গতকাল প্রয়াত হয়েছেন বরেণ্য কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। কেন তিনি অতীতের বর্তমান এবং একই সঙ্গে আগামী দিনের পাঠকের ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে থাকবেন? লিখেছেন এই সময়ের এক কথাসাহিত্যিক।
হামীম কামরুল হক
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রয়াত হয়ে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অনেক স্মৃতি রেখে গেলেন। ভবিষ্যতের স্মৃতি কেন? সেটি কী বিষয়? স্মৃতি তো অতীতের বিষয়। তা কীভাবে ভবিষ্যতের হতে পারে। একসময় কথাগুলো খুব চমকে দিত—অতীতের বর্তমান, বর্তমানের অতীত, ভবিষ্যতের অতীত এবং ভবিষ্যতের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের স্মৃতি; সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রয়াণে হঠাৎ করে কথাগুলো মনে হলো।
আগে ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। এসব কথা ধাঁধার মতোই মনে হতো। মনে হতো এসব হেঁয়ালির কোনো মানে নেই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে শব্দের বিমূর্তায়নগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কবিতাকেই মনে হয়ে সবচেয়ে গদ্যময়, যুক্তির বিন্যাসে স্পষ্ট। অন্যদিকে, অনেক গদ্যরচনা, যেখানে প্রতিটি শব্দের অর্থ জানা, কিন্তু মনে হয় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাতে চমকপ্রদ বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে—কবিতার মতো আপাত দুর্বোধ্য বিষয় বোধনের সীমায় এসে যাচ্ছে। আর গদ্য হয়ে যাচ্ছে জটিল দুর্বোধ্য ও বোধনের অতীত। সাহিত্যের এই উল্টো যাত্রাও দারুণ নিদারুণ। কবিতা হচ্ছে গদ্যে, আর গদ্য হয়ে যাচ্ছে কবিতার মতো। যেভাবে হ্বিটগেনস্টাইন দর্শনকে কবিতার মতো করে লেখার কথা ভেবেছিলেন। কথাগুলি বলছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ দিককে মনে রেখে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মানে আমার কাছে বাংলাদেশের সর্বশেষ চমকে দেওয়া, থমকে দেওয়া এক ছোটগল্পকারের নাম। তাঁর ছোটগল্পগুলোয় যেন একটা গদ্য ও কাব্যিকতার মাঝামাঝি ব্যাপার ঘটে গেছে। বলা হয়, তাঁর লেখাতে জাদুবাস্তবতা আছে, কিন্তু সেটি না মার্কেসীয় না গুন্টার গ্রাসীয় বা রুশদির মতো। এমনকি একসময় দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর ‘অলস দিনের হাওয়া’ নামের কলাম থেকে যে শহীদুল জহির প্রথম জাদুবাস্তববাদের খোঁজ পেয়েছিলেন, সেই শহীদুলের গল্পের জাদুময়তার সঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পে জাদুময় বাস্তবতার মিল নেই।
এসবই আমাদের ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে উঠতে থাকবে; যেমন তিনি সংবাদের ‘অলস দিনের হাওয়া’ লিখে, বিশ্বসাহিত্যের অভিনব সব লেখকের কীর্তির সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। উমাবর্তো একো, জোসেফ ব্রডস্কি বা নিকোলাস গিয়েন থেকে জেমস বল্ডুইন বা বহুমিল হ্রাবাল, এমন কি নয়নতারা সাহগল। এখন বলতেই হবে, দুয়ারের পর দুয়ার খুলে দিয়ে ‘অলস দিনের হাওয়া’ অতীতে পাঠককে আজকে ভবিষ্যতে এনে ফেলেছে, আর ভবিষ্যতের পাঠককে সেদিনের অতীতে নিয়ে যাবে। তখন মনে হয় সাহিত্য সত্যিই অতীত ও ভবিষ্যতের ভেতরে সেতু তৈরি করে দিয়ে আমাদের বর্তমানকে অদ্ভুত এক গতিময়তা এখন এনে দিচ্ছে ও আগামীসময়েও এনে দেবে।
২.
‘বিশাল মৃত্যু’ নামের যে গল্পটি দিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাহিত্য যাত্রা শুরু হয়েছিলো, মাঝখানে বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ নানান কারণে কিছুটা শিথিলতা নেমে এলেও এক পর্যায়ে দেখা গেল বাংলাদেশে তিনি হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে সক্রিয় ছোটগল্প লেখক। কেবল তাই নয়, তিনি পূর্ববর্তী ছোটগল্পের চেহারা বদলে দিয়ে চললেন। প্রকাশিত হতে থাকল একের পর এক ছোটগল্পের বই, ‘থাকা না থাকার গল্প’, ‘কাচভাঙা রাতের গল্প’, ‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘সুখদুঃখের গল্প’, ‘বেলা অবেলার গল্প’। লেখকের চেয়ে তিনি যেন কথকের ভূমিকা পালন করেছেন প্রতিটি গল্পে। তাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তাঁদের বাড়ির গৃহকর্মীজাতীয় কাজে থাকা হাবিব ভাইয়ের কাছে গল্প বলার এই ভঙ্গিটি তিনি পেয়েছিলেন। এর ভেতর থেকে ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ বইটিতে একটির পর একটি গল্প আমাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিতে থাকল। এটা অতীতের বর্তমান এবং একই সঙ্গে আগামী দিনের পাঠকের ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে ওঠার মতো।
‘আধাখানা মানুষ’, ‘দিনরাত্রিগুলি’, ‘আজগুবি রাত’, ‘তিন পর্বের জীবন’ বা ‘কানাগলির মানুষেরা’ বা ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে মিলে ‘যোগাযোগর গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন মানুষ একা একা’—এসব লেখা নানান কারণে পাঠকের সামনে লেখক হিসেবে তাঁর শক্তি ও দুর্বলতার বিষয়গুলিকে হাজির করবে নিঃসন্দেহে। কেউ কেউ যেমন মনে করতেই পারেন যে ঔপন্যাসিক মনজুরুল ইসলামের চেয়ে ছোটগল্পকার মনজুরুল ইসলাম অনেক বেশি দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী লেখক। কথকের ভঙ্গিতে লেখা গল্পগুলোতে যেন জীবনের ভেতর থেকেই জাদুগুলো বের করে আনা। ফলে ‘ফারগুসান ডিনারওয়ালা’, বা ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয় বিক্রয়’ বা ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’র ভেতর দিয়ে তিনি যে বিষয়গুলো হাজির করেন, কোনোভাবে তা অবিশ্বাস্য মনে হয় না। কারণ, গল্পকারের সার্থকতাই এই যে তিনি যদি বাঘকে ঘাস খাওয়ানোর ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন, সেখানেই তাঁর জিত। গল্পকার হিসেবে মনজুরুল ইসলাম তাই ঔপন্যাসিক মনজুরুল ইসলামকে টেক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এছাড়াও লেখক হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আরো কয়েকটি দিক তো ছিলই। এর একটি হলো ধীমান প্রাবন্ধিক হিসেবে দারুণ সব বইয়ের জন্ম দেওয়া। বলা যায়, প্রয়োজনীয় বা সাহিত্যচর্চায় কাজে দেবে এমন সব বই তিনি লিখেছেন। ‘অলস দিনের হাওয়া’র কথা তো বলাই হলো। কিন্তু দুঃখে বিষয় হলো সেই কলামে যে আড়াই শ প্রবন্ধ তৈরি হয়েছিল, তার থেকে সামান্যই রক্ষা করা গেছে। বাদবাকি সব হারিয়ে গেছে। হয়ত কোনো মহাফেজখানায়, যেমন, বাংলা একাডেমি বা জাতীয় সংগ্রহশালার কোনো একটিতে যদি বাকিগুলি পাওয়া যায়, তাহলে অতীব মূল্যবান সংগ্রহটির নতুন জন্ম হবে। এই সংগ্রহের বাকি লেখাগুলি উদ্ধার করা যেতেই পারে এবং হওয়াটা জরুরিও।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রয়াণে এই কাজটি যেন এই সময়ের বা আগামীর দায়িত্বশীল গবেষকদের জন্য দারুণ একটি কাজের কাজ হতে পারে। কারণ বলা যায় না, তাঁর ওই সব লেখাগুলো থেকে আগামী সময়ের ক্রমে কমে আসা সাহিত্যপাঠে পাগল মানুষদের কেউ কেউ নতুন করে লেখালেখির স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন। নতুন নতুন শহীদুল জহির তো তৈরি হতেই পারে। এটাও হতে পারে আমাদের ভবিষ্যতের স্মৃতি।
‘নন্দনতত্ত্ব’র মতো তাঁর লেখা ছোট্ট একটি বই যে কত উপকারী, সেটি যারা পড়েছেন, জানেন। আমরা যারা মনে করি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে নান্দনিক বোধ ও রুচির মাধ্যমেই তৈরি হতে পারে আগামীর মানবিক সমাজ। নইলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নামে যে উন্মাদনা, এককাট্টা ব্যবসায়-বাণিজ্যের নামে যে ভয়াবহ একমুখীতা, সেটি সমাজে হারবাট মার্কুইসের সেই ভয়ংকর একমাত্রিক মানুষের সমাজের জন্ম দেবে। আর সেটি কোনোভাবেই আগামী পৃথিবীর জন্য সুখকর হবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই দিক থেকে চিত্রকলার ওপরও প্রচুর লেখা লিখেছেন। দেশেবিদেশের ছবি ও চিত্রশিল্পীদের নিয়ে তাঁর মূল্যায়নগুলোও আমাদের জন্য বড় কাজের এক ভান্ডার হয়ে আছে। ‘রবীন্দ্রনাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ’ বইতে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের নানা শিল্পীর ওপর দৃষ্টিপাত আমাদের সমৃদ্ধ করেছে, সেই সঙ্গে বিশ্বের শিল্প জগতের সঙ্গে সেতু তৈরি করে দিয়েছে।
৩.
মনে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন বিখ্যাত লেখক কার্ট ভানেগার্টের মৃত্যুতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘হ্যালো/স্বাগতম ভানেগার্ট’- মানে ভানেগার্টের মতো লেখককে বিদায় বলার কোনো মানে হয় না। ভানেগার্টের মতো লেখক আগামী পৃথিবীর জন্য বার বার ফিরে ফিরে দরকার হবে। ফলে তাঁর চলে যাওয়াতে বলতে হবে, হ্যালো ভানেগার্ট।’ সত্যিকার অর্থে তাঁর এই লেখার মাধ্যমেই বাংলাদেশের অবিদ্যায়তনিক জগতের অনেক আগ্রহী পাঠক ভানেগার্টের নাম প্রথম শুনতে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভানেগার্টের পাঠক সংখ্যা বাংলাদেশে কিছুটা হলেও বেড়েছিল।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সারা জীবন ধরেই এই সংযোগ সাধনের কাজগুলি করেছেন। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাসাহিত্যের এবং বাংলাসাহিত্যে নিক্তিতে বিশ্বসাহিত্যের দশা শনাক্ত করতে তিনি ছিলেন অতীব সিদ্ধহস্ত একজন ধীমান প্রাবন্ধিক। ‘কতিপয় প্রবন্ধ’ কি ‘অলসদিনের হওয়া’র মতো বইতে তিনি কম বেশি দেশি-বিদেশি সাহিত্যরুচির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে যে কাজটি করেছেন, তা হলো সাহিত্যে নামে আমাদের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে দেওয়া। অথচ বিষয়টি উল্টো হতে পারত। মানে, হয়তো আমরা সবাই আহা-উহুর হাহাকার তুলে মনে করতাম, বিদেশে এমন সব লেখক, আর আমরা সবাই কী লিখছি! বাংলা সাহিত্যে কোথায় এত পরীক্ষা নিরীক্ষা আর আধুনিক-উত্তরাধুনিক অতিযাত্রা!
বলাবাহুল্য, বাংলা সাহিত্যের বিষয়গুলো বাঙালি হিসেবে বা বাংলাভাষাভাষী মানুষ হিসেবে আমাদের কম বেশি জানা। এছাড়া বিদ্যায়তনিক ও অবিদ্যাতনিকভাবে বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করীম থেকে বাংলা সাহিত্যের সদ্য তরুণ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা থাকলেও তিনি নজর দিয়েছেন মূলত বিশ্বসাহিত্যের দিকে। ফলে তুলনামূলক সাহিত্য জগতেও তাঁকে হানা দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলক সাহিত্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি তিনিই সম্প্রতি নতুন করে হাজির করেছেন। তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ্যসূচি তৈরিতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভূমিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটেও নথিবদ্ধ হয়ে আছে।
গত ত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যসূচি/সিলেবাস তৈরিতে, পরীক্ষক হিসেবে তিনি সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। বলতেই হবে যে, এটা তাঁর পেশাগত জীবনের অন্যতম দিক। সেক্ষেত্রে দেশকালের বাস্তবতা মনে রেখে অভিজ্ঞ অধ্যাপকের চোখ দিয়ে তিনি টেক্সট নির্বাচন করেছেন, প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেটি সবার মনঃপূত হোক বা না হোক, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করতে তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এটি ব্যক্তি ও অধ্যাপক হিসেবে তাঁর বিশেষ দিক।
জানা যায়, শ্রেণিকক্ষে গল্পের ভঙ্গিতেই তিনি লেকচার দিতেন। কিন্তু ভেতর দিয়েই ক্ল্যাসিক, আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতার বিচিত্র তথ্য, তত্ত্ব ও ব্যক্তিত্বদের পাঠ তিনি দিয়েছেন। যাঁরা নিতে পেরেছে তারা রেখেছেন সেই গ্রহিষ্ণুতার প্রমাণ।
আরও দুয়েকটি দিকের কথা না বললেই নয়। তিনি ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যখনই বাংলায় বক্তৃতা করতেন, তখন একটি শব্দও আর ইংরেজিতে ব্যবহার করতেন না। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরই যোগ্য ছাত্র ছিলেন। যেমন বলতেন, ‘মুঠোফোনের পর্দায় ক্ষুদে বার্তা পেয়ে বিষয়টি জানতে পেরেছি।’ আরেকটি দিক হলো সবসময় সহযোগিতাপূর্ণ মনটিকে সজীব রাখা। যেকোনো প্রয়োজনে বহু বহু মানুষের নানান সংকটে বিপদে তিনি ত্রাতা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। ফলে মানুষ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের এইসব দিকও ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তৈরি করবে আরও অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্মৃতি।
৪.
১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রয়াত হলেন ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর। কাটিয়ে গেলেন চুয়াত্তর বছরের এক উদ্যমী, সৃষ্টিশীল ও কর্মময় জীবন। প্রধান পরিচয় এখন কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হলেও পেশাগত জীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তিনি যেমন টিপিক্যাল কথাসাহিত্যিক ছিলেন না, তেমন ছিলেন না টিপিক্যাল অধ্যাপক।
বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকসহ দেশের অনেক সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। একসময়ের সাড়াজাগানো দৈনিক আজকের কাগজের কাগজ সাহিত্য পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার একঅর্থে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। এ ছাড়াও তিনি দেশ ও সমাজের বিচিত্র সব সংকটে পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। যদিও যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষের মতো তাঁকেও আপস বনাম সাহসের গণিত শিখে নিতে হয়েছে। উগ্রতা বা হঠকারী মনোভাবের থেকে নিজেকে সবসময় দূরে রেখেছেন। ফলে অনেকেরই সমালোচনার শিকার হয়েছেন। আর সেটা হওয়াটাই স্বাভাবকি ছিল। সবার কাছে ভালো হওয়ার মতো খারাপ কিছু তো এ জগতে আর কিছু হতে পারে না। চাইলে মানুষ সবার কাছে ভালো থাকতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সুনাম-দুর্নাম দুই-ই কমবেশি এসে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাঁধে চেপেছে। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার বিচিত্র দাবি দাওয়া নিত্য পূরণ করতে হয়েছে। তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহু সংগঠনেও কাজ করে গেছেন। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নানান প্রকল্পেও সময় দিতে ছুটে বেড়িয়েছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। ফলে তাঁর সক্রিয়তার বড় একটা দিক নিজের চেয়ে অন্যদের কাজে বেশি খরচ হয়েছে। এর ফলে বোধ করি তাঁর লেখক ও শিক্ষকসত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদুপরি, তিনি লেখক, শিক্ষক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী মানুষ হিসেবে যা দিয়ে গেছেন, আগামীর যারা ওই লেখালেখির জগতে বা শিক্ষার জগতের কাজ করবেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সফলতা-ব্যর্থতাগুলো তাদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে। এটি ভবিষ্যতের স্মৃতির আরেক ভাণ্ডার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রয়াত হয়ে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অনেক স্মৃতি রেখে গেলেন। ভবিষ্যতের স্মৃতি কেন? সেটি কী বিষয়? স্মৃতি তো অতীতের বিষয়। তা কীভাবে ভবিষ্যতের হতে পারে। একসময় কথাগুলো খুব চমকে দিত—অতীতের বর্তমান, বর্তমানের অতীত, ভবিষ্যতের অতীত এবং ভবিষ্যতের বর্তমান এবং ভবিষ্যতের স্মৃতি; সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রয়াণে হঠাৎ করে কথাগুলো মনে হলো।
আগে ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। এসব কথা ধাঁধার মতোই মনে হতো। মনে হতো এসব হেঁয়ালির কোনো মানে নেই। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে শব্দের বিমূর্তায়নগুলো স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। কবিতাকেই মনে হয়ে সবচেয়ে গদ্যময়, যুক্তির বিন্যাসে স্পষ্ট। অন্যদিকে, অনেক গদ্যরচনা, যেখানে প্রতিটি শব্দের অর্থ জানা, কিন্তু মনে হয় ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তাতে চমকপ্রদ বিষয়টি দাঁড়াচ্ছে—কবিতার মতো আপাত দুর্বোধ্য বিষয় বোধনের সীমায় এসে যাচ্ছে। আর গদ্য হয়ে যাচ্ছে জটিল দুর্বোধ্য ও বোধনের অতীত। সাহিত্যের এই উল্টো যাত্রাও দারুণ নিদারুণ। কবিতা হচ্ছে গদ্যে, আর গদ্য হয়ে যাচ্ছে কবিতার মতো। যেভাবে হ্বিটগেনস্টাইন দর্শনকে কবিতার মতো করে লেখার কথা ভেবেছিলেন। কথাগুলি বলছি সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কথাসাহিত্যের একটি বিশেষ দিককে মনে রেখে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মানে আমার কাছে বাংলাদেশের সর্বশেষ চমকে দেওয়া, থমকে দেওয়া এক ছোটগল্পকারের নাম। তাঁর ছোটগল্পগুলোয় যেন একটা গদ্য ও কাব্যিকতার মাঝামাঝি ব্যাপার ঘটে গেছে। বলা হয়, তাঁর লেখাতে জাদুবাস্তবতা আছে, কিন্তু সেটি না মার্কেসীয় না গুন্টার গ্রাসীয় বা রুশদির মতো। এমনকি একসময় দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে তাঁর ‘অলস দিনের হাওয়া’ নামের কলাম থেকে যে শহীদুল জহির প্রথম জাদুবাস্তববাদের খোঁজ পেয়েছিলেন, সেই শহীদুলের গল্পের জাদুময়তার সঙ্গে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পে জাদুময় বাস্তবতার মিল নেই।
এসবই আমাদের ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে উঠতে থাকবে; যেমন তিনি সংবাদের ‘অলস দিনের হাওয়া’ লিখে, বিশ্বসাহিত্যের অভিনব সব লেখকের কীর্তির সঙ্গে আমাদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। উমাবর্তো একো, জোসেফ ব্রডস্কি বা নিকোলাস গিয়েন থেকে জেমস বল্ডুইন বা বহুমিল হ্রাবাল, এমন কি নয়নতারা সাহগল। এখন বলতেই হবে, দুয়ারের পর দুয়ার খুলে দিয়ে ‘অলস দিনের হাওয়া’ অতীতে পাঠককে আজকে ভবিষ্যতে এনে ফেলেছে, আর ভবিষ্যতের পাঠককে সেদিনের অতীতে নিয়ে যাবে। তখন মনে হয় সাহিত্য সত্যিই অতীত ও ভবিষ্যতের ভেতরে সেতু তৈরি করে দিয়ে আমাদের বর্তমানকে অদ্ভুত এক গতিময়তা এখন এনে দিচ্ছে ও আগামীসময়েও এনে দেবে।
২.
‘বিশাল মৃত্যু’ নামের যে গল্পটি দিয়ে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাহিত্য যাত্রা শুরু হয়েছিলো, মাঝখানে বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ নানান কারণে কিছুটা শিথিলতা নেমে এলেও এক পর্যায়ে দেখা গেল বাংলাদেশে তিনি হয়ে উঠেছেন সবচেয়ে সক্রিয় ছোটগল্প লেখক। কেবল তাই নয়, তিনি পূর্ববর্তী ছোটগল্পের চেহারা বদলে দিয়ে চললেন। প্রকাশিত হতে থাকল একের পর এক ছোটগল্পের বই, ‘থাকা না থাকার গল্প’, ‘কাচভাঙা রাতের গল্প’, ‘অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প’, ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’, ‘সুখদুঃখের গল্প’, ‘বেলা অবেলার গল্প’। লেখকের চেয়ে তিনি যেন কথকের ভূমিকা পালন করেছেন প্রতিটি গল্পে। তাঁর এক সাক্ষাৎকারে জানা যায়, তাঁদের বাড়ির গৃহকর্মীজাতীয় কাজে থাকা হাবিব ভাইয়ের কাছে গল্প বলার এই ভঙ্গিটি তিনি পেয়েছিলেন। এর ভেতর থেকে ‘প্রেম ও প্রার্থনার গল্প’ বইটিতে একটির পর একটি গল্প আমাদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দিতে থাকল। এটা অতীতের বর্তমান এবং একই সঙ্গে আগামী দিনের পাঠকের ভবিষ্যতের স্মৃতি হয়ে ওঠার মতো।
‘আধাখানা মানুষ’, ‘দিনরাত্রিগুলি’, ‘আজগুবি রাত’, ‘তিন পর্বের জীবন’ বা ‘কানাগলির মানুষেরা’ বা ব্রাত্য রাইসুর সঙ্গে মিলে ‘যোগাযোগর গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন মানুষ একা একা’—এসব লেখা নানান কারণে পাঠকের সামনে লেখক হিসেবে তাঁর শক্তি ও দুর্বলতার বিষয়গুলিকে হাজির করবে নিঃসন্দেহে। কেউ কেউ যেমন মনে করতেই পারেন যে ঔপন্যাসিক মনজুরুল ইসলামের চেয়ে ছোটগল্পকার মনজুরুল ইসলাম অনেক বেশি দৃঢ় ও আত্মবিশ্বাসী লেখক। কথকের ভঙ্গিতে লেখা গল্পগুলোতে যেন জীবনের ভেতর থেকেই জাদুগুলো বের করে আনা। ফলে ‘ফারগুসান ডিনারওয়ালা’, বা ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্রয় বিক্রয়’ বা ‘ডিডেলাসের ঘুড়ি’র ভেতর দিয়ে তিনি যে বিষয়গুলো হাজির করেন, কোনোভাবে তা অবিশ্বাস্য মনে হয় না। কারণ, গল্পকারের সার্থকতাই এই যে তিনি যদি বাঘকে ঘাস খাওয়ানোর ঘটনাটি বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন, সেখানেই তাঁর জিত। গল্পকার হিসেবে মনজুরুল ইসলাম তাই ঔপন্যাসিক মনজুরুল ইসলামকে টেক্কা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
এছাড়াও লেখক হিসেবে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের আরো কয়েকটি দিক তো ছিলই। এর একটি হলো ধীমান প্রাবন্ধিক হিসেবে দারুণ সব বইয়ের জন্ম দেওয়া। বলা যায়, প্রয়োজনীয় বা সাহিত্যচর্চায় কাজে দেবে এমন সব বই তিনি লিখেছেন। ‘অলস দিনের হাওয়া’র কথা তো বলাই হলো। কিন্তু দুঃখে বিষয় হলো সেই কলামে যে আড়াই শ প্রবন্ধ তৈরি হয়েছিল, তার থেকে সামান্যই রক্ষা করা গেছে। বাদবাকি সব হারিয়ে গেছে। হয়ত কোনো মহাফেজখানায়, যেমন, বাংলা একাডেমি বা জাতীয় সংগ্রহশালার কোনো একটিতে যদি বাকিগুলি পাওয়া যায়, তাহলে অতীব মূল্যবান সংগ্রহটির নতুন জন্ম হবে। এই সংগ্রহের বাকি লেখাগুলি উদ্ধার করা যেতেই পারে এবং হওয়াটা জরুরিও।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রয়াণে এই কাজটি যেন এই সময়ের বা আগামীর দায়িত্বশীল গবেষকদের জন্য দারুণ একটি কাজের কাজ হতে পারে। কারণ বলা যায় না, তাঁর ওই সব লেখাগুলো থেকে আগামী সময়ের ক্রমে কমে আসা সাহিত্যপাঠে পাগল মানুষদের কেউ কেউ নতুন করে লেখালেখির স্বপ্ন দেখতে শুরু করবেন। নতুন নতুন শহীদুল জহির তো তৈরি হতেই পারে। এটাও হতে পারে আমাদের ভবিষ্যতের স্মৃতি।
‘নন্দনতত্ত্ব’র মতো তাঁর লেখা ছোট্ট একটি বই যে কত উপকারী, সেটি যারা পড়েছেন, জানেন। আমরা যারা মনে করি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে নান্দনিক বোধ ও রুচির মাধ্যমেই তৈরি হতে পারে আগামীর মানবিক সমাজ। নইলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি নামে যে উন্মাদনা, এককাট্টা ব্যবসায়-বাণিজ্যের নামে যে ভয়াবহ একমুখীতা, সেটি সমাজে হারবাট মার্কুইসের সেই ভয়ংকর একমাত্রিক মানুষের সমাজের জন্ম দেবে। আর সেটি কোনোভাবেই আগামী পৃথিবীর জন্য সুখকর হবে না।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সেই দিক থেকে চিত্রকলার ওপরও প্রচুর লেখা লিখেছেন। দেশেবিদেশের ছবি ও চিত্রশিল্পীদের নিয়ে তাঁর মূল্যায়নগুলোও আমাদের জন্য বড় কাজের এক ভান্ডার হয়ে আছে। ‘রবীন্দ্রনাথের জ্যামিতি ও অন্যান্য শিল্পপ্রসঙ্গ’ বইতে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের নানা শিল্পীর ওপর দৃষ্টিপাত আমাদের সমৃদ্ধ করেছে, সেই সঙ্গে বিশ্বের শিল্প জগতের সঙ্গে সেতু তৈরি করে দিয়েছে।
৩.
মনে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমকালীন বিখ্যাত লেখক কার্ট ভানেগার্টের মৃত্যুতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন, ‘হ্যালো/স্বাগতম ভানেগার্ট’- মানে ভানেগার্টের মতো লেখককে বিদায় বলার কোনো মানে হয় না। ভানেগার্টের মতো লেখক আগামী পৃথিবীর জন্য বার বার ফিরে ফিরে দরকার হবে। ফলে তাঁর চলে যাওয়াতে বলতে হবে, হ্যালো ভানেগার্ট।’ সত্যিকার অর্থে তাঁর এই লেখার মাধ্যমেই বাংলাদেশের অবিদ্যায়তনিক জগতের অনেক আগ্রহী পাঠক ভানেগার্টের নাম প্রথম শুনতে পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভানেগার্টের পাঠক সংখ্যা বাংলাদেশে কিছুটা হলেও বেড়েছিল।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সারা জীবন ধরেই এই সংযোগ সাধনের কাজগুলি করেছেন। বিশ্বের সঙ্গে বাংলাসাহিত্যের এবং বাংলাসাহিত্যে নিক্তিতে বিশ্বসাহিত্যের দশা শনাক্ত করতে তিনি ছিলেন অতীব সিদ্ধহস্ত একজন ধীমান প্রাবন্ধিক। ‘কতিপয় প্রবন্ধ’ কি ‘অলসদিনের হওয়া’র মতো বইতে তিনি কম বেশি দেশি-বিদেশি সাহিত্যরুচির সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিতে যে কাজটি করেছেন, তা হলো সাহিত্যে নামে আমাদের হীনম্মন্যতা কাটিয়ে দেওয়া। অথচ বিষয়টি উল্টো হতে পারত। মানে, হয়তো আমরা সবাই আহা-উহুর হাহাকার তুলে মনে করতাম, বিদেশে এমন সব লেখক, আর আমরা সবাই কী লিখছি! বাংলা সাহিত্যে কোথায় এত পরীক্ষা নিরীক্ষা আর আধুনিক-উত্তরাধুনিক অতিযাত্রা!
বলাবাহুল্য, বাংলা সাহিত্যের বিষয়গুলো বাঙালি হিসেবে বা বাংলাভাষাভাষী মানুষ হিসেবে আমাদের কম বেশি জানা। এছাড়া বিদ্যায়তনিক ও অবিদ্যাতনিকভাবে বিভূতি-তারাশঙ্কর-মানিক বা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, রশীদ করীম থেকে বাংলা সাহিত্যের সদ্য তরুণ সম্পর্কে তাঁর স্পষ্ট ধারণা থাকলেও তিনি নজর দিয়েছেন মূলত বিশ্বসাহিত্যের দিকে। ফলে তুলনামূলক সাহিত্য জগতেও তাঁকে হানা দিতে হয়েছে। বাংলাদেশে তুলনামূলক সাহিত্যের বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ইতিহাসটি তিনিই সম্প্রতি নতুন করে হাজির করেছেন। তুলনামূলক সাহিত্যের পাঠ্যসূচি তৈরিতে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ভূমিকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটেও নথিবদ্ধ হয়ে আছে।
গত ত্রিশ বছর ধরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের পাঠ্যসূচি/সিলেবাস তৈরিতে, পরীক্ষক হিসেবে তিনি সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। বলতেই হবে যে, এটা তাঁর পেশাগত জীবনের অন্যতম দিক। সেক্ষেত্রে দেশকালের বাস্তবতা মনে রেখে অভিজ্ঞ অধ্যাপকের চোখ দিয়ে তিনি টেক্সট নির্বাচন করেছেন, প্রস্তাবনা দিয়েছেন। সেটি সবার মনঃপূত হোক বা না হোক, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পেশ করতে তিনি দ্বিধান্বিত ছিলেন না। এটি ব্যক্তি ও অধ্যাপক হিসেবে তাঁর বিশেষ দিক।
জানা যায়, শ্রেণিকক্ষে গল্পের ভঙ্গিতেই তিনি লেকচার দিতেন। কিন্তু ভেতর দিয়েই ক্ল্যাসিক, আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতার বিচিত্র তথ্য, তত্ত্ব ও ব্যক্তিত্বদের পাঠ তিনি দিয়েছেন। যাঁরা নিতে পেরেছে তারা রেখেছেন সেই গ্রহিষ্ণুতার প্রমাণ।
আরও দুয়েকটি দিকের কথা না বললেই নয়। তিনি ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে যখনই বাংলায় বক্তৃতা করতেন, তখন একটি শব্দও আর ইংরেজিতে ব্যবহার করতেন না। এক্ষেত্রে তিনি তাঁর শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীরই যোগ্য ছাত্র ছিলেন। যেমন বলতেন, ‘মুঠোফোনের পর্দায় ক্ষুদে বার্তা পেয়ে বিষয়টি জানতে পেরেছি।’ আরেকটি দিক হলো সবসময় সহযোগিতাপূর্ণ মনটিকে সজীব রাখা। যেকোনো প্রয়োজনে বহু বহু মানুষের নানান সংকটে বিপদে তিনি ত্রাতা হিসেবে দেখা দিয়েছেন। ফলে মানুষ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের এইসব দিকও ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তৈরি করবে আরও অনেক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্মৃতি।
৪.
১৯৫১ সালের ১৮ জানুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করা সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রয়াত হলেন ২০২৫ সালের ১০ অক্টোবর। কাটিয়ে গেলেন চুয়াত্তর বছরের এক উদ্যমী, সৃষ্টিশীল ও কর্মময় জীবন। প্রধান পরিচয় এখন কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক হলেও পেশাগত জীবনে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কিন্তু তিনি যেমন টিপিক্যাল কথাসাহিত্যিক ছিলেন না, তেমন ছিলেন না টিপিক্যাল অধ্যাপক।
বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার ও একুশে পদকসহ দেশের অনেক সম্মাননা তিনি পেয়েছেন। একসময়ের সাড়াজাগানো দৈনিক আজকের কাগজের কাগজ সাহিত্য পুরস্কার, প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের পুরস্কার একঅর্থে কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে। এ ছাড়াও তিনি দেশ ও সমাজের বিচিত্র সব সংকটে পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করেছেন দ্বিধাহীনভাবে। যদিও যেকোনো বুদ্ধিমান মানুষের মতো তাঁকেও আপস বনাম সাহসের গণিত শিখে নিতে হয়েছে। উগ্রতা বা হঠকারী মনোভাবের থেকে নিজেকে সবসময় দূরে রেখেছেন। ফলে অনেকেরই সমালোচনার শিকার হয়েছেন। আর সেটা হওয়াটাই স্বাভাবকি ছিল। সবার কাছে ভালো হওয়ার মতো খারাপ কিছু তো এ জগতে আর কিছু হতে পারে না। চাইলে মানুষ সবার কাছে ভালো থাকতে পারে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার সুনাম-দুর্নাম দুই-ই কমবেশি এসে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাঁধে চেপেছে। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার বিচিত্র দাবি দাওয়া নিত্য পূরণ করতে হয়েছে। তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বহু সংগঠনেও কাজ করে গেছেন। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে নানান প্রকল্পেও সময় দিতে ছুটে বেড়িয়েছেন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। ফলে তাঁর সক্রিয়তার বড় একটা দিক নিজের চেয়ে অন্যদের কাজে বেশি খরচ হয়েছে। এর ফলে বোধ করি তাঁর লেখক ও শিক্ষকসত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তদুপরি, তিনি লেখক, শিক্ষক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মী মানুষ হিসেবে যা দিয়ে গেছেন, আগামীর যারা ওই লেখালেখির জগতে বা শিক্ষার জগতের কাজ করবেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সফলতা-ব্যর্থতাগুলো তাদের সামনে দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকবে। এটি ভবিষ্যতের স্মৃতির আরেক ভাণ্ডার।
লেখক: কথাসাহিত্যিক; জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক
এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন হাঙ্গেরির কথাসাহিত্যিক লাজলো ক্রাসনাহোরকাই। তাঁর বিশেষত্ব কোথায়? কেন তাঁর গদ্যের ভেতর ঘোর আর ঘোরের ভেতর গদ্য?
১ ঘণ্টা আগেআজ আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস। বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ১১ অক্টোবর পালিত হয় এ দিবস। ব্যস্ত ঢাকা শহরে কন্যাশিশুকে লালন-পালন করতে গিয়ে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হন মায়েরা? এই লেখক কেন এক কন্যাশিশুর মা হিসেবে নিজেকে ‘অপরাধী’ভাবছেন?
৭ ঘণ্টা আগেউনিশ শতকের শেষতম দশক। গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক স্কুল শিক্ষক। এ বাড়ি ও বাড়ি গিয়ে পরশপাথরের মতো খুঁজে ফিরছেন ‘অতি সামান্য’জিনিস, পরোনো পুঁথি। মনে হতে পারে, আহা মরি কিছু নয়। উচ্চবর্গের ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র কাছে এর বিশেষ কদর থাকার কথাও নয়। কিন্তু কেউ কেউ এর মূল্য বুঝেছিলেন ভবিষ্যতের বিচারে; সেই জনাকয়েক সমঝদ
১১ ঘণ্টা আগেযা লিখলাম, যা ভাবছি, যা লিখতে চাই, তা আমার বড় নিজস্ব কথা। কারণ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে নিয়ে আমার যে শোক, তা আমার একান্তই পারিবারিক, ব্যক্তিগত।
১ দিন আগে