leadT1ad

মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কত বড়, বাংলাদেশিদের জন্য কতটা সম্ভাবনাময়

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ২১: ১১
আপডেট : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১২: ১৫
মালয়েশিয়া যেন বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক জনশক্তি গ্রহণ করে, সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করছে সরকার। সংগৃহীত ছবি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত সোমবার (১১ আগস্ট) মালয়েশিয়ায় যান। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই সফরের মূল লক্ষ্য অভিবাসন সহজ করা এবং বিনিয়োগ নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নয়ন। মালয়েশিয়া বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানির অন্যতম প্রধান গন্তব্য। বাংলাদেশের চতুর্থ শীর্ষ শ্রমবাজার ছিল দেশটি।

কিন্তু গত বছরের ১ জুন থেকে বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য ফের বন্ধ হয়ে যায় দেশটির দরজা। সেই দরজা খোলা এই সফরের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি। মালয়েশিয়া যেন বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক জনশক্তি গ্রহণ করে, সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই কাজ করছে সরকার।

সফরের দ্বিতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেন। এসময় দুই দেশের মধ্যে ৫টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত এবং তিনটি সহযোগিতামূলক নোট বিনিময় হয়। এরপর এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে আরও বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি কাজ করার সুযোগ পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে পুত্রজায়ার পার্দানা পুত্রা ভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ছবি: পিআইডি
মালয়েশিয়া সফরের দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সেদেশের প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে পুত্রজায়ার পার্দানা পুত্রা ভবনে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ছবি: পিআইডি

আজ বুধবার মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী জাম্ব্রি আবদুল কাদিরের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর আরও জানা যায়, মালয়েশিয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ‘গ্র্যাজুয়েট প্লাস’ ভিসা দেওয়ার বিষয়েও সম্মতি দিয়েছে। এই ভিসা পেলে বাংলাদেশের হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট এই দেশটিতে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।

সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, আগামী ৬ বছরে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ১২ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। বর্তমানে মালয়েশিয়ায় প্রায় ৮ লাখ ৯৮ হাজার ৯৭০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন, যা দেশটির বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে সর্বোচ্চ।

কিন্তু মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার কত বড় এবং বাংলাদেশিদের জন্য ঠিক কতটা সম্ভাবনাময়? বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাড়তি বাণিজ্য শুল্ক আরোপ নিয়ে অনিশ্চয়তা, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দেশটির অভ্যন্তরীণ আর্থিক সংস্কারের ফলে ব্যবসায়িক খরচও বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এমন প্রশ্ন ওঠাটা অস্বাভাবিক নয়।

ট্রাম্পের শুল্কে কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কা

মালয়েশিয়ার সংবাদ সংস্থা দ্য এজ মালয়েশিয়ার প্রতিবেদন বলছে, দেশটির বাজার গবেষণা সংস্থা বিআইএমবি সিকিউরিটিজ রিসার্চও সোমবার এক নোটে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নিয়ে সতর্ক করেছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, এই আগস্ট থেকে মালয়েশিয়ার পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত ১৯ শতাংশ শুল্ক আরোপ রপ্তানিমুখী উৎপাদন খাতের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, আরও উদ্বেগজনক হলো বর্তমানে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্য, যেমন সেমিকন্ডাক্টর এবং ওষুধও শুল্কের আওতায় আসতে পারে। সেমিকন্ডাক্টরে শুল্ক সর্বোচ্চ ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এতে এর অর্ডার কমে যেতে পারে। ফলে এই খাতে কর্মী নিয়োগ সীমিত হতে পারে, মজুরি বৃদ্ধিতে আসতে পারে বাধা। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক ও ইলেকট্রনিক পণ্য ক্লাস্টার এবং শিল্পাঞ্চলেও কর্মসংস্থানের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে।

তবে প্রতিষ্ঠানটি বলছে, এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল থাকতে পারে এবং ২০২৫ সালে মালয়েশিয়ায় গড়ে বেকারত্বের হার প্রায় ৩ দশমিক ২ শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে। জুন পর্যন্ত যা ছিল ৩ দশমিক ১ শতাংশ।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পুত্রাজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। ছবি: পিআইডি
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে পুত্রাজায়ায় মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। ছবি: পিআইডি

ইউওবি গ্লোবাল ইকোনমিকস অ্যান্ড মার্কেটস রিসার্চও শুল্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি তারা জানিয়েছে, সরকারের কিছু পদক্ষেপ—যেমন সম্প্রসারিত বিক্রয় ও সেবা কর (এসএসটি), বিদেশি কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক ২ শতাংশ এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএফ) এবং পুনর্নির্ধারিত আরওএন৯৫ জ্বালানি ভর্তুকি ব্যবস্থা— কোম্পানিগুলোর মুনাফায় চাপ ফেলতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানকে যদি টিকে থাকার জন্যই সংগ্রাম করতে হয়, তাহলে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবণতা

তবে এসব আশংকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশটির অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবণতাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাদের মতে, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং সেবা খাতের সম্প্রসারণের কারণে বছরের শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার স্থিতিশীল থাকবে।

গত সোমবার বিজনেস টুডে মালয়েশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জুন মাসে দেশের শ্রমবাজার ইতিবাচক ধারা বজায় রেখেছে। জুনে মাসওয়ারি হিসেবে কর্মসংস্থানের হার শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ, মে মাসের তুলনায় জুন মাসে ৫২ হাজার ৯০০ জন বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। জুনের শেষে দেশটিতে মোট কর্মরত মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ।

অর্থনীতির কর্মসংস্থান তৈরির সক্ষমতার সূচক তথা কর্মসংস্থান-জনসংখ্যার অনুপাত অপরিবর্তিত ছিল—৬৮ দশমিক ৭ শতাংশে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রধান প্রধান সব খাতেই বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর মধ্যে সেবা খাত ছিল শীর্ষে। বিশেষ করে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, আবাসন ও খাদ্য-পানীয় সেবা এবং তথ্য ও যোগাযোগ খাতে প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। উৎপাদন, নির্মাণ, খনি ও পাথর উত্তোলন এবং কৃষি খাতেও স্থিতিশীল অগ্রগতি দেখা গেছে।

কর্মজীবিরা মালয়েশিয়ার শ্রমশক্তির সর্ববৃহৎ অংশ। দেশটির মোট কর্মসংস্থানের ৭৫ শতাংশই এদের দখলে। এই শ্রেণিতে কর্মীর সংখ্যা শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বেড়ে (২৯ হাজার ৪০০ জন) দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজারে। অন্যদিকে, স্বকর্মসংস্থানকারী—যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে (১৯ হাজার ৪০০ জন) দাঁড়িয়েছে ৩২ লাখে।

বেকারত্বের হার কমাও অব্যাহত রয়েছে। জুনে বেকারের সংখ্যা শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ (৩ হাজার ৭০০ জন) কমে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৭০০ জনে দাঁড়িয়েছে। ফলে টানা তৃতীয় মাসে জাতীয় বেকারত্বের হার ৩ শতাংশে স্থিতিশীল থেকেছে।

শ্রমশক্তির আকার এক মাসে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ (৪৯ হাজার ২০০ জন) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৩০ হাজারে। এতে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ৭০ দশমিক ৮ শতাংশে স্থির রয়েছে।

কর্মজীবীরা মালয়েশিয়ার শ্রমশক্তির সর্ববৃহৎ অংশ। দেশটির মোট কর্মসংস্থানের ৭৫ শতাংশই এদের দখলে। সংগৃহীত ছবি
কর্মজীবীরা মালয়েশিয়ার শ্রমশক্তির সর্ববৃহৎ অংশ। দেশটির মোট কর্মসংস্থানের ৭৫ শতাংশই এদের দখলে। সংগৃহীত ছবি

দ্য মালয়েশিয়ান রিজার্ভ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরওয়ারি হিসাবে ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে শ্রমশক্তির হার বেড়েছে ২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর বিপরীতে একই সময়ে কর্মসংস্থান বেড়েছে ৩ শতাংশ। অর্থাৎ, শ্রমশক্তির হার বাড়ার চেয়ে কর্মসংস্থান বাড়ার হার বেশি। এ ছাড়া বেকারের সংখ্যা এক বছরে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৮ হাজার ৭০০ জনে। এতে টানা তৃতীয় মাসের মতো বেকারত্বের হার ৩ শতাংশে স্থির রয়েছে, যা ২০১৫ সালের এপ্রিলের পর সর্বনিম্ন।

এদিকে, শ্রমশক্তির বাইরে থাকা—অর্থাৎ যারা কাজ খুঁজছেন না—এমন মানুষের সংখ্যা সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৭১ লাখ ৮০ হাজারে। শ্রমবাজারে কাজ না খোঁজার কারণ হিসেবে সর্বাধিক উল্লেখ করা হয়েছে, গৃহস্থালি কাজ ও পারিবারিক দায়িত্বে ব্যস্ততার কথা (৪৩ দশমিক ৭ শতাংশ)। এরপর রয়েছে পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ (৪০ দশমিক ৯ শতাংশ)।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও টানা কর্মসংস্থান বৃদ্ধি মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রমাণ। এর পেছনে শ্রমবাজারে চাহিদার প্রধান চালিকা শক্তি ছিল সেবা খাত। বিশেষ করে পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্য, আবাসন ও খাদ্য-পানীয় সেবা এবং তথ্য ও যোগাযোগ খাতে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আর এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা। মালয়েশিয়া যেন বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চসংখ্যক জনশক্তি গ্রহণ করে, সেই উদ্যোগ নিতে পারে সরকার।

তথ্যসূত্র: দ্য এজ মালয়েশিয়া, বিজনেস টুডে মালয়েশিয়া, দ্য মালয়েশিয়ান রিজার্ভ

Ad 300x250

সম্পর্কিত