স্ট্রিম ডেস্ক
ড্রোন বা মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন আধুনিক যুদ্ধের অপরিহার্য অস্ত্র। একসময় এগুলো সীমিত পর্যবেক্ষণযন্ত্র ছিল, এখন তা নির্ভুল আঘাত, কম খরচ এবং নিরাপদ পরিচালনার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্ষুদ্রাকৃতির প্রযুক্তি ও সমন্বিত আক্রমণ ক্ষমতার অগ্রগতির ফলে ড্রোন এখন গুপ্তহত্যা থেকে শুরু করে বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্রের হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিবর্তনকে দ্রুত ত্বরান্বিত করেছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় আয়মান আল-জাওয়াহিরির হত্যাকাণ্ড কিংবা কাবুলে সাম্প্রতিক কথিত ‘পাকিস্তানি ড্রোন হামলা’র ঘটনাও এর প্রতিধ্বনি। ইরান ও তুরস্কের মতো দেশ ড্রোন প্রযুক্তি ও রপ্তানিতে নতুন প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে, যা বৈশ্বিক অস্ত্রবাজার ও ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ: বিশ্বের প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের পর ইউক্রেন যুদ্ধ ইতিহাসে প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ইউক্রেন ড্রোন যুদ্ধের কৌশল ও প্রাণহানির ধরণ সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। প্রথমে নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হলেও দ্রুতই ড্রোন আক্রমণাত্মক অস্ত্রে রূপ নেয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত বা আহত সেনাদের ৬০–৭০ শতাংশই ড্রোন হামলার শিকার হয় বলে চিকিৎসকেরা জানান।
ইউক্রেন তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকায় তারা বাণিজ্যিক ড্রোন—যেমন পরিবর্তিত ডিজেআই মডেল—গ্রেনেডসহ অস্ত্রে রূপান্তর করে। তুরস্কের তৈরি বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন ট্যাংক ও সরবরাহ লাইন ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইউক্রেন পরবর্তীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘কামিকাজে’ড্রোন তৈরি করে, যা নিজে থেকেই লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে আঘাত হানে।
রাশিয়া তার পাল্টা হামলায় ইরানি ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন ব্যবহার করে, যা বৃহৎ এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ফলে ইউক্রেন ‘ড্রোন ওয়াল’ তৈরি করে এসব প্রতিহত করতে। ২০২৫ সালের মধ্যে উভয় পক্ষই ‘ড্রোন সোয়ার্ম’ বা সমন্বিত ড্রোন ব্যবস্থার ব্যবহার শুরু করে। এসব পরস্পরসংযুক্ত ড্রোন একযোগে সমন্বিত আক্রমণ চালায়। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্র ক্রমেই স্বয়ংক্রিয় ও তথ্যনির্ভর হয়ে ওঠে—যেখানে ‘কিলিং চেইন’ বা লক্ষ্য নির্ধারণ থেকে আঘাত পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াই ডেটা ও অ্যালগরিদমে পরিচালিত হয়।
এই যুদ্ধ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ন্যাটো দেশগুলো প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, আর ইয়েমেন থেকে সুদান পর্যন্ত সংঘাতে ড্রোন ব্যবহারের ধরণ ইউক্রেনের মডেল অনুসরণ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, ‘ইউক্রেন এখন বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী যুদ্ধযন্ত্র’, যা বিশ্বকে দ্রুত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ওপেন-সোর্স ডিজাইনের পাঠ দিচ্ছে।
আয়মান আল-জাওয়াহিরি হত্যায় মার্কিন ড্রোন হামলা
২০২২ সালের ১ আগস্ট কাবুলে মার্কিন ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হন। ওসামা বিন লাদেনের উত্তরসূরি ও ৯/১১ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী জাওয়াহিরিকে সিআইএ-র তথ্যসূত্রের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। ‘সিনামন হারভেস্ট’ নামে এই অভিযানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মার্কিন ঘাঁটি থেকে উড়ানো এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এতে একটিমাত্র হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়, যাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সীমিত থাকে—তবে এক শিশু আহত হয়।
এই হামলা ড্রোন ব্যবহারের নতুন ধারা সূচিত করে। আগের মতো শুধু অনুমানের ভিত্তিতে নয়, বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ‘পার্সোনালিটি স্ট্রাইক’ চালানো শুরু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন একে ৯/১১–র সন্ত্রাসী হামলায় ৩ হাজার নিহতের ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে কাবুল সরকার একে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে অভিযোগ তোলে।
আইনি ও নৈতিক বিতর্ক সত্ত্বেও এই হামলা দেখায়—ড্রোন নির্ভুল হত্যায় সক্ষম, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে কার্যকারিতা সীমিত। জাওয়াহিরি নিহত হলেও আল-কায়েদার সংগঠন ভেঙে পড়েনি। এটি প্রমাণ করে, ড্রোন নেতৃত্ব ধ্বংসে সফল হলেও আদর্শ ও নেটওয়ার্ক ধ্বংসে এখনও অকার্যকর।
কাবুলের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা: আঞ্চলিক উত্তেজনার নতুন ধাপ
বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, পাকিস্তানের ড্রোন আফগান রাজধানীতে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ‘জঙ্গি’দের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর পেছনে ছিল খাইবার পাখতুনখোয়ায় আত্মঘাতী হামলার প্রতিশোধ, যেখানে ৫৮ জন নিহত হয়—এর মধ্যে কয়েকজন চীনা প্রকৌশলীও ছিলেন।
কথিত এই ‘পাকিস্তানি হামলা’য় টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদের সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল ধ্বংস হয় বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ অভিযানের দায় স্বীকার করেনি।
ঘটনাটি ঘটে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, ২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তালেবান সরকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে—বিশেষ করে পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপিকে, যাদেরকে ইসলামাবাদ তার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেড়ে চলা হামলার জন্য দায়ী করছে।
বিস্ফোরণের সময়সূচি মিলে যায় তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারতে ছয় দিনের সফরের শুরুর দিনটির সঙ্গেও। তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর এটি ছিল ভারতে তাদের এমন উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর।
কাবুলে বিস্ফোরণের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর গুঞ্জন শুরু হয় যে পাকিস্তানই এই হামলার পেছনে রয়েছে। ধারণা করা হয়, হামলার লক্ষ্য ছিল টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদসহ শীর্ষ নেতারা। তবে আফগান কর্মকর্তারা পরে জানান, মেহসুদ নিরাপদ আছেন।
এসব ঘটনা আঞ্চলিক যুদ্ধনীতিতে ড্রোন ব্যবহারের স্বাভাবিকীকরণকে ইঙ্গিত করে, যেখানে সীমান্তের ধারণা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তালেবান এটিকে পরোক্ষে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে নিন্দা জানায়। হামলার পরও আকাশে ড্রোনের উপস্থিতি উত্তেজনা আরও বাড়ায়।
বিশ্লেষকদের মতে, টিটিপির পুনরুত্থান ও আফগান তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কে উৎসাহিত অবস্থানের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের এই ‘আর নয়’ অবস্থান এসেছে। এটি আয়মান আল-জাওয়াহিরির হত্যার ঘটনার প্রতিধ্বনি তৈরি করলেও দৃশ্যপট এবার ভিন্ন—এবার কোনো যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং এক আঞ্চলিক শক্তি সস্তা ড্রোন ব্যবহার করছে গোপন আক্রমণের কৌশল হিসেবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কৌশল এখন দক্ষিণ এশিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইরান ও তুরস্কে ড্রোন শিল্পের উত্থান
এ সময় সমান্তরালভাবে ড্রোন রপ্তানির কেন্দ্র হিসেবে ইরান ও তুরস্কের উত্থান ঘটে। বিখ্যাত টিবি২ নির্মাতা তুরস্কের ড্রোন কোম্পানি বাইকার, ২০২৪ সালে রপ্তানিতে রেকর্ড ৭.১ বিলিয়ন ডলার আয় করে, যা লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। ইউক্রেন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় বিক্রির পাশাপাশি ন্যাটো অংশীদারত্ব তুরস্ককে শীর্ষ রপ্তানিকারক করে তুলেছে। ২০১৫–২০১৯ সালে যেখানে বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানিতে তাদের অংশ ছিল ০.৮%, ২০২০–২০২৪ সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১.৭%। আকিনজি’র মতো কম খরচে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন অসম যুদ্ধক্ষেত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হলেও আফ্রিকা ও এশিয়ায় নতুন সংঘাত উস্কে দিচ্ছে।
ইরানও নিজস্ব প্রযুক্তিতে ‘শাহেদ সিরিজ’-এর ড্রোন তৈরি করছে, যা রাশিয়া, হুতি ও বিভিন্ন মিলিশিয়াকে সরবরাহ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে চীন, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২৯টি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যারা ইরানের ড্রোন কর্মসূচিতে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইরানের ইসরায়েলবিরোধী ড্রোন হামলার পর বৈশ্বিক বাজারে তুর্কি ও মার্কিন অস্ত্রের বিক্রি বেড়ে যায়। তুলনামূলক কম নিয়ন্ত্রণের কারণে ইরান ও তুরস্ক পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এশিয়ায় তুরস্ক এখন ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী, আর ইরানের নকশা বিশ্বজুড়ে অনুকরণ হচ্ছে।
ড্রোনযুদ্ধের নতুন যুগ
ইউক্রেনের উদ্ভাবনী ল্যাব থেকে কাবুলের আকাশ পর্যন্ত—ড্রোন এখন যুদ্ধকে ‘গণতান্ত্রিক’ করে তুলেছে। রাষ্ট্র ও অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী উভয়েই কম খরচে ভয়াবহ ধ্বংস চালাতে পারছে। জাওয়াহিরি হত্যায় ড্রোনের নিখুঁততা যেমন প্রমাণিত হয়েছিল, কাবুলের ড্রোন হামলা তেমনি দেখিয়েছে সীমান্ত অতিক্রমের প্রলোভন। কিন্তু এই দ্রুত বিস্তার উদ্বেগও বাড়াচ্ছে—ড্রোনের প্রসার নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে। বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের নৈতিক প্রশ্নও উঠছে।
যুদ্ধ এখন ‘মানব চালকহীন সোয়ার্ম’-এর দিকে ঝুঁকছে। তাই জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো মারাত্মক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিষিদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। নতুন এই বাস্তবতায় ড্রোন আর কেবল যুদ্ধের যন্ত্র নয়—এগুলো বদলে দিচ্ছে কে যুদ্ধ করবে, কীভাবে করবে, আর এর জন্য কত মূল্য চুকাতে হবে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, পলিটিকো, অস্ট্রেলিয়ান আর্মি রিসার্চ সেন্টার, সিএসআইএস ডট ওআরজি, ক্রাইসিস গ্রুপ ডট ওআরজি
ড্রোন বা মানববিহীন আকাশযান (ইউএভি) এখন আধুনিক যুদ্ধের অপরিহার্য অস্ত্র। একসময় এগুলো সীমিত পর্যবেক্ষণযন্ত্র ছিল, এখন তা নির্ভুল আঘাত, কম খরচ এবং নিরাপদ পরিচালনার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), ক্ষুদ্রাকৃতির প্রযুক্তি ও সমন্বিত আক্রমণ ক্ষমতার অগ্রগতির ফলে ড্রোন এখন গুপ্তহত্যা থেকে শুরু করে বৃহৎ যুদ্ধক্ষেত্রের হামলায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিবর্তনকে দ্রুত ত্বরান্বিত করেছে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় আয়মান আল-জাওয়াহিরির হত্যাকাণ্ড কিংবা কাবুলে সাম্প্রতিক কথিত ‘পাকিস্তানি ড্রোন হামলা’র ঘটনাও এর প্রতিধ্বনি। ইরান ও তুরস্কের মতো দেশ ড্রোন প্রযুক্তি ও রপ্তানিতে নতুন প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে, যা বৈশ্বিক অস্ত্রবাজার ও ভূরাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আনছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ: বিশ্বের প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসনের পর ইউক্রেন যুদ্ধ ইতিহাসে প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ইউক্রেন ড্রোন যুদ্ধের কৌশল ও প্রাণহানির ধরণ সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। প্রথমে নজরদারির জন্য ব্যবহৃত হলেও দ্রুতই ড্রোন আক্রমণাত্মক অস্ত্রে রূপ নেয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি নাগাদ যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত বা আহত সেনাদের ৬০–৭০ শতাংশই ড্রোন হামলার শিকার হয় বলে চিকিৎসকেরা জানান।
ইউক্রেন তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকায় তারা বাণিজ্যিক ড্রোন—যেমন পরিবর্তিত ডিজেআই মডেল—গ্রেনেডসহ অস্ত্রে রূপান্তর করে। তুরস্কের তৈরি বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন ট্যাংক ও সরবরাহ লাইন ধ্বংসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইউক্রেন পরবর্তীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘কামিকাজে’ড্রোন তৈরি করে, যা নিজে থেকেই লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করে আঘাত হানে।
রাশিয়া তার পাল্টা হামলায় ইরানি ‘শাহেদ-১৩৬’ ড্রোন ব্যবহার করে, যা বৃহৎ এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ফলে ইউক্রেন ‘ড্রোন ওয়াল’ তৈরি করে এসব প্রতিহত করতে। ২০২৫ সালের মধ্যে উভয় পক্ষই ‘ড্রোন সোয়ার্ম’ বা সমন্বিত ড্রোন ব্যবস্থার ব্যবহার শুরু করে। এসব পরস্পরসংযুক্ত ড্রোন একযোগে সমন্বিত আক্রমণ চালায়। এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্র ক্রমেই স্বয়ংক্রিয় ও তথ্যনির্ভর হয়ে ওঠে—যেখানে ‘কিলিং চেইন’ বা লক্ষ্য নির্ধারণ থেকে আঘাত পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াই ডেটা ও অ্যালগরিদমে পরিচালিত হয়।
এই যুদ্ধ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা এখন বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ন্যাটো দেশগুলো প্রতিরোধমূলক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, আর ইয়েমেন থেকে সুদান পর্যন্ত সংঘাতে ড্রোন ব্যবহারের ধরণ ইউক্রেনের মডেল অনুসরণ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, ‘ইউক্রেন এখন বিশ্বের সবচেয়ে উদ্ভাবনী যুদ্ধযন্ত্র’, যা বিশ্বকে দ্রুত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ওপেন-সোর্স ডিজাইনের পাঠ দিচ্ছে।
আয়মান আল-জাওয়াহিরি হত্যায় মার্কিন ড্রোন হামলা
২০২২ সালের ১ আগস্ট কাবুলে মার্কিন ড্রোন থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হন। ওসামা বিন লাদেনের উত্তরসূরি ও ৯/১১ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী জাওয়াহিরিকে সিআইএ-র তথ্যসূত্রের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়। ‘সিনামন হারভেস্ট’ নামে এই অভিযানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের মার্কিন ঘাঁটি থেকে উড়ানো এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন ব্যবহার করা হয়। এতে একটিমাত্র হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়, যাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সীমিত থাকে—তবে এক শিশু আহত হয়।
এই হামলা ড্রোন ব্যবহারের নতুন ধারা সূচিত করে। আগের মতো শুধু অনুমানের ভিত্তিতে নয়, বরং নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে ‘পার্সোনালিটি স্ট্রাইক’ চালানো শুরু হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন একে ৯/১১–র সন্ত্রাসী হামলায় ৩ হাজার নিহতের ‘ন্যায়বিচার’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে কাবুল সরকার একে সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন বলে অভিযোগ তোলে।
আইনি ও নৈতিক বিতর্ক সত্ত্বেও এই হামলা দেখায়—ড্রোন নির্ভুল হত্যায় সক্ষম, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে কার্যকারিতা সীমিত। জাওয়াহিরি নিহত হলেও আল-কায়েদার সংগঠন ভেঙে পড়েনি। এটি প্রমাণ করে, ড্রোন নেতৃত্ব ধ্বংসে সফল হলেও আদর্শ ও নেটওয়ার্ক ধ্বংসে এখনও অকার্যকর।
কাবুলের সাম্প্রতিক ড্রোন হামলা: আঞ্চলিক উত্তেজনার নতুন ধাপ
বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, পাকিস্তানের ড্রোন আফগান রাজধানীতে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) ‘জঙ্গি’দের ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এর পেছনে ছিল খাইবার পাখতুনখোয়ায় আত্মঘাতী হামলার প্রতিশোধ, যেখানে ৫৮ জন নিহত হয়—এর মধ্যে কয়েকজন চীনা প্রকৌশলীও ছিলেন।
কথিত এই ‘পাকিস্তানি হামলা’য় টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদের সম্ভাব্য আশ্রয়স্থল ধ্বংস হয় বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ অভিযানের দায় স্বীকার করেনি।
ঘটনাটি ঘটে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের ক্রমাবনতিশীল সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে। পাকিস্তান অভিযোগ করছে, ২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতায় আসার পর থেকে তালেবান সরকার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দিচ্ছে—বিশেষ করে পাকিস্তান তালেবান বা টিটিপিকে, যাদেরকে ইসলামাবাদ তার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বেড়ে চলা হামলার জন্য দায়ী করছে।
বিস্ফোরণের সময়সূচি মিলে যায় তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির ভারতে ছয় দিনের সফরের শুরুর দিনটির সঙ্গেও। তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর এটি ছিল ভারতে তাদের এমন উচ্চপর্যায়ের প্রথম সফর।
কাবুলে বিস্ফোরণের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর গুঞ্জন শুরু হয় যে পাকিস্তানই এই হামলার পেছনে রয়েছে। ধারণা করা হয়, হামলার লক্ষ্য ছিল টিটিপি প্রধান নূর ওয়ালি মেহসুদসহ শীর্ষ নেতারা। তবে আফগান কর্মকর্তারা পরে জানান, মেহসুদ নিরাপদ আছেন।
এসব ঘটনা আঞ্চলিক যুদ্ধনীতিতে ড্রোন ব্যবহারের স্বাভাবিকীকরণকে ইঙ্গিত করে, যেখানে সীমান্তের ধারণা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তালেবান এটিকে পরোক্ষে ‘যুদ্ধ ঘোষণা’ বলে নিন্দা জানায়। হামলার পরও আকাশে ড্রোনের উপস্থিতি উত্তেজনা আরও বাড়ায়।
বিশ্লেষকদের মতে, টিটিপির পুনরুত্থান ও আফগান তালেবানের সঙ্গে সম্পর্কে উৎসাহিত অবস্থানের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের এই ‘আর নয়’ অবস্থান এসেছে। এটি আয়মান আল-জাওয়াহিরির হত্যার ঘটনার প্রতিধ্বনি তৈরি করলেও দৃশ্যপট এবার ভিন্ন—এবার কোনো যুক্তরাষ্ট্র নয়, বরং এক আঞ্চলিক শক্তি সস্তা ড্রোন ব্যবহার করছে গোপন আক্রমণের কৌশল হিসেবে। ইউক্রেন যুদ্ধের কৌশল এখন দক্ষিণ এশিয়ায়ও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ইরান ও তুরস্কে ড্রোন শিল্পের উত্থান
এ সময় সমান্তরালভাবে ড্রোন রপ্তানির কেন্দ্র হিসেবে ইরান ও তুরস্কের উত্থান ঘটে। বিখ্যাত টিবি২ নির্মাতা তুরস্কের ড্রোন কোম্পানি বাইকার, ২০২৪ সালে রপ্তানিতে রেকর্ড ৭.১ বিলিয়ন ডলার আয় করে, যা লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। ইউক্রেন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় বিক্রির পাশাপাশি ন্যাটো অংশীদারত্ব তুরস্ককে শীর্ষ রপ্তানিকারক করে তুলেছে। ২০১৫–২০১৯ সালে যেখানে বৈশ্বিক অস্ত্র রপ্তানিতে তাদের অংশ ছিল ০.৮%, ২০২০–২০২৪ সময়ে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১.৭%। আকিনজি’র মতো কম খরচে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন অসম যুদ্ধক্ষেত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হলেও আফ্রিকা ও এশিয়ায় নতুন সংঘাত উস্কে দিচ্ছে।
ইরানও নিজস্ব প্রযুক্তিতে ‘শাহেদ সিরিজ’-এর ড্রোন তৈরি করছে, যা রাশিয়া, হুতি ও বিভিন্ন মিলিশিয়াকে সরবরাহ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালে চীন, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ২৯টি কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, যারা ইরানের ড্রোন কর্মসূচিতে যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিলে ইরানের ইসরায়েলবিরোধী ড্রোন হামলার পর বৈশ্বিক বাজারে তুর্কি ও মার্কিন অস্ত্রের বিক্রি বেড়ে যায়। তুলনামূলক কম নিয়ন্ত্রণের কারণে ইরান ও তুরস্ক পশ্চিমা দেশগুলোর চেয়ে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। এশিয়ায় তুরস্ক এখন ইসরায়েলের প্রতিদ্বন্দ্বী, আর ইরানের নকশা বিশ্বজুড়ে অনুকরণ হচ্ছে।
ড্রোনযুদ্ধের নতুন যুগ
ইউক্রেনের উদ্ভাবনী ল্যাব থেকে কাবুলের আকাশ পর্যন্ত—ড্রোন এখন যুদ্ধকে ‘গণতান্ত্রিক’ করে তুলেছে। রাষ্ট্র ও অরাষ্ট্রীয় গোষ্ঠী উভয়েই কম খরচে ভয়াবহ ধ্বংস চালাতে পারছে। জাওয়াহিরি হত্যায় ড্রোনের নিখুঁততা যেমন প্রমাণিত হয়েছিল, কাবুলের ড্রোন হামলা তেমনি দেখিয়েছে সীমান্ত অতিক্রমের প্রলোভন। কিন্তু এই দ্রুত বিস্তার উদ্বেগও বাড়াচ্ছে—ড্রোনের প্রসার নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতা উসকে দিতে পারে। বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহারের নৈতিক প্রশ্নও উঠছে।
যুদ্ধ এখন ‘মানব চালকহীন সোয়ার্ম’-এর দিকে ঝুঁকছে। তাই জাতিসংঘের মতো সংস্থাগুলো মারাত্মক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিষিদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে। নতুন এই বাস্তবতায় ড্রোন আর কেবল যুদ্ধের যন্ত্র নয়—এগুলো বদলে দিচ্ছে কে যুদ্ধ করবে, কীভাবে করবে, আর এর জন্য কত মূল্য চুকাতে হবে।
তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, পলিটিকো, অস্ট্রেলিয়ান আর্মি রিসার্চ সেন্টার, সিএসআইএস ডট ওআরজি, ক্রাইসিস গ্রুপ ডট ওআরজি
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ধাপে ধাপে যুদ্ধবিরতি চুক্তির ঘোষণা দিয়েছেন। ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা ১০ অক্টোবর প্রথম ধাপের শান্তি পরিকল্পনা অনুমোদন করে। এতে ২৪ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এই সাফল্য গাজা যুদ্ধের প্রথম বড় ধরনের উত্তেজনা প্রশমনের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
৭ ঘণ্টা আগেজুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে গণভোটের বিষয়ে একমত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। শিগগিরই হয়তো ভোটের আয়োজনও করা হবে। গণভোট হলো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট, যা কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব, আইন বা রাজনৈতিক বিষয়ে নেওয়া হয়।
১৪ ঘণ্টা আগেদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গঠিত হয় জাতিসংঘ। আজকে তা এক মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি—যুক্তরাষ্ট্র সরে গেলে সংস্থাটির কী হবে? সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনামূলক বক্তব্য এই বিতর্ককে নতুন করে উসকে দিয়েছে।
২ দিন আগে‘রাজমহলে বহু বাঙালি পরিবার রয়েছে, যাঁদের পূর্বপুরুষ আফগানিস্তানের বলখসহ নানা অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।’ ১৬২৬ সালে মন্তব্য করেছিলেন আফগান পর্যটক মাহমুদ বালখি। এমনকি ঔপনিবেশিক যুগে বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী শিক্ষক হিসেবে স্থায়ী হয়েছিলেন আফগানিস্তানে। কাবুল কৃষি কলেজে অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার
২ দিন আগে