leadT1ad

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মহীনের ঘোড়াগুলির তাপস বাপী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গান গাইতে যেতে চাই’

গতকাল ছিল কলকাতার বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপী দাসের জন্মদিন। ১৯৫৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মানো এই শিল্পীর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল বাংলাদেশে। এ দেশে গান গাইতে আসার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর। ২০২৩ সালে মারা যাওয়ায় এ ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়নি।

প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১: ৪৬
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মহীনের ঘোড়াগুলির তাপস বাপী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে গান গাইতে যেতে চাই’। স্ট্রিম গ্রাফিক

‘ভালোবাসি জ্যোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে/হায় ভালোবাসি’, ‘এই সুরে বহুদূরে’, ‘সুধীজন শোনো’, ‘ভেসে আসে কলকাতা’, ‘সংবিগ্ন পাখিকূল’; এই গানগুলো আমরা অনেকেই শুনেছি। সত্তরের দশকে গাওয়া কলকাতার বিখ্যাত ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র এসব গান গানগুলো আজও সবার মুখে মুখে ফেরে। ওপরের এসব গানের কণ্ঠ, সুরে কিংবা কথায় মিশে আছে একজনের নাম।

বলছিলাম মহীনের ঘোড়াগুলির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তাপস বাপী দাস, আমাদের সবার ‘বাপীদা’র কথা। ২০২৩ সালের ২৫ জুন তাঁর দৈহিক জীবনের ইতি ঘটেছে। বাপীদা মননে ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক বাঙালি। ‘ছিলেন’ কেন বলছি? তিনি তো আজীবন থাকবেন এই পৃথিবীর আস্তাবলে, মহীনের আদি ঘোড়া হয়ে চরে বেড়াবেন জ্যোৎস্নার প্রান্তরে।

বাপীদা সত্তরের আত্মা। তিনি কখনো থেমে থাকেননি। কাজ করে গেছেন। সক্রিয় থেকে মহীনের ঘোড়াগুলির সাংগীতিক দর্শন বুকে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। ব্যান্ডের দলনেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায় মারা যাওয়ার কয়েক বছর পর, ২০০৩ সালে বাপীদা নতুনদের নিয়ে ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’ নামে ব্যান্ড করলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে দীর্ঘদিন হাঁটতে না পারলেও গান চালিয়ে গেছেন। মহীনের কাউন্টার কালচারের পরম্পরা ধরে রেখেছিলেন। আপস করেন নি কখনোই, তাঁর গুরু গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মতো।

বাপীদার সঙ্গে যখনই কথা হতো, জানাতেন, বাংলাদেশে গাইতে আসতে চাই। আমরা কয়েকজন মিলে বাংলাদেশে আয়োজনও করতে চেয়েছিলাম তাঁর ব্যান্ডের কনসার্ট। প্রাথমিক পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ল।

তাপস বাপীদার সঙ্গে আমার পরিচয় বছর দশেকের। শেষ দিনগুলোতে পরিবারের বাইরে আমার সঙ্গে তাঁর সবচেয়ে বেশি কথা হতো। তখন প্রায়ই বাবার চিকিৎসা করাতে কলকাতা যেতাম। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে একদিন হাসপাতালে তাঁকে দেখতে গেলাম।

বাপীদা আমাকে দেখেই বললেন, ‘কত কথা বলার আছে তোমার সঙ্গে! কিন্তু আমি এখন এই অবস্থায়!’ আমি বললাম, আপনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবেন। এরপর আরো চারবার বাপীদার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তাঁর ছিল প্রবল মনোবল। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও প্রচণ্ড খারাপ শারীরিক অবস্থাতেও ভাবতেন, তিনি দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন, আবার গান গাইবেন। দেখা করতে গেলেই অক্সিজেনের নল খুলে কথা বলতে শুরু করতেন। একবার হাসপাতালের বেডে শুয়ে জানালেন, ‘এবার সুস্থ হয়ে বাংলাদেশে গান গাইতে যেতে চাই। তোমরা আয়োজন করো।’

মহীনের ঘোড়াগুলি। সংগৃহীত ছবি
মহীনের ঘোড়াগুলি। সংগৃহীত ছবি

বাপীদা আর সুস্থ হননি। তবে গান ঠিকই গান করেছেন, তাও আবার স্টেজে। চিকিৎসা চলাকালেই নাকে রাইস টিউব লাগিয়ে কলকাতার দেশপ্রিয় পার্কের মঞ্চে গান গাইতে হাজির হয়েছিলেন হাজারো মানুষের সামনে। মঞ্চে তিনি তাঁর ব্যান্ড ‘মহীন এখন ও বন্ধুরা’ নিয়ে পরিবেশন করছিলেন শ্রোতৃপ্রিয় গানগুলো। কোনো কিছুই থামাতে পারেনি সত্তরের কলকাতায় ‘নতুন দিনের গান’ আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা এই তাপস বাপী দাসকে।

তাপস বাপী দাস বাংলাদেশের প্রতি সব সময় আলাদা টান অনুভব করতেন। কেন জানেন? ১৯৫৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মানো এই শিল্পীর পূর্বপুরুষের ভিটা ছিল বাংলাদেশে। খবরাখবর রাখতেন বাংলাদেশ নিয়ে। রাজনীতি থেকে শিল্পসংস্কৃতি—সব নিয়েই আলাপ হতো আমাদের। বাংলাদেশে এখনো ওপেন এয়ার কনসার্টে দশ হাজার মানুষ টিকেট কেটে গান শুনতে যায় জেনে বাপীদা তাঁদের ১৯৭৫-৮১ সালের ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র লড়াইয়ের গল্প শোনাতেন।

বাপীদাকে আমাদের ব্যান্ডগুলোর গানও পাঠাতাম। বাংলাদেশের গিটার মায়েস্ত্রো নিলয় দাশ ১৯৯২ সালে তাঁর অ্যালবামে ‘ভালোবাসি জ্যোৎস্নায়’ গান কাভার করেছিলেন। তখন মহীনের ঘোড়াগুলি কলকাতায়ও তেমন চর্চিত ছিল না। সেই সময়ে বাংলাদেশে তাঁদের গান কাভার হয়েছে জেনে তিনি যে কী খুশি হয়েছিলেন! জেমসের গান নিয়েও আলাপ হতো। আমি তখন ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ব্যান্ডের ম্যানেজার ছিলাম। আমাদের গান শুনে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে এখন এমন গানও তৈরি হচ্ছে। খুবই ভালো লাগলো শুনে।’

১৯৭৫-৮১ পর্যন্ত সক্রিয় থাকাকালে ৩টি অ্যালবাম বের হয়েছিল এই ব্যান্ডের। অ্যালবামের অধিকাংশ গানেই কোনো না কোনোভাবে ছিল বাপীদার উপস্থিতি। গতানুগনিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে সে সময় তাঁদের গানে রাজনীতি-বিপ্লব, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, স্বাধীনতা—সবকিছুই এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। এরপর এই ব্যান্ড ভেঙে যায়। থেমে যায় কলকাতায় এই ঘোড়াদের খুরের আওয়াজ।

বাপীদার সঙ্গে যখনই কথা হতো, জানাতেন, বাংলাদেশে গাইতে আসতে চাই। আমরা কয়েকজন মিলে বাংলাদেশে আয়োজনও করতে চেয়েছিলাম তাঁর ব্যান্ডের কনসার্ট। প্রাথমিক পরিকল্পনা সাজিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই শরীরে ক্যানসার ধরা পড়ল।

তবে, আমরা বাংলাদেশ থেকে বাপীদার চিকিৎসা সহায়তায় কনসার্টের আয়োজন করেছিলাম। সেখানে বাংলাদেশের ৪০+ শিল্পী মহীনের ঘোড়াগুলির গান গেয়েছিলেন। ব্যাপারটা যখন প্রথম বাপীদার সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম, তখন খুব খুশি হয়েছিলেন। নিজে আর বাংলাদেশে আসতে না পারলেও তাঁকে স্মরণ করে আমরা কিছু করতে চলেছি, এটা তাঁর ভালো লেগেছিল।

তাপস বাপী দাস, ১৯৮০ সালের দিকে। সংগৃহীত ছবি
তাপস বাপী দাস, ১৯৮০ সালের দিকে। সংগৃহীত ছবি

কিন্তু খারাপ লাগে এটা ভেবে যে, এই কনসার্ট তিনি দেখে যেতে পারলেন না। এর আগেই চলে গেলেন। মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা আগেও তিনি আমাদের কনসার্টের জন্য স্মারক টি-শার্টে স্বাক্ষর করেছিলেন। এরপর আমরা সেই কনসার্ট করেছিলাম, তাঁকে স্মরণ করে। কনসার্টের টিকেট বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছিলাম তাঁর স্ত্রী সুতপা ঘোষের হাতে।

ছোটবেলা থেকেই গানবাজনা ও লেখালেখির প্রতি ঝোঁক ছিল বাপীদার। গানে বাঁধাধরা কোনো তালিম পাননি কখনো। কিশোর বয়সেই বেহালায় পাড়ার অনুষ্ঠানে নিয়মিত গান করতেন। সত্তরের দশকের শুরুতে মহীনের ঘোড়াগুলির ভ্যানগার্ড, দলনেতা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা গড়ে ওঠে। পাড়ার বয়স্কদের ভাষায়, গৌতম চট্টোপাধ্যায় তখন অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের রীতিমতো ‘বখে যাওয়ার’ তালিম দিচ্ছেন।

তখনো মহীনের ঘোড়াগুলির জন্ম হয়নি। সবাই একসঙ্গে আড্ডা দিতেন, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের গান শুনতেন। দলবলসহ কলকাতার রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন নতুন গানের সন্ধানে। রক, লাতিন মিউজিক থেকে শুরু করে বেদে, বৃহন্নলাদের গান, লোকাল ট্রেনের বাউল গান, গ্রামগঞ্জের বাউল উৎসবের গান—সবই মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। পাশ্চাত্যের সঙ্গে বাংলার নিজস্বতা জারি রেখে গান তৈরি করার চেষ্টা করতেন।

তখনকার সময়ে শ্রোতারা রোমান্টিক সুরেলা ঘরানার গানে মোহগ্রস্ত ছিলেন। এসব দেখে গৌতম চট্টোপাধ্যায়, তাপস বাপী দাস সব ব্যান্ডের সবাই চিন্তা করতেন, সবকিছু তো আজীবন একই সরলরেখা বরাবর চলতে পারে না। সুতরাং তাঁদের নতুন কিছু সৃষ্টি করতে হবে।

হাসপাতালের বিছানায় তাপস বাপী দাসের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে
হাসপাতালের বিছানায় তাপস বাপী দাসের সঙ্গে লেখক। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এরপর নকশাল আন্দোলন শুরু হলে গৌতম চট্টোপাধ্যায় সেই আন্দোলনে যোগ দিলেন। বাপীদা পরোক্ষভাবে নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গেলেন। গৌতম চট্টোপাধ্যায় যখন আন্ডারগ্রাউন্ডে, তখন বাপীদা দূত হিসেবেও গেছেন নকশাল ডেরায়, সেখান থেকে ফেরার পথেই জন্ম ‘হায় ভালোবাসি’ নামে জনপ্রিয় গানের। এরপর একসময় গৌতম চট্টোপাধ্যায় ধরা পড়লেন। ভাগ্য ভালো বিধায় জেল হলো দেড় বছরের। এরপর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কলকাতার বাইরে কিছুকাল কাটিয়ে ফিরে এসে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ পেরিয়ে সাতজন সদস্য নিয়ে ১৯৭৫ সালে গঠিত হয় কলকাতার প্রথম বাংলা ব্যান্ড মহীনের ঘোড়াগুলির।

১৯৭৫-৮১ পর্যন্ত সক্রিয় থাকাকালে ৩টি অ্যালবাম বের হয়েছিল এই ব্যান্ডের। অ্যালবামের অধিকাংশ গানেই কোনো না কোনোভাবে ছিল বাপীদার উপস্থিতি। গতানুগনিক সংগীতবোধের বাইরে গিয়ে সে সময় তাঁদের গানে রাজনীতি-বিপ্লব, ভালোবাসা, দারিদ্র্য, অন্যায়-অবিচার, স্বাধীনতা—সবকিছুই এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। এরপর এই ব্যান্ড ভেঙে যায়। থেমে যায় কলকাতায় এই ঘোড়াদের খুরের আওয়াজ।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আবার তারা ফিরে আসে সম্পাদিত অ্যালবামগুলো দিয়ে। মূলত সেই সময়েই মহীনের ঘোড়াগুলি তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে মহীন–অধ্যায়ের। এরপর বাপীদা নিজের ব্যান্ড করেছেন। বয়স কখনো তাঁকে কাবু করতে পারেনি। সব সময় নতুনদের আলো দেখিয়েছেন নতুন কিছু করার, তাঁদের পাশে থেকেছেন বটগাছ হয়ে, ঠিক যেমনটা ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

Ad 300x250

সম্পর্কিত