leadT1ad

কাতারে ইসরায়েলের হামলা, মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কৌশলগত সুযোগের সম্ভাবনা কতখানি

সুমন সুবহান
স্ট্রিম গ্রাফিক

ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং হামাসকে সমর্থন করার কারণে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ তারিখে ইসরায়েল কাতারে হামলা করেছে ধারণা করা হয়। এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে নাটকীয়ভাবে বদলে দিয়েছে বলে দাবি করা যেতে পারে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটিটা কাতারের আল-উদেইদে অবস্থিত, যা এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির প্রাণকেন্দ্র। ইসরায়েলের এমন আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নতুন করে তাদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে।

এর ফলে চীন নিজেকে একটি স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য বিকল্প শক্তি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। এমনিতেই মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আসলে কাতারে ইসরায়েলি হামলা চীনের জন্য কৌশলগত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে যা আগামী দিনের বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাসে নতুন মেরুকরণ তৈরি করবে।

চীন ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা অকার্যকর প্রমাণিত হলে চীন এই দেশগুলোকে আরও বেশি করে সামরিক সহযোগিতা, উন্নত প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ প্রস্তাব দিতে পারে।

এর ফলে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব আরও বাড়বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এই ঘটনা কেবল আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন আনবে না, বরং এটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠতে পারে। এর সম্ভাব্য কারণগুলো আলোচনা করা হলো।

ক. কাতারের ঘটনা ও মার্কিন সামরিক উপস্থিতির কার্যকারিতা

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল সামরিক উপস্থিতি রয়েছে; বিশেষ করে কাতারে অবস্থিত আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতে প্রায় ২০,০০০ মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়ার বাসভবনে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা মার্কিন সামরিক উপস্থিতির কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে।

কাতারে ইসরায়েলি হামলা চীনের জন্য কৌশলগত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে যা আগামী দিনের বৈশ্বিক ক্ষমতার বিন্যাসে নতুন মেরুকরণ তৈরি করবে।

কাতার – যারা কিনা হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছিল, তাদের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হওয়ায় আঞ্চলিক কূটনৈতিক সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠেছে। এই হামলার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয় যে মার্কিন সামরিক নিরাপত্তা এই অঞ্চলে সব ধরনের হুমকি মোকাবিলায় কার্যকর নয়, বিশেষ করে যখন হুমকিটি তাদের নিজস্ব মিত্রের কাছ থেকে আসে।

খ. মার্কিন নিরাপত্তা মডেলের দুর্বলতা

ঐতিহ্যগতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি দুটি প্রধান উদ্দেশ্যে কাজ করে; প্রথমত, ইরান বা অন্যান্য বিরোধী শক্তির কাছ থেকে আসা বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলা করা। দ্বিতীয়ত, তেলের সরবরাহ লাইন ও বৈশ্বিক বাণিজ্য পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তবে কাতারের ঘটনার মতো অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও মিত্রদের নিজেদের মধ্যেকার প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবিলায় এই মডেলটি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এটি একটি মৌলিক দুর্বলতা প্রকাশ করে; তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের মধ্যে বিভেদ ও অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

গ. আস্থার সংকট ও পরিণতি

কাতারে হামলার ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থার সংকট তৈরি করেছে। যখন একটি দেশ দেখে যে তার ভূখণ্ডে থাকা মার্কিন সামরিক বাহিনী অন্য কোনো মিত্রের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করতে পারছে না, তখন তারা বিকল্প নিরাপত্তা অংশীদার খুঁজতে বাধ্য।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একক নির্ভরতা নিরাপদ নয়। এই প্রেক্ষাপটে তারা চীন ও রাশিয়ার মতো উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী হচ্ছে। এই দেশগুলো সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রতিরক্ষা চুক্তি ও ভূ-রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা মডেলের চেয়ে ভিন্ন। এটি আঞ্চলিক দেশগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে এবং একটি বহুমুখী নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে উৎসাহিত করছে, যেখানে চীন একটি প্রধান ভূমিকা নিতে পারে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এখন বুঝতে পারছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর একক নির্ভরতা নিরাপদ নয়। এই প্রেক্ষাপটে তারা চীন ও রাশিয়ার মতো উদীয়মান বৈশ্বিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী হচ্ছে। এই দেশগুলো সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ, প্রতিরক্ষা চুক্তি ও ভূ-রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা মডেলের চেয়ে ভিন্ন।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক নিরাপত্তার দুর্বলতা চীনের জন্য বিশাল কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। আর এখন সামরিক ও নিরাপত্তা খাতেও প্রবেশ করতে চাইছে।

ক. অর্থনৈতিক প্রভাবের বিস্তার

চীন মধ্যপ্রাচ্যে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর মাধ্যমে বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করেছে। বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইরানের মতো দেশগুলোতে বন্দর, রেললাইন ও জ্বালানি প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ ব্যাপক। এই অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে চীন এখন নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও অংশীদার হতে চাইছে।

খ. প্রতিরক্ষা অংশীদারত্ব

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, বিশেষ করে যারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারাচ্ছে, তারা এখন চীনের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার দিকে ঝুঁকছে। চীন ইতোমধ্যে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে ড্রোন এবং অন্যান্য উন্নত সামরিক প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশগুলো ছাড়াও চীন আফ্রিকার মিশর, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, রুয়ান্ডার কাছেও বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে। চীনের এই প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে।

ইরান-সৌদি আরব চুক্তি প্রমাণ করে যে, চীন এই অঞ্চলে একটি নির্ভরযোগ্য এবং নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়।

ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে মিশর সম্প্রতি সিনাই উপত্যকায় চীনের তৈরি উন্নত এইচকিউ-৯বি দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। এইচকিউ-৯বি হলো চীনের তৈরি একটি অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, যা রাশিয়ার এস-৪০০ ব্যবস্থার সমতুল্য বলে মনে করা হয়। এই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা বিমান, ড্রোন ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মতো লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে মিশর ইসরায়েলকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে চেয়েছে যে সিনাই উপত্যকায় যেকোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপ কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হবে। বিশেষ করে, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সিনাইয়ে স্থানান্তরিত করার ইসরায়েলি পরিকল্পনাকে মিশর ‘রেড লাইন’ হিসেবে দেখেছে।

গ. কূটনৈতিক মধ্যস্থতা

১. মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কূটনৈতিক মধ্যস্থতা এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি বড় পরিবর্তন এনেছে। এই মধ্যস্থতার প্রধান উদ্দেশ্য সামরিক শক্তি বা হস্তক্ষেপের পরিবর্তে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগানো। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ।

২০২৩ সালের মার্চ মাসে চীনের মধ্যস্থতায় বেইজিংয়ে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিটির মাধ্যমে ৭ বছর পর এই দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় চালু হয়। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে চীনের এই মধ্যস্থতা একটি বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এই চুক্তির কয়েকটা দিক :

ক. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট : শিয়া-প্রধান ইরান ও সুন্নি-প্রধান সৌদি আরব বহু দশক ধরে এই অঞ্চলের দুটি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবাননের মতো দেশগুলোতে তারা প্রক্সি যুদ্ধে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এই দীর্ঘস্থায়ী শত্রুতা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল।

খ. চীনের ভূমিকা : যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা শক্তির ব্যর্থতার বিপরীতে চীন নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে। চীন উভয় দেশের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে আস্থা তৈরি করেছে। সৌদি আরব চীনের অন্যতম প্রধান তেল সরবরাহকারী এবং ইরান চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

গ. ফলাফল : এই চুক্তিটি শুধু ইরান ও সৌদি আরবের সম্পর্কই স্বাভাবিক করেনি, বরং মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য উত্তেজনাও প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। যেমন ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা এবং সিরিয়াকে আরব লীগে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রক্রিয়া সহজ হয়েছে।

চীন চায় মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। কারণ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা তার অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। চীন তার শক্তির বিশাল অংশের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল।

২. ইরান-সৌদি আরব চুক্তি প্রমাণ করে যে, চীন এই অঞ্চলে একটি নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে এই চুক্তির পর চীন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সংঘাতপূর্ণ এলাকায়ও মধ্যস্থতা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। যেমন :

ক. ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত : চীন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানকে সমর্থন করে এবং এই দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও এই সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল, তবে চীনের এই আগ্রহ ইঙ্গিত দেয় যে তারা এই অঞ্চলের প্রতিটি প্রধান সমস্যায় নিজেদের ভূমিকা রাখতে চায়।

খ. সিরিয়া ও অন্যান্য দেশ : সিরিয়ায় চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাড়ছে এবং দেশটি সিরিয়া সরকারকে সমর্থন করে। চীন সিরিয়াকে আরব বিশ্বে পুনরায় একীভূত করতেও ভূমিকা রাখছে।

সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কূটনৈতিক মধ্যস্থতা একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে, যেখানে সামরিক শক্তি নয়, বরং কূটনীতি ও অর্থনীতি এই অঞ্চলের ভবিষ্যত নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করতে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের এই কূটনৈতিক মধ্যস্থতার কারণগুলো নিম্নরূপ :

ক. আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা

চীন চায় মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা বজায় থাকুক। কারণ এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা তার অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য অপরিহার্য। চীন তার শক্তির বিশাল অংশের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীল।

খ. বৈশ্বিক প্রভাব

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের কূটনৈতিক সাফল্য তার বৈশ্বিক ভাবমূর্তি উন্নত করছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের বিপরীতে একটি বিকল্প মডেল হিসেবে চীনকে তুলে ধরছে। এই মডেলটি সামরিক শক্তি নয়, বরং অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও কূটনৈতিক আলোচনার ওপর ভিত্তি করে গঠিত।

গ. যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস

মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। যখন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক হস্তক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে ব্যস্ত, তখন চীন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে মনোযোগী হচ্ছে, যা আঞ্চলিক দেশগুলোর কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।

মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার প্রভাববলয় বৃদ্ধিতে চীন নিজস্ব নিরাপত্তা মডেল নিয়ে আসতে পারে, যা মার্কিন মডেলের চেয়ে ভিন্ন। বিশেষ করে যারা বাইরের সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায় তাদের জন্য চীনের মডেল অনেক দেশের কাছে আকর্ষণীয় হতে পারে। কেননা মার্কিন মডেল সামরিক জোট ও হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল, অথচ চীনের মডেলটি অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং হস্তক্ষেপ না করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। আর তাই অর্থনৈতিক সহযোগিতা, কূটনৈতিক মধ্যস্থতা ও স্থিতিশীলতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা চীনের নিরাপত্তা মডেলকে ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তা’ মডেলও বলা যেতে পারে। এই মডেলের মূল ভিত্তি,

ক. অর্থনৈতিক সহযোগিতা : চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বিশাল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগের লক্ষ্য দেশগুলোকে অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত করা এবং তাদের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। চীন বিশ্বাস করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আর তাই চীনের মডেলটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার উপর জোর দেয় যা দেশগুলোকে তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম করে।

চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে, তবে কোনো সামরিক জোটে আবদ্ধ হয় না। এই সামরিক বাণিজ্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে শক্তিশালী করে।

খ. কূটনৈতিক মধ্যস্থতা : চীন এই অঞ্চলে একটি নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে চীনের ভূমিকা। এই সাফল্য প্রমাণ করে যে চীন সামরিক শক্তি প্রয়োগ না করেও আঞ্চলিক উত্তেজনা কমাতে সক্ষম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বুঝতে পারছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি সবসময় তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, বরং কখনো কখনো আঞ্চলিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে।

গ. হস্তক্ষেপ না করার নীতি : চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘শাসন পরিবর্তন’ বা তথাকথিত ‘গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’র নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত। এই নীতি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কারণ তারা নিজেদের সার্বভৌমত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা মডেল সামরিক ঘাঁটি ও হস্তক্ষেপের ওপর নির্ভরশীল। এর উদ্দেশ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করা এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। এই প্রেক্ষাপটে চীনের হস্তক্ষেপ না করা এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার মডেল একটি কার্যকর বিকল্প হিসেবে উঠে এসেছে।

ঘ. সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ: চীন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে, তবে কোনো সামরিক জোটে আবদ্ধ হয় না। এই সামরিক বাণিজ্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে, যা পরোক্ষভাবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে শক্তিশালী করে।

কাতারে ইসরায়েলের হামলা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক নিরাপত্তার কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তৈরি করেছে। এই শূন্যতা চীনের জন্য একটি বড় কৌশলগত সুযোগ সৃষ্টি করেছে। অর্থনৈতিক প্রভাব, সামরিক অংশীদারত্ব ও কূটনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে চীন এখন মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। এটি বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত