তুফায়েল আহমদ

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) কমিশনের বৈঠক থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ সাংবাদিকদের বলেছেন, রোববারের বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোনো দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি নির্বাচন ‘একতরফা’, ‘রাতের ভোট’ ও ‘ডামি’র তকমা পেয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্য যেকোনো নির্বাচনের দিক থেকে আলাদা। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালটের পাশাপাশি এবার একই দিনে গণভোট হবে। দুটি ভিন্ন ব্যালটে ভোট প্রদানের বিষয় বিবেচনায় রেখে ও ভোটারদের সুবিধার্থে ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে কমিশন। অর্থাৎ প্রথাগত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টার পরিবর্তে ভোটগ্রহণ বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলতে পারে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে গোপন বুথের সংখ্যা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক– আসলে নির্বাচনী তফসিল কী, কী থাকে এতে এবং কেন বা এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
সাধারণত নির্বাচনী তফসিল হলো নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক সূচনা। সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনের জন্য যে সময়সূচি বা দিনক্ষণ নির্ধারণ করে, তাকেই নির্বাচনী পরিভাষায় তফসিল বলা হয়।
এটি কেবল ভোটের তারিখ নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনের রূপরেখা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যমে এই সময়সূচি ঘোষণা করেন, তখন থেকেই মূলত দেশে নির্বাচনী আবহ বা আইনি বাধ্যবাধকতা শুরু হয়ে যায়।
আরপিও-এর গেজেট অনুসারে, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলো নির্বাচন কমিশনকে ‘প্রয়োজনীয় সহায়তা’ দিতে বাধ্য। এছাড়া ডিসি, এসপি, ইউএনও, পুলিশ সকলেই নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুসরণ করবে। অর্থাৎ পুরো সময়টিতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় কাজ করে।
তফসিল ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও ভোটারদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আনুষ্ঠানিক বার্তা দেওয়া।
তফসিলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনক্ষণ। তফসিলে উল্লেখ থাকে যে, আগ্রহী প্রার্থীরা কত তারিখের মধ্যে তাদের মনোনয়নপত্র সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিতে পারবেন।
সাধারণত তফসিল ঘোষণার পর থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন সময় দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের হলফনামা, সম্পদের বিবরণী এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ মনোনয়নপত্র জমা দেন।
তফসিলে উল্লেখ করা এই নির্দিষ্ট তারিখের পর আর কোনো মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয় না। এই সময়সীমা পার হওয়ার পরই বোঝা যায়, কোন আসনে কতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর তফসিলে উল্লেখ করা পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো মনোনয়নপত্র যাছাই-বাছাই পর্ব। এই ধাপে রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রার্থীদের জমা দেওয়া নথিপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন। প্রার্থীর বয়স, নাগরিকত্ব, ঋণখেলাপি বা বিলখেলাপি হওয়ার তথ্য, ফৌজদারি মামলার তথ্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিষয় যাচাই করা হয়।
কোনো তথ্যে গরমিল থাকলে বা অসম্পূর্ণ হলে রিটার্নিং কর্মকর্তা সেই মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারেন। তফসিলে এই বাছাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট এক বা একাধিক দিন বরাদ্দ থাকে।
বাছাইপর্বে যাদের মনোনয়নপত্র বৈধ বলে গণ্য হয়, তারা সবাই যে নির্বাচনে অংশ নেবেন এমনটি নাও হতে পারে। রাজনৈতিক সমীকরণ, দলীয় সিদ্ধান্ত বা ব্যক্তিগত কারণে অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চান। তাই তফসিলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা থাকে। এই তারিখের মধ্যে কোনো প্রার্থী চাইলে লিখিতভাবে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।
প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেন। যারা এই তালিকার মধ্যে থাকবেন, কেবল তারাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং ব্যালট পেপারে তাদের নাম ও প্রতীক থাকবে।
তফসিলের অন্যতম অংশ হলো প্রতীক বরাদ্দের দিন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরপরই, সাধারণত পরদিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় প্রতীক পায়, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত বিভিন্ন প্রতীক থেকে লটারির মাধ্যমে বা পছন্দের ভিত্তিতে প্রতীক দেওয়া হয়।
তফসিলে উল্লেখ করা এই প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রতীক বরাদ্দের আগে কোনো প্রার্থী জনসভা, মিছিল বা পোস্টার লাগিয়ে প্রচারণা চালাতে পারেন না। প্রতীক পাওয়ার পর থেকে ভোটগ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রার্থীরা আইন মেনে প্রচারণা চালানোর সুযোগ পান।
তফসিলের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অংশটি হলো ভোটগ্রহণের তারিখ। নির্বাচন কমিশন এই দিনটি ঠিক করার আগে সরকারি ছুটি, পরীক্ষার সময়সূচি, ধর্মীয় উৎসব ও আবহাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখে।
তফসিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে যে, কোন তারিখে ও দিনের কোন সময়ে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়মে সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যেহেতু আসন্ন নির্বাচনে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, তাই ভোটারদের দুটি ভিন্ন ব্যালট পেপারে সিল দিতে হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি ভোটারের বুথের ভেতরে একটু বেশি সময় লাগবে।
এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত করার পরিকল্পনা করছে।
তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে নির্বাচনী আচরণবিধি বলবৎ হয়ে যায়। এর মানে হলো, মন্ত্রী, এমপি বা সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা আর সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। তারা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা অনুদান ঘোষণা করতে পারেন না।
তফসিল ঘোষণার পর সরকার কেবল রুটিন মাফিক কাজ চালিয়ে যায়, ভোটারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন নীতিনির্ধারণী কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না । মূলত তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
যদিও মূল তফসিলে সাধারণত বড় ধাপগুলোর উল্লেখ থাকে, তবে এর সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ার একটি সময়সূচিও জড়িত থাকে। রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেন, তখন সেই প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারেন। আবার কারো মনোনয়নপত্র বৈধ হলে তার বিরুদ্ধেও অন্য প্রার্থী আপিল করতে পারেন। তফসিলে এই আপিল দায়ের এবং তা নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশন একটি ট্রাইব্যুনাল বা আপিল কর্তৃপক্ষের মতো কাজ করে এই অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করে। প্রতীক বরাদ্দের আগেই এই আপিল প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়, যাতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করতে কোনো আইনি জটিলতা না থাকে।
এবারের তফসিল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আলাদা হওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রস্তাবিত গণভোট। জাতীয় নির্বাচনের তফসিলে সাধারণত সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের বিষয়ই মুখ্য থাকে। কিন্তু এবার একই তফসিলে গণভোটের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট পেপার ছাপানো, প্রশ্ন নির্ধারণ ও গণভোটের ফলাফল কীভাবে গণনা করা হবে—সে বিষয়গুলোও এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হবে।
নির্বাচন কমিশনকে এবার দ্বিগুণ লজিস্টিকস বা রসদ সামলাতে হবে। গোপন বুথের সংখ্যা বাড়ানোর যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা মূলত এই দ্বৈত ভোটদান প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার জন্যই। তফসিলে এই বিশেষ ব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে।
নির্বাচনী তফসিল কেবল তারিখের ঘোষণা নয়, গণতন্ত্রের মহাযজ্ঞ পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ ব্লু-প্রিন্ট বা নকশা। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে বাছাই, প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দ এবং সর্বশেষ ভোটগ্রহণ—প্রতিটি ধাপের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা এই তফসিলে বেঁধে দেওয়া হয়।
আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে যে তফসিল ঘোষিত হতে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করতে পারে, বিশেষ করে গণভোট ও সময় বর্ধিতকরণের প্রেক্ষাপটে। নির্বাচন কমিশন রোববার তাদের বৈঠকে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে, তার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হবে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ। ভোটার, প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দল—সবার চোখ এখন নির্বাচন কমিশনের সেই ঘোষণার দিকে।
তথ্যসূত্র: নির্বাচন কমিশন, বিবিসি, দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র : নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন (ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী ও ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ)

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) কমিশনের বৈঠক থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ সাংবাদিকদের বলেছেন, রোববারের বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ৭ থেকে ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোনো দিন প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার আমলে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি নির্বাচন ‘একতরফা’, ‘রাতের ভোট’ ও ‘ডামি’র তকমা পেয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর এবারের নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্য যেকোনো নির্বাচনের দিক থেকে আলাদা। কারণ, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যালটের পাশাপাশি এবার একই দিনে গণভোট হবে। দুটি ভিন্ন ব্যালটে ভোট প্রদানের বিষয় বিবেচনায় রেখে ও ভোটারদের সুবিধার্থে ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে কমিশন। অর্থাৎ প্রথাগত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টার পরিবর্তে ভোটগ্রহণ বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলতে পারে। এছাড়া ভোটকেন্দ্রে গোপন বুথের সংখ্যা বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক– আসলে নির্বাচনী তফসিল কী, কী থাকে এতে এবং কেন বা এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
সাধারণত নির্বাচনী তফসিল হলো নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক সূচনা। সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনের জন্য যে সময়সূচি বা দিনক্ষণ নির্ধারণ করে, তাকেই নির্বাচনী পরিভাষায় তফসিল বলা হয়।
এটি কেবল ভোটের তারিখ নয়, বরং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরো নির্বাচনী কার্যক্রম পরিচালনের রূপরেখা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যমে এই সময়সূচি ঘোষণা করেন, তখন থেকেই মূলত দেশে নির্বাচনী আবহ বা আইনি বাধ্যবাধকতা শুরু হয়ে যায়।
আরপিও-এর গেজেট অনুসারে, তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি সংস্থাগুলো নির্বাচন কমিশনকে ‘প্রয়োজনীয় সহায়তা’ দিতে বাধ্য। এছাড়া ডিসি, এসপি, ইউএনও, পুলিশ সকলেই নির্বাচনের সময় নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুসরণ করবে। অর্থাৎ পুরো সময়টিতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনায় কাজ করে।
তফসিল ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও ভোটারদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আনুষ্ঠানিক বার্তা দেওয়া।
তফসিলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনক্ষণ। তফসিলে উল্লেখ থাকে যে, আগ্রহী প্রার্থীরা কত তারিখের মধ্যে তাদের মনোনয়নপত্র সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে জমা দিতে পারবেন।
সাধারণত তফসিল ঘোষণার পর থেকে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জন্য বেশ কিছুদিন সময় দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাদের হলফনামা, সম্পদের বিবরণী এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্রসহ মনোনয়নপত্র জমা দেন।
তফসিলে উল্লেখ করা এই নির্দিষ্ট তারিখের পর আর কোনো মনোনয়নপত্র গ্রহণ করা হয় না। এই সময়সীমা পার হওয়ার পরই বোঝা যায়, কোন আসনে কতজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হওয়ার পর তফসিলে উল্লেখ করা পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো মনোনয়নপত্র যাছাই-বাছাই পর্ব। এই ধাপে রিটার্নিং কর্মকর্তারা প্রার্থীদের জমা দেওয়া নথিপত্র পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন। প্রার্থীর বয়স, নাগরিকত্ব, ঋণখেলাপি বা বিলখেলাপি হওয়ার তথ্য, ফৌজদারি মামলার তথ্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ক্ষেত্রে ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিষয় যাচাই করা হয়।
কোনো তথ্যে গরমিল থাকলে বা অসম্পূর্ণ হলে রিটার্নিং কর্মকর্তা সেই মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারেন। তফসিলে এই বাছাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট এক বা একাধিক দিন বরাদ্দ থাকে।
বাছাইপর্বে যাদের মনোনয়নপত্র বৈধ বলে গণ্য হয়, তারা সবাই যে নির্বাচনে অংশ নেবেন এমনটি নাও হতে পারে। রাজনৈতিক সমীকরণ, দলীয় সিদ্ধান্ত বা ব্যক্তিগত কারণে অনেক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে চান। তাই তফসিলে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য করা থাকে। এই তারিখের মধ্যে কোনো প্রার্থী চাইলে লিখিতভাবে তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন।
প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেন। যারা এই তালিকার মধ্যে থাকবেন, কেবল তারাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন এবং ব্যালট পেপারে তাদের নাম ও প্রতীক থাকবে।
তফসিলের অন্যতম অংশ হলো প্রতীক বরাদ্দের দিন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরপরই, সাধারণত পরদিন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ করা হয়। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় প্রতীক পায়, আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন কমিশন নির্ধারিত বিভিন্ন প্রতীক থেকে লটারির মাধ্যমে বা পছন্দের ভিত্তিতে প্রতীক দেওয়া হয়।
তফসিলে উল্লেখ করা এই প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই মূলত আনুষ্ঠানিক নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, প্রতীক বরাদ্দের আগে কোনো প্রার্থী জনসভা, মিছিল বা পোস্টার লাগিয়ে প্রচারণা চালাতে পারেন না। প্রতীক পাওয়ার পর থেকে ভোটগ্রহণের ৪৮ ঘণ্টা আগ পর্যন্ত প্রার্থীরা আইন মেনে প্রচারণা চালানোর সুযোগ পান।
তফসিলের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অংশটি হলো ভোটগ্রহণের তারিখ। নির্বাচন কমিশন এই দিনটি ঠিক করার আগে সরকারি ছুটি, পরীক্ষার সময়সূচি, ধর্মীয় উৎসব ও আবহাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখে।
তফসিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে যে, কোন তারিখে ও দিনের কোন সময়ে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়মে সাধারণত সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ চলে। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। যেহেতু আসন্ন নির্বাচনে একই দিনে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, তাই ভোটারদের দুটি ভিন্ন ব্যালট পেপারে সিল দিতে হবে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিটি ভোটারের বুথের ভেতরে একটু বেশি সময় লাগবে।
এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়িয়ে বিকেল ৫টা পর্যন্ত করার পরিকল্পনা করছে।
তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দেশে নির্বাচনী আচরণবিধি বলবৎ হয়ে যায়। এর মানে হলো, মন্ত্রী, এমপি বা সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা আর সরকারি প্রটোকল ব্যবহার করে কোনো ধরনের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারেন না। তারা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন বা অনুদান ঘোষণা করতে পারেন না।
তফসিল ঘোষণার পর সরকার কেবল রুটিন মাফিক কাজ চালিয়ে যায়, ভোটারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এমন নীতিনির্ধারণী কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে না । মূলত তফসিল ঘোষণার মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়।
যদিও মূল তফসিলে সাধারণত বড় ধাপগুলোর উল্লেখ থাকে, তবে এর সঙ্গে আইনি প্রক্রিয়ার একটি সময়সূচিও জড়িত থাকে। রিটার্নিং কর্মকর্তা যখন কোনো প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করেন, তখন সেই প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারেন। আবার কারো মনোনয়নপত্র বৈধ হলে তার বিরুদ্ধেও অন্য প্রার্থী আপিল করতে পারেন। তফসিলে এই আপিল দায়ের এবং তা নিষ্পত্তির জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
নির্বাচন কমিশন একটি ট্রাইব্যুনাল বা আপিল কর্তৃপক্ষের মতো কাজ করে এই অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি করে। প্রতীক বরাদ্দের আগেই এই আপিল প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়, যাতে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত করতে কোনো আইনি জটিলতা না থাকে।
এবারের তফসিল অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আলাদা হওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রস্তাবিত গণভোট। জাতীয় নির্বাচনের তফসিলে সাধারণত সংসদ সদস্যদের নির্বাচনের বিষয়ই মুখ্য থাকে। কিন্তু এবার একই তফসিলে গণভোটের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। গণভোটের জন্য আলাদা ব্যালট পেপার ছাপানো, প্রশ্ন নির্ধারণ ও গণভোটের ফলাফল কীভাবে গণনা করা হবে—সে বিষয়গুলোও এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অংশ হবে।
নির্বাচন কমিশনকে এবার দ্বিগুণ লজিস্টিকস বা রসদ সামলাতে হবে। গোপন বুথের সংখ্যা বাড়ানোর যে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা মূলত এই দ্বৈত ভোটদান প্রক্রিয়াকে মসৃণ করার জন্যই। তফসিলে এই বিশেষ ব্যবস্থার প্রতিফলন দেখা যেতে পারে।
নির্বাচনী তফসিল কেবল তারিখের ঘোষণা নয়, গণতন্ত্রের মহাযজ্ঞ পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ ব্লু-প্রিন্ট বা নকশা। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে বাছাই, প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দ এবং সর্বশেষ ভোটগ্রহণ—প্রতিটি ধাপের জন্য নির্ধারিত সময়সীমা এই তফসিলে বেঁধে দেওয়া হয়।
আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে যে তফসিল ঘোষিত হতে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় যোগ করতে পারে, বিশেষ করে গণভোট ও সময় বর্ধিতকরণের প্রেক্ষাপটে। নির্বাচন কমিশন রোববার তাদের বৈঠকে যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে, তার ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হবে আগামী দিনের রাজনীতির গতিপথ। ভোটার, প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দল—সবার চোখ এখন নির্বাচন কমিশনের সেই ঘোষণার দিকে।
তথ্যসূত্র: নির্বাচন কমিশন, বিবিসি, দক্ষিণ এশিয়ায় গণতন্ত্র : নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন (ড. সাবের আহমেদ চৌধুরী ও ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ)

লাতিন আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে ভেনেজুয়েলা আজ এক ভয়াবহ দ্বৈরথের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলভাণ্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটে ধুঁকছে।
১৭ ঘণ্টা আগে
দ্রুতই বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার সমীকরণ। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক’ দীর্ঘদিন অচল। দুই প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতাও তুঙ্গে।
১ দিন আগে
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে গত ২৬ নভেম্বর দুই ন্যাশনাল গার্ড সদস্যের ওপর গুলি করা হয়। এতে সারাহ বেকস্ট্রম নিহত ও তাঁর সহকর্মী অ্যান্ড্রু ওলফ গুরুতর আহত হন। এক আফগান নাগরিকের বিরুদ্ধে এই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
২ দিন আগে
পুতিনের দিল্লি সফর মূলত বাস্তববাদী স্বার্থের প্রতিফলন। ভারতের জন্য এটি প্রতিরক্ষা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সুযোগ, আর রাশিয়ার জন্য অর্থনৈতিক সহায়তার পথ অব্যাহত রাখার উপায়। যুক্তরাষ্ট্রের চাপ ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের মধ্যেও দুই দেশ তাদের সম্পর্ক ধরে রাখছে।
২ দিন আগে