leadT1ad

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, হঠাৎ কেন আলোচনায়

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনায় উঠে এসেছে। তালেবানের দখলে থাকা এই ঘাঁটি একসময় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। এখন প্রশ্ন উঠছে—আবার কি সেটি মার্কিন নিয়ন্ত্রণে যাবে?

তুফায়েল আহমদ
আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি কেন গুরুত্বপূর্ণ, হঠাৎ কেন আলোচনায়। ছবি: সংগৃহীত

একসময় আফগানিস্তানে বৃহত্তম মার্কিন সামরিক স্থাপনা ছিল বাগরাম বিমানঘাঁটি। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন কার্যক্রম আবারও বাগরাম বিমানঘাঁটিকে বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে। তালেবানের নিয়ন্ত্রিত এই ঘাঁটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন ট্রাম্প। এই প্রচেষ্টা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের দখলদারি মনোভাবের ধারাবাহিকতা নয়, বরং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা এবং মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ রক্ষার একটি বৃহত্তর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।

১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় বাগরামে বিমানঘাঁটি নির্মিত হয়েছিল। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে চালানো আগ্রাসনের পর এ ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রায় দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০২১ সালের ২ জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বাগরাম বিমানঘাঁটি ত্যাগ করে।

গত মার্চে ট্রাম্প বলেছিলেন, আফগানিস্তান ছাড়লেও বাগরামের নিয়ন্ত্রণ রাখার পরিকল্পনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের।

গত বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান, তার প্রশাসন বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনরায় নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

গত শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) ট্রাম্পের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে তালেবান সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জাকির জালালি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আফগানিস্তান আলোচনায় বসতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু কোনোভাবেই আমেরিকান সেনাদের আফগানিস্তানে আসতে দেওয়া হবে না।

জবাবে গতকাল শনিবার (২০ সেপ্টেম্বর) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রুথ সোশ্যালে ট্রাম্প বলেন, ‘যদি আফগানিস্তান বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত না দেয়, তাহলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে।’

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগরাম। যুদ্ধ পরিচালনা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম চালানোর ঘাঁটি ছিল বাগরাম।

প্রচলিত প্রবাদ মতে, যে মধ্য এশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, সে ইউরেশিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ইউরেশিয়াতেই বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলোর সম্মিলন ঘটেছে। সামরিক শক্তিতে রাশিয়া, বিশাল অর্থনীতিতে চীন এবং বিপুল জনসংখ্যা ও ক্রমবর্ধমান শক্তিতে দাঁড়িয়ে আছে ভারত।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে, আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগরাম। যুদ্ধ পরিচালনা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ এবং সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম চালানোর ঘাঁটি ছিল বাগরাম।

ট্রাম্প বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে বাগরাম কেবল আফগান যুদ্ধের একটি ধ্বংসাবশেষ নয়। সুবিশাল রানওয়ে, উন্নত চিকিৎসা সুবিধা ও কমান্ড সেন্টারের সমন্বয়ে অতুলনীয় লজিস্টিক ও কৌশলগত সুবিধার ঘাঁটি এই বাগরাম। ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য বাগরাম নিয়ন্ত্রণ করার অর্থ হলো প্রভাব খাটানোর সুযোগ, দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষমতা এবং মধ্য এশিয়ায় আমেরিকান শক্তি প্রদর্শনের একটি প্ল্যাটফর্ম।

ট্রাম্প কেন বাগরাম ফিরে চান

কৌশলগত, সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাগরাম বিমানঘাঁটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীন, রাশিয়া ও বৃহত্তর মধ্য এশিয়ার ‘পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ বাগরাম কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, তার কিছু কারণ তুলে ধরা হলো :

আফগানিস্তানে নির্মিত সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক কেন্দ্র

বাগরাম শুধু একটি বিমানঘাঁটি ছিল না, ছিল একটি বিশাল দুর্গ। অনেক আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চেয়েও দীর্ঘ রানওয়ে, সুরক্ষিত আশ্রয়কেন্দ্র, হাসপাতাল, জ্বালানি ডিপো এবং হাজার হাজার সৈন্যের থাকার ব্যবস্থা ছিল। এটি ছিল এই অঞ্চলে আমেরিকার ‘স্নায়ুকেন্দ্র’।

কাবুল থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত বাগরাম ইরান, পাকিস্তান, মধ্য এশিয়া এবং চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এখান থেকে আমেরিকা প্রায় সব দিকেই তার শক্তি প্রদর্শন করতে পারত।

চীনের স্পর্শকাতর স্থাপনার কাছাকাছি অবস্থান

ট্রাম্প বারবার উল্লেখ করেছেন যে বাগরাম চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা থেকে মাত্র ‘এক ঘণ্টার দূরত্বে’ অবস্থিত। এই তথ্যটি শতভাগ সঠিক না হলেও, এর অবস্থান চীনকে পর্যবেক্ষণের জন্য আমেরিকার সবচেয়ে কাছের সুবিধাজনক স্থান।

দীর্ঘদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে, চীন তার 'বেল্ট অ্যান্ড রোড' উদ্যোগের পরিধি বাড়াতে এবং ভারতের কাছাকাছি একটি সমরঘাঁটি স্থাপনের জন্য বাগরামের দিকে নজর রাখছে।

আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি। ছবি: সংগৃহীত
আফগানিস্তানের বাগরাম বিমানঘাঁটি। ছবি: সংগৃহীত

নজরদারি ও গোয়েন্দা তথ্যের সোনার খনি

ওয়াশিংটনের জন্য বাগরাম ধরে রাখার অর্থ ইউরেশিয়ার বিশাল অংশজুড়ে আকাশপথে নজরদারি এবং সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ। রাশিয়ার সামরিক কার্যকলাপ থেকে শুরু করে 'বেল্ট অ্যান্ড রোড'-এর অধীনে চীনের অবকাঠামো প্রকল্প পর্যন্ত সবকিছুর ব্যাপারে সতর্ক পর্যবেক্ষণের সুযোগ। এই জায়গা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে দেওয়ার অর্থ চীন, রাশিয়া কিংবা ভারতের এই শূন্যস্থানের দখল নেওয়া।

বাগরাম থেকে আমেরিকা মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার প্রভাব এবং পশ্চিমে ইরানের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণ করতে পারত।

সরবরাহ ব্যবস্থা ও বাণিজ্য পথের ওপর নিয়ন্ত্রণ

আফগানিস্তান প্রচুর অব্যবহৃত খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। পাশাপাশি বিশ্ব বাণিজ্যের অনেক করিডর আফগানিস্তান হয়েই গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন ও রাশিয়া যে অর্থনৈতিক করিডরগুলো সুরক্ষিত করতে চায়, বাগরাম থেকে সেগুলোর ওপর কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব।

সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন ও মার্কিনিদের সম্মান

আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালানোর সময় বাগরাম ছিল তালেবান, আল-কায়েদা ও আইসিসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের লঞ্চপ্যাড। এটি হারানোর ফলে এই অঞ্চলে আমেরিকার দ্রুত হামলা চালানোর ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে।

২০২১ সালে বাগরাম পরিত্যাগ করাকে বিশ্বজুড়ে একটি অপমান হিসেবে দেখা হয়েছিল। তাই বাগরাম পুনরুদ্ধার করতে পারলে শক্তিশালী বার্তার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র যে মধ্য এশিয়া থেকে পিছু হটছে না তার চাক্ষুষ প্রমাণ দেবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

২০২১ সালের জুলাইয়ে মার্কিন সেনাদের গভীর রাতে বাগরাম ত্যাগ বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। সামরিক বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারকদের মতে, বাগরামের নিয়ন্ত্রণ হারানো একই সঙ্গে আমেরিকার দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি এবং কৌশলগত পরাজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাগরামকে কেবল একটি সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসেবেই দেখেন না, বরং চীন ও রাশিয়াকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি সম্মুখ ঘাঁটি হিসেবে দেখেন। পাশাপাশি এই অঞ্চলে চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলো পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগকে নস্যাৎ করতে পারে এমন এক কৌশলগত অবস্থান হিসেবে চিহ্নিত করেন।

সমালোচকরা সতর্ক করেছেন, ঘাঁটিটি পুনরুদ্ধার করতে গেলে তালেবানের সঙ্গে নতুন সংঘাত শুরু হতে পারে, যা মার্কিন সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। তালেবান বাগরামে চীনের আগ্রহের কথা অস্বীকার করলেও এর অবকাঠামোতে বেইজিংয়ের সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা নিয়ে ওয়াশিংটনে জল্পনা-কল্পনা অব্যাহত রয়েছে। মার্কিন নীতি আলোচনায় বাগরামের উপস্থিতি প্রমাণ করে বৈশ্বিক নিরাপত্তা কৌশলের জন্য বাগরাম কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র: মিলিটারি টাইমস, কাউন্সিল অন ফরেইন রিলেশনস, দ্য ডিপ্লোম্যাট, ফরেন পলিসি, দ্য ইকোনমিক্স টাইমস ও আল-জাজিরা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত