leadT1ad

ট্রাম্পের শুল্কের চাপ কি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সামলাতে পারবে

তুফায়েল আহমদ
প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ২০: ১৭
আপডেট : ০১ আগস্ট ২০২৫, ২০: ২২
স্ট্রিম গ্রাফিক

চলতি বছরের ২ এপ্রিল ‘বৈশ্বিক বাণিজ্য নীতি’ ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সমস্ত পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন।

ওই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার ওপর সর্বোচ্চ ৪৪ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ, পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ ও নেপাল, ভুটান, আফগানিস্তানের ওপর ১০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়।

আগে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রপ্তানি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক শুল্ক ১০–১৫ শতাংশের মধ্যে ছিল। তৈরি পোশাক ও হস্তশিল্পের কিছু পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক থাকলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশের সুবিধা (জিএসপি) অথবা কম শুল্ক হার প্রযোজ্য ছিল। পাল্টা শুল্ক আরোপের পর আগের বাধ্যতামূলক শুল্কের সঙ্গে যোগ হয়ে সম্পূর্ণ শুল্কের পরিমাণ অনেক বেশি বেড়ে যাবে।

পরে বাজারের অস্থিরতা দূর করতে ও শুল্ক নিয়ে দরকষাকষির পথ খুলে দিতে ৯ এপ্রিল বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত তিন মাসের জন্য স্থগিতের করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

এপ্রিলে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর থেকেই বিশ্ব অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কার মুখে পড়ে। অনেক বিশেষজ্ঞই ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপকে বাণিজ্যযুদ্ধ বলে সম্বোধন করেন। বিশ্ববাজারে এই শুল্কের প্রভাবে বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।

তবে সর্বশেষ পরিস্থিতি অনুযায়ী, আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে কার্যকর হওয়া এই পাল্টা শুল্কের কারণে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা এড়ানো গেছে। উচ্চ শুল্কহারের ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে সম্ভাব্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা এখনো বাস্তবে রূপ নেয়নি বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা।

তবে ছোটখাটো অর্থনৈতিক ক্ষতি এবং বাজারে অস্থিরতাও সব দেশেই কমবেশি দেখা যাচ্ছে। বাদ যায়নি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও। ট্রাম্পের এই অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে যে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শঙ্কা করা হচ্ছিল, তা এখনো কাটেনি বলে সতর্ক করছেন অর্থনীতিবিদেরা।

বাংলাদেশে প্রভাব

বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে তৈরি পোশাক শিল্পনির্ভর। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য ইকোনমিস্টের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮৪ শতাংশ এসেছে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এককভাবে এই খাতের সবচেয়ে বড় বাজার ছিল যুক্তরাষ্ট্র। যদিও আলোচনার মাধ্যমে পাল্টা শুল্কের হার ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, তবুও আগের বাধ্যতামূলক শুল্কের সঙ্গে এই নতুন শুল্ক যোগ হয়ে মোট শুল্কের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। এর ফলে সরাসরি প্রভাব পড়বে পণ্যের দামে এবং মার্কিন বাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের পরিমাণে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মতে, অনেক মার্কিন খুচরা বিক্রেতা অর্ডার কমিয়ে দিতে পারে বা সস্তা বিকল্প খুঁজতে শুরু করতে পারে। এর ফলে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের মুনাফা ভেঙে পড়তে পারে। এমনকি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিও সৃষ্টি হতে পারে।

বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, এই বিপর্যয়ে বাংলাদেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার হারাতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক অগ্রগতি হুমকির মুখে পড়বে। মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ক্রেতারা বিকল্প দেশ—যেমন জর্ডান, মিশর বা ভিয়েতনাম থেকে পণ্য সংগ্রহের কথা ভাবতে পারে। ফলে দেশের বহু কারখানায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে এবং শ্রমিক ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা বাড়বে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে নিয়োজিত প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৬০ শতাংশই নারী। নতুন এই শুল্ক নীতির ফলে যদি রপ্তানি-আদেশ কমে আসে বা বন্ধ হয়, তাহলে নারীদের কর্মসংস্থান ও জীবিকা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়বে।

মানচিত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান। ছবি: সংগৃহীত
মানচিত্রে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান। ছবি: সংগৃহীত

শ্রীলংকা

২০২৪ সালে শ্রীলঙ্কা প্রায় ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক, রাবারজাত পণ্য ও চা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। দেশটির বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এপ্রিলে শ্রীলঙ্কার ওপর ৪৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের পর থেকেই দেশটির অর্থনীতিতে তীব্রভাবে প্রভাব পড়ছে । যদিও আলোচনার মাধ্যমে ৪৪ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কমিয়ে ২০ শতাংশে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে দেশটি। কিন্তু আগের বাধ্যতামূলক শুল্কের সঙ্গে এই শুল্ক যুক্ত হয়ে মোট শুল্কের পরিমাণ ৩২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। শ্রীলঙ্কা ২০২২ সালের ঋণ সংকট ও আইএমএফ-সমর্থিত কৃচ্ছ্রসাধননীতি থেকে নিজেকে উদ্ধার করছিল। এমন পরিস্থিতিতে এই শুল্ক ধারনার থেকেও বেশি প্রভাব বিস্তারে সক্ষম বলে দাবি করছে শ্রীলংকার সংবাদমাধ্যম ভিভালংকা।

শ্রীলঙ্কা তার মোট পোশাকের ৪০ শতাংশই রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। ফলে শ্রীলঙ্কার পোশাক শিল্প বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মতোই বড় ধাক্কা খাবে। শ্রীলংকা পোশাক কারখানাগুলোতে অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে অনেকেরই চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে ধারনা করা হচ্ছে। এপ্রিলে শুল্কের ঘোষণার পরপরই শ্রীলঙ্কার সরকার জরুরি রপ্তানি কৌশল টাস্কফোর্স গঠন করে এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বিকল্প বাজারের জন্য আলোচনা শুরু করে।

ভারত

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থা আরও গোলমেলে। ২০২৪ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ওষুধ, টেক্সটাইল, আইটি সেবা, অটোমোবাইল পার্টস, হীরাসহ অনেক খাতে মোট ৮৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে। এপ্রিলে ট্রাম্প শুল্ক আরোপের আগে অধিকাংশ পণ্যে শুল্ক ছিল ৬ থেকে ১২ শতাংশ।

দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ হিসেবে পরিচিত। তা সত্ত্বেও, এপ্রিলে ঘোষিত ২৬ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আলাপ-আলচনার মাধ্যমে মাত্র ১ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয় দেশটি। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে মতে, এই শুল্কের কারণে পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবের মতো অঞ্চলের চামড়া ও টেক্সটাইল খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

তবে পরিষেবা-ভিত্তিক ও জরুরি পণ্য হিসেবে আইটি ও ওষুধ রপ্তানি খাত পাল্টা শুল্ক থেকে রক্ষা পেয়েছে বলে ভারতীয় সরকার বলছে, শুল্কের প্রভাব খুব একটা ভারতের অর্থনীতিতে পড়বে না।

পাকিস্তান

২০২৪ সালে ৬ বিলিয়ন ডলারের সুতি টেক্সটাইল ও পোশাক পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছিল পাকিস্তান। এপ্রিলে ঘোষিত ২৯ শতাংশ পাল্টা শুল্ক, আগের বাধ্যতামূলক শুল্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশটির উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ঋণ বৃদ্ধি এবং নিম্ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের জন্য বড় ধরনের আঘাত আনবে। পাকিস্তানের রপ্তানির ৬০ শতাংশই টেক্সটাইল খাত থেকে আসে। আলোচনার পর পাল্টা শুল্ক ১৯ শতাংশে নেমে আসলেও যুক্তরাষ্ট্রে টেক্সটাইলের চাহিদা হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের চেয়ে সীমিত। নেপাল ২০২৪ সালে কার্পেট, পশমিনা ও হস্তশিল্পের প্রায় ১২ কোটি ডলারের পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে। বাধ্যতামূলক ১০ শতাংশের সঙ্গে পাল্টা শুল্ক যোগ হলে এই অল্প রপ্তানিতেও প্রভাব পড়বে বলে মনে করছে নেপালের সংবাদমাধ্যম দ্য কাঠমাণ্ডু পোস্ট। আফগানিস্তান ও ভুটানে একই পরিস্থিতি দেখা গেছে।

আর্থিক দিক থেকে প্রভাব সীমিত হলেও দীর্ঘমেয়াদে এসব পরিবর্তন রপ্তানি পরিকল্পনায় বাধা দেয় এবং বহুমুখীকরণ নিরুৎসাহিত করে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর নিজেদের অর্থনৈতিক সুরক্ষার জন্য নতুনভাবে ভাবতে হবে। পারস্পরিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার পাশাপাশি শক্তিশালী আঞ্চলিক জোটের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছেন অনেকেই। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য নীতি সংস্কার, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা অগ্রাধিকার না দিলে পাল্টা শুল্ক দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শঙ্কাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারে।

Ad 300x250

মেদভেদেভের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ ট্রাম্প, রাশিয়ার কাছাকাছি পারমাণবিক সাবমেরিন মোতায়েনের নির্দেশ

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো গোপন চুক্তি হয়নি: বাণিজ্য উপদেষ্টা

মাহফুজের আশা ৫ আগস্টের মধ্যেই ঘোষণাপত্র, আসিফ বললেন, আসছে…

চবি ছাত্রী হলে রাত ১০টার আগে না ফিরলে সিট বাতিলের হুমকি

দেশ নির্মাণের নতুন লড়াই শুরু হয়েছে : মির্জা ফখরুল

সম্পর্কিত