স্ট্রিম ডেস্ক

১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে অস্ট্রেলিয়া। এই আইন ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। বিশ্বে এই ধরনের আইন এটাই প্রথম। আইনটি টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক ও থ্রেডসসহ প্রধান প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৬ বছরের কম বয়সীরা যেন অ্যাকাউন্ট খুলতে বা চালিয়ে যেতে না পারে, এর জন্য কোম্পানিগুলোকে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান আইন না মানলে সর্বোচ্চ ৪৯.৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে, যা প্রায় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ সামাজিক মাধ্যমকে ‘ক্ষতিকর প্রবণতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, সামাজিক মাধ্যম কিশোর-কিশোরীদের উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ায়। সমর্থকদের মতে, এই আইন ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের রক্ষা করবে।
আইনটিতে মূলত টেক কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধ করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে শিশু বা অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। মেটা আগে থেকেই তাদের প্ল্যাটফর্মে কিশোরদের ব্লক করা শুরু করেছে। ইউটিউব জানিয়েছে, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাবালকদের সাইন-আউট করবে।
তবে এই আইন নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। আইনটি কতটা কার্যকর হবে, বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব এবং অধিকার ও নিরাপত্তার ওপর কী প্রভাব ফেলবে এসব বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা
এই আইনের মূল উদ্দেশ্য শিশুদের অনলাইন ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যম কিশোরদের হতাশা, উদ্বেগ ও আত্মসম্মানবোধের সংকট বাড়ায়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরী উল্লেখযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্ল্যাটফর্মগুলোর আসক্তিমূলক অ্যালগরিদম পরিস্থিতি আরও খারাপ করে।
সরকার ও অভিভাবকদের মতে, সামাজিক মাধ্যম শিশুদের সাইবার বুলিং, অশালীন কনটেন্ট ও অনলাইন শিকারির ঝুঁকিতে ফেলে। প্রধানমন্ত্রী অ্যালবানিজ শিশুদের স্ক্রিনের পরিবর্তে মাঠে সময় কাটানোর পরামর্শ দিয়েছেন এবং আইনটিকে সুস্থ জীবনযাপনের পথ খুলে দিবে বলে তুলে ধরেছেন।
এই উদ্যোগে গতি আসে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্রিমিয়ার পিটার মালিনাউস্কাসের তৎপরতায়। তার স্ত্রী জনাথন হেইডের বই ‘দ্য অ্যানজাস জেনারেশন’ পড়ার পর তিনি সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলই এই পদক্ষেপে সমর্থন দিয়েছে। এমনকি বিরোধীদল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে তারা আরও দ্রুত আইনটি বাস্তবায়ন করবে।
কেন এত বিতর্ক
দুই দলেরই সমর্থন থাকলেও সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা তীব্র হয়েছে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ, কিশোর-কিশোরীরা ও নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো নানা প্রশ্ন তুলেছে। নিচে বিতর্কের প্রধান দিকগুলো তুলে ধরা হলো—
১. বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও ব্যর্থতার আশঙ্কা
সমালোচকদের মতে, এই আইন কার্যকর করা কঠিন হবে। শিশুরা সহজেই ভিপিএন, ভুয়া অ্যাকাউন্ট বা প্রাপ্তবয়স্কদের পরিচয় ব্যবহার করে বয়স যাচাই এড়িয়ে যেতে পারে। অনেকে ইতিমধ্যেই লেমন এইট ও ইয়োপের মতো কম পরিচিত অ্যাপে চলে যাচ্ছে। সেগুলো হয়তো এই আইনের আওতায় পড়বে না বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল।
অস্ট্রেলিয়ার ই-সেফটি কমিশনার এসব অ্যাপকে ঝুঁকি মূল্যায়নের অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এক প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করলে অন্যগুলো মাথা তুলবে। অনেকের শঙ্কা, এতে কিশোর-কিশোরীরা নিয়ন্ত্রিত অ্যাপ থেকে সরে গিয়ে আরও বিপজ্জনক ও নজরদারির বাইরে থাকা অ্যাপে যেতে পারে। যেমন কট্টরপন্থী বা ঘৃণাবিষয়ক কনটেন্টের সাইট।
২. নিরাপত্তা ও অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ
ইউটিউবসহ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দাবি, অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হলে বরং শিশুদের ঝুঁকি বাড়বে। অ্যাকাউন্ট না থাকলে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল, কনটেন্ট ফিল্টার বা সুপারভাইজড মোড ব্যবহার করা যাবে না। ফলে শিশুরা আনমডারেটেড ও নিয়ন্ত্রণহীন কনটেন্ট দেখতে পারে। ইউটিউব বলেছে, আইনটি বেশি ‘তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে’।
১৫ বছর বয়সী এক কিশোর এই আইনের বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তার মতে, নিষেধাজ্ঞা শিশুদের আরও অনিরাপদ ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে ঠেলে দেবে।
৩. ইতিবাচক সুবিধা এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর উপর বিধিনিষেধ
বিরোধীদের যুক্তি, সামাজিক মাধ্যম শুধু ক্ষতির উৎস নয়। প্রান্তিক শিশুদের, বিশেষ করে এলজিবিটিকিউপ্লাস তরুণ বা দূর্গম অঞ্চলে থাকা শিক্ষার্থীদের, জন্য সামাজিক মাধ্যম পারস্পরিক সহায়তা, কমিউনিটি ও শেখার জগত তৈরি করে। সরাসরি নিষেধাজ্ঞায় তারা এ সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হবে।
অনেক তরুণ বলছে, নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের বদলে প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা ও মডারেশন বাড়ানো উচিত। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক জরিপে দেখা যায়, কিশোরদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। কেউ নিষেধাজ্ঞাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বলছে, আবার কেউ অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
৪. গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্ন
বয়স নির্ধারণের জন্য বায়োমেট্রিক ডেটা বা পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হতে পারে। এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁসের ঝুঁকি ও নজরদারির ভয় তৈরি হয়েছে। এ কারণেই এক কিশোর ও ডিজিটাল ফ্রিডম প্রজেক্ট আইনটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছে। তাদের দাবি, এই আইন রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইটিআইএফ একে পিছিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, এই আইন মতপ্রকাশ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সীমিত করতে পারে।
৫. অতিরিক্ত অভিভাবকসুলভ নীতি
এ আইনকে অনেকেই বিশ্বের জন্য একটি পরীক্ষামূলক মডেল হিসেবে দেখছেন। অন্যান্য দেশও এর দিকে নজর রাখছে। তবে কেউ কেউ আইনটিকে অতিরিক্ত অভিভাবকসুলভ নীতি বলে মন্তব্য করেছেন। সামাজিক মঞ্চে অনেকেই বলছেন, প্রযুক্তিতে দক্ষ কিশোর-কিশোরীদের এই আইন থামাতে পারবে না।
অনেকের মতে, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার বদলে কোম্পানিগুলোর ওপর কঠোর দায়িত্ব আরোপ করাই বেশি কার্যকর। ইউনিসেফের তরুণদের উদ্দেশে প্রকাশিত নির্দেশনায়ও সুবিধা ও সম্ভাব্য ক্ষতি—দুটিই তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে অনলাইন ক্ষতি কমবে, অন্যদিকে যোগাযোগ ও কমিউনিটি হারানোর ঝুঁকি থাকবে।
এই বিতর্ক দেখায়, আইনটি যতটা সাহসী, বাস্তবে প্রয়োগ ততটাই জটিল। শিশুদের সুরক্ষা ও স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে তৈরি হবে—সেটিই এখন প্রশ্ন।
বিভিন্ন অংশীজনের দৃষ্টিভঙ্গি
সরকার ও সমর্থক: সরকারের মতে, এই আইন শিশুদের সুরক্ষায় একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ই-সেফটি কমিশনার জুলি ইনম্যান গ্রান্ট স্বীকার করেছেন যে শুরুতে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। তবে তিনি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান: বেশিরভাগ টেক কোম্পানি আইনটিকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করছে। মেটা আইন মেনে কাজ করছে, কিন্তু তারা বলছে—নিষেধাজ্ঞা সহজেই পাশ কাটানো সম্ভব। আইনে ইউটিউবকে অন্তর্ভুক্ত করায় গুগল মামলা করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে।
তরুণ প্রজন্ম ও বিশেষজ্ঞ: অনেক কিশোর-কিশোরী ও গবেষক মনে করেন, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার বদলে প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও নিরাপদ করা প্রয়োজন। দ্য কনভারসেশন-এ প্রকাশিত বিশ্লেষণে তরুণদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়—তারা ‘আরও নিরাপদ সামাজিক মাধ্যম’ চায়, বন্ধ নয়।
অভিভাবক: অভিভাবকদের মতামতও ভিন্ন। কেউ মনে করছেন এটি নজরদারির চাপ কমাবে। আবার কেউ উদ্বিগ্ন, এতে ছুটির সময় শিশুদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়তে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার এই নিষেধাজ্ঞা তরুণদের মানসিক সুস্থতা ও সুরক্ষাকে ডিজিটাল স্বাধীনতার ওপরে অগ্রাধিকার দেওয়ার সাহসী প্রচেষ্টা। কিন্তু এর বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ, অনাকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন শুরু হলে মুরডক চিলড্রেন’স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে।
এই আইন ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে নাকি ফাঁকফোকর ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হয়ে পড়বে—তা এখনো অনিশ্চিত। তবে এই আইন দেখায়, ডিজিটাল যুগে অনলাইনে সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, ব্লুমবার্গ, সিএনএন, এবিসি নিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস

১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপে নতুন আইন প্রণয়ন করেছে অস্ট্রেলিয়া। এই আইন ১০ ডিসেম্বর ২০২৫ থেকে কার্যকর হবে। বিশ্বে এই ধরনের আইন এটাই প্রথম। আইনটি টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, স্ন্যাপচ্যাট, ফেসবুক ও থ্রেডসসহ প্রধান প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৬ বছরের কম বয়সীরা যেন অ্যাকাউন্ট খুলতে বা চালিয়ে যেতে না পারে, এর জন্য কোম্পানিগুলোকে যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ নিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান আইন না মানলে সর্বোচ্চ ৪৯.৫ মিলিয়ন অস্ট্রেলীয় ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে, যা প্রায় ৩২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান।
কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ থেকেই এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি অ্যালবানিজ সামাজিক মাধ্যমকে ‘ক্ষতিকর প্রবণতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁর মতে, সামাজিক মাধ্যম কিশোর-কিশোরীদের উদ্বেগ ও হতাশা বাড়ায়। সমর্থকদের মতে, এই আইন ঝুঁকিতে থাকা শিশুদের রক্ষা করবে।
আইনটিতে মূলত টেক কোম্পানিগুলোকে দায়বদ্ধ করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করলে শিশু বা অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। মেটা আগে থেকেই তাদের প্ল্যাটফর্মে কিশোরদের ব্লক করা শুরু করেছে। ইউটিউব জানিয়েছে, তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাবালকদের সাইন-আউট করবে।
তবে এই আইন নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। আইনটি কতটা কার্যকর হবে, বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব এবং অধিকার ও নিরাপত্তার ওপর কী প্রভাব ফেলবে এসব বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা
এই আইনের মূল উদ্দেশ্য শিশুদের অনলাইন ঝুঁকি থেকে রক্ষা করা। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যম কিশোরদের হতাশা, উদ্বেগ ও আত্মসম্মানবোধের সংকট বাড়ায়। অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কিশোর-কিশোরী উল্লেখযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্ল্যাটফর্মগুলোর আসক্তিমূলক অ্যালগরিদম পরিস্থিতি আরও খারাপ করে।
সরকার ও অভিভাবকদের মতে, সামাজিক মাধ্যম শিশুদের সাইবার বুলিং, অশালীন কনটেন্ট ও অনলাইন শিকারির ঝুঁকিতে ফেলে। প্রধানমন্ত্রী অ্যালবানিজ শিশুদের স্ক্রিনের পরিবর্তে মাঠে সময় কাটানোর পরামর্শ দিয়েছেন এবং আইনটিকে সুস্থ জীবনযাপনের পথ খুলে দিবে বলে তুলে ধরেছেন।
এই উদ্যোগে গতি আসে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্রিমিয়ার পিটার মালিনাউস্কাসের তৎপরতায়। তার স্ত্রী জনাথন হেইডের বই ‘দ্য অ্যানজাস জেনারেশন’ পড়ার পর তিনি সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় দলই এই পদক্ষেপে সমর্থন দিয়েছে। এমনকি বিরোধীদল প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে তারা আরও দ্রুত আইনটি বাস্তবায়ন করবে।
কেন এত বিতর্ক
দুই দলেরই সমর্থন থাকলেও সামাজিক মাধ্যম নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা তীব্র হয়েছে। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ, কিশোর-কিশোরীরা ও নাগরিক অধিকার সংগঠনগুলো নানা প্রশ্ন তুলেছে। নিচে বিতর্কের প্রধান দিকগুলো তুলে ধরা হলো—
১. বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ ও ব্যর্থতার আশঙ্কা
সমালোচকদের মতে, এই আইন কার্যকর করা কঠিন হবে। শিশুরা সহজেই ভিপিএন, ভুয়া অ্যাকাউন্ট বা প্রাপ্তবয়স্কদের পরিচয় ব্যবহার করে বয়স যাচাই এড়িয়ে যেতে পারে। অনেকে ইতিমধ্যেই লেমন এইট ও ইয়োপের মতো কম পরিচিত অ্যাপে চলে যাচ্ছে। সেগুলো হয়তো এই আইনের আওতায় পড়বে না বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল।
অস্ট্রেলিয়ার ই-সেফটি কমিশনার এসব অ্যাপকে ঝুঁকি মূল্যায়নের অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এক প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করলে অন্যগুলো মাথা তুলবে। অনেকের শঙ্কা, এতে কিশোর-কিশোরীরা নিয়ন্ত্রিত অ্যাপ থেকে সরে গিয়ে আরও বিপজ্জনক ও নজরদারির বাইরে থাকা অ্যাপে যেতে পারে। যেমন কট্টরপন্থী বা ঘৃণাবিষয়ক কনটেন্টের সাইট।
২. নিরাপত্তা ও অভিভাবকদের নিয়ন্ত্রণ
ইউটিউবসহ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর দাবি, অ্যাকাউন্ট নিষিদ্ধ হলে বরং শিশুদের ঝুঁকি বাড়বে। অ্যাকাউন্ট না থাকলে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল, কনটেন্ট ফিল্টার বা সুপারভাইজড মোড ব্যবহার করা যাবে না। ফলে শিশুরা আনমডারেটেড ও নিয়ন্ত্রণহীন কনটেন্ট দেখতে পারে। ইউটিউব বলেছে, আইনটি বেশি ‘তাড়াহুড়া করে করা হয়েছে’।
১৫ বছর বয়সী এক কিশোর এই আইনের বিরুদ্ধে আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তার মতে, নিষেধাজ্ঞা শিশুদের আরও অনিরাপদ ও নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে ঠেলে দেবে।
৩. ইতিবাচক সুবিধা এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর উপর বিধিনিষেধ
বিরোধীদের যুক্তি, সামাজিক মাধ্যম শুধু ক্ষতির উৎস নয়। প্রান্তিক শিশুদের, বিশেষ করে এলজিবিটিকিউপ্লাস তরুণ বা দূর্গম অঞ্চলে থাকা শিক্ষার্থীদের, জন্য সামাজিক মাধ্যম পারস্পরিক সহায়তা, কমিউনিটি ও শেখার জগত তৈরি করে। সরাসরি নিষেধাজ্ঞায় তারা এ সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত হবে।
অনেক তরুণ বলছে, নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের বদলে প্ল্যাটফর্মের নিরাপত্তা ও মডারেশন বাড়ানো উচিত। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর এক জরিপে দেখা যায়, কিশোরদের মধ্যেও মতভেদ রয়েছে। কেউ নিষেধাজ্ঞাকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় বলছে, আবার কেউ অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে।
৪. গোপনীয়তা ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্ন
বয়স নির্ধারণের জন্য বায়োমেট্রিক ডেটা বা পরিচয়পত্রের প্রয়োজন হতে পারে। এতে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁসের ঝুঁকি ও নজরদারির ভয় তৈরি হয়েছে। এ কারণেই এক কিশোর ও ডিজিটাল ফ্রিডম প্রজেক্ট আইনটির বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আবেদন করেছে। তাদের দাবি, এই আইন রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও উদ্ভাবন বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইটিআইএফ একে পিছিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, এই আইন মতপ্রকাশ ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সীমিত করতে পারে।
৫. অতিরিক্ত অভিভাবকসুলভ নীতি
এ আইনকে অনেকেই বিশ্বের জন্য একটি পরীক্ষামূলক মডেল হিসেবে দেখছেন। অন্যান্য দেশও এর দিকে নজর রাখছে। তবে কেউ কেউ আইনটিকে অতিরিক্ত অভিভাবকসুলভ নীতি বলে মন্তব্য করেছেন। সামাজিক মঞ্চে অনেকেই বলছেন, প্রযুক্তিতে দক্ষ কিশোর-কিশোরীদের এই আইন থামাতে পারবে না।
অনেকের মতে, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার বদলে কোম্পানিগুলোর ওপর কঠোর দায়িত্ব আরোপ করাই বেশি কার্যকর। ইউনিসেফের তরুণদের উদ্দেশে প্রকাশিত নির্দেশনায়ও সুবিধা ও সম্ভাব্য ক্ষতি—দুটিই তুলে ধরা হয়েছে। একদিকে অনলাইন ক্ষতি কমবে, অন্যদিকে যোগাযোগ ও কমিউনিটি হারানোর ঝুঁকি থাকবে।
এই বিতর্ক দেখায়, আইনটি যতটা সাহসী, বাস্তবে প্রয়োগ ততটাই জটিল। শিশুদের সুরক্ষা ও স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য কীভাবে তৈরি হবে—সেটিই এখন প্রশ্ন।
বিভিন্ন অংশীজনের দৃষ্টিভঙ্গি
সরকার ও সমর্থক: সরকারের মতে, এই আইন শিশুদের সুরক্ষায় একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ই-সেফটি কমিশনার জুলি ইনম্যান গ্রান্ট স্বীকার করেছেন যে শুরুতে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। তবে তিনি সময় নিয়ে ধীরে ধীরে সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থান: বেশিরভাগ টেক কোম্পানি আইনটিকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করছে। মেটা আইন মেনে কাজ করছে, কিন্তু তারা বলছে—নিষেধাজ্ঞা সহজেই পাশ কাটানো সম্ভব। আইনে ইউটিউবকে অন্তর্ভুক্ত করায় গুগল মামলা করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে।
তরুণ প্রজন্ম ও বিশেষজ্ঞ: অনেক কিশোর-কিশোরী ও গবেষক মনে করেন, সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার বদলে প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও নিরাপদ করা প্রয়োজন। দ্য কনভারসেশন-এ প্রকাশিত বিশ্লেষণে তরুণদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়—তারা ‘আরও নিরাপদ সামাজিক মাধ্যম’ চায়, বন্ধ নয়।
অভিভাবক: অভিভাবকদের মতামতও ভিন্ন। কেউ মনে করছেন এটি নজরদারির চাপ কমাবে। আবার কেউ উদ্বিগ্ন, এতে ছুটির সময় শিশুদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বাড়তে পারে।
সামাজিক মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ার এই নিষেধাজ্ঞা তরুণদের মানসিক সুস্থতা ও সুরক্ষাকে ডিজিটাল স্বাধীনতার ওপরে অগ্রাধিকার দেওয়ার সাহসী প্রচেষ্টা। কিন্তু এর বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ, অনাকাঙ্ক্ষিত নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং অধিকার লঙ্ঘনের আশঙ্কায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন শুরু হলে মুরডক চিলড্রেন’স রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করবে।
এই আইন ভবিষ্যতে বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে নাকি ফাঁকফোকর ব্যবহার করে নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হয়ে পড়বে—তা এখনো অনিশ্চিত। তবে এই আইন দেখায়, ডিজিটাল যুগে অনলাইনে সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, বিবিসি, ব্লুমবার্গ, সিএনএন, এবিসি নিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে নিয়ে যেতে কাতার সরকার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের বিশেষ সহায়তা দিচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে কাতারের এরকম সহায়তা দেওয়ার একাধিক নজির আছে।
৯ মিনিট আগে
ম্যানিলার রাজপথ ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এক নতুন প্রজন্মের উত্থানের সাক্ষী, তারা হলো জেন-জি। বিশ্বের নানা প্রান্তে তরুণরা যখন জলবায়ু থেকে ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার, তখন এশিয়াও এই পরিবর্তনের ঢেউয়ে ভাসছে।
২৬ মিনিট আগে
বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন আরও শক্তিশালী করার প্রয়োজনীয়তা যেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রাণী অধিকারকর্মীদের মতে, আইন থাকলেও বাস্তবে মামলার সংখ্যা কম এবং শাস্তি অপর্যাপ্ত বলে নির্যাতনকারীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায় না।
১৭ ঘণ্টা আগে
পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে এক নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে। ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির যে পরিমাণ ক্ষমতা অর্জন করেছেন, তা নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে তুমুল বিতর্ক।
১ দিন আগে