বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। কারও দাবি আগে নির্বাচনের, কারও সংস্কার। এমন রাজনৈতিক টানা পোড়েনের মধ্যে দেশজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। সংকটময় এ পরিস্থিতিতে গতকাল দেশের প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। কী বার্তা দিল এই সংলাপ?
মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন একটি সংকটময় একটি কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। গত ২৮ আগস্ট ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজকে প্রাধান্য দিয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রোডম্যাপ ঘোষণার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। দেশজুড়ে সংঘর্ষ ও সহিংসতার নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল (৩১ আগস্ট) রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের তিনটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এই সংলাপ শুধু দলীয় মতপার্থক্য কমানোর চেষ্টা নয়, বরং দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সংলাপগুলো গণতন্ত্রের জন্য আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? এটি কি সত্যিকারের সমঝোতার পথ প্রশস্ত করছে, না কি আরও সন্দেহ আর বিভেদের জন্ম দিচ্ছে? সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে সংলাপগুলো গণতন্ত্রের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত হলেও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এর যে গভীরতা ও কার্যকারিতা, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ থেকে যায়।
৩১ আগস্ট সংলাপের পর তিনিটি রাজনৈতিক দলই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। জানিয়েছেন নিজেদের দলীয় অবস্থান। সে পরিপ্রেক্ষিতেই কথাটি বললাম। এই বৈঠক ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।
আবার এনসিপির মূল কথা ছিল, জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগামী নির্বাচন অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে।
আর জামায়াত বলেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও কার্যকর সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হোক। দলটির কথা হলো, একদিনে সব বিচার হবে না। কিন্তু বিচার অব্যাহত থাকতে হবে। পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
তবে নির্বাচন বিষয়ে সবাই এত কথা বললেও মানুষের মনে ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে কেন? কারণ, কেবল সরকার ও বিএনপি ছাড়া নির্বাচন প্রসঙ্গে অন্য দুই দল যে অবস্থান নিয়েছে, তার সঙ্গে তারা কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে।
ফলে গতকালের সংলাপ নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করবে কি না, তা বুঝতে আমাদের হয়তো আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন বেশ নাজুক। তা ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দেখা যাচ্ছে, যা সামগ্রিক জনজীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি রয়েছে রাজপথে অস্থিরতা। দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা বেড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করেছে। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের প্রতি জনগণের যে আস্থা ছিল, এসব ঘটনায় তাতেও কি চিড় ধরেনি?
সত্য হলো, সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে খানিকটা। মূলত এসবই এখন আমজনতার জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছে। আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ চাপের কারণে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে, প্রকারান্তরে তা রাজনৈতিক অস্থিরতারও জ্বালানি জোগাচ্ছে। ফলে সরকার বনাম জনগণ—শুরু হয়ে গেছে আস্থার সংকট। কেন না, বেশির ভাগ মানুষের মনেই এখন এ ধারণা প্রোথিত হয়েছে যে সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার যথেষ্ট সক্ষম নয়। সরকার কাউকে কিছু বলে না।
এসব বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সংলাপের উদ্যোগ গণতন্ত্র ও দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক এক বার্তা দেয়। অর্থাৎ ধারণা করা যায়, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবস্থানগত যে ভেদরেখা তৈরি হয়েছে এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, সরকার এখন তার অবসান ঘটাতে চায়। একা চলার পরিবর্তে সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চায় সরকার, যা গণতন্ত্রের জন্য খুবই জরুরি।
সরকারের পক্ষ থেকে এর মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও প্রকাশ করেছে রোডম্যাপ। গণতন্ত্রের পক্ষে এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, নির্বাচনই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু এ ঘোষণার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ও সন্দেহ বাড়ছে। বিভিন্ন দল মনে করছে, নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষ হবে না; অথবা এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের সুবিধার জন্য পরিচালিত হবে। এ রকম সন্দেহের কারণে এ ধরনের সংলাপের প্রয়োজনীয়তা এখন আরও বেড়েছে। সংলাপের মাধ্যমে যদি মতপার্থক্য কমানো যায়, গণতন্ত্রের জন্য সেটি এই শক্তিশালী বার্তা দেবে যে বাংলাদেশের রাজনীতি সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে সংলাপের মাধ্যমে অনেক সংকটেরই সমাধান হয়েছে। যেমন ১৯৯০-এর দশকের রাজনৈতিক অচলাবস্থা। কিন্তু বর্তমানের এই সংলাপ যদি ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে তা নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এমনও আশঙ্কা করছেন, সংলাপ ফলপ্রসূ না হলে বিঘ্নিত হতে পারে গোটা নির্বাচনব্যবস্থা। আর এটি ঘটলে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি যে আবারও পিছিয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন রাজনৈতিক দলের বৈঠকের পর কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নির্বাচন তথা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ব্যাপারে খানিকটা সন্দিহান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের এই সন্দেহ আগেও ব্যক্ত করেছে তারা।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি মনে করছে, একটি নির্দিষ্ট মহল নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টায় আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই গণ-অভুত্থানে যে দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ছিল, তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে গভীর অবিশ্বাস, সাধারণ জনগণ তো এমনই মনে করবেন, তাই না?
আবার কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন, নির্বাচন কি এ মুহূর্তে জরুরি? আমরা বলতে চাই, অবশ্যই জরুরি। এর প্রধান কারণ হলো, এখনকার এই অস্থির অবস্থায় নির্বাচন যদি না হয়, তবে বিঘ্নিত হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আর দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়লে ‘তৃতীয় পক্ষ’ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। অতীতেও এমন দেখেছি আমরা। ইতিহাস বলছে, অতীতে যখনই দেশে নির্বাচন বিলম্বিত হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে ঘটেছে সামরিক হস্তক্ষেপ। অস্থিতিশীল হয়েছে দেশ।
আসলে আমরা এসব বাস্তবতার সাক্ষী। আবার এমন ভাবনাও অমূলক নয়, নির্বাচন যদি সময়মতো না হয়, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন সহজ হতে পারে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে এবং দলের মূল নেতৃত্ব রয়েছেন দেশের বাইরে। কিন্তু এটি অস্বীকার করা যাবে না যে তাদের একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে তাদের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এ ছাড়াও তাদের হাতে আছে বিপুল অর্থ। যদি কোনো কারণে নির্বাচন বানচাল হয় এবং দেশে অস্থিরতা বাড়ে, তবে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্যে স্থিতিশীলতার জন্য আকাঙ্ক্ষা বাড়বে। আওয়ামী লীগ সে সুযোগে নিজেদের 'স্থিতিশীলতার প্রতীক' হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। দলটির নেতারা ইতোমধ্যে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তাঁদের কথা এমন: বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় অক্ষম।
তাই যেকোনো ধরনের অস্থিরতার মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাঠ ও রাজপথের রাজনীতিতে দলটি সব সময় শক্তিশালী। এ কথা মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না যে নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ধরনের সংকট দেখা দিলে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত হবে। আর এমন যদি ঘটে, গণতন্ত্রের জন্য তা হবে ক্ষতিকর। কারণ, এতে নির্বাচনের পরিবর্তে প্রাধান্য পাবে শক্তির খেলা। ফিরে আসতে পারে আবার পুরোনো ধারার রাস্তার রাজনীতি।
গণতন্ত্রে সমঝোতা অপরিহার্য। বিভিন্ন দলের মধ্যে সংলাপ যদি সফল হয়, তাহলে এটি প্রমাণিত হবে যে বাংলাদেশের রাজনীতি পরিপক্ব হয়েছে। কিন্তু যদি তা ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়বে। দুর্বল হবে গণতন্ত্রের ভিত্তি। ফলে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া এখন বোধ করি খুবই জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন করা, দলগুলোর দাবি বিবেচনা করা ইত্যাদি। এ ছাড়া, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও চাই দ্রুত পদক্ষেপ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশের তিনটি প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তবর্তী সরকার প্রধানের এ সংলাপ গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই একটি আশার বার্তা দিচ্ছে। অন্তত এটি দেখাতে পারছে যে সব পক্ষ মিলে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা তাদের রয়েছে। তবে এই সংলাপের সফলতা নির্ভর করবে দলগুলোর সত্যিকারের সমঝোতার ওপর। সংলাপ যদি শুধু আনুষ্ঠানিকতা হয়, তবে তা আরও বিভেদের জন্ম দেবে। তাই বাস্তবতার নিরিখে এখন যা দরকার তা হলো, দেশের কথা ভেবে সব পক্ষেরই কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণ--তিনে মিলে সংলাপটিকে প্রকৃত অর্থে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারলেই কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্র হবে শক্তিশালী।
মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল:[email protected]
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন একটি সংকটময় একটি কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে। গত ২৮ আগস্ট ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ২৪টি গুরুত্বপূর্ণ কাজকে প্রাধান্য দিয়ে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রোডম্যাপ ঘোষণার পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের রাজনীতি। দেশজুড়ে সংঘর্ষ ও সহিংসতার নতুন নতুন ঘটনা ঘটছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গতকাল (৩১ আগস্ট) রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশের তিনটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এই সংলাপ শুধু দলীয় মতপার্থক্য কমানোর চেষ্টা নয়, বরং দেশের সামগ্রিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার একটি প্রয়াস বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সংলাপগুলো গণতন্ত্রের জন্য আসলে কী বার্তা দিচ্ছে? এটি কি সত্যিকারের সমঝোতার পথ প্রশস্ত করছে, না কি আরও সন্দেহ আর বিভেদের জন্ম দিচ্ছে? সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটি স্পষ্ট যে সংলাপগুলো গণতন্ত্রের জন্য একটি ইতিবাচক সংকেত হলেও দেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এর যে গভীরতা ও কার্যকারিতা, তা নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ থেকে যায়।
৩১ আগস্ট সংলাপের পর তিনিটি রাজনৈতিক দলই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছে। জানিয়েছেন নিজেদের দলীয় অবস্থান। সে পরিপ্রেক্ষিতেই কথাটি বললাম। এই বৈঠক ‘ফলপ্রসূ’ হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।
আবার এনসিপির মূল কথা ছিল, জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তির জন্য আগামী নির্বাচন অবশ্যই গণপরিষদ নির্বাচন হতে হবে।
আর জামায়াত বলেছে, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও কার্যকর সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হোক। দলটির কথা হলো, একদিনে সব বিচার হবে না। কিন্তু বিচার অব্যাহত থাকতে হবে। পাশাপাশি একটি অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে।
পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার বরাত দিয়ে তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
তবে নির্বাচন বিষয়ে সবাই এত কথা বললেও মানুষের মনে ‘কিন্তু’ থেকে যাচ্ছে কেন? কারণ, কেবল সরকার ও বিএনপি ছাড়া নির্বাচন প্রসঙ্গে অন্য দুই দল যে অবস্থান নিয়েছে, তার সঙ্গে তারা কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে।
ফলে গতকালের সংলাপ নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করবে কি না, তা বুঝতে আমাদের হয়তো আরও কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে।
সব মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এখন বেশ নাজুক। তা ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে দেখা যাচ্ছে, যা সামগ্রিক জনজীবনের ওপর প্রভাব ফেলছে। পাশাপাশি রয়েছে রাজপথে অস্থিরতা। দেশে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনা বেড়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় কাছাকাছি সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি করেছে। পাশাপাশি গণ-অভ্যুত্থানের পর সরকারের প্রতি জনগণের যে আস্থা ছিল, এসব ঘটনায় তাতেও কি চিড় ধরেনি?
সত্য হলো, সরকারের ওপর মানুষের আস্থা কমেছে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যও বেড়েছে খানিকটা। মূলত এসবই এখন আমজনতার জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলেছে। আর সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানাবিধ চাপের কারণে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে, প্রকারান্তরে তা রাজনৈতিক অস্থিরতারও জ্বালানি জোগাচ্ছে। ফলে সরকার বনাম জনগণ—শুরু হয়ে গেছে আস্থার সংকট। কেন না, বেশির ভাগ মানুষের মনেই এখন এ ধারণা প্রোথিত হয়েছে যে সমস্যাগুলো সমাধানে সরকার যথেষ্ট সক্ষম নয়। সরকার কাউকে কিছু বলে না।
এসব বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরকারের সংলাপের উদ্যোগ গণতন্ত্র ও দেশের সার্বিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রকৃত অর্থেই ইতিবাচক এক বার্তা দেয়। অর্থাৎ ধারণা করা যায়, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবস্থানগত যে ভেদরেখা তৈরি হয়েছে এবং ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, সরকার এখন তার অবসান ঘটাতে চায়। একা চলার পরিবর্তে সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চায় সরকার, যা গণতন্ত্রের জন্য খুবই জরুরি।
সরকারের পক্ষ থেকে এর মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও প্রকাশ করেছে রোডম্যাপ। গণতন্ত্রের পক্ষে এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কারণ, নির্বাচনই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু এ ঘোষণার পরও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য ও সন্দেহ বাড়ছে। বিভিন্ন দল মনে করছে, নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষ হবে না; অথবা এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের সুবিধার জন্য পরিচালিত হবে। এ রকম সন্দেহের কারণে এ ধরনের সংলাপের প্রয়োজনীয়তা এখন আরও বেড়েছে। সংলাপের মাধ্যমে যদি মতপার্থক্য কমানো যায়, গণতন্ত্রের জন্য সেটি এই শক্তিশালী বার্তা দেবে যে বাংলাদেশের রাজনীতি সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে সংলাপের মাধ্যমে অনেক সংকটেরই সমাধান হয়েছে। যেমন ১৯৯০-এর দশকের রাজনৈতিক অচলাবস্থা। কিন্তু বর্তমানের এই সংলাপ যদি ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে তা নির্বাচন প্রক্রিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এমনও আশঙ্কা করছেন, সংলাপ ফলপ্রসূ না হলে বিঘ্নিত হতে পারে গোটা নির্বাচনব্যবস্থা। আর এটি ঘটলে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি যে আবারও পিছিয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন রাজনৈতিক দলের বৈঠকের পর কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নির্বাচন তথা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ব্যাপারে খানিকটা সন্দিহান। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে দায়ী ব্যক্তিদের বিচার এবং নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতার প্রশ্নে তাদের এই সন্দেহ আগেও ব্যক্ত করেছে তারা।
দ্বিতীয়ত, বিএনপি মনে করছে, একটি নির্দিষ্ট মহল নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টায় আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই গণ-অভুত্থানে যে দলগুলো ঐক্যবদ্ধ ছিল, তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে গভীর অবিশ্বাস, সাধারণ জনগণ তো এমনই মনে করবেন, তাই না?
আবার কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তুলেছেন, নির্বাচন কি এ মুহূর্তে জরুরি? আমরা বলতে চাই, অবশ্যই জরুরি। এর প্রধান কারণ হলো, এখনকার এই অস্থির অবস্থায় নির্বাচন যদি না হয়, তবে বিঘ্নিত হবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। আর দেশে অস্থিতিশীলতা বাড়লে ‘তৃতীয় পক্ষ’ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। বলা বাহুল্য, গণতন্ত্রের জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। অতীতেও এমন দেখেছি আমরা। ইতিহাস বলছে, অতীতে যখনই দেশে নির্বাচন বিলম্বিত হয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা প্রচ্ছন্নভাবে ঘটেছে সামরিক হস্তক্ষেপ। অস্থিতিশীল হয়েছে দেশ।
আসলে আমরা এসব বাস্তবতার সাক্ষী। আবার এমন ভাবনাও অমূলক নয়, নির্বাচন যদি সময়মতো না হয়, সেক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন সহজ হতে পারে। বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্ষমতার বাইরে এবং দলের মূল নেতৃত্ব রয়েছেন দেশের বাইরে। কিন্তু এটি অস্বীকার করা যাবে না যে তাদের একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক ভিত্তি রয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে তাদের সুবিধাভোগী গোষ্ঠী। এ ছাড়াও তাদের হাতে আছে বিপুল অর্থ। যদি কোনো কারণে নির্বাচন বানচাল হয় এবং দেশে অস্থিরতা বাড়ে, তবে স্বাভাবিকভাবেই জনগণের মধ্যে স্থিতিশীলতার জন্য আকাঙ্ক্ষা বাড়বে। আওয়ামী লীগ সে সুযোগে নিজেদের 'স্থিতিশীলতার প্রতীক' হিসেবে উপস্থাপন করতে পারে। দলটির নেতারা ইতোমধ্যে এ ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তাঁদের কথা এমন: বর্তমান সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় অক্ষম।
তাই যেকোনো ধরনের অস্থিরতার মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থকেরা রাজপথে সক্রিয় হয়ে উঠলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মাঠ ও রাজপথের রাজনীতিতে দলটি সব সময় শক্তিশালী। এ কথা মোটেই অতিরঞ্জিত হবে না যে নির্বাচন নিয়ে যেকোনো ধরনের সংকট দেখা দিলে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তনের পথ প্রশস্ত হবে। আর এমন যদি ঘটে, গণতন্ত্রের জন্য তা হবে ক্ষতিকর। কারণ, এতে নির্বাচনের পরিবর্তে প্রাধান্য পাবে শক্তির খেলা। ফিরে আসতে পারে আবার পুরোনো ধারার রাস্তার রাজনীতি।
গণতন্ত্রে সমঝোতা অপরিহার্য। বিভিন্ন দলের মধ্যে সংলাপ যদি সফল হয়, তাহলে এটি প্রমাণিত হবে যে বাংলাদেশের রাজনীতি পরিপক্ব হয়েছে। কিন্তু যদি তা ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়বে। দুর্বল হবে গণতন্ত্রের ভিত্তি। ফলে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষে আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে অন্তর্ভুক্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া এখন বোধ করি খুবই জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচন কমিশনকে আরও স্বাধীন করা, দলগুলোর দাবি বিবেচনা করা ইত্যাদি। এ ছাড়া, জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানেও চাই দ্রুত পদক্ষেপ।
সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশের তিনটি প্রতিনিধিত্বশীল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অন্তবর্তী সরকার প্রধানের এ সংলাপ গণতন্ত্রের জন্য অবশ্যই একটি আশার বার্তা দিচ্ছে। অন্তত এটি দেখাতে পারছে যে সব পক্ষ মিলে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছা তাদের রয়েছে। তবে এই সংলাপের সফলতা নির্ভর করবে দলগুলোর সত্যিকারের সমঝোতার ওপর। সংলাপ যদি শুধু আনুষ্ঠানিকতা হয়, তবে তা আরও বিভেদের জন্ম দেবে। তাই বাস্তবতার নিরিখে এখন যা দরকার তা হলো, দেশের কথা ভেবে সব পক্ষেরই কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণ--তিনে মিলে সংলাপটিকে প্রকৃত অর্থে ফলপ্রসূ করে তুলতে পারলেই কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্র হবে শক্তিশালী।
মোহাম্মদ মোজাহিদুল ইসলাম: শিক্ষক ও গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল:[email protected]
কেফিয়ায় মুখ ঢেকে গণমাধ্যমে আসেন তিনি। তাঁকে নিয়ে রচিত হয়েছে বহু গান। যার একটি, ‘হে আবু উবায়দা, তোমার ইচ্ছাশক্তি দৃঢ়, তোমার কথাই বুলেটের গুলি’। তিনি আবু উবায়দা। বহু ফিলিস্তিনি বীরের মতো তিনিও শহীদ হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে লিখেছেন সালেহ ফুয়াদ।
২১ মিনিট আগেবাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক সংকটময় পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়নসহ বেশ কিছু সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র মতবিরোধ এবং সাম্প্রতিক সহিংস ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে।
১ দিন আগেগত ২৩ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার ঢাকায় সফর করেন। বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্কের সাম্প্রতিক এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে ইসলামাবাদ ‘ঐতিহাসিক’ ও ‘একটি তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক’ হিসেবে বর্ণনা করে। ২০১২ সালের পর এটাই ছিল দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ।
১ দিন আগেনির্বাচন কমিশন (ইসি) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। ইসি বলছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
৩ দিন আগে