একাত্তরে শেলাবুনিয়া গ্রামের মানুষদের দেওয়া কথা রেখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকব।’ চিরকালের জন্য এই বাংলার মাটির অংশ হয়ে গেলেন ফাদার মারিনো রিগন।
স্ট্রিম ডেস্ক

‘ফাদার, আপনি চলে যান। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।’ শেলাবুনিয়ার গ্রামবাসী অনুরোধ করেন তাঁকে। শান্ত চোখে তাকালেন তিনি। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘আমার সন্তানেরা বিপদে, আর আমি বাবা হয়ে পালিয়ে যাব? আমি কোথাও যাব না। তোমাদের সঙ্গেই থাকব, তোমাদের সঙ্গেই মরব।’ শেলাবুনিয়া গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের ইতালিয়ান ফাদার মারিনো রিগন কোথাও গেলেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেকে গেলেন ওই গ্রামে।
বলছি, ১৯৭১ সালের কথা। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রাম। চারদিকে থমথমে পরিবেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে মারছে মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল বিদেশি নাগরিক ও মিশনারিদের। অনেকেই জীবন বাঁচাতে নিজ দেশে পাড়ি জমাচ্ছিলেন। কিন্তু একচুলও নড়লেন না ফাদার মারিনো রিগন।
যুদ্ধ শুরু হতেই ফাদার রিগন তাঁর গির্জা ও থাকার ঘরটি পুরোপুরি পাল্টে ফেললেন। ঈশ্বরের উপাসনালয় হয়ে উঠল এক গোপন হাসপাতাল। রিগনের কোনো ডাক্তারি ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু যুদ্ধের প্রয়োজনে তিনি হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর সার্জন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ওষুধ কিনলেন। স্থানীয় মেয়েদের দিলেন নার্সিং প্রশিক্ষণ। সুন্দরবনের গহিনে গড়ে তুললেন এক অভয়ারণ্য। যেখানে পাকিস্তানি বুলেটে ক্ষতবিক্ষত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসা নিতে আসতেন।
ফাদার রিগনের জীবনের সবচেয়ে বড় অগ্নিপরীক্ষা ছিল হেমায়েত বাহিনীর প্রধান, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমকে বাঁচানো। জুলাই মাসের এক রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিনের চোয়াল উড়ে যায়। মুখমণ্ডল হয়ে যায় চূর্ণবিচূর্ণ। এই অবস্থায় তাঁকে বাঁচাতে পারে এমন কোনো হাসপাতাল আশেপাশে ছিল না। সঙ্গীরা তাঁকে নিয়ে এলেন ফাদার রিগনের কাছে। রিগন হেমায়েত উদ্দিনের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলেন। কিন্তু হাত কাঁপল না তাঁর। তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করে অস্ত্রোপচার শুরু করলেন। সীমিত যন্ত্রপাতি আর সামান্য অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হেমায়েতের ক্ষতবিক্ষত মুখমণ্ডল জোড়া লাগালেন তিনি।
ফাদার মারিনো রিগনের এই গল্পটি শুধু সাহসিকতার গল্প নয়, এটি এমন এক ‘হিলারের’ গল্প, যিনি ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যুদ্ধের ময়দানে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয়স্থল।

ভালোবেসেছিলেন বাংলার সংস্কৃতিকে
শুধু যুদ্ধ নয়, ফাদার রিগন ভালোবেসেছিলেন বাংলার সংস্কৃতিকে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’, লালন সাঁইয়ের গান, আর জসীম উদ্দীনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, ‘আমি ইতালিতে জন্মেছি বটে, কিন্তু আমার আত্মা বাঙালি।’
২০০১ সালে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে ইতালিতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। রিগন ফিরে গেলেন, কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইল সুন্দরবনের সেই নোনা হাওয়ায়, শেলাবুনিয়ার সেই কাদামাটিতে।
২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর। ইতালির ভিচেঞ্জায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯২ বছর বয়সে মারা যান ফাদার মারিনো রিগন। মৃত্যুর আগে তাঁর স্বজনদের এবং বাংলাদেশ সরকারকে এক অদ্ভুত অনুরোধ করে যান তিনি। বলেন, ‘আমি ইতালির মাটিতে শুতে চাই না। আমার শরীরটা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ো। আমি আমার শেলাবুনিয়ার মাটিতে, আমার ভালোবাসার মানুষের পাশে চিরনিদ্রায় শুতে চাই।’
রিগনের এই অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করা হয়। মৃত্যুর এক বছর পর, ২০১৮ সালে ২১ অক্টোবর ইতালি থেকে বাংলাদেশে উড়িয়ে আনা হয় তাঁর কফিনবন্দি মরদেহ।
দৃশ্যটি কল্পনা করুন—একটি কফিন প্লেন থেকে নামছে। সেই কফিনে শুয়ে আছেন একজন ইতালিয়ান, অথচ কফিনটি মোড়ানো বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকায়। তাঁকে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্মান, গার্ড অব অনার।
শেলাবুনিয়ার গির্জার পাশে তাঁর নিজের হাতে গড়া সেই মাটির কাছাকাছি সমাহিত করা হয় তাঁকে।
একাত্তরে শেলাবুনিয়া গ্রামের মানুষদের দেওয়া কথা রেখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকব।’ চিরকালের জন্য এই বাংলার মাটির অংশ হয়ে গেলেন ফাদার মারিনো রিগন।

‘ফাদার, আপনি চলে যান। ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে।’ শেলাবুনিয়ার গ্রামবাসী অনুরোধ করেন তাঁকে। শান্ত চোখে তাকালেন তিনি। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, ‘আমার সন্তানেরা বিপদে, আর আমি বাবা হয়ে পালিয়ে যাব? আমি কোথাও যাব না। তোমাদের সঙ্গেই থাকব, তোমাদের সঙ্গেই মরব।’ শেলাবুনিয়া গ্রামের ক্যাথলিক মিশনের ইতালিয়ান ফাদার মারিনো রিগন কোথাও গেলেন না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে থেকে গেলেন ওই গ্রামে।
বলছি, ১৯৭১ সালের কথা। সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে মোংলার শেলাবুনিয়া গ্রাম। চারদিকে থমথমে পরিবেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গ্রাম পুড়িয়ে দিচ্ছে, নির্বিচারে মারছে মানুষ। নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ ছিল বিদেশি নাগরিক ও মিশনারিদের। অনেকেই জীবন বাঁচাতে নিজ দেশে পাড়ি জমাচ্ছিলেন। কিন্তু একচুলও নড়লেন না ফাদার মারিনো রিগন।
যুদ্ধ শুরু হতেই ফাদার রিগন তাঁর গির্জা ও থাকার ঘরটি পুরোপুরি পাল্টে ফেললেন। ঈশ্বরের উপাসনালয় হয়ে উঠল এক গোপন হাসপাতাল। রিগনের কোনো ডাক্তারি ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু যুদ্ধের প্রয়োজনে তিনি হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর সার্জন। নিজের জমানো টাকা দিয়ে ওষুধ কিনলেন। স্থানীয় মেয়েদের দিলেন নার্সিং প্রশিক্ষণ। সুন্দরবনের গহিনে গড়ে তুললেন এক অভয়ারণ্য। যেখানে পাকিস্তানি বুলেটে ক্ষতবিক্ষত মুক্তিযোদ্ধারা চিকিৎসা নিতে আসতেন।
ফাদার রিগনের জীবনের সবচেয়ে বড় অগ্নিপরীক্ষা ছিল হেমায়েত বাহিনীর প্রধান, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমকে বাঁচানো। জুলাই মাসের এক রক্তক্ষয়ী সম্মুখযুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিনের চোয়াল উড়ে যায়। মুখমণ্ডল হয়ে যায় চূর্ণবিচূর্ণ। এই অবস্থায় তাঁকে বাঁচাতে পারে এমন কোনো হাসপাতাল আশেপাশে ছিল না। সঙ্গীরা তাঁকে নিয়ে এলেন ফাদার রিগনের কাছে। রিগন হেমায়েত উদ্দিনের অবস্থা দেখে শিউরে উঠলেন। কিন্তু হাত কাঁপল না তাঁর। তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করে অস্ত্রোপচার শুরু করলেন। সীমিত যন্ত্রপাতি আর সামান্য অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে হেমায়েতের ক্ষতবিক্ষত মুখমণ্ডল জোড়া লাগালেন তিনি।
ফাদার মারিনো রিগনের এই গল্পটি শুধু সাহসিকতার গল্প নয়, এটি এমন এক ‘হিলারের’ গল্প, যিনি ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যুদ্ধের ময়দানে হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয়স্থল।

ভালোবেসেছিলেন বাংলার সংস্কৃতিকে
শুধু যুদ্ধ নয়, ফাদার রিগন ভালোবেসেছিলেন বাংলার সংস্কৃতিকে। রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’, লালন সাঁইয়ের গান, আর জসীম উদ্দীনের ‘নকশি কাঁথার মাঠ’ ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, ‘আমি ইতালিতে জন্মেছি বটে, কিন্তু আমার আত্মা বাঙালি।’
২০০১ সালে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে ইতালিতে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেন। রিগন ফিরে গেলেন, কিন্তু তাঁর মন পড়ে রইল সুন্দরবনের সেই নোনা হাওয়ায়, শেলাবুনিয়ার সেই কাদামাটিতে।
২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর। ইতালির ভিচেঞ্জায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯২ বছর বয়সে মারা যান ফাদার মারিনো রিগন। মৃত্যুর আগে তাঁর স্বজনদের এবং বাংলাদেশ সরকারকে এক অদ্ভুত অনুরোধ করে যান তিনি। বলেন, ‘আমি ইতালির মাটিতে শুতে চাই না। আমার শরীরটা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়ো। আমি আমার শেলাবুনিয়ার মাটিতে, আমার ভালোবাসার মানুষের পাশে চিরনিদ্রায় শুতে চাই।’
রিগনের এই অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করা হয়। মৃত্যুর এক বছর পর, ২০১৮ সালে ২১ অক্টোবর ইতালি থেকে বাংলাদেশে উড়িয়ে আনা হয় তাঁর কফিনবন্দি মরদেহ।
দৃশ্যটি কল্পনা করুন—একটি কফিন প্লেন থেকে নামছে। সেই কফিনে শুয়ে আছেন একজন ইতালিয়ান, অথচ কফিনটি মোড়ানো বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকায়। তাঁকে দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্মান, গার্ড অব অনার।
শেলাবুনিয়ার গির্জার পাশে তাঁর নিজের হাতে গড়া সেই মাটির কাছাকাছি সমাহিত করা হয় তাঁকে।
একাত্তরে শেলাবুনিয়া গ্রামের মানুষদের দেওয়া কথা রেখেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকব।’ চিরকালের জন্য এই বাংলার মাটির অংশ হয়ে গেলেন ফাদার মারিনো রিগন।

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। প্যারিসের অরলি বিমানবন্দর। হাড়কাঁপানো শীতের দুপুর। রানওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের বিশাল বোয়িং ৭২০ বিমান, ফ্লাইট ৭১২। গন্তব্য করাচি হয়ে ঢাকা। সিটবেল্ট বেঁধে তৈরি যাত্রীরা। ইঞ্জিনে থ্রাস্ট দেওয়ার অপেক্ষায় পাইলট।
১ দিন আগে
এআই চ্যাটবট খুলে প্রথম উত্তরটাই আমরা এখন ‘ঠিক’ ধরে নিই। দ্রুত সমাধান আমাদের তৃপ্তি দেয় ঠিকই, কিন্তু গবেষণা বলছে এই ভরসাই ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছে আমাদের নিজের ভাবনা, যাচাই আর সমালোচনামূলক চিন্তার ক্ষমতা।
১ দিন আগে
শীত এসে গেছে। তুলনামূলক আরামদায়ক হলেও ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, জ্বর হওয়ার আশঙ্কা এ সময়ে অনেক বেশি। কিন্তু এমন কেন হয়, প্রতিকারই-বা কী? পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান ও ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. ফারুক আহাম্মদ।
২ দিন আগে
১৯৭১ সাল। ঢাকা সেনানিবাস। ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর। বিলাসবহুল ড্রয়িংরুমে বসে আছেন এক শ্বেতাঙ্গ ভদ্রলোক। পরনে দামী স্যুট, হাতে জ্বলন্ত সিগার। আর সামনে ধোঁয়া ওঠা কফি। তার ঠিক উল্টো দিকে বসে আছেন পাকিস্তানের কোনো জেনারেল।
২ দিন আগে