১৯৯২ সালের পর থেকে ৩৩ বছর জাকসু নির্বাচন হয়নি। ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর এবার নির্বাচন হচ্ছে। শিক্ষকদের অন্তর্কোন্দল, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারের অনীহার কারণে এত দিন নির্বাচন হয়নি।
মাহবুবুল আলম তারেক
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে আজ। ১৯৯২ সালের পর এটাই প্রথম জাকসু নির্বাচন। গত ৩৩ বছর এই নির্বাচন হয়নি। তাই আজ মনে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই লাইন—তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি। না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, না শিক্ষকরা, না সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এটি মাত্র দশম নির্বাচন। দীর্ঘ বিরতি ও অনিয়মিত আয়োজন জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্ররাজনীতির অস্থিরতাকেই স্পষ্ট করে। ফলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে তা বন্ধ ছিল। গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর এখন আবার সেই নির্বাচন শুরু হলো। বিষয়টি নিয়ে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে। তখন মাত্র চারটি বিভাগ, ২১ জন শিক্ষক ও ১৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাকসু গঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চা চালু রাখা।
প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। গোলাম মোরশেদ সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং জাসদ ছাত্রলীগের নেতা শাহ বোরহানউদ্দিন রোকন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। শুরু থেকেই ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল প্রবল। তবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও বহিরাগত হস্তক্ষেপ নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে নিয়মিত নির্বাচন হয়। এরপর শুরু হয় বিরতি। ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ এই ২০ বছরে মাত্র মোট ৯টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যেও রাজনৈতিক অস্থিরতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৩ সালের ভোটকে ঘিরে বড় বিতর্ক দেখা দেয়। অভিযোগ ছিল, ঢাকা থেকে আসা ছাত্রলীগ নেতারা ব্যালট দখল করে ভোটার সংখ্যা ৯০ শতাংশের বেশি দেখায়।
সহিংস ঘটনাও জাকসুকে দুর্বল করে। ১৯৭২ সালে শাহ বোরহানউদ্দিনকে নারায়ণগঞ্জে হত্যা করা হয়। ১৯৭৩ সালের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগ নেতা মোজাম্মেল হককে আল-বেরুনী হলে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ওঠে, সর্বহারা দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এতে জড়িত ছিল।
পরে অনিয়মিতভাবে ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে নির্বাচন হয়। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিপুল জয় পায়। জাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে ১০৭টির মধ্যে ১০৫টি পদে তারা বিজয়ী হয়। এর পর থেকে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং সহিংসতার কারণে প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। শাসক দলগুলো আশঙ্কা করত, ভোট হলে তারা ক্যাম্পাসে প্রভাব হারাবে। তাই তারা নির্বাচন ঠেকিয়ে দেয়। শাসক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো আবাসিক হলে নিয়ন্ত্রণ নেয়। ‘গেস্ট রুম’ ও ‘গণরুম’ সংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক দমন করা হতো। এতে নির্বাচনকে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়। ফলে ধারাবাহিকভাবে জাকসু নির্বাচন স্থগিত থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত ৩৩ বছরে আসলে দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। মাঝে ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ে ঢাকসু নির্বাচন হয়। কিন্তু ভিপি পদে ছাত্রলীগের প্রার্থী হেরে যাওয়ায় এরপর আর আওয়ামী লীগ সরকার ডাকসু নির্বাচন দেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে জাকসুতেও ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ধরে রাখার জন্য নির্বাচন দেওয়া হয়নি। একইভাবে গত ৩৩ বছর ধরে সব সরকারি দলই তাদের ছাত্র সংগঠনের হেরে যাওয়ার ভয়ে জাকসুতে নির্বাচন দেয়নি। সরকারি দলগুলো জানত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নাই। তাই তারা নির্বাচন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সরকারগুলোকে সহযোগিতা করে।’
১৯৯৩ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচনে সংঘর্ষের ঘটনা: ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় বড় একটি ঘটনা ঘটে। অভিযোগ ওঠে, কয়েকজন শিক্ষক জাকসু প্রতিনিধি ও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে অন্য শিক্ষকদের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েকজন আহত হন। সে সময় উপাচার্য, যিনি জাকসুর সভাপতিও ছিলেন, সংগঠনটি ভেঙে দেন। ভবিষ্যতের ছাত্রসংসদ নির্বাচনগুলো বন্ধ রাখার জন্যও এই ঘটনাকে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার কর হয়।
সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা: জাকসুর প্রারম্ভিক ইতিহাসেই সহিংসতার ছাপ স্পষ্ট। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে দুই সাধারণ সম্পাদক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ ঘটনার পেছনে ছিল স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ১৯৯৩ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচনের সহিংসতাও সেই ধারা অব্যাহত রাখে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ধারণা দৃঢ় হয় যে ছাত্র সংসদ মানেই সংঘাত। তাই নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো ভোট ছাড়াই প্রভাব বজায় রাখে।
প্রশাসনিক অনীহা ও কাঠামোগত সমস্যা: নির্বাচন না হওয়ার আরেক কারণ প্রশাসনের অনীহা। এর পেছনে রাজনৈতিক চাপ যেমন ছিল, তেমনি অভ্যন্তরীণ জটিলতাও ছিল। জাকসু সংবিধান অনুযায়ী উপাচার্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সভাপতি হন। এতে প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। অনেক ছাত্রসংগঠন চেয়েছিল, সভাপতি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হোক। প্রশাসন তা মানেনি। সংগঠনগুলোর মধ্যে মতবিরোধও দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের শুরুতে জাকসুর সংবিধান সময়মতো চূড়ান্ত করা যায়নি। এ কারণেও ভোটসূচি ঘোষণা বিলম্বিত হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ বলেন, ‘এতো বছর জাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের ও প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব একটি বড় কারণ। ১৯৯৩ সালে শিক্ষকদের অন্তর্কোন্দলে ছাত্রনেতাদের ব্যবহারের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিরোধিতা করেন। বিভিন্ন আমলে সরকারি দলগুলোও এই সুযোগ নিয়ে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে সেই দল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং প্রশাসনে নিজেদের অনুগতদেরই প্রাধান্য দেয়। সরকারি দলগুলো জানত সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্র-সংগঠনকে ভোট দিবে না। এভাবে শিক্ষক, প্রশাসন ও সরকার মিলে নিজেদের সুবিধার জন্যই জাকসু নির্বাচন বন্ধ রাখে।’
শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ: দীর্ঘ বিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহও কমে যায়। শাসক দলের আধিপত্য ও ‘গেস্ট রুম’ সংস্কৃতি অনেককে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। নারী শিক্ষার্থী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ আরও কমে যায়। এমনকি চলমান নির্বাচনেও সেই অনাগ্রহের কিছুটা দেখা গেছে। যেমন মেয়েদের হল সংসদের ১৫০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩৪টিতে প্রার্থী দাঁড়িয়েছে। ৫৯টি আসন শূন্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩৩ বছরের বিরতি শিক্ষার্থীদের জাকসুর গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ করে তুলেছে। এতে অংশগ্রহণের আগ্রহও কমে গেছে।
২০২৫ সালের জাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফল। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এতে বড় ভূমিকা রাখে। এ সময়ই দাবি ওঠে জাকসু নির্বাচনের। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানে যাঁরা বিগত শাসকের হয়ে বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন, ওঠে তাঁদের বিচারের দাবিও।
গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা আরও জোরালোভাবে জাকসু নির্বাচনের দাবি জানান। জিয়া উদ্দিন আয়ান নামের এক শিক্ষার্থী ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আমরণ অনশনে বসেন। জাকসু সক্রিয় করার দাবিতে তাঁর ১৫ ঘণ্টার অনশন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। উপাচার্য পাঁচ দিনের মধ্যে রোডম্যাপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর সেই রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়।
তবে নির্বাচন আয়োজনে বিলম্ব হয়। প্রথমে গত ২১ মের নির্ধারিত ভোট পিছিয়ে ৩১ জুলাই করা হয়। পরে আবার ১১ সেপ্টেম্বর তারিখ ঘোষণা করা হয়। জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার ও আন্দোলন-সংক্রান্ত মামলার মতো ঝুলে থাকা বিষয়গুলো এর কারণ। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রোডম্যাপ অনুযায়ী গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন। এর মাধ্যমে দীর্ঘ বিরতির পর আজ ভোটের আয়োজন হয়।
জাকসুর ৩৩ বছরের অচলাবস্থার পেছনে ছিল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, সহিংসতা, প্রশাসনিক অনীহা ও শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ। ১৯৯৩ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচন-পরবর্তী ভাঙন ছিল মোড় ঘোরানো ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জাতীয়ভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দমনের প্রবণতা। তবে ২০২৪ সালের আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সক্রিয়তা অবশেষে অচলাবস্থা ভাঙে। এর ফলে ২০২৫ সালে ভোট হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে আজ। ১৯৯২ সালের পর এটাই প্রথম জাকসু নির্বাচন। গত ৩৩ বছর এই নির্বাচন হয়নি। তাই আজ মনে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই লাইন—তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি। না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, না শিক্ষকরা, না সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩ বছরের ইতিহাসে এটি মাত্র দশম নির্বাচন। দীর্ঘ বিরতি ও অনিয়মিত আয়োজন জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্ররাজনীতির অস্থিরতাকেই স্পষ্ট করে। ফলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণে তা বন্ধ ছিল। গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পর এখন আবার সেই নির্বাচন শুরু হলো। বিষয়টি নিয়ে ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি যাত্রা শুরু করে। তখন মাত্র চারটি বিভাগ, ২১ জন শিক্ষক ও ১৫০ জন শিক্ষার্থী ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাকসু গঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা এবং ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক চর্চা চালু রাখা।
প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৭২ সালে। গোলাম মোরশেদ সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং জাসদ ছাত্রলীগের নেতা শাহ বোরহানউদ্দিন রোকন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। শুরু থেকেই ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল প্রবল। তবে রাজনৈতিক সহিংসতা ও বহিরাগত হস্তক্ষেপ নির্বাচনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
১৯৭২, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে নিয়মিত নির্বাচন হয়। এরপর শুরু হয় বিরতি। ১৯৭২ থেকে ১৯৯২ এই ২০ বছরে মাত্র মোট ৯টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যেও রাজনৈতিক অস্থিরতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৩ সালের ভোটকে ঘিরে বড় বিতর্ক দেখা দেয়। অভিযোগ ছিল, ঢাকা থেকে আসা ছাত্রলীগ নেতারা ব্যালট দখল করে ভোটার সংখ্যা ৯০ শতাংশের বেশি দেখায়।
সহিংস ঘটনাও জাকসুকে দুর্বল করে। ১৯৭২ সালে শাহ বোরহানউদ্দিনকে নারায়ণগঞ্জে হত্যা করা হয়। ১৯৭৩ সালের সাধারণ সম্পাদক ও ছাত্রলীগ নেতা মোজাম্মেল হককে আল-বেরুনী হলে হত্যা করা হয়। অভিযোগ ওঠে, সর্বহারা দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা এতে জড়িত ছিল।
পরে অনিয়মিতভাবে ১৯৮০, ১৯৮১, ১৯৮৯, ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯২ সালে নির্বাচন হয়। ১৯৯২ সালের নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল বিপুল জয় পায়। জাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে ১০৭টির মধ্যে ১০৫টি পদে তারা বিজয়ী হয়। এর পর থেকে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত এবং সহিংসতার কারণে প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়।
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরে আসে। এরপর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। শাসক দলগুলো আশঙ্কা করত, ভোট হলে তারা ক্যাম্পাসে প্রভাব হারাবে। তাই তারা নির্বাচন ঠেকিয়ে দেয়। শাসক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো আবাসিক হলে নিয়ন্ত্রণ নেয়। ‘গেস্ট রুম’ ও ‘গণরুম’ সংস্কৃতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক দমন করা হতো। এতে নির্বাচনকে ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকি হিসেবে দেখা হয়। ফলে ধারাবাহিকভাবে জাকসু নির্বাচন স্থগিত থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিগত ৩৩ বছরে আসলে দেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়নি। মাঝে ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ে ঢাকসু নির্বাচন হয়। কিন্তু ভিপি পদে ছাত্রলীগের প্রার্থী হেরে যাওয়ায় এরপর আর আওয়ামী লীগ সরকার ডাকসু নির্বাচন দেয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে জাকসুতেও ছাত্রলীগের একক আধিপত্য ধরে রাখার জন্য নির্বাচন দেওয়া হয়নি। একইভাবে গত ৩৩ বছর ধরে সব সরকারি দলই তাদের ছাত্র সংগঠনের হেরে যাওয়ার ভয়ে জাকসুতে নির্বাচন দেয়নি। সরকারি দলগুলো জানত সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের ছাত্র সংগঠনগুলোর কোনও গ্রহণযোগ্যতা নাই। তাই তারা নির্বাচন ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের আধিপত্য ধরে রাখার কৌশল নেয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও সরকারগুলোকে সহযোগিতা করে।’
১৯৯৩ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচনে সংঘর্ষের ঘটনা: ১৯৯৩ সালের ২৯ জুলাই শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় বড় একটি ঘটনা ঘটে। অভিযোগ ওঠে, কয়েকজন শিক্ষক জাকসু প্রতিনিধি ও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে অন্য শিক্ষকদের ওপর হামলা চালান। এতে কয়েকজন আহত হন। সে সময় উপাচার্য, যিনি জাকসুর সভাপতিও ছিলেন, সংগঠনটি ভেঙে দেন। ভবিষ্যতের ছাত্রসংসদ নির্বাচনগুলো বন্ধ রাখার জন্যও এই ঘটনাকে একটি অজুহাত হিসেবে ব্যবহার কর হয়।
সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা: জাকসুর প্রারম্ভিক ইতিহাসেই সহিংসতার ছাপ স্পষ্ট। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে দুই সাধারণ সম্পাদক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ ঘটনার পেছনে ছিল স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ১৯৯৩ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচনের সহিংসতাও সেই ধারা অব্যাহত রাখে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ধারণা দৃঢ় হয় যে ছাত্র সংসদ মানেই সংঘাত। তাই নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে ক্যাম্পাসে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ে। এই সময়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনগুলো ভোট ছাড়াই প্রভাব বজায় রাখে।
প্রশাসনিক অনীহা ও কাঠামোগত সমস্যা: নির্বাচন না হওয়ার আরেক কারণ প্রশাসনের অনীহা। এর পেছনে রাজনৈতিক চাপ যেমন ছিল, তেমনি অভ্যন্তরীণ জটিলতাও ছিল। জাকসু সংবিধান অনুযায়ী উপাচার্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সভাপতি হন। এতে প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে। অনেক ছাত্রসংগঠন চেয়েছিল, সভাপতি সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হোক। প্রশাসন তা মানেনি। সংগঠনগুলোর মধ্যে মতবিরোধও দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৫ সালের শুরুতে জাকসুর সংবিধান সময়মতো চূড়ান্ত করা যায়নি। এ কারণেও ভোটসূচি ঘোষণা বিলম্বিত হয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমন সাজ্জাদ বলেন, ‘এতো বছর জাকসু নির্বাচন না হওয়ার পেছনে শিক্ষকদের ও প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব একটি বড় কারণ। ১৯৯৩ সালে শিক্ষকদের অন্তর্কোন্দলে ছাত্রনেতাদের ব্যবহারের ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিরোধিতা করেন। বিভিন্ন আমলে সরকারি দলগুলোও এই সুযোগ নিয়ে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে সেই দল শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং প্রশাসনে নিজেদের অনুগতদেরই প্রাধান্য দেয়। সরকারি দলগুলো জানত সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্র-সংগঠনকে ভোট দিবে না। এভাবে শিক্ষক, প্রশাসন ও সরকার মিলে নিজেদের সুবিধার জন্যই জাকসু নির্বাচন বন্ধ রাখে।’
শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ: দীর্ঘ বিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের আগ্রহও কমে যায়। শাসক দলের আধিপত্য ও ‘গেস্ট রুম’ সংস্কৃতি অনেককে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। নারী শিক্ষার্থী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ আরও কমে যায়। এমনকি চলমান নির্বাচনেও সেই অনাগ্রহের কিছুটা দেখা গেছে। যেমন মেয়েদের হল সংসদের ১৫০টি আসনের মধ্যে মাত্র ৩৪টিতে প্রার্থী দাঁড়িয়েছে। ৫৯টি আসন শূন্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩৩ বছরের বিরতি শিক্ষার্থীদের জাকসুর গুরুত্ব সম্পর্কে অজ্ঞ করে তুলেছে। এতে অংশগ্রহণের আগ্রহও কমে গেছে।
২০২৫ সালের জাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফল। বিশেষ করে ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এতে বড় ভূমিকা রাখে। এ সময়ই দাবি ওঠে জাকসু নির্বাচনের। পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানে যাঁরা বিগত শাসকের হয়ে বিভিন্ন সহিংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন, ওঠে তাঁদের বিচারের দাবিও।
গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীরা আরও জোরালোভাবে জাকসু নির্বাচনের দাবি জানান। জিয়া উদ্দিন আয়ান নামের এক শিক্ষার্থী ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আমরণ অনশনে বসেন। জাকসু সক্রিয় করার দাবিতে তাঁর ১৫ ঘণ্টার অনশন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করে। উপাচার্য পাঁচ দিনের মধ্যে রোডম্যাপ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর সেই রোডম্যাপ প্রকাশিত হয়।
তবে নির্বাচন আয়োজনে বিলম্ব হয়। প্রথমে গত ২১ মের নির্ধারিত ভোট পিছিয়ে ৩১ জুলাই করা হয়। পরে আবার ১১ সেপ্টেম্বর তারিখ ঘোষণা করা হয়। জাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার ও আন্দোলন-সংক্রান্ত মামলার মতো ঝুলে থাকা বিষয়গুলো এর কারণ। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। রোডম্যাপ অনুযায়ী গঠিত হয় নির্বাচন কমিশন। এর মাধ্যমে দীর্ঘ বিরতির পর আজ ভোটের আয়োজন হয়।
জাকসুর ৩৩ বছরের অচলাবস্থার পেছনে ছিল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, সহিংসতা, প্রশাসনিক অনীহা ও শিক্ষার্থীদের অনাগ্রহ। ১৯৯৩ সালের সিন্ডিকেট নির্বাচন-পরবর্তী ভাঙন ছিল মোড় ঘোরানো ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল জাতীয়ভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দমনের প্রবণতা। তবে ২০২৪ সালের আন্দোলন ও শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক সক্রিয়তা অবশেষে অচলাবস্থা ভাঙে। এর ফলে ২০২৫ সালে ভোট হয়।
১৯৭২ সালে জাকসু প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৮ বার নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯২ সালে সর্বশেষ জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
৩ ঘণ্টা আগেইতিহাস বলছে, বিপ্লবের নেপথ্যে থাকে কোনো মহৎ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অভীপ্সা। আর সেই লড়াইয়ে পুরোভাগে নেতৃত্ব দেন বিদ্রোহী স্পার্টাকাস। একুশ শতকের অভ্যুত্থানের কোনো একক নায়ক নেই। কোনো একটি পক্ষ নেই, এমনকি কোনো সুপরিকল্পনাও হয়তো থাকে না।
১ দিন আগেতরুণেরা এখন বালেন্দ্রকে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর হিসেবে চাইছেন, দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্তমানে চলছে এমনই রব।
২ দিন আগেআজ ডাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ ছয় বছরের বিরতির পর আবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু। এ নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়েছে সারাদেশে। এমনকি অনেকেই মনে করছেন, এ নির্বাচন প্রশাসনের জন্য জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি পরীক্ষা।
২ দিন আগে