leadT1ad

‘ডিম হামলা’র প্রথা এল কোথা থেকে, শাস্তি কী

ডিম ছোড়াকে নিরীহ প্রতিবাদ মনে হলেও বাস্তবে ডিম ছোড়া অধিকাংশ দেশে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। লক্ষ্যবস্তু যেই হোক, কাউকে ভীত করার উদ্দেশে কারও গায়ে ডিম ছুঁড়ে মারা আইনের চোখে আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়। জনসমক্ষে করলে এটি জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের মত আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাজনৈতিক বা আদর্শিক ঘৃণা থেকে যদি কারো উপর আক্রমণ হিসেবে ডিম নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে অনেক দেশে এর জন্য শাস্তির বিধানের ব্যবস্থা থাকে।

মাহবুবুল আলম তারেক
১৮শ শতকের দিকে ডিম হয়ে ওঠে প্রতিবাদের সুলভ হাতিয়ার। স্ট্রিম গ্রাফিক

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের জন এফ. কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে (জেএফকে) জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ‘ডিম হামলা’র ঘটনা ঘটেছে। আখতারকে লক্ষ্য করে ডিম নিক্ষেপ করেছে বাংলাদেশে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা সংগঠন আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতাকর্মীরা। দলটির প্রায় ২০ জন নেতাকর্মী বিমানবন্দরের আগমন এলাকায় হামলা চালায়। তারা অন্তত দুটি ডিম ছোড়ে। একটি আখতার হোসেনের পিঠে লাগে।

পুলিশ ঘটনাস্থলেই দিদারুল ইসলাম নামে একজন হামলাকারীকে আটক করে। তবে অভিযোগ গঠনের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত হয়নি। এনসিপি নেতৃত্ব এ ঘটনাকে ‘বর্বর ও সংগঠিত রাজনৈতিক আক্রমণ’ বলে নিন্দা জানায়। তারা প্রবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা জোরদারের দাবিও জানায়।

কিন্তু ডিম নিক্ষেপ করে হামলার প্রথা আসলো কোথা থেকে? বিমানবন্দরের নিরাপত্তা এড়িয়ে কীভাবে ডিম ভেতরে আসে? এই হামলার আইনি পরিণতি কী হতে পারে?

প্রতিবাদের আঠালো প্রতীকের ইতিহাস

ডিম ছুড়ে প্রতিবাদের ইতিহাস অনেক পুরোনো। সহজলভ্যতা, অপমান সৃষ্টির ক্ষমতা এবং তুলনামূলক কম ঝুঁকির কারণে এটি প্রতিবাদের একটি কার্যকর অস্ত্র।

৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিউনিশিয়ার হাদ্রামাউতে এমন ঘটনা ঘটে। তিউনিসিয়া সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের শাসনে ছিল। দুর্ভিক্ষপীড়িত জনতা রোমান গভর্নর (পরে সম্রাট) ভেসপাসিয়ানের দিকে শালগম ছুড়ে মারে। সস্তা ও পচনশীল খাবারের জিনিস দিয়ে প্রতিবাদ করার এই হচ্ছে সবচেয়ে পুরোনো ইতিহাস।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে জনসম্মুখে অপরাধী বা কর্মকর্তাদের লজ্জা দিতে ডিম বা পচা ফল ব্যবহার করার উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৫০০–১৬০০ সালের এলিজাবেথান থিয়েটারে খারাপ অভিনেতাদের দিকে দর্শকরা পচা ডিম ছুঁড়ে মারতো। এতে প্রতিবাদ ও অভিনয় সমালোচনা একসঙ্গে যুক্ত হতো।

১৮শ শতকের দিকে ডিম হয়ে ওঠে প্রতিবাদের সুলভ হাতিয়ার। সেই সময় ইংল্যান্ড এবং আয়ারল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত আইল অব ম্যানের এক ঘটনায় স্থানীয় জনতা মেথডিস্ট ধর্মপ্রচারকদের উপর ডিম ছুঁড়ে মারে। ১৮৩৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথাবিরোধী কবি জন গ্রিনলিফ হুইটিয়ার নিউ হ্যাম্পশায়ারে বক্তৃতার সময় ডিম হামলার শিকার হন।

আধুনিক ইতিহাসে ডিম ছোড়ার উদাহরণ অনেক। ১৯১০ সালে নারী ভোটাধিকার অস্বীকারের প্রতিবাদে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলকে ডান্ডিতে ডিম ছোড়া হয়। ১৯১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী বিলি হিউজকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সেনা নিয়োগ সমাবেশে ডিম ছোড়া হয়। ২০০১ সালে ব্রিটেনে ‘এগগেট’ নামে পরিচিত ঘটনায় উপ-প্রধানমন্ত্রী জন প্রেসকট নির্বাচনী প্রচারে ডিম ছোড়ার পর হামলাকারীকে ঘুষি মারেন।

২০১৯ সালে মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দেওয়া সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম ভাঙে। অস্ট্রেলিয়ার কিশোর উইল কনোলি। ঘটনাটি ভাইরাল হয় এবং তার সমর্থনে ১ লাখ ডলারের বেশি অর্থ উঠে। কনোলি পরিচিতি পায় ‘এগ বয়’ নামে।

বৃটিশ রাজপরিবারও এর থেকে রেয়াত পায়নি। ২০২৩ সালে যুক্তরাজ্য সফরে রাজা চার্লস তৃতীয় ডিম নিক্ষেপের শিকার হন। পরে হামলাকারীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

ডিম হামলার পর আখতার হোসেনের নাজেহাল অবস্থা। ছবি: সংগৃহীত।
ডিম হামলার পর আখতার হোসেনের নাজেহাল অবস্থা। ছবি: সংগৃহীত।

বাংলাদেশে ডিম হামলা

কাউকে অপমান করার উদ্দেশ্যে ডিম ছুঁড়ে মারা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বহুল প্রচলিত একটি প্রথা। স্বাভাবিকভাবেই, বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। কিছুদিন আগেই গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে আদালত প্রাঙ্গনে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনা ঘটেছে ।

গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাকে হত্যা ও হত্যার ইন্ধনের মামলায় গ্রেফতার সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, সাবেক ডাক,টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলকসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের অনেক রাজনীতিবিদের উপরই ডিম ছুড়ে মারা হয়েছে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে। সম্প্রতি লন্ডনে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলমের গাড়িতেও আওয়ামী সমর্থকদের দ্বারা ডিম নিক্ষেপ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

আওয়ামী কর্মীরা বিমানবন্দরে কীভাবে ডিম নিয়ে ঢুকল

কীভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীরা জেএফকে বিমানবন্দরে ডিম নিয়ে ঢুকতে পারল? সহজ কারণ: ডিম কোনো অবৈধ বস্তু নয়। নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ডিমকে শক্ত খাবার হিসেবে গণ্য করে। ৯/১১-র সন্ত্রাসী হামলার পরের নিয়মে তরল বা জেল জাতীয় জিনিস বহনের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা আছে। তবে কঠিন খাবার বহনে কোন সমস্যা নেই। আস্ত ডিম আপেল বা স্যান্ডউইচের মতো আপনি সঙ্গে রাখা ব্যাগের মধ্যে করেই নিয়ে যেতে পারবেন। চেকিং-এর সময় জানিয়ে দিলেই হবে। কেউ বাধা দেবে না।

আখতার হোসেনের ঘটনায়, হামলাকারীরা স্বাভাবিকভাবেই ডিম সঙ্গে করে বিমান বন্দরে ঢুকেছেন। অথবা নিরাপত্তা চেকের পরে ডিম কিনেছেন। জেএফকে-তে দোকান আছে। পরে ডিম ব্যবহার করা হয়েছে জনসমক্ষে, চেকপয়েন্টের বাইরে।

ডিম হামলার পর পুলিশ একজনকে আটক করে। ছবি: সংগৃহীত।
ডিম হামলার পর পুলিশ একজনকে আটক করে। ছবি: সংগৃহীত।

শাস্তি কী হতে পারে

ডিম ছোড়া অধিকাংশ দেশে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। কারও গায়ে ডিম ছুঁড়ে মারা আইনের চোখে আঘাত হিসেবে বিবেচিত হয়। জনসমক্ষে করলে এটি জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের মত আইনে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। রাজনৈতিক বা আদর্শিক ঘৃণা থেকে যদি কারো উপর আক্রমণ হিসেবে ডিম নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে অনেক দেশে এর জন্য শাস্তির বিধান আছে।

যুক্তরাষ্ট্রে কেউ অন্যকে লক্ষ্য করে ডিম ছুঁড়ে মারলে তা সরাসরি আঘাত হিসেবে ধরা হয়। আঘাত অল্প হলে জরিমানা হতে পারে। আর যদি আঘাত গুরুতর হয় আঘাতকারীকে কারাগারে যেতে হয়। যদি লক্ষ্যবস্তু রাজনৈতিক নেতা বা জনসাধারণের সমাবেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয় তবে ডিম ছোড়াকে হুমকিমূলক বা অপমানজনক আচরণ হিসেবে ধরা হয়।

হামলাটি শুধু অসদারচরণমূলক হলে এবং গুরুতর আঘাত না হলে শাস্তি হতে পারে সর্বোচ্চ ১ বছর পর্যন্ত জেল বা ৫০০-১০০০ ডলার জরিমানা ও প্রোবেশন বা কমিউনিটি সার্ভিস। গাড়িতে ডিম নিক্ষেপে শাস্তি হতে পারে ১-৫ হাজার ডলার জরিমানা এবং সর্বোচ্চ ৬ মাস পর্যন্ত জেল।

আখতার হোসেনের ওপর হামলাকারী নিউ ইয়র্কে অসদারচরণমূলক আঘাতের অভিযোগে বিচারাধীন। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি মার্কিন নাগরিক না হন তাহলে তাঁকে দেশ থেকে ফেরত পাঠানো হতে পারে। এই ধরনের মামলায় ক্ষতির প্রমাণ না থাকলে শাস্তির ঘটনা সাধারণত বিরল। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি ভবিষ্যতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকায় আদালতের কাছে নিরাপত্তা চাইতে পারেন।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা ৩২৩, ৫০৬ অনুসারে কারো উপর এই ধরনের ঘটনায় শারীরিক আঘাত, ভীতি প্রদর্শন বা জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আসতে পারে। সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ এবং সন্ত্রাস বিরোধী আইন, ২০০৯ এর ধারা-১৮(১) অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও তার সকল অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ। তাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কোন আওয়ামী সমর্থকের প্রতিপক্ষের কাউকে ডিম নিক্ষেপ বাংলাদেশি আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রবিরোধী নিষিদ্ধ সংগঠনের কার্যক্রমে হিসেবে গণ্য হবে।

বাংলাদেশের পেনাল কোড ৩২৩ ও ৫০৬ অনুযায়ী সাধারণ আঘাত বা হুমকির শাস্তি ১–৩ মাসের জেল বা ৫০০ টাকা জরিমানা। তবে এই শাস্তি হামলার ফলাফল প্রমাণ এবং আঘাতের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে।

যুক্তরাষ্ট্রের জেএফকে বিমানবন্দরে এনসিপি-র সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর ডিম নিক্ষেপের ঘটনা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনারই এক ছবি। প্রতিবাদের পুরনো ঐতিহ্যের মাধ্যমে প্রবাসে দেশীয় রাজনৈতিক সংঘাতের প্রতিফলন ঘটল। এই হামলা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ এবং আইনের প্রয়োগের জটিলতাকে এক সঙ্গে তুলে ধরেছে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত