সময়টা ১৯৭৯ সাল। লন্ডনের এক ব্যস্ত বিকেল। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের কাউন্টার থেকে হঠাৎ ঘোষণা এল—‘ফ্লাইট ক্যানসেল’। বিরক্ত, ক্লান্ত যাত্রীরা ধীরে ধীরে এয়ারপোর্ট ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যাত্রীদের মধ্যে ছিলেন ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ। হুট করে তাঁর মাথায় এল এক অদ্ভুত আইডিয়া। তিনি পকেট থেকে ২০০০ ডলার বের করে একটা উড়োজাহাজ ভাড়া করলেন। তারপর টার্মিনালে ঘুরে ঘুরে যাত্রী খুঁজতে লাগলেন।
একটি বোর্ডে লিখলেন, ‘ভার্জিন এয়ারওয়েজ: মাত্র ৩৯ ডলারে ওয়ান ওয়ে টিকেট।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।
বিমান আকাশে উঠতেই সেই তরুণের মাথায় আরেকটি নতুন আইডিয়া আসলো। তিনি ভাবলেন ‘যদি আমি উড়োজাহাজ ভাড়া করেই এত সহজে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্যাসেঞ্জারদের আমার প্লেনে তুলতে পারি, তাহলে কেন নিজের একটি এয়ারলাইনস খুলছি না!’ আর এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিয়েছিল ‘ভার্জিন আটলান্টিক এয়ারলাইন্স’। তখন কে জানত যে এই ছোট্ট কোম্পানিটিই পরবর্তী এক দশকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের মতো বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় নামতে পারবে। সেদিনের সেই তরুণের নাম রিচার্ড ব্র্যানসন, যিনি ‘স্যার রিচার্ড ব্র্যানসন’ নামেও পরিচিত।
ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণে নিজের কোম্পানির তৈরি রকেটে তিন সহকর্মীকে নিয়ে মহাকাশ ঘুরে এসে রিচার্ড ব্র্যানসন। সংগৃহীত ছবিযদিও প্রথমে অনেকে ব্র্যানসনের আইডিয়াকে হাস্যকর মনে করত। কারণ এয়ারওয়েজ মার্কেটে তখন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ রীতিমত গডফাদার। বাজারের বড় অংশই তাঁদের দখলে ছিল। মার্কেট শেয়ার ৬০% এরও বেশি। সরকারও তাদের পাশে ছিল। কিন্তু ব্র্যানসন অন্যভাবে ভাবলেন। সেই সময় আকাশপথে ভ্রমণ ছিল খুবই সাদামাটা আর একঘেয়ে। ব্র্যানসন বুঝলেন, ভ্রমণকে একটু মজাদার করা যায় না?
সেই ভাবনা থেকেই ব্র্যানসন চালু করলেন ‘ইন-ফ্লাইট’ ম্যাসাজ থেরাপি, ফ্রী আইসক্রিম, আরামদায়ক কেবিন, মিনি বার, হাসিখুশি-স্টাইলিশ ইউনিফর্মে এয়ার হোস্টেস, কাস্টমারকে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেওয়া। মানুষ সেগুলো পছন্দ করতে শুরু করল। ভার্জিন আটলান্টিকের বহরে যুক্ত হতে থাকল একের পর এক নতুন বিমান।
রিচার্ড ব্র্যানসন স্কুলে খুব ভালো ও মনোযোগী ছাত্র ছিলেন না। ডিসলেক্সিয়ার কারণে তিনি লেখাপড়া ঠিকভাবে করতে পারতেন না। এর মধ্যেই ১৬ বছর বয়সে তিনি ‘স্টুডেন্ট ম্যাগাজিন’ নামে নিজের একটি ম্যাগাজিন শুরু করেন। আর এটাই ছিল তাঁর উদ্যোক্তা জীবনের শুরু।
এরপর অবশ্য ম্যাগাজিন ব্যবসায় ক্ষতি হলে ব্র্যানসন মেইল-অর্ডার রেকর্ড ব্যবসা শুরু করেন, যা পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে ‘ভার্জিন রেকর্ডস’ নামে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড সেক্স পিস্টলসও তাদের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। অথচ শুরুতে তিনি আর তার বন্ধু ফোন বুথে দাঁড়িয়ে রেকর্ড বিক্রির অর্ডার নিতেন।
রিচার্ড ব্র্যানসন। সংগৃহীত ছবিব্র্যানসন শুধু ব্যবসায়ী নন, তিনি দুঃসাহসী মানুষও। তিনি সাধারণ মানুষকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। সেখান থেকেই শুরু হয় ‘ভার্জিন গ্যালাকটিক’। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় হট-এয়ার বেলুন বানিয়ে তিনটি মহাদেশ পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। একবার পুরো বেলুন মাঝ আকাশে ছিঁড়ে গেলে তিনি সমুদ্রে পড়ে প্রায় মৃত্যুর মুখে পড়েছিলেন। শেষ মুহূর্তে উদ্ধার করা হয় তাঁকে।
রিচার্ড ব্র্যানসনের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাঁর অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাওয়ার সাহস। একবার এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি তো সবকিছুতে ঝাঁপিয়ে পড়েন, ভয় লাগে না?’ উত্তরে ব্র্যানসন বলেছেলিন, ‘যদি কেউ তোমাকে দারুণ কোনও সুযোগ দেয় আর তুমি নিশ্চিত না হও যে তুমি সেটা করতে পারবে, তবুও হ্যাঁ বলো। তারপর শিখে নাও কীভাবে সেটা করতে হবে!’
এটাই ছিল তার জীবনের নিয়ম। সাহস করে এগিয়ে যাওয়া। আর তাই তাঁর ভার্জিন গ্রুপের সুনাম আজ বিশ্বজোড়া। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসা বিমান ও টেলিযোগাযোগ থেকে শুরু করে মহাকাশযান পর্যন্ত বিস্তৃত।