leadT1ad

পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে ধর্মীয় উসকানি

‘বাবরি মসজিদের’ ভিত্তির পাল্টায় গীতা পাঠ বিজেপির

স্ট্রিম ডেস্ক
স্ট্রিম ডেস্ক

পাঁচ লাখের কণ্ঠে গীতা পাঠ অনুষ্ঠান। ছবি: সংগৃহীত

সামনের বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনই তুঙ্গে সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির। আর সেই রাজনীতিতে শুরুতেই ঢুকে গেছে ধর্মীয় উসকানি। একদিকে বাবরির আদলে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ, অন্যদিকে রাম মন্দির নির্মাণ সূচনা। একদিকে পাঁচ লাখ কণ্ঠে গীতা পাঠের বিপরীতে এক লাখ লোকের কণ্ঠে কোরআন পাঠের কর্মসূচি। আর এসব কর্মকাণ্ডই করা হচ্ছে ঐতিহাসিকভাবে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার জন্য পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায়। এসব নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস-বিজেপি পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে। আর ভারতীয় কংগ্রেস বলছে, রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে দল দুটি বিভাজনের রাজনীতি করছে।

এসবের শুরুটা করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত নেতা হুমায়ুন কবীর। তিনি বাবরি মসজিদ ভাঙার বার্ষিকীতে গত ৬ ডিসেম্বর মুর্শিদাবাদে বাবরি আদলে মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় রোববার (৭ ডিসেম্বর) কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে গীতা পাঠের আয়োজন করা হয়।

পাঁচ লাখ লোকের কণ্ঠে ‘ভগবদ গীতা পাঠ’-এর এ আয়োজন করেছে সনাতন সংস্কৃতি সংসদ নামের একটি সংগঠন। এটি বিভিন্ন মঠ এবং হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে আগত সন্ন্যাসী এবং আধ্যাত্মিক নেতাদের নিয়ে গঠিত।

এদিকে, এই গীতা পাঠের আয়োজনের দিনই আবার হুমায়ুন কবীর ঘোষণা করেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে এক লাখ লোকের কোরআন পাঠের কর্মসূচি।

আজ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার রেজিনগরে সাংবাদিকদের হুমায়ুন কবীর বলেন, ফেব্রুয়ারিতে আমি এক লাখ লোকের কণ্ঠে কোরআন পাঠের আয়োজন করবো।

এর আগে শনিবার হুমায়ুন অযোধ্যার বাবরির আদলে মুর্শিদাবাদে মসজিদ তৈরির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে রাজ্য পুলিশ, আরএএফ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী নিরাপত্তা দিয়েছিল। সেদিন হুমায়ুন কবীর জানান, মসজিদ নির্মাণে অংশগ্রহণকারীদের তিনি ভাত ও মাংস দিয়ে আপ্যায়ন করবেন।

পরে তিনি প্রস্তাবিত স্থান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের মঞ্চে ফিতা কেটে মসজিদ নির্মাণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ সময় হাজার হাজার সমর্থক প্রতীকী ইট হাতে, ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাবরি মসজিদ নির্মাণ কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চার লাখ মানুষ উপস্থিত ছিলেন বলে দাবি করেছেন হুমায়ুন। পরে সমর্থকদের দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, মসজিদ নির্মাণের ব্যাপারটি অসাংবিধানিক কিছু নেই। প্রার্থনালয় নির্মাণ একটি সাংবিধানিক অধিকার। বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হবে।

১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কথা উল্লেখ করে হুমায়ুন এই প্রকল্পটিকে আবেগের পুনরুদ্ধার জানান । তিনি বলেন, তেত্রিশ বছর আগে, মুসলমানদের হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছিল। আজ আমরা সেই ক্ষতস্থানে একটি ছোট মলম লাগাচ্ছি।

তবে তিনিও এই জানিয়েছিলেন, মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ায় তিনি হুমকি পেয়েছিলেন।

ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতে ৪০ কোটি মুসলিমের বাস। আর এই রাজ্যে চার কোটি মুসলিমের বসবাস। আমরা কি একটি মসজিদ নির্মাণ করতে পারি না?

এসময় সৌদি আরব থেকে আসা এক হুজুর মঞ্চে উঠেন। পরে তিনি কোরআন থেকে একটি সূরা তিলওয়াত করে শোনান।

এদিকে, একই দিন বিজেপি নেতা সেখরব সরকার পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর বাঞ্জাতিয়ার মণীন্দ্র নগরে একটি রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তিনি অবশ্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে নানা মন্তব্য করেন। তবে যেখানে রাম মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, তা বাবরি মসজিদের নির্ধারিত স্থান থেকে বেশি দূরে নয়।

বাবরি মসজিদের আদলে মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত
বাবরি মসজিদের আদলে মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানের একটি চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

সেখরব সরকার অভিযোগ করে বলেন, বাবরি মসজিদ কেবল হুমায়ুন কবীরের প্রকল্প নয়। রাজ্য প্রশাসন এবং তৃণমূল কংগ্রেসও এতে জড়িত।

অবশ্যই ওই দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেন, বাংলার মাটি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ঐক্যের মাটি। এই ভূমি কখনও বিভেদমূলক রাজনীতির সামনে মাথা নত করেনি, করবেও না। বিশ্বাস ব্যক্তিগত, কিন্তু উৎসব সবার।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই’ অব্যাহত থাকবে।

এছাড়া, বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতা অমিত মালব্য এক্সে এক পোস্টে অভিযোগ করেন, নির্মাণ কাজের জন্য কবীরের সমর্থকদের ইট নিয়ে যেতে দেখা গেছে। কবীর একে বাবরি মসজিদ নির্মাণ বলছেন। কিন্তু তাঁর পক্ষে রাজ্য পুলিশের সমর্থনও রয়েছে।

তিনি বলেন, এই তথাকথিত মসজিদ প্রকল্প কোনো ধর্মীয় সেবামূলক নয়, এটি রাজনৈতিক। এটি পশ্চিমবঙ্গের স্থিতিশীলতার জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গকে অশান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন।

অন্যদিকে, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, আজ মুর্শিদাবাদে মোঘল-পাঠান রাজনীতির বীজ বপন করা হয়েছে। একজন আক্রমণকারীর নামে মসজিদের নামকরণ করা লজ্জাজনক। বাবর অত্যাচার ও ধ্বংসের প্রতীক। এটিকে সমর্থন করা মানে আগুন নিয়ে খেলা করা।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের স্মরণে উত্তর কলকাতায় আয়োজিত ‘শৌর্য যাত্রা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এই বক্তব্য দেন শুভেন্দু অধিকারী। অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন ‘সিংহ বাহিনী’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। নির্বাচনকে সামনে রেখে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের শোভাযাত্রায় যদিও ‘ভিক্ষু এবং অংশগ্রহণকারীদের’ ত্রিশূল হাতে হিন্দু ঐক্যের জন্য স্লোগান দিতে দেখা গেছে।

এদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস আবার বলছে উল্টো কথা। দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা অভিযোগ করেছেন, বহিষ্কৃত বিধায়ক হুমায়ুন কবীর ‘বিজেপির বেতনভুক্ত’। শুধু তাই নয়, অস্থিরতাকে উসকে দিতে বিজেপির অ্যাজেন্ট হিসেবে হুমায়ুন কাজ করছেন বলেও অভিযোগ করেছে দলটি।

তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা বলেন, মুর্শিদাবাদের মানুষ শান্তি প্রিয়। তাঁরা তাঁর উসকানিকে সমর্থন করে না।

অন্যদিকে, বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং এই সংক্রান্ত পুরো বিষয়গুলোর জন্য তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপিকে দায়ী করেছে ভারতীয় কংগ্রেস। দলটির অভিযোগ, ঐতিহাসিকভাবেই মুর্শিদাবাদ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার জায়গা ছিল। এখন দল দুটি সেই জেলায়ই ধর্মীয় উদ্বেগকে কাজে লাগাচ্ছে।

এই দিকটি সামনে রেখে শত শত কংগ্রেস কর্মী কলকাতায় সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে। সমাবেশের আগে একটি মসজিদের সামনে থেকে এক মন্দির পর্যন্ত মিছিল করে কংগ্রেস কর্মীরা। এসময় তারা বাবরি মসজিদ ভাঙার পরবর্তী সময়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সে সম্পর্কে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান।

রাজ্য কংগ্রেসের প্রধান শুভঙ্কর সরকার বলেন, মন্দির ও মসজিদ মানুষকে চাকরি বা খাবার দেবে না। বিভাজনের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। হুমায়ুনের নিজস্ব রাজনৈতিক চাপ এই ষড়যন্ত্রকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

হুমায়ুনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েও কংগ্রেস সন্দিহান। কারণ হুমায়ুন প্রথমে কংগ্রেসে ছিলেন। পরে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে কিছুদিনের জন্য বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে আবার তৃণমূল কংগ্রেসেই ফিরে আসেন। বিভিন্ন সময়ে অস্থিরতা ও নাটকীয়তার জন্য হুমায়ুন কবীর বেশ পরিচিত। সর্বশেষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্বে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার হন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত