সুমন সুবহান

লাতিন আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে ভেনেজুয়েলা আজ এক ভয়াবহ দ্বৈরথের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলভাণ্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটে ধুঁকছে। একদিকে নিকোলাস মাদুরো, যিনি সামরিক বাহিনীর আনুগত্য এবং রাশিয়া, চীন ও কিউবার মতো আন্তর্জাতিক মিত্রদের সমর্থনে কর্তৃত্ববাদী শাসন আঁকড়ে ধরে আছেন, অন্যদিকে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরো ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং মাদক পাচারের অভিযোগে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক রণসজ্জা বাড়িয়ে সরাসরি আল্টিমেটাম দিয়েছে। এই সংঘাত কেবল অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, এটি ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের এক বৃহত্তর খেলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য যেখানে পশ্চিমা গোলার্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তেল বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সেখানে মাদুরোর মিত্ররা মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক মেরুকরণকে কাজে লাগাচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দেশটিতে চলছে অতি-মুদ্রাস্ফীতি আর খাদ্য ও ওষুধের তীব্র ঘাটতি। এর ফলে প্রায় ৭৯ লাখ নাগরিক উন্নত জীবন ও নিরাপত্তার সন্ধানে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শরণার্থী সংকটে পরিণত হয়েছে।
মাদুরো-ট্রাম্পের এই দ্বৈরথ ভেনেজুয়েলাকে এক 'টাইম বোমা'র ওপর দাঁড় করিয়েছে, যার চরম মূল্য দিচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষ। এই লেখায় আমরা ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের জটিল সমীকরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
সংকটের উৎস: তেল, সমাজতন্ত্র ও অর্থনৈতিক ধস
ভেনেজুয়েলার এই সংকটের মূল কারণ নিহিত আছে একাধারে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে। বিশ্বের বৃহত্তম তেলভাণ্ডারের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দেশটি হুগো চাভেজের সমাজতান্ত্রিক নীতির দুর্বল বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক একমুখিতা থেকে সৃষ্ট এক বিষমচক্রের শিকার। এর ফলে তেলনির্ভর অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, যা দেশটিকে বর্তমান রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ক। অতিনির্ভরশীলতা ও দুর্নীতি
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রমাণিত তেলভাণ্ডারের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এটিই দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। হুগো চাভেজের ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ ধারণা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেলেও সরকার তেল রপ্তানির আয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি করে। এই অতিনির্ভরশীলতার সুযোগে, ব্যাপক দুর্নীতি এবং নিকোলাস মাদুরো সরকারের অব্যাহত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে অন্যসব উৎপাদনশীল খাত উপেক্ষিত হয়। এর ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করলে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বর্তমান মানবিক সংকটের পেছনে এটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
খ। অতিমুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্য
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ ও প্রত্যক্ষ ফল হলো দীর্ঘকাল ধরে চলা তীব্র অতিমুদ্রাস্ফীতি। তীব্র মূল্যবৃদ্ধি দেশটির জাতীয় মুদ্রা বলিভারকে কার্যত মূল্যহীন করে দিয়েছে, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আকাশ ছুঁয়ে যায়। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে, যা অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন সরকারি স্কুলশিক্ষকের মাসিক বেতন কমে মাত্র ১০-১২ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে, যা দিয়ে জীবনধারণ করা অসম্ভব। এই অর্থনৈতিক ধস লাখ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।
গ। কর্তৃত্ববাদী শাসন
ভেনেজুয়েলার সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা। মাদুরো সরকার দেশের বিরোধী দল ও গণতন্ত্রের পরিসরকে সীমিত করার মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে গিয়ে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি জুলাই ২০২৪ মাসের নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কারচুপি এবং অনিয়মের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এই নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এসব কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপগুলোর ফলে দেশে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকারের সমালোচনাকারী রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যাও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। মাদুরো সরকারের এই একনায়কতান্ত্রিক আচরণ ভেনেজুয়েলার সংকটকে গভীর ও জটিল করে তুলেছে।
ট্রাম্পের আল্টিমেটাম ও সামরিক চাপ: 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' না তেলের দখল?
ভেনেজুয়েলার চলমান সংকটে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সবচেয়ে কঠোর রূপটি এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতি ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ সংকটে সামরিক উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দিয়েছে। মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন একদিকে যেমন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তেমনই অন্যদিকে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। এই আগ্রাসী নীতিকে মাদুরো সরকার তাদের তেল সম্পদ দখলের চক্রান্ত হিসেবে দেখছে, যা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ক। কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও পুরস্কার
মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার প্রধান লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। এর পাশাপাশি মাদুরো এবং তার ঘনিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং আর্থিক সম্পদ জব্দ করা হয়। পরিস্থিতি তীব্র করতে যুক্তরাষ্ট্র নিকোলাস মাদুরোকে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেতা' এবং 'মাদক পাচারকারী' হিসেবে অভিযুক্ত করে। তার গ্রেপ্তারে সহায়ক তথ্যের জন্য পুরস্কারের অঙ্ক প্রাথমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। এই পদক্ষেপগুলো মাদুরো সরকারের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছে।
খ। সামরিক রণসজ্জা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ক্যারিবীয় অঞ্চলে সরাসরি সামরিক রণসজ্জা মোতায়েন করা হয়েছে। ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদক্ষেপকে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনের অংশ হিসেবে প্রচার করলেও, এর মূল উদ্দেশ্য মাদুরো সরকারের ওপর সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা। এই নীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডসহ অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ এবং হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। অন্যদিকে সম্ভাব্য সামরিক অভিযান ঠেকাতে ভেনেজুয়েলা পাল্টা প্রস্তুতি নিয়েছে। মাদুরো সরকার তাদের সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বিশাল সংখ্যক মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রস্তুত করেছে এবং নিয়মিত সামরিক মহড়া চালিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিকে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। এই সামরিক উপস্থিতি ভেনেজুয়েলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
গ। আকাশসীমা বন্ধ ও হুমকির বার্তা
ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরোর ওপর চাপ বাড়াতে আকাশসীমা ব্যবহারেও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ঘোষণা করে যে, ভেনেজুয়েলার সামরিক বা আধা-সামরিক বিমানগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনলে তাদের গুলি করে ভূপাতিত করা হতে পারে। এই পদক্ষেপ মাদুরো সরকারকে কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে একঘরে করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় কূটনৈতিক রীতির বাইরে গিয়ে মাদুরোকে ফোনে আল্টিমেটাম দেন। তিনি মাদুরোকে ক্ষমতা ছেড়ে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার জন্য সরাসরি আহ্বান জানান, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। এই বার্তাগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের ভেনেজুয়েলা নীতিতে আগ্রাসী মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়।
ঘ। ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা নীতির এই আগ্রাসী রূপটির মূল কারণ শুধুমাত্র গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না, বরং এর পেছনে কাজ করেছে সুদূরপ্রসারী ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। এই স্বার্থের কেন্দ্রে রয়েছে কারাকাসের বিশাল তেল ভাণ্ডার, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য একটি লোভনীয় সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্র এই তেল ভাণ্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিম গোলার্ধে তাদের ঐতিহ্যবাহী আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। অন্যদিকে মাদুরো সরকার এবং তাদের মিত্ররা এই সামরিক তৎপরতাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে এটিকে 'ঔপনিবেশিক হুমকি' এবং ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদ দখলের চক্রান্ত হিসেবেই দেখছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই দ্বৈরথকে অভ্যন্তরীণ সংঘাত থেকে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক খেলার মঞ্চে রূপান্তরিত করেছে।
আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন: রাশিয়া, চীন ও বৈশ্বিক মেরুকরণ
মাদুরো সরকারের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মূল চাবিকাঠি হলো রাশিয়া, চীন এবং ইরানের মতো বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত অবিচল অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন। এই দেশগুলো মাদুরোর পাশে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।
ক। রাশিয়া ও চীনের কৌশলগত সমর্থন
রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলাকে বিপুল পরিমাণ ঋণ ও বিনিয়োগ দিয়েছে, যা মাদুরো সরকারকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা জোগায়। একইসঙ্গে মস্কো এবং বেইজিং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে। এছাড়াও রাশিয়া ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন বৃদ্ধিকে তাদের নিজস্ব তেল বাজারে বিকল্প সরবরাহ তৈরি করার একটি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখে।
খ। কিউবা ও ইরানের নিরাপত্তা সহযোগিতা
কিউবা ও ইরান মাদুরো সরকারকে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন প্রদান করে। কিউবার গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক উপদেষ্টারা মাদুরোর নিরাপত্তা ও সামরিক অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে। এর পাশাপাশি ইরান ও অন্যান্য মিত্ররা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভেনেজুয়েলার তেল ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা করে। এই আন্তর্জাতিক মেরুকরণ ভেনেজুয়েলাকে সিরিয়ার মতো একটি 'বিদেশি স্বার্থের দাবার ঘুঁটিতে' পরিণত করেছে, যেখানে বহিরাগত শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যেকার সংঘাতের কারণে সংকটটির সমাধান না হয়ে বরং আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
ট্রাম্প-মাদুরো দ্বৈরথের চূড়ান্ত ও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে ভেনেজুয়েলার সাধারণ নাগরিকদের। এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাতের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় এক নজিরবিহীন মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এরফলে লাখ লাখ মানুষ বাধ্য হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় খুঁজছে, যা লাতিন আমেরিকায় এক বিশাল শরণার্থী সংকটের সৃষ্টি করেছে।
ক। বিশাল শরণার্থী সংকট
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় এক নজিরবিহীন বিশাল শরণার্থী সংকটের জন্ম দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৯ লাখের বেশি মানুষ উন্নত জীবন, খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপত্তার সন্ধানে তাদের জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই ব্যাপক দেশত্যাগের ঘটনা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অভিবাসী সংকটে পরিণত হয়েছে, যা সিরিয়ার শরণার্থীর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। এই শরণার্থীরা মূলত কলম্বিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, চিলি এবং ব্রাজিলসহ অন্যান্য লাতিন আমেরিকান দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই মানবীয় ঢল শুধু ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রকাশ করে না বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ব্যাপক আর্থ-সামাজিক চাপও সৃষ্টি করেছে, যা এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
খ। অভ্যন্তরীণ ভোগান্তি
ভেনেজুয়েলার সাধারণ নাগরিকদের জন্য অভ্যন্তরীণ ভোগান্তি দৈনন্দিন জীবনের এক চরম বাস্তবতা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশে বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং ওষুধের তীব্র ঘাটতি একটি নিত্যদিনের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়মিত ঘটনা, যা জনজীবন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। মাদুরো সরকারের অব্যাহত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং তার সঙ্গে যুক্ত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মৌলিক চাহিদা মেটানোর অক্ষমতা এবং মুদ্রার দ্রুত পতন জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই দ্বৈরথের সবচেয়ে বড় শিকার দেশের অভ্যন্তরে থাকা সাধারণ মানুষজন।
ট্রাম্প-মাদুরো দ্বৈরথ ভেনেজুয়েলাকে এক 'টাইম বোমা'র ওপর দাঁড় করিয়েছে, যা যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রাসী সামরিক প্রস্তুতি এবং কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো মাদুরোর অনমনীয় কর্তৃত্ববাদী অবস্থানকে আরও মজবুত করেছে। ওয়াশিংটন হয়তো মাদুরোকে উৎখাত করে স্থিতিশীলতা ফেরাতে চাইছে, কিন্তু বিশ্লেষকদের আশঙ্কা এই কঠোর নীতির কারণে উল্টো মাদুরোর জাতীয়তাবাদী সমর্থন আরও বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং আন্তর্জাতিক সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকির মধ্যে থাকা ভেনেজুয়েলার ভবিষ্যৎ তাই অত্যন্ত অনিশ্চিত। মাদুরো যদি চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে শেষ পর্যন্ত টিকে যান, তবে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাব মারাত্মকভাবে দুর্বল হবে। আবার সেখানে যদি কোনো প্রকারের সামরিক হস্তক্ষেপ বা অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ঘটে, তবে অঞ্চলটি গভীর অনিশ্চয়তা, দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং নজিরবিহীন শরণার্থী সংকটে নিমজ্জিত হবে। তবে এই ভূ-রাজনৈতিক দ্বৈরথের ফলাফল যাই হোক না কেন ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের কষ্টের অবসান কবে হবে, সে উত্তর এখনও অজানা। কারণ আন্তর্জাতিক শক্তির এই খেলায় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং মানবিক সংকটের সমাধান ক্রমশই গৌণ হয়ে উঠেছে।

লাতিন আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে ভেনেজুয়েলা আজ এক ভয়াবহ দ্বৈরথের কেন্দ্রবিন্দু—যেখানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তেলভাণ্ডারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি দেশ গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটে ধুঁকছে। একদিকে নিকোলাস মাদুরো, যিনি সামরিক বাহিনীর আনুগত্য এবং রাশিয়া, চীন ও কিউবার মতো আন্তর্জাতিক মিত্রদের সমর্থনে কর্তৃত্ববাদী শাসন আঁকড়ে ধরে আছেন, অন্যদিকে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরো ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং মাদক পাচারের অভিযোগে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক রণসজ্জা বাড়িয়ে সরাসরি আল্টিমেটাম দিয়েছে। এই সংঘাত কেবল অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা দখলের লড়াই নয়, এটি ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের এক বৃহত্তর খেলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য যেখানে পশ্চিমা গোলার্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও তেল বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, সেখানে মাদুরোর মিত্ররা মার্কিন হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক মেরুকরণকে কাজে লাগাচ্ছে।
বর্তমানে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দেশটিতে চলছে অতি-মুদ্রাস্ফীতি আর খাদ্য ও ওষুধের তীব্র ঘাটতি। এর ফলে প্রায় ৭৯ লাখ নাগরিক উন্নত জীবন ও নিরাপত্তার সন্ধানে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম শরণার্থী সংকটে পরিণত হয়েছে।
মাদুরো-ট্রাম্পের এই দ্বৈরথ ভেনেজুয়েলাকে এক 'টাইম বোমা'র ওপর দাঁড় করিয়েছে, যার চরম মূল্য দিচ্ছে দেশটির সাধারণ মানুষ। এই লেখায় আমরা ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ বিপর্যয় এবং আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের জটিল সমীকরণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।
সংকটের উৎস: তেল, সমাজতন্ত্র ও অর্থনৈতিক ধস
ভেনেজুয়েলার এই সংকটের মূল কারণ নিহিত আছে একাধারে অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে। বিশ্বের বৃহত্তম তেলভাণ্ডারের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দেশটি হুগো চাভেজের সমাজতান্ত্রিক নীতির দুর্বল বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক একমুখিতা থেকে সৃষ্ট এক বিষমচক্রের শিকার। এর ফলে তেলনির্ভর অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, যা দেশটিকে বর্তমান রাজনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ক। অতিনির্ভরশীলতা ও দুর্নীতি
ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রমাণিত তেলভাণ্ডারের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এটিই দেশটির বর্তমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ। হুগো চাভেজের ‘একুশ শতকের সমাজতন্ত্র’ ধারণা অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেলেও সরকার তেল রপ্তানির আয়ের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা তৈরি করে। এই অতিনির্ভরশীলতার সুযোগে, ব্যাপক দুর্নীতি এবং নিকোলাস মাদুরো সরকারের অব্যাহত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে অন্যসব উৎপাদনশীল খাত উপেক্ষিত হয়। এর ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমতে শুরু করলে ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। বর্তমান মানবিক সংকটের পেছনে এটি বড় কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
খ। অতিমুদ্রাস্ফীতি ও দারিদ্র্য
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ ও প্রত্যক্ষ ফল হলো দীর্ঘকাল ধরে চলা তীব্র অতিমুদ্রাস্ফীতি। তীব্র মূল্যবৃদ্ধি দেশটির জাতীয় মুদ্রা বলিভারকে কার্যত মূল্যহীন করে দিয়েছে, যেখানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আকাশ ছুঁয়ে যায়। এর ফলে মোট দেশজ উৎপাদন মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে, যা অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, একজন সরকারি স্কুলশিক্ষকের মাসিক বেতন কমে মাত্র ১০-১২ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে, যা দিয়ে জীবনধারণ করা অসম্ভব। এই অর্থনৈতিক ধস লাখ লাখ মানুষকে চরম দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে এবং খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে।
গ। কর্তৃত্ববাদী শাসন
ভেনেজুয়েলার সংকটের অন্যতম প্রধান কারণ হলো প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা। মাদুরো সরকার দেশের বিরোধী দল ও গণতন্ত্রের পরিসরকে সীমিত করার মাধ্যমে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করতে গিয়ে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা, গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি জুলাই ২০২৪ মাসের নির্বাচন নিয়েও ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যেখানে কারচুপি এবং অনিয়মের সুস্পষ্ট অভিযোগ উঠেছে। এই নির্বাচনকে আন্তর্জাতিক মহল থেকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এসব কর্তৃত্ববাদী পদক্ষেপগুলোর ফলে দেশে বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সরকারের সমালোচনাকারী রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যাও উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। মাদুরো সরকারের এই একনায়কতান্ত্রিক আচরণ ভেনেজুয়েলার সংকটকে গভীর ও জটিল করে তুলেছে।
ট্রাম্পের আল্টিমেটাম ও সামরিক চাপ: 'মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' না তেলের দখল?
ভেনেজুয়েলার চলমান সংকটে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সবচেয়ে কঠোর রূপটি এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের নীতি ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ সংকটে সামরিক উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে দিয়েছে। মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন একদিকে যেমন কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তেমনই অন্যদিকে ক্যারিবীয় অঞ্চলে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করে চাপ সৃষ্টি করেছে। এই আগ্রাসী নীতিকে মাদুরো সরকার তাদের তেল সম্পদ দখলের চক্রান্ত হিসেবে দেখছে, যা দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে।
ক। কঠোর নিষেধাজ্ঞা ও পুরস্কার
মাদুরো সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার প্রধান লক্ষ্য ভেনেজুয়েলার তেল রপ্তানি, যা সরকারের আয়ের প্রধান উৎস। এর পাশাপাশি মাদুরো এবং তার ঘনিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা এবং আর্থিক সম্পদ জব্দ করা হয়। পরিস্থিতি তীব্র করতে যুক্তরাষ্ট্র নিকোলাস মাদুরোকে 'আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেতা' এবং 'মাদক পাচারকারী' হিসেবে অভিযুক্ত করে। তার গ্রেপ্তারে সহায়ক তথ্যের জন্য পুরস্কারের অঙ্ক প্রাথমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। এই পদক্ষেপগুলো মাদুরো সরকারের ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছে।
খ। সামরিক রণসজ্জা
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং ক্যারিবীয় অঞ্চলে সরাসরি সামরিক রণসজ্জা মোতায়েন করা হয়েছে। ওয়াশিংটন আনুষ্ঠানিকভাবে এই পদক্ষেপকে মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ দমনের অংশ হিসেবে প্রচার করলেও, এর মূল উদ্দেশ্য মাদুরো সরকারের ওপর সামরিক ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করা। এই নীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরি ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডসহ অন্যান্য যুদ্ধজাহাজ এবং হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করেছে। অন্যদিকে সম্ভাব্য সামরিক অভিযান ঠেকাতে ভেনেজুয়েলা পাল্টা প্রস্তুতি নিয়েছে। মাদুরো সরকার তাদের সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বিশাল সংখ্যক মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রস্তুত করেছে এবং নিয়মিত সামরিক মহড়া চালিয়ে আন্তর্জাতিক শক্তিকে নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। এই সামরিক উপস্থিতি ভেনেজুয়েলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সরাসরি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
গ। আকাশসীমা বন্ধ ও হুমকির বার্তা
ট্রাম্প প্রশাসন মাদুরোর ওপর চাপ বাড়াতে আকাশসীমা ব্যবহারেও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে ঘোষণা করে যে, ভেনেজুয়েলার সামরিক বা আধা-সামরিক বিমানগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনলে তাদের গুলি করে ভূপাতিত করা হতে পারে। এই পদক্ষেপ মাদুরো সরকারকে কূটনৈতিক এবং সামরিকভাবে একঘরে করার উদ্দেশ্যে গৃহীত হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় কূটনৈতিক রীতির বাইরে গিয়ে মাদুরোকে ফোনে আল্টিমেটাম দেন। তিনি মাদুরোকে ক্ষমতা ছেড়ে নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার জন্য সরাসরি আহ্বান জানান, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিরল ঘটনা। এই বার্তাগুলো ট্রাম্প প্রশাসনের ভেনেজুয়েলা নীতিতে আগ্রাসী মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়।
ঘ। ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্য
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা নীতির এই আগ্রাসী রূপটির মূল কারণ শুধুমাত্র গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না, বরং এর পেছনে কাজ করেছে সুদূরপ্রসারী ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ। এই স্বার্থের কেন্দ্রে রয়েছে কারাকাসের বিশাল তেল ভাণ্ডার, যা বিশ্বের যেকোনো দেশের জন্য একটি লোভনীয় সম্পদ। যুক্তরাষ্ট্র এই তেল ভাণ্ডারের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিম গোলার্ধে তাদের ঐতিহ্যবাহী আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। অন্যদিকে মাদুরো সরকার এবং তাদের মিত্ররা এই সামরিক তৎপরতাকে তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে এটিকে 'ঔপনিবেশিক হুমকি' এবং ভেনেজুয়েলার তেল সম্পদ দখলের চক্রান্ত হিসেবেই দেখছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই দ্বৈরথকে অভ্যন্তরীণ সংঘাত থেকে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক খেলার মঞ্চে রূপান্তরিত করেছে।
আন্তর্জাতিক টানাপোড়েন: রাশিয়া, চীন ও বৈশ্বিক মেরুকরণ
মাদুরো সরকারের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার মূল চাবিকাঠি হলো রাশিয়া, চীন এবং ইরানের মতো বৈশ্বিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত অবিচল অর্থনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন। এই দেশগুলো মাদুরোর পাশে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর চাপের বিরুদ্ধে এক আন্তর্জাতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে।
ক। রাশিয়া ও চীনের কৌশলগত সমর্থন
রাশিয়া ও চীন ভেনেজুয়েলাকে বিপুল পরিমাণ ঋণ ও বিনিয়োগ দিয়েছে, যা মাদুরো সরকারকে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় আর্থিক সহায়তা জোগায়। একইসঙ্গে মস্কো এবং বেইজিং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হস্তক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করে। এছাড়াও রাশিয়া ভেনেজুয়েলার তেল উৎপাদন বৃদ্ধিকে তাদের নিজস্ব তেল বাজারে বিকল্প সরবরাহ তৈরি করার একটি কৌশলগত সুযোগ হিসেবে দেখে।
খ। কিউবা ও ইরানের নিরাপত্তা সহযোগিতা
কিউবা ও ইরান মাদুরো সরকারকে রাজনৈতিক ও কৌশলগত সমর্থন প্রদান করে। কিউবার গোয়েন্দা সংস্থা এবং সামরিক উপদেষ্টারা মাদুরোর নিরাপত্তা ও সামরিক অবকাঠামোকে শক্তিশালী করতে সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে। এর পাশাপাশি ইরান ও অন্যান্য মিত্ররা মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভেনেজুয়েলার তেল ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা করে। এই আন্তর্জাতিক মেরুকরণ ভেনেজুয়েলাকে সিরিয়ার মতো একটি 'বিদেশি স্বার্থের দাবার ঘুঁটিতে' পরিণত করেছে, যেখানে বহিরাগত শক্তিগুলোর নিজেদের মধ্যেকার সংঘাতের কারণে সংকটটির সমাধান না হয়ে বরং আরও জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।
ট্রাম্প-মাদুরো দ্বৈরথের চূড়ান্ত ও চরম মূল্য দিতে হচ্ছে ভেনেজুয়েলার সাধারণ নাগরিকদের। এই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংঘাতের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় এক নজিরবিহীন মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে। অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় খাদ্য, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এরফলে লাখ লাখ মানুষ বাধ্য হয়ে জন্মভূমি ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় খুঁজছে, যা লাতিন আমেরিকায় এক বিশাল শরণার্থী সংকটের সৃষ্টি করেছে।
ক। বিশাল শরণার্থী সংকট
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয় এক নজিরবিহীন বিশাল শরণার্থী সংকটের জন্ম দিয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭৯ লাখের বেশি মানুষ উন্নত জীবন, খাদ্য, ওষুধ ও নিরাপত্তার সন্ধানে তাদের জন্মভূমি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এই ব্যাপক দেশত্যাগের ঘটনা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম অভিবাসী সংকটে পরিণত হয়েছে, যা সিরিয়ার শরণার্থীর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে। এই শরণার্থীরা মূলত কলম্বিয়া, পেরু, ইকুয়েডর, চিলি এবং ব্রাজিলসহ অন্যান্য লাতিন আমেরিকান দেশে আশ্রয় নিয়েছে। এই মানবীয় ঢল শুধু ভেনেজুয়েলার অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রকাশ করে না বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর ব্যাপক আর্থ-সামাজিক চাপও সৃষ্টি করেছে, যা এই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
খ। অভ্যন্তরীণ ভোগান্তি
ভেনেজুয়েলার সাধারণ নাগরিকদের জন্য অভ্যন্তরীণ ভোগান্তি দৈনন্দিন জীবনের এক চরম বাস্তবতা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে দেশে বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং ওষুধের তীব্র ঘাটতি একটি নিত্যদিনের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়মিত ঘটনা, যা জনজীবন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের অভাবে বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। মাদুরো সরকারের অব্যাহত অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং তার সঙ্গে যুক্ত মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক বিপর্যয় সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মৌলিক চাহিদা মেটানোর অক্ষমতা এবং মুদ্রার দ্রুত পতন জনগণের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ বৃদ্ধি করেছে। এই পরিস্থিতি স্পষ্ট করে যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই দ্বৈরথের সবচেয়ে বড় শিকার দেশের অভ্যন্তরে থাকা সাধারণ মানুষজন।
ট্রাম্প-মাদুরো দ্বৈরথ ভেনেজুয়েলাকে এক 'টাইম বোমা'র ওপর দাঁড় করিয়েছে, যা যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরিত হতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রাসী সামরিক প্রস্তুতি এবং কঠোর নিষেধাজ্ঞাগুলো মাদুরোর অনমনীয় কর্তৃত্ববাদী অবস্থানকে আরও মজবুত করেছে। ওয়াশিংটন হয়তো মাদুরোকে উৎখাত করে স্থিতিশীলতা ফেরাতে চাইছে, কিন্তু বিশ্লেষকদের আশঙ্কা এই কঠোর নীতির কারণে উল্টো মাদুরোর জাতীয়তাবাদী সমর্থন আরও বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং আন্তর্জাতিক সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকির মধ্যে থাকা ভেনেজুয়েলার ভবিষ্যৎ তাই অত্যন্ত অনিশ্চিত। মাদুরো যদি চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে শেষ পর্যন্ত টিকে যান, তবে লাতিন আমেরিকায় মার্কিন প্রভাব মারাত্মকভাবে দুর্বল হবে। আবার সেখানে যদি কোনো প্রকারের সামরিক হস্তক্ষেপ বা অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান ঘটে, তবে অঞ্চলটি গভীর অনিশ্চয়তা, দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং নজিরবিহীন শরণার্থী সংকটে নিমজ্জিত হবে। তবে এই ভূ-রাজনৈতিক দ্বৈরথের ফলাফল যাই হোক না কেন ভেনেজুয়েলার সাধারণ মানুষের কষ্টের অবসান কবে হবে, সে উত্তর এখনও অজানা। কারণ আন্তর্জাতিক শক্তির এই খেলায় অর্থনীতির পুনরুদ্ধার এবং মানবিক সংকটের সমাধান ক্রমশই গৌণ হয়ে উঠেছে।

অন্তর্বর্তী সরকার গত ৩০ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে। এটি বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অধ্যাদেশের ফলে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় গঠিত হয়। এতে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা সরাসরি প্রধান বিচারপতির অধীনে আসে।
৩ ঘণ্টা আগে
ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারছেন কিনা, কোনো কারচুপি হচ্ছে কিনা কিংবা নির্বাচনী কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছেন কিনা—এসব বিষয় তদারকি করে প্রতিবেদন দেওয়াই তাদের কাজ।
১০ ঘণ্টা আগে
ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা না হলেও, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধ নির্ধারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। নির্বাচন কমিশন (ইসি) তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) কমিশনের বৈঠক থেকে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
১ দিন আগে
দ্রুতই বদলে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষমতার সমীকরণ। এই অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা-সার্ক’ দীর্ঘদিন অচল। দুই প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ ভারত-পাকিস্তানের বৈরিতাও তুঙ্গে।
১ দিন আগে