা দরকার, ক্যারোল সলোমনের বইটি প্রকাশের পর আন্তর্জাতিক গবেষণামহলে লালন সাঁইয়ের গান নিয়ে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়। দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি নিয়ে কাজ করা বহু প্রতিষ্ঠানই বইটিকে একটি মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ, এটি প্রথম গ্রন্থ, যেখানে লালনের গান, বাংলা পাঠ, উচ্চারণরীতি, এবং ইংরেজি অনুবাদ একই সঙ্গে রয়েছে। এই বইয়ের সাফল্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বাংলাদেশের লালন সাঁইয়ের গান ও দর্শন—সবই এক বিশ্বসম্পদ, যা সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরই।
বইয়ের ভূমিকায় বিশ্ববিখ্যাত বাউল গবেষক জিয়ান ওপেনশ লিখেছেন, লালন সাঁই (প্রায় ১৭৭৪–১৮৯০) ছিলেন এক অসাম্প্রদায়িক সাধক, যিনি মানবদেহের মধ্যেই পরম সত্যের সন্ধান করেছেন। তাঁর দর্শনে ঈশ্বর ও মানুষ আলাদা নয়; বরং মানুষ নিজেই ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি। তিনি জাতপাত, ধর্মীয় বিভেদ, ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছেন।
আর প্রসঙ্গকথায় রিচার্ড সলোমনের ভাষ্য হলো, লালনের গানগুলো তাই শুধু সংগীত নয়, এক গভীর দার্শনিক ভাষ্য—যা আজও মানবতাবাদের সবচেয়ে প্রাঞ্জল উচ্চারণগুলোর একটি। ক্যারল স্যালোমনের অনুবাদ এই গভীরতা অনুধাবনের জন্য এক অনন্য জানালা খুলে দিয়েছে পশ্চিমা পাঠকের কাছে।
ক্যারল স্যালোমনের উদ্যোগ প্রমাণ করে, সংস্কৃতির সীমানা ভাষা বা ভূগোল দ্বারা নির্ধারিত নয়। ভালোবাসা, কৌতূহল আর একাডেমিক সততা থাকলে যে কোনো জাতির ঐতিহ্য অন্য জাতির হৃদয়ে পৌঁছাতে পারে। তাঁর কাজকে তাই বলা যায় এক আমেরিকান গবেষকের ভালোবাসা থেকে জন্ম নেওয়া এক বাঙালির আত্মার আরশিনগর। এই গবেষকের মৃত্যু যেমন আমাদের শোকাহত করে, তেমনি তাঁর উত্তরাধিকার আমাদের অনুপ্রাণিত করে যে বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমরা যেন আমাদের সংস্কৃতির মর্মে ফিরে তাকাই, তা নথিবদ্ধ করি; এবং সঠিকভাবে উপস্থাপন করি।
শেষে বলব, ‘সিটি অব মিররস: সংস অব লালন সাঁই’ শুধু একটি বই নয়; এটি এক বহুজাতিক বন্ধনের প্রতীক—যেখানে বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি, মার্কিন একাডেমিক গবেষণা, এবং মানবতার সার্বজনীন চেতনা মিলিত হয়েছে।
এই বইয়ের মধ্য দিয়ে লালন সাঁই বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে জন্ম নিয়েছেন বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে জেগে উঠেছেন।
লেখক: লোকসংস্কৃতি গবেষক; কবি
বিগত রাকসু নির্বাচনগুলোর ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এবারেই প্রথম রাকসুতে নেতৃত্বে এল ছাত্রশিবির। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর 'রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন’ এবং রাকসু মিলিয়ে ছাত্র সংসদের ভোট হয়েছে মোট ১৭ বার।
১ দিন আগেজনপ্রিয় গোয়েন্দা লেখক রকিব হাসান প্রয়াত হয়েছেন। । তাঁর ‘তিন গোয়েন্দা’ এক সময় তুমুল জনপ্রিয় ছিল।
২ দিন আগেচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৯ বছরের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র সাতবার। এসব নির্বাচনে কারা জয়ী হয়েছিল? কেমন ছিল সেসব নির্বাচন?
২ দিন আগেআমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন চার টাকা দিয়ে মুগদা ব্যাংক কলোনির গলি থেকে মতিঝিল মডেল স্কুলে যাতায়াত হয়ে যেত। যেতে লাগত দুই টাকা, আসতে দুই টাকা। এই টাকাটা বাঁচাতে আমি ও আমার বড় ভাই—আমরা দুজনেই হেঁটে যাতায়াত করতাম। বিনিময়ে লুকিয়ে চুরিয়ে একটা সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা কিনতাম। পেপারব্যাকের চায়না নিউজপ্
৩ দিন আগে