মাহবুবুল আলম তারেক

অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে। এটি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধ্যাদেশের ফলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠিত হয়। এতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা সরাসরি প্রধান বিচারপতির অধীনে আসে।
এর আগে বিচারবিভাগ দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, বাজেট বরাদ্দ ও নীতি প্রণয়নের মতো সিদ্ধান্তে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাব ছিল বেশি। এই অধ্যাদেশ সংবিধানের ১০৯ এবং ১১৬(ক) অনুচ্ছেদের দীর্ঘদিনের নির্দেশনা পূরণ করেছে। ১৯৯৯ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন রায় এবং ২০০৭ সালের আংশিক স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় এটি বাস্তবায়িত হলো।
গতকাল শনিবার (৬ ডিসেম্বর ২০২৫) এক সেমিনারে প্রধান বিচারপতি বলেন, নতুন কাঠামোর ফলে সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব পদ সৃষ্টি করতে পারবে, বাজেট পরিচালনা করতে পারবে, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন করতে পারবে এবং নীতি প্রণয়ন সহজ হবে। তাঁর মতে, এটি টেকসই বিচার সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করবে।
অধ্যাদেশটি বাণিজ্যিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত কমার্শিয়াল কোর্ট প্রতিষ্ঠার সুযোগও তৈরি করছে, যা অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পারে। তবে অধ্যাদেশটি অস্থায়ী। নির্বাচন শেষে স্থায়ী আইন করতে হলে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে এর লাভ-ক্ষতি বা এ ব্যবস্থার সুফল ও সম্ভাব্য ঝুঁকি বা সীমাবদ্ধতাগুলো কী। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ একে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন, তবে বাস্তবায়ন, দায়বদ্ধতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে কিছু উদ্বেগও রয়েছে।
লাভ: প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের সুফল
এই অধ্যাদেশ দীর্ঘদিনের নির্বাহী হস্তক্ষেপ কমিয়ে একটি কার্যকর ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার পথ তৈরি করেছে। প্রধান সুবিধাগুলো হলো—
১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি
সুপ্রিম কোর্ট এখন নিজেই বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থা তদারকি করতে পারবে। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব ও পক্ষপাত কমবে।
১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচারব্যবস্থার স্বশাসন জোরদার হয়েছে।
পৃথক সচিবালয় আদালতের ব্যবস্থাপনা পেশাদারভাবে পরিচালনা করবে। গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও নীতি প্রণয়ন আরও উন্নত হবে।
এতে মামলা জট কমতে পারে এবং বিচার সেবা আরও দ্রুত ও মানসম্মত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা একে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখছেন।
২. আর্থিক স্বায়ত্তশাসন ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা
বাজেট ব্যবহারে আর আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে না। ব্যয় অনুমোদনের এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির অধীনে এসেছে।
সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব বাজেট প্রস্তাব তৈরি করতে পারবে। বেতন, প্রশাসনিক খরচ, অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণ—সব ক্ষেত্রেই দ্রুত সিদ্ধান্ত সম্ভব হবে।
অতীতে অর্থ বরাদ্দে দেরি ও ঘাটতির কারণে বহু উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন তা সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
৩. গণতান্ত্রিক ও কাঠামোগত লাভ
নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ কমায় বিচার বিভাগ এখন রাষ্ট্রকে আরও কার্যকরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে। এতে স্বচ্ছতা ও জনআস্থা বাড়বে।
একে গণতন্ত্রের জন্য একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখা হচ্ছে—বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের পর প্রেক্ষাপটে।
দায়বদ্ধতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধের কারণে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ দীর্ঘদিন ধরে বিলম্বিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই পুরোনো সীমাবদ্ধতা মোকাবিলার সুযোগ তৈরি হলো।
ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
অধ্যাদেশটি অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করলেও সমালোচক ও বিশ্লেষকদের মতে কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। শুধু কাঠামোগত স্বাধীনতা দিলেই কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয় না। প্রধান উদ্বেগগুলো হলো—
১. বাস্তবায়ন ও দায়বদ্ধতার ঝুঁকি
বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও ন্যায়বিচার নির্ভর করবে বিচারকদের নৈতিক সাহস, সততা ও পক্ষপাতমুক্ত সিদ্ধান্তের ওপর।
অতীতে বহু ক্ষেত্রে আইনি ব্যাখ্যার আড়ালে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা বা রিমান্ড-জুলুম, জামিন না দেওয়া, একই অপরাধে একাধিক মামলা—এমন কর্মকাণ্ড ঘটেছে।
প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে স্বাধীনতার মধ্যেও বিচারব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণ থেকে যেতে পারে।
আরও একটি ঝুঁকি হলো—অধ্যাদেশটি অস্থায়ী। ভবিষ্যৎ সংসদে এটি আইন হিসেবে পাস না হলে সিদ্ধান্তটি বাতিল হয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক মতভেদের কারণে এই প্রক্রিয়া আবারও দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে পারে।
২. কাঠামোগত ও গঠনগত উদ্বেগ
সচিবালয় কমিশনে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী/উপদেষ্টার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কিছু মহলে আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে এতে নির্বাহী প্রভাব ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আবার সকল ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির অধীনে কেন্দ্রীভূত হলে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতা, পক্ষপাত বা প্রভাব তৈরির আশঙ্কা থাকে। স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে দায়বদ্ধতা কমে যেতে পারে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা
২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হলেও নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ বহু বছর ধরে বজায় ছিল। অনুরূপ স্থবিরতা নতুন ব্যবস্থায়ও দেখা দিতে পারে যদি সচিবালয়ের প্রয়োগ কাঠামো শক্তিশালী না হয়।
আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধ, রাজনৈতিক প্রভাব ও জবাবদিহির অভাব—এগুলো ঐতিহাসিকভাবে সংস্কারের গতি বাধাগ্রস্ত করেছে।
আরেকটি আশঙ্কা—যদি মামলা নিষ্পত্তির হার না বাড়ে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজ না হয়, তবে কাঠামোগত স্বাধীনতা বাস্তব সুফলে রূপ নাও নিতে পারে।
এই ঝুঁকিগুলো মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা হলো একটি সুযোগ, চূড়ান্ত সমাধান নয়। প্রকৃত সাফল্যের জন্য প্রয়োজন আইন প্রণয়ন, শক্তিশালী বাস্তবায়ন, নৈতিক বিচারপ্রক্রিয়া ও জবাবদিহি।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ বিচার বিভাগের জন্য সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক অগ্রগতি। এতে বিচার স্বাধীনতা, দক্ষতা এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সুফলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে কমার্শিয়াল কোর্ট চালুর উদ্যোগের মাধ্যমে।
বলা যায়, সামগ্রিকভাবে ‘লাভ’ সম্ভাব্য ‘ক্ষতি’র চেয়ে বেশি। তবে এর প্রকৃত ফল নির্ভর করবে বাস্তবায়নের সতর্কতা, বিচারকদের নৈতিক অবস্থান ও সংসদের আইন প্রণয়নের ওপর। নির্বাচনের পর অধ্যাদেশটি আইনে রূপ দেওয়া একটি বড় পরীক্ষা হবে।
অবশেষে, ন্যায়বিচার সবার জন্য নিশ্চিত হলে এই পরিবর্তন গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে। কিন্তু সংস্কারের অন্তর্নিহিত অসুবিধা দূর করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। এতদিন নিয়োগ, বদলি, বাজেট ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ ছিল, যা বিচার বিভাগকে অনেক জটিলতায় জড়িয়ে রাখত। এই অধ্যাদেশ সেই বাধাকে দূর করবে এবং বিচার বিভাগকে কাঠামোগত সক্ষমতা দেবে।’
ড. জাহেদের মতে, ‘ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ হবে—এই স্বায়ত্তশাসনকে স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগতভাবে পরিচালনা করা। বিচারবিভাগ নিজে কতটা স্বাধীন থাকতে চায় তার ওপরও এটি নির্ভর করছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি ব্যবস্থা, আর্থিক নিরীক্ষা, বিচারভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন—এসব নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজ করতে হলে মামলা দ্রুত সমাধানের উপর জোর দিতে হবে।’
কাজী জাহেদ ইকবাল আরও বলেন, ‘এটি সুযোগ, পূর্ণ সাফল্য নয়। সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে সততা, দক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতি দিয়ে। আগামী সংসদ একে স্থায়ী আইন হিসেবে পাস করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শুধু নথিতে নয়, বাস্তবেও প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের বিচারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা এই সুযোগ কীভাবে ব্যবহার করি তার ওপর।’

অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে। এটি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধ্যাদেশের ফলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠিত হয়। এতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা সরাসরি প্রধান বিচারপতির অধীনে আসে।
এর আগে বিচারবিভাগ দ্বৈত নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, বাজেট বরাদ্দ ও নীতি প্রণয়নের মতো সিদ্ধান্তে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রভাব ছিল বেশি। এই অধ্যাদেশ সংবিধানের ১০৯ এবং ১১৬(ক) অনুচ্ছেদের দীর্ঘদিনের নির্দেশনা পূরণ করেছে। ১৯৯৯ সালের ঐতিহাসিক মাসদার হোসেন রায় এবং ২০০৭ সালের আংশিক স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় এটি বাস্তবায়িত হলো।
গতকাল শনিবার (৬ ডিসেম্বর ২০২৫) এক সেমিনারে প্রধান বিচারপতি বলেন, নতুন কাঠামোর ফলে সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব পদ সৃষ্টি করতে পারবে, বাজেট পরিচালনা করতে পারবে, প্রশিক্ষণ উন্নয়ন করতে পারবে এবং নীতি প্রণয়ন সহজ হবে। তাঁর মতে, এটি টেকসই বিচার সংস্কারের ভিত্তি স্থাপন করবে।
অধ্যাদেশটি বাণিজ্যিক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত কমার্শিয়াল কোর্ট প্রতিষ্ঠার সুযোগও তৈরি করছে, যা অর্থনীতিকে গতিশীল করতে পারে। তবে অধ্যাদেশটি অস্থায়ী। নির্বাচন শেষে স্থায়ী আইন করতে হলে সংসদের অনুমোদন নিতে হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠেছে এর লাভ-ক্ষতি বা এ ব্যবস্থার সুফল ও সম্ভাব্য ঝুঁকি বা সীমাবদ্ধতাগুলো কী। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ একে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন, তবে বাস্তবায়ন, দায়বদ্ধতা ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিয়ে কিছু উদ্বেগও রয়েছে।
লাভ: প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসনের সুফল
এই অধ্যাদেশ দীর্ঘদিনের নির্বাহী হস্তক্ষেপ কমিয়ে একটি কার্যকর ও নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার পথ তৈরি করেছে। প্রধান সুবিধাগুলো হলো—
১. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি
সুপ্রিম কোর্ট এখন নিজেই বিচারক নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও শৃঙ্খলা ব্যবস্থা তদারকি করতে পারবে। ফলে রাজনৈতিক প্রভাব ও পক্ষপাত কমবে।
১৯৯৯ সালের মাসদার হোসেন রায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিচারব্যবস্থার স্বশাসন জোরদার হয়েছে।
পৃথক সচিবালয় আদালতের ব্যবস্থাপনা পেশাদারভাবে পরিচালনা করবে। গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও নীতি প্রণয়ন আরও উন্নত হবে।
এতে মামলা জট কমতে পারে এবং বিচার সেবা আরও দ্রুত ও মানসম্মত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা একে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখছেন।
২. আর্থিক স্বায়ত্তশাসন ও সম্পদ ব্যবস্থাপনা
বাজেট ব্যবহারে আর আইন মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাগবে না। ব্যয় অনুমোদনের এখতিয়ার প্রধান বিচারপতির অধীনে এসেছে।
সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব বাজেট প্রস্তাব তৈরি করতে পারবে। বেতন, প্রশাসনিক খরচ, অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি বা প্রশিক্ষণ—সব ক্ষেত্রেই দ্রুত সিদ্ধান্ত সম্ভব হবে।
অতীতে অর্থ বরাদ্দে দেরি ও ঘাটতির কারণে বহু উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন তা সমাধানের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
৩. গণতান্ত্রিক ও কাঠামোগত লাভ
নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ কমায় বিচার বিভাগ এখন রাষ্ট্রকে আরও কার্যকরভাবে জবাবদিহির আওতায় আনতে পারবে। এতে স্বচ্ছতা ও জনআস্থা বাড়বে।
একে গণতন্ত্রের জন্য একটি ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে দেখা হচ্ছে—বিশেষ করে ২০২৪ সালের গণআন্দোলনের পর প্রেক্ষাপটে।
দায়বদ্ধতার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধের কারণে বিচার বিভাগকে পৃথকীকরণ দীর্ঘদিন ধরে বিলম্বিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই পুরোনো সীমাবদ্ধতা মোকাবিলার সুযোগ তৈরি হলো।
ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ
অধ্যাদেশটি অগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করলেও সমালোচক ও বিশ্লেষকদের মতে কিছু ঝুঁকি রয়ে গেছে। শুধু কাঠামোগত স্বাধীনতা দিলেই কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত হয় না। প্রধান উদ্বেগগুলো হলো—
১. বাস্তবায়ন ও দায়বদ্ধতার ঝুঁকি
বিচার বিভাগ স্বাধীন হলেও ন্যায়বিচার নির্ভর করবে বিচারকদের নৈতিক সাহস, সততা ও পক্ষপাতমুক্ত সিদ্ধান্তের ওপর।
অতীতে বহু ক্ষেত্রে আইনি ব্যাখ্যার আড়ালে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষা বা রিমান্ড-জুলুম, জামিন না দেওয়া, একই অপরাধে একাধিক মামলা—এমন কর্মকাণ্ড ঘটেছে।
প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে স্বাধীনতার মধ্যেও বিচারব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাবানদের নিয়ন্ত্রণ থেকে যেতে পারে।
আরও একটি ঝুঁকি হলো—অধ্যাদেশটি অস্থায়ী। ভবিষ্যৎ সংসদে এটি আইন হিসেবে পাস না হলে সিদ্ধান্তটি বাতিল হয়ে যেতে পারে। রাজনৈতিক মতভেদের কারণে এই প্রক্রিয়া আবারও দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে পারে।
২. কাঠামোগত ও গঠনগত উদ্বেগ
সচিবালয় কমিশনে অ্যাটর্নি জেনারেল ও আইনমন্ত্রী/উপদেষ্টার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে কিছু মহলে আপত্তি রয়েছে। তাদের মতে এতে নির্বাহী প্রভাব ফিরে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
আবার সকল ক্ষমতা প্রধান বিচারপতির অধীনে কেন্দ্রীভূত হলে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতা, পক্ষপাত বা প্রভাব তৈরির আশঙ্কা থাকে। স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা না থাকলে দায়বদ্ধতা কমে যেতে পারে।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা
২০০৭ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করা হলেও নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ বহু বছর ধরে বজায় ছিল। অনুরূপ স্থবিরতা নতুন ব্যবস্থায়ও দেখা দিতে পারে যদি সচিবালয়ের প্রয়োগ কাঠামো শক্তিশালী না হয়।
আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধ, রাজনৈতিক প্রভাব ও জবাবদিহির অভাব—এগুলো ঐতিহাসিকভাবে সংস্কারের গতি বাধাগ্রস্ত করেছে।
আরেকটি আশঙ্কা—যদি মামলা নিষ্পত্তির হার না বাড়ে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজ না হয়, তবে কাঠামোগত স্বাধীনতা বাস্তব সুফলে রূপ নাও নিতে পারে।
এই ঝুঁকিগুলো মনে করিয়ে দেয়—স্বাধীনতা হলো একটি সুযোগ, চূড়ান্ত সমাধান নয়। প্রকৃত সাফল্যের জন্য প্রয়োজন আইন প্রণয়ন, শক্তিশালী বাস্তবায়ন, নৈতিক বিচারপ্রক্রিয়া ও জবাবদিহি।
সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ বিচার বিভাগের জন্য সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক অগ্রগতি। এতে বিচার স্বাধীনতা, দক্ষতা এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সুফলের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে—বিশেষ করে কমার্শিয়াল কোর্ট চালুর উদ্যোগের মাধ্যমে।
বলা যায়, সামগ্রিকভাবে ‘লাভ’ সম্ভাব্য ‘ক্ষতি’র চেয়ে বেশি। তবে এর প্রকৃত ফল নির্ভর করবে বাস্তবায়নের সতর্কতা, বিচারকদের নৈতিক অবস্থান ও সংসদের আইন প্রণয়নের ওপর। নির্বাচনের পর অধ্যাদেশটি আইনে রূপ দেওয়া একটি বড় পরীক্ষা হবে।
অবশেষে, ন্যায়বিচার সবার জন্য নিশ্চিত হলে এই পরিবর্তন গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে। কিন্তু সংস্কারের অন্তর্নিহিত অসুবিধা দূর করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের দাবি পূরণের দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। এতদিন নিয়োগ, বদলি, বাজেট ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে নির্বাহী নিয়ন্ত্রণ ছিল, যা বিচার বিভাগকে অনেক জটিলতায় জড়িয়ে রাখত। এই অধ্যাদেশ সেই বাধাকে দূর করবে এবং বিচার বিভাগকে কাঠামোগত সক্ষমতা দেবে।’
ড. জাহেদের মতে, ‘ভবিষ্যতের বড় চ্যালেঞ্জ হবে—এই স্বায়ত্তশাসনকে স্বচ্ছ ও ন্যায়সংগতভাবে পরিচালনা করা। বিচারবিভাগ নিজে কতটা স্বাধীন থাকতে চায় তার ওপরও এটি নির্ভর করছে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি ব্যবস্থা, আর্থিক নিরীক্ষা, বিচারভিত্তিক বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন—এসব নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজ করতে হলে মামলা দ্রুত সমাধানের উপর জোর দিতে হবে।’
কাজী জাহেদ ইকবাল আরও বলেন, ‘এটি সুযোগ, পূর্ণ সাফল্য নয়। সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে সততা, দক্ষতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নীতি দিয়ে। আগামী সংসদ একে স্থায়ী আইন হিসেবে পাস করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শুধু নথিতে নয়, বাস্তবেও প্রতিষ্ঠিত হবে। দেশের বিচারব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা এই সুযোগ কীভাবে ব্যবহার করি তার ওপর।’

ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন কিনা, কোনো কারচুপি হচ্ছে কিনা কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা—এসব বিষয় তদারকি করে প্রতিবেদন দেওয়াই তাদের কাজ।
১৮ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) কমিশনের বৈঠক থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
১ দিন আগে
লাতিন আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে ভেনেজুয়েলা আজ এক ভয়াবহ দ্বৈরথের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলভাণ্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটে ধুঁকছে।
১ দিন আগে
দ্রুতই বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার সমীকরণ। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক’ দীর্ঘদিন অচল। দুই প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতাও তুঙ্গে।
২ দিন আগে