leadT1ad

পাকিস্তান কীভাবে হয়ে উঠল মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ

তুফায়েল আহমদ
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩: ২৯
পাকিস্তান কীভাবে হয়ে উঠল মুসলিম বিশ্বের একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। স্ট্রিম গ্রাফিক

গত ১৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান ও সৌদি আরবের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি সৌদি আরবকে পাকিস্তানের পারমাণবিক ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে, যা মুসলিম বিশ্বে পাকিস্তানের অনন্য ও শক্তিশালী অবস্থানকে নতুন করে সামনে এনেছে। কিছুদিন আগেই কাতারের দোহায় হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এই হামলার পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর জন্য একটি সম্মিলিত নিরাপত্তা জোট, অর্থাৎ ‘ইসলামিক ন্যাটো’ গঠনের আলোচনা নতুন করে গতি পেয়েছে।

এই উত্তেজনাময় ভূরাজনৈতিক আলোচনার সময় একটি কঠিন বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: ৫০টিরও বেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মধ্যে কেবল পাকিস্তানের কাছেই পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। অন্যদিকে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি তীব্র আন্তর্জাতিক নজরদারিতে রয়েছে এবং সম্প্রতি ইসরায়েল ও মার্কিন বিমান হামলার শিকারও হয়েছে। দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়নি।

এই পরিস্থিতি একটি মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দেয়: রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তান কীভাবে এই অনন্য মর্যাদা অর্জন করল? এর উত্তর লুকিয়ে আছে গভীর নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কা, অবিচল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব ও একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার এক জটিল সংমিশ্রণে।

পাকিস্তানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেকড় নিহিত আছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীল সম্পর্কের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় থেকে উদ্ভূত ও পরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে তীব্র হওয়া এই শত্রুতা পাকিস্তানের কৌশলগত মহলে এক চিরস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি করে।

ভারতের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা উদ্বেগ

পাকিস্তানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেকড় নিহিত আছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তার দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীল সম্পর্কের মধ্যে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় থেকে উদ্ভূত ও পরবর্তী বিভিন্ন যুদ্ধের মাধ্যমে তীব্র হওয়া এই শত্রুতা পাকিস্তানের কৌশলগত মহলে এক চিরস্থায়ী নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি তৈরি করে।

পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির সবচেয়ে বড় অনুঘটক ছিল ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারতের ‘স্মাইলিং বুদ্ধ’ নামক সফল পারমাণবিক পরীক্ষা। যদিও ভারতের দাবি ছিল, এটি একটি "শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক বিস্ফোরণ"। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পাকিস্তান এটিকে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুতর নতুন হুমকি হিসেবে দেখেছিল। এই পরীক্ষা স্পষ্টভাবে ভারতের পারমাণবিক সক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল, যা দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে এবং পাকিস্তানকে পারমাণবিক ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। পাকিস্তানি নেতারা এই ঘটনাকে অস্তিত্বের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করেন।

আগে থেকেই বিদ্যমান সামরিক উত্তেজনা ভারতের পারমাণবিক সক্ষমতার কারণে আরও বিপজ্জনকভাবে জটিল হয়ে ওঠে। ফলে নিজস্ব পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়া পাকিস্তানের জন্য আর কোনো কার্যকর বিকল্পের পথ ছিল না।

১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের মুলতানে দেশটির শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একটি সভায় ভুট্টো তাঁদের একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য অনুরোধ করেন। এই সভাটিকেই পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক সূচনা বলে মনে করা হয়।

রাজনীতির মঞ্চে যখন পারমাণবিক প্রতিরোধব্যবস্থার জনক

এই অস্তিত্বের সংকটের মুখে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের রাজনৈতিক সদিচ্ছার সবচেয়ে প্রবল প্রবক্তা হিসেবে আবির্ভূত হন পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। বিশ্লেষকদের দাবি, ভুট্টোর বিখ্যাত ‘ভারত যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে তবে আমরা ঘাস, লতাপাতা খাব এমনকি অনাহারে থাকব, কিন্তু আমরাও নিজেদের বোমা তৈরি করব’ উক্তিটি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল চালিকাশক্তি ছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পাকিস্তানের "পারমাণবিক প্রতিরোধ ব্যবস্থার জনক" বলেও ভূষিত করা হয়।

১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানের মুলতানে দেশটির শীর্ষ বিজ্ঞানীদের একটি সভায় ভুট্টো তাঁদের একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য অনুরোধ করেন। এই সভাটিকেই পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক সূচনা বলে মনে করা হয়। ভুট্টোর সরকার এই বিশাল কাজের জন্য পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনসহ (পিএইসি) প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে।

ভুট্টোর প্রশাসন পারমাণবিক প্রযুক্তি অর্জনের জন্য নিরলস ছিল। গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য তারা তহবিল বরাদ্দ করেছে। ভুট্টোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা কেবল কথার কথা ছিল না, বিজ্ঞানী সম্প্রদায়কে একত্রিত করে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও দক্ষতা অর্জনের সব ধরনের সুযোগও তিনি দেন।

ভুট্টোর বিখ্যাত ‘ভারত যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে তবে আমরা ঘাস, লতাপাতা খাব এমনকি অনাহারে থাকব, কিন্তু আমরাও নিজেদের বোমা তৈরি করব’ উক্তিটি পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির মূল চালিকাশক্তি ছিল।

ড. আবদুল কাদির খানের বৈজ্ঞানিক নেতৃত্ব

রাজনৈতিক সদিচ্ছা এই কর্মসূচির চালিকাশক্তি জোগান দিলেও বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ছিল বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার। পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী ড. আবদুল কাদির খান তখন আবির্ভূত হন এক ত্রাতা হিসেবে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রযুক্তিগত বাধা অতিক্রম করার জন্য প্রায়শই আবদুল কাদির খানকে ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জনক’ বলেও অভিহিত করা হয়।

পারমাণবিক প্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ সেন্ট্রিফিউজ প্রযুক্তি সম্পর্কে আবদুল কাদির খান জানতে পারেন ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে নেদারল্যান্ডসে ইউরোপীয় কনসোর্টিয়াম ইউরেনকোর একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়। ১৯৭৪ সালে আবদুল কাদির খান প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে চিঠি লিখে তার দক্ষতা পারমাণবিক কর্মসূচিতে ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। সুযোগটি অনুধাবন করে ভুট্টো তাঁকে পাকিস্তানে আমন্ত্রণ জানান।

আবদুল কাদির খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ (কেআরএল) প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করেছেন, যা ছিল পাকিস্তানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রচেষ্টার স্নায়ুকেন্দ্র। তাঁর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বিজ্ঞানীরা সফলভাবে পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ফিসাইল উপাদান তৈরি করতে পারে এমন ইউরেনিয়াম তৈরি ও পরিচালনা করতে সক্ষম হন।

পদার্থবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী ড. আবদুল কাদির খান তখন আবির্ভূত হন এক ত্রাতা হিসেবে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের প্রযুক্তিগত বাধা অতিক্রম করার জন্য প্রায়শই আবদুল কাদির খানকে ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির জনক’ বলেও অভিহিত করা হয়।

বৈদেশিক সহায়তা, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও গোপন নেটওয়ার্ক

পারমাণবিক অস্ত্রের প্রযুক্তি বিস্তার রোধে একটি বৈশ্বিক নীতি রয়েছে। এই নীতি উপেক্ষা করে পারমাণবিক শক্তির মালিক হতে গেলে গোপনীয়তার কোনো বিকল্প নেই। পাকিস্তানও পারমাণবিক প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় উপাদান ও উপকরণ সংগ্রহের জন্য গোপন পথের আশ্রয় নিয়েছিল।

পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সবচেয়ে সহায়তাপ্রদানকারী দেশ ছিল চীন। পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে বারবার ইঙ্গিত করা হয়েছে, চীন পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্রের নকশাসহ পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করেছে। এই সহায়তার পেছনে সম্ভবত ভারতের আঞ্চলিক ক্ষমতাকে ভারসাম্যে রাখার অভিন্ন কৌশলগত স্বার্থ কাজ করেছিল।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সহায়তার বাইরেও আবদুল কাদির খান একটি বিস্তৃত আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিলেন। এই নেটওয়ার্কটি আন্তর্জাতিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁকফোকর ব্যবহার করে পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করত। এই নেটওয়ার্কটি ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়াম টিউব থেকে শুরু করে ভ্যাকুয়াম পাম্প ও ইনভার্টারসহ বিভিন্ন পণ্যের চূড়ান্ত গন্তব্য গোপন করে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পাকিস্তান পর্যন্ত নিয়ে আসতে অত্যন্ত দক্ষ ছিল।

পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিছক সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, বরং ছিল অস্তিত্ব রক্ষার এক মরিয়া প্রচেষ্টা। ভারতের পারমাণবিক সক্ষমতার মুখে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ় সংকল্প ও আন্তর্জাতিক চাপকে পাশ কাটিয়ে প্রযুক্তি হাসিলের অধ্যবসায় পাকিস্তানকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিল।

নিষেধাজ্ঞা ও আন্তর্জাতিক চাপ

পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির কার্যক্রম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের, নজর এড়ায়নি। পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক চাপ এবং একাধিক অর্থনৈতিক ও সামরিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যয় বাড়িয়ে দেওয়া ও কর্মসূচি পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা।

তবে, এই বাহ্যিক চাপ পাকিস্তানকে দমাতে পারেনি। পাকিস্তান বারবার পারমাণবিক অস্ত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষা অস্বীকার করে এবং কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করে।

১৯৯৮ সালের মে মাসে পাকিস্তান সফলভাবে একাধিক পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে একটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।

পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিছক সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না, বরং ছিল অস্তিত্ব রক্ষার এক মরিয়া প্রচেষ্টা। ভারতের পারমাণবিক সক্ষমতার মুখে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দৃঢ় সংকল্প ও আন্তর্জাতিক চাপকে পাশ কাটিয়ে প্রযুক্তি হাসিলের অধ্যবসায় পাকিস্তানকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিল। এই পারমাণবিক সক্ষমতা দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যই বদলে দেওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানকে মুসলিম বিশ্বে কৌশলগত গভীরতা প্রদান করে, যার ভূরাজনৈতিক তাৎপর্য আজও বিশ্বজুড়ে অনুভূত হয়।

তথ্যসূত্র: স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, বুলেটিন অব দি অ্যাটমিক সায়েন্টিস্টস, ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টস, ডন, বিবিসি, রয়টার্স ও আল-জাজিরা

Ad 300x250

সম্পর্কিত