leadT1ad

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আসার আট বছর

রোহিঙ্গা-সংকটের পেছনে রয়েছে যেসব ভূ-রাজনীতির খেলা

প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ১৭: ৩৬
আপডেট : ২৫ আগস্ট ২০২৫, ২০: ৩৩
রোহিঙ্গা-সংকটের পেছনে রয়েছে যেসব ভূ-রাজনীতির খেলা। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রতিবছর ২৫ আগস্টকে স্মরণ করা হয় রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবস হিসেবে। ২০১৭ সালের এই সময়ে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। সে সময়ে মিয়ানমারে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের দ্বারা পরিচালিত সহিংসতা ও গণহত্যার শিকার হয়। এটি ছিল তাদের ইতিহাসের স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ একটি অধ্যায়। এ নির্যাতনের ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ তাদের নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয় বাংলাদেশে। আমরা এ-ও জানি যে রোহিঙ্গাদের এই বাস্তচ্যুত হওয়ার বিষয়টি এবারই প্রথম নয়, এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। ২০১৭ সালের আগেও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে তার একটি বড় অংশ একপর্যায়ে নিজের দেশে ফেরত যায়। সে সময় কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে থেকে গেলেও এদের সংখা খুব বেশি নয়। কিন্তু ২০১৭ সালে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রায় ১ দশমিক ২ মিলিয়ন। সম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার জান্তার যুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, বিগত বছরে প্রায় দেড় লাখ নতুন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নির্যাতন ও গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে এ সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখতে পাইনি। বলা ভালো, এই সমস্যার মূলে রয়েছে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব রোধ করা এবং ধীরে ধীরে নাগরিক হিসেবে তাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করা। এই প্রক্রিয়ারও একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। একসময় যাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং যারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেত, সেই রোহিঙ্গাদেরই ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। এ প্রসঙ্গে এক বিখ্যাত আলোকচিত্রী গ্রেগ কন্সটান্টিনের একটি ব্যতিক্রমধর্মী কাজের উল্লেখ করা যায়। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি রোহিঙ্গাদের ওপর কাজ করছেন, যেখানে তিনি একসময় যে রোহিঙ্গাদের বার্মিজ বা মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে পরিচয়পত্র ছিল, আলোকচিত্রের মাধ্যমে তাঁর প্রমাণ দেখিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, গ্রেগ কন্সটান্টিন আরও দেখান যে তাদের সেই অধিকার কীভাবে ধীরে ধীরে হরণ করা হয়েছে। এগুলো ছাড়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের অধিবাসী ও নাগরিক হিসেবে থাকার ঐতিহাসিক নানা রকম প্রমাণও রয়েছে।

রোহিঙ্গা-সংকটের পেছনে রয়েছে যেসব ভূ-রাজনীতির খেলা। সংগৃহীত ছবি
রোহিঙ্গা-সংকটের পেছনে রয়েছে যেসব ভূ-রাজনীতির খেলা। সংগৃহীত ছবি

একসময়ের নাগরিক ও অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের কেন বিতাড়িত করা হলো?

এর পেছনের ভূ-রাজনৈতিক জটিলতাগুলো কীভাবে কাজ করে, তা ভেবে দেখা গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টির শুরু মিয়ানমারের অধিবাসীদের একটি একক জাতীয় পরিচিতি বিনির্মাণের তৎপরতার মাধ্যমে। এ সময় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নন এমন জনগোষ্ঠীকে প্রান্তিক করে ফেলার রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। আর এর প্রধান বলি হয় মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।

ধীরে ধীরে একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় মিয়ানমারের জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা হয়। প্রক্রিয়াটি মিয়ানমার সরকারের জাতীয় পরিচিতি বিনির্মাণের রাজনৈতিক প্রকল্পের একটি অংশ। যা সরকারের পক্ষ থেকে ধীরে ধীরে সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর এর ফলাফল হিসেবে ২০১৭ সালে একটি বিশাল অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে অত্যাচারিত হয়ে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হতে দেখি। বাধ্য হয়ে এরাই এখন রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীরূপে ও শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

একসময় যাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং যারা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেত, সেই রোহিঙ্গাদেরই ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়।

প্রশ্ন হলো, মিয়ানমার একটি জাতিরাষ্ট্র হিসেবে নিজের জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে যখন তার দেশের অধিবাসী হিসেবে বিবেচনা না করে বিতাড়ন করেছে, তখন বৈশ্বিক শক্তিগুলো, বিশেষত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কেন তার প্রতিবাদ করছে না। কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না কেন? এর পেছনে মিয়ানমারের প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও স্বার্থ কীভাবে যুক্ত, বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

আমরা জানি, ভূ-রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যে যেসব বিষয় যুক্ত থাকে সেগুলো হলো, একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, সেই অঞ্চলের কৌশলগত গুরুত্ব, ওই দেশ বা স্থানের বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ। এসবের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে যখন আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশগুলোর অন্তর্নিহিত স্বার্থ যুক্ত হয়ে পড়ে তখন সেই স্বার্থ বাস্তবায়নের জন্য খড়গ চাপিয়ে দেওয়া হয় সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের ওপর। ওই স্থানে বসবাসরত জনগোষ্ঠী যদি হয় দেশটির সংখ্যালঘু ও নির্যাতিত কোনো গোষ্ঠী, তাহলে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রোহিঙ্গাদের অবস্থা ঠিক তেমনই ছিল, তেমনই আছে।

এখন দেখা যাক, আঞ্চলিক দেশ হিসেবে মিয়ানমারের পাশের দেশ—বিশেষত চীন ও ভারতের অবস্থান কী। কেন এই দুটি দেশ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তেমন কোনো সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। এর পেছনে তাদের অন্তর্নিহিত কোনো স্বার্থ আছে কি? থাকলে সেই সব স্বার্থগুলো কীভাবে এ সংকট সমাধানে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। সংগৃহীত ছবি
রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। সংগৃহীত ছবি

বিভিন্ন বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পারি, চীন সক্রিয়ভাবে মিয়ানমারের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করে আসছে। এর মধ্যে রয়েছে বন্দর গড়ে তোলা, তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন, রেল যোগাযোগ স্থাপন ইত্যাদি। এছাড়া রাখাইনে তাদের আরও কিছু বড় প্রকল্প রয়েছে প্রক্রিয়াধীন। যেমন একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, একটি গভীর সমুদ্র বন্দর এবং কিয়াপ্পু নামক একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। যেগুলোকে চীন আবার তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) একটি সক্রিয় অংশ হিসেবে দেখে থাকে।

আর এসবের মধ্যে দিয়ে চীন মিয়ানমারের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই প্রক্রিয়ায় চীনের পররাষ্ট্রবিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি যদি আমরা খেয়াল করি, তবে দেখতে পাব যে চীন কখনোই একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না; বরং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো অন্য দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার মোকাবিলা করার প্রচেষ্টা জারি রাখা। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে চীন আসলে কতটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সংকটটি মোকাবিলায় সহায়তা করছে?

বিশেষত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কেন তার প্রতিবাদ করছে না। কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না কেন? এর পেছনে মিয়ানমারের প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশগুলোর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও স্বার্থ কীভাবে যুক্ত, বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

আমরা যদি চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিকে তাকাই, দেখতে পাব, বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক বিনিয়োগকারী দেশ হলো চীন—যাকে আমরা বলে থাকি বাংলাদেশের একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী। বর্তমানে বাংলাদেশে পরিচালিত অনেক বড় প্রকল্প, বিশেষত বিআরআই-কেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে চীনের একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। সেদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধান বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হলো চীন। তাহলে এমন বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র কেন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না?

এক্ষেত্রে আমরা যদি চীনের ভূমিকা বুঝতে চাই, তবে দেখতে পাই যে তারা তাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতির মধ্যে থেকে এ সংকট মোকাবিলা বা সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বার্থের দিক থেকে চিন্তা করলে এটি হয়তো রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় তেমন কোনো ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসছে না। কিন্তু আমাদের এ-ও মনে রাখতে হবে যে চীন সবসময় জোর দিয়ে বলছে, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সংলাপের মধ্যে দিয়ে সমস্যাটির সমাধান করা সম্ভব। যদিও আমরা বিগত সময়ে দেখেছি, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় তেমন কোনো ফল আসেনি। উল্লেখ্য, চীন যে তাদের পররাষ্ট্রবিষয়ক নীতি অনুযায়ী মিয়ানমারের ওপর জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দেবে, তা-ও আমরা প্রত্যাশা করতে পারি না। ফলে রোহিঙ্গা-সংকট মোকাবিলায় চীনের এই প্রচেষ্টা খুব বেশি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। আর তা না হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো, দেশটির সামরিক জান্তার সঙ্গে আরাকান আর্মির ক্রমাগত যুদ্ধ।

রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। সংগৃহীত ছবি
রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। সংগৃহীত ছবি

আমরা দেখতে পাচ্ছি, রাখাইনের বেশির ভাগ অংশের নিয়ন্ত্রণ এখন আরাকান আর্মির হাতে। ফলে দ্বিপাক্ষিক আলাপ-আলোচনা তেমন কোনো আশার আলো দেখতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে চীনের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও মিয়ানমারে নতুন করে এই যুদ্ধাবস্থা রোহিঙ্গা সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।

বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখতে পাব, রোহিঙ্গা সংকটের শুরু থেকেই ভারতের এক ধরনের নীরব ভূমিকা রয়েছে। বিগত সরকারের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের একটি তথাকথিত ভালো সম্পর্কের বয়ান আমরা দেখতে পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই ভালো সম্পর্কের বয়ানের মধ্যেও রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের তেমন কোনো সহায়তা বাংলাদেশ পায়নি। উপরন্তু দেখতে পাচ্ছি, ভারতের পক্ষ থেকে ওই দেশে বসবাসরত বাংলা ভাষাভাষী অনেক মুসলমানকে ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের বাংলাভাষী মুসলমান বিষয়ক নীতি এবং মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতির মধ্যে তেমন একটা পার্থক্য দেখা যায় না।

রোহিঙ্গা সংকটটি এখন এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে মিয়ানমারের নিজস্ব হস্তক্ষেপ খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। আঞ্চলিক দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা না থাকার কারণেও সমাধানের পথ প্রস্তুত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীরব থাকার প্রবণতাও সংকট সমাধানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া রাখাইনকে কেন্দ্র করে রয়েছে ভারতের বিখ্যাত ‘কালাদান মাল্টি মোডাল ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট’ প্রকল্প। যা মূলত কালাদান প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। ভারতের এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, দেশটির চিকেন নেকখ্যাত শিলিগুড়ি করিডোর এড়িয়ে কলকাতা বন্দর থেকে রাখাইনের সিতওয়ে বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যে প্রবেশের একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করা। আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার যুদ্ধাবস্থার কারণে কালাদান প্রকল্পটিও অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

রোহিঙ্গা সংকটটি আরও ঘনীভূত হচ্ছে রাখাইনে অবস্থিত অবশিষ্ট রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর আরাকান আর্মির নির্যাতন ও সহিংসতার মাধ্যমে। এ কারণে স্থানীয় আরাকানের অধিবাসীদের সঙ্গেও রোহিঙ্গাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, তাদের সঙ্গে গড়ে উঠছে একধরনের ভয়ের সম্পর্ক। আর তাই সেখানে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের একাংশ প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছে। মূলত এসব ভূ-রাজনৈতিক কারণেই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই সংকটের সঙ্গে আরও যে বিষয় যুক্ত হয়েছে, সেটি হলো আরাকানের সঙ্গে রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ।

রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। সংগৃহীত ছবি
রোহিঙ্গাদের ধীরে ধীরে নিজের দেশ থেকে নাগরিকহীন একটি পরিচয় দিয়ে বিতাড়িত করা হয়। সংগৃহীত ছবি

রোহিঙ্গা সংকট সমাধান আসলে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার—সবার জন্যই একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা ভূ-রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরেও এই সংকট এখন আঞ্চলিক পরিসরে নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টির হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট ও প্রকট; সেটি হলো, একটি জনগোষ্ঠী যখন বছরের পর বছর ধরে নির্যাতিত হয়ে আসে, তখন তাদের মধ্যকার হতাশাগ্রস্ত একটি অংশের সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা অনেক বেড়ে যায়। একটি মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে এই ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে ওঠা অস্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। যা আমরা এর মধ্যেই আরাকান আর্মি ও রোহিঙ্গাদের মধ্যকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সশস্ত্র দ্বন্দ্বের মাধ্যমে ছোট আকারে হলেও দেখতে পাচ্ছি। ফলে ভবিষ্যতে এ ধরনের সহিংসতা আঞ্চলিক পরিসরে ছড়িয়ে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের ধারণামতে, অনেকেই রোহিঙ্গা সংকটকে একটি ‘টিকিং বম্ব’ হিসেবে উল্লেখ করছেন, যার আশু সমাধান এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য জরুরি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনার জন্য তহবিল সংকটের দ্রুত সমাধান করা। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব উন্নয়ন সংকটের নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।

তাই আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি, রোহিঙ্গা সংকটটি এখন এমন একটি অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে মিয়ানমারের নিজস্ব হস্তক্ষেপ খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। আঞ্চলিক দেশগুলোর সক্রিয় ভূমিকা না থাকার কারণেও সমাধানের পথ প্রস্তুত হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীরব থাকার প্রবণতাও সংকট সমাধানের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত এসব কারণেই নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন ঘটছে না। ফলে বিষয়টির সমাধানে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা সংকটকে আবারও নতুনভাবে জরুরি একটি বিষয়ে রূপান্তরিত করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু প্রশংসনীয় পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি। যার মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ হাতে নেওয়া। এখানে এটিও বলে রাখা দরকার যে এগুলোর মাধ্যমে আমরা হয়তো অতি দ্রুত রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দেখতে পাব না। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরিসরে সংকটটিকে আবার তুলে ধরে আন্তর্জাতিক সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার দ্বার আমরা উন্মোচন করতে পারি।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনার জন্য তহবিল সংকটের দ্রুত সমাধান করা। একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব উন্নয়ন সংকটের নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। সেই জায়গা থেকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়। আমরা আশা করব, আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সম্মানজনক প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসবে।

লেখক: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

যে ছয় মাস আছি, প্রত্যেক জেলায় লিগ্যাল এইডের ব্যবস্থা করে যাব: আইন উপদেষ্টা

মুসলমানি-বাংলা থেকে বাংলাদেশি: ভাষার রাজনৈতিক বিভাজন

রোহিঙ্গারা অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে ফিরতে প্রস্তুত: খলিলুর রহমান

ভারতের নতুন নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের পাটশিল্পে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা

‘রোহিঙ্গা সংকট স্থবির হয়ে আছে, সমাধানে আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক সক্রিয়তা জরুরি’

সম্পর্কিত