leadT1ad

২৩ দিনে ৬০ মৃত্যু, সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বাধিক

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
ডেঙ্গু আর মৌসুমি নয়, সারা বছর ছড়াচ্ছে গ্রাম-শহরে। স্ট্রিম গ্রাফিক

দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত ১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৬৪ জন। এ নিয়ে এ বছর মশাবাহিত এ রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১৮২ জনে। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ হাজার ১৭৩ জনে।

আজ মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ১ নারী জন মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অন্যজন মারা গেছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে।

রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যালয়ে গতকাল সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেন, ‘চলতি বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, মৃত্যুর অন্যতম কারণ হলো হাসপাতালে দেরিতে ভর্তি হওয়া এবং জটিল অবস্থায় চিকিৎসা শুরু করা।’ এ ছাড়াও তিনি জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে—ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রোগীদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ভর্তি হওয়ার এক দিনের মধ্যেই মারা গেছেন, যা পরিস্থিতির গুরুতর সংকেত বহন করছে।

পরিসংখ্যান কী বলছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৮২ জন। এর মধ্যে ৮১ শতাংশ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তিন দিনের বেশি সময় ধরে জ্বরে ভুগছিলেন। ভর্তি হওয়ার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই মারা গেছেন প্রায় ৭৪ শতাংশ। এর মধ্যে অন্তত ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে (ডিএসএস) এবং ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এক্সপ্যান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোমে (ইডিএস)। চিকিৎসকদের মতে, এ দুটি জটিলতা তখনই তৈরি হয়, যখন প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু হয় না।

২৩ দিনে ৬০ মৃত্যু, সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বাধিক। স্ট্রিম গ্রাফিক
২৩ দিনে ৬০ মৃত্যু, সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বাধিক। স্ট্রিম গ্রাফিক

বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণেও একটি উদ্বেগজনক চিত্র দেখা যাচ্ছে। ২০–৩০ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যেই সর্বাধিক মৃত্যু (৪৩ জন)। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধ্যাপক হালিমুর রশিদ বলেন, ‘তরুণরা বেশি সময় বাইরে থাকেন, আবার জ্বর হলে তা প্রাথমিকভাবে গুরুত্ব দেন না। ফলে জটিলতা বাড়ে।’

মৃত্যুহার কমলেও বেড়েছে শনাক্তের সংখ্যা

২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে, গত বছর আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার ছিল শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। চলতি বছর তা কিছুটা কমে শূন্য দশমিক ৪২ শতাংশ হলেও আক্রান্ত ও মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে যথাক্রমে ৮১ শতাংশ ও ৪৩ শতাংশ। অর্থাৎ রোগীর সংখ্যা এত বেশি বেড়েছে যে মৃত্যুর হার শতাংশে কমলেও ডেঙ্গু শনাক্তের সংখ্যা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে।

গত কয়েক বছরের মতো এবারও সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। ২০২৪ সালে শুধু সেপ্টেম্বরে মারা গিয়েছিলেন ৮৭ জন। এ বছরও সেপ্টেম্বরের প্রথম ২৩ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের। শতকরা হিসাবে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ২৩ দিনের তুলনায় ২০২৫ সালে কিছুটা কম মৃত্যু হয়েছে।

সামাজিক ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রভাব

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা.ফারুক আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘ডেঙ্গুর এই উচ্চ সংক্রমণ কেবল স্বাস্থ্য খাতেই চাপ বাড়াচ্ছে না, বরং অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকেও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। কর্মক্ষম বয়সীদের আক্রান্ত ও মৃত্যু মানে পরিবারগুলোতে হঠাৎ আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাওয়া বা দীর্ঘ চিকিৎসা ব্যয় বহনের বোঝা তৈরি হওয়া।’

ডা. ফারুক আহমেদ আরও বলেন হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে চাপ। শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন ৪৬ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৮ জন এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ জন।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো পুরোপুরি প্রস্তুত না থাকায় অনেকেই ঢাকায় ভিড় করছেন, এতে কেন্দ্রীয় হাসপাতালগুলো অতিরিক্ত চাপে পড়ছে।

২৩ দিনে ৬০ মৃত্যু, সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বাধিক। স্ট্রিম গ্রাফিক
২৩ দিনে ৬০ মৃত্যু, সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বাধিক। স্ট্রিম গ্রাফিক

জনসচেতনতা ও সমন্বয়হীনতাই প্রধান দুর্বলতা

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর বলেছেন, ‘যত ব্যবস্থাই নেওয়া হোক না কেন, জনগণ সচেতন না হলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’ তিনি স্বীকার করেন, মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার বিভাগের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও সমন্বয়ে ঘাটতি রয়ে গেছে।

ডা. আবু জাফর আরও বলেন, ‘প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অনেকে জ্বরকে সাধারণ রোগ ভেবে গড়িমসি করেন এবং শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে আসেন। এতে চিকিৎসকরা কার্যকর চিকিৎসার যথেষ্ট সময় পান না।’

সমাধান কোথায়

ডেঙ্গু পরিস্থিতির সমাধান কোথায়, এই প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হয় ডা. ফারুক আহমেদে বলেন, ‘কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হলে চারটি দিককে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, প্রাথমিক শনাক্তকরণ বাড়াতে হবে। এজন্য পর্যাপ্ত ডেঙ্গু টেস্ট কিটের ব্যবহার নিশ্চিত করে দ্রুত রোগী শনাক্ত করতে হবে, যাতে চিকিৎসা শুরুতে দেরি না হয়। দ্বিতীয়ত, জনসচেতনতা প্রচার জোরদার করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে এমন প্রচার চালাতে হবে যাতে মানুষ জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণকে হালকাভাবে না নেয় এবং দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যায়। তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে দ্রুততা ও দক্ষতা আনা ছাড়া এ সমস্যা মোকাবিলা সম্ভব নয়। আর চতুর্থত, হাসপাতাল প্রস্তুত রাখতে হবে। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত বেড, ফ্লুইড ও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক নিশ্চিত করতে হবে, যাতে রোগীরা ঢাকামুখী হয়ে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করেন।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত