leadT1ad

দুই সপ্তাহে ১৫ দেশের সঙ্গে বৈঠক

কূটনীতিক পাড়ায় আনাগোনা বেড়েছে জামায়াতের

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী গত ৪ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত, প্রতিনিধি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছে। স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী শুধু গত ৪ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই সপ্তাহেই ১৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত, প্রতিনিধি ও কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছে। আর গতবছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের এক বছরে এ ধরনের বৈঠক হয়েছে অন্তত ৩০টি দেশের সঙ্গে।
আগে বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের খুব একটা দেখা যেতো না। তবে সাম্প্রতিক এমন তৎপরতা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানান আলোচনা রয়েছে। যদিও বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক দলের এমন বৈঠক স্বাভাবিক, আর এতে আন্তদেশীয় কূটনৈতিক সম্পর্কেও তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না। তবে জামায়াতের দাবি, অভ্যুত্থানে তাদের ভূমিকা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদগুলোতে ছাত্রশিবিরের জয়ের পর  কূটনীতিকরা তাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন।

দুই সপ্তাহে ১৫ দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ
গত ১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরা এলাকায় জামায়াত আমিরের বাসায় দলটির শীর্ষ নেতাদের একটি বৈঠক হয়। সেখানে দলটির নায়েবে আমির, সেক্রেটারি জেনারেল ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলসহ নির্বাহী পরিষদের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর তিন দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন দূতাবাস ও কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের সাক্ষাৎ ও বৈঠক হতে থাকে।
এই দুই সপ্তাহে চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, ব্রাজিল, ফিলিস্তিন, সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, এস্তোনিয়া, পোল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, ভ্যাটিকান সিটি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে জামায়াতের নীতি-নির্ধারকরা সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকের পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে জামায়াত।
শুধু ৫, ৬, ১২ ও ১৩ সেপ্টেম্বর—এই চারদিন কোনো কূটনীতিকের সঙ্গে সাক্ষাতের খবর পাওয়া যায়নি। তবে ওই চারদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার ছিল। অন্যদিকে ৭, ১০, ১১ ও ১৬ সেপ্টেম্বর সকাল-বিকাল বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক হয়। এর একদিন পরেই ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে পাঁচ দফা দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচিতে যায় জামায়াত। তাদের সঙ্গে প্রায় অভিন্ন দাবিতে একই কর্মসূচি পালন করে আরও কয়েকটি দল।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ, সহিংস আন্দোলন ও উগ্রবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল জামায়াত। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছেও তাদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা চোখে পড়েনি। তবে সরকার পতনের পর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে দলটি। এরইমধ্যে কূটনৈতিক মহলেও তাদের আনাগোনা বেড়েছে।

এক বছরে ৩০ দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক  
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ, সহিংস আন্দোলন ও উগ্রবাদে সম্পৃক্ততার অভিযোগ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মহলে একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল জামায়াত। বিদেশি কূটনীতিকদের কাছেও তাদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা চোখে পড়েনি। তবে সরকার পতনের পর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে দলটি। এরইমধ্যে কূটনৈতিক মহলেও তাদের আনাগোনা বেড়েছে।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর জামায়াতের কার্যালয়ে গিয়ে একান্ত বৈঠক করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। এরপর গত এক বছরে আরও একাধিকবার চীনের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন জামায়াত নেতারা। গত জুলাইয়ে আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে চীন ঘুরে এসেছে দলটির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদলও।
গত ১ বছরে চীন ছাড়াও জামায়াত নেতারা অন্তত ৩০টি দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার ও কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, জার্মানি, জাপান, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ প্রভাবশালী অনেক দেশও। এই সময়ের মধ্যেই প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ সফর করেছেন জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে জাতিসংঘ সফরে রয়েছেন।

কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে চাইছে জামায়াত। স্ট্রিম গ্রাফিক
কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে চাইছে জামায়াত। স্ট্রিম গ্রাফিক

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক
চলতি বছরের ১০ মার্চ ঢাকার মগবাজারে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক দুই কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম ও জন ড্যানিলোভিচ। মাইলাম ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সময়ে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আর ড্যানিলোভিচ ২০০৭ থেকে ২০১১ সময়ে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কাউন্সিলর এবং কিছুদিন ডেপুটি চিফ অব মিশন ছিলেন।

এরপর গত ২১ জুলাই সোমবার দুপুরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসনের সঙ্গে দলটির আমির শফিকুর রহমানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়। সেখানে বাংলাদেশে চলমান সংস্কার কার্যক্রম, নির্বাচন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন ও আঞ্চলিক সিকিউরিটি থ্রেটসহ (নিরাপত্তা হুমকি) বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। এসময় বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা দরকার হলে সেটি করতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ জানান জামায়াতের আমির।

গত আগস্টের ২৪ তারিখ পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন জামায়াতের শীর্ষ নেতারা। তাদের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী হওয়া ওই বৈঠকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী তারিক বাযওয়া, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিরেক্টর জেনারেল (সাউথ এশিয়া ও সার্ক) ইলিয়াস মেহমুদ নিজামী, ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান হায়দার, ডেপুটি হাইকমিশনার মুহাম্মাদ ওয়াসিফ ও পলিটিক্যাল কাউন্সেল কামরান দাঙ্গলও উপস্থিত ছিলেন।

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি বৈঠক বা যোগাযোগ বাস্তবসম্মত নয়।

‘জামায়াত কখনো ভারতবিরোধী ছিল না’

জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য অন্যতম মানদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক দলের সরাসরি বৈঠক বা যোগাযোগ বাস্তবসম্মত নয়।

জামায়াতের সঙ্গেও ভারতের কোনো সরাসরি বৈঠক বা যোগাযোগের খবর পাওয়া যায়নি। তবে ২০২৪-এর সেপ্টেম্বরে ভারতের অন্তত দুইটি গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান।

এসব সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, জামায়াতে ইসলামী কখনও ‘ভারতবিরোধী ছিল না…এটি অপপ্রচার’। তিনি বলেন, ‘জামায়াতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করতে সুচিন্তিতভাবে, মিথ্যা ও অপপ্রচার করা হয়েছে।’

‘জামায়াতের কূটনৈতিক তৎপরতা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ’

কূটনীতিকদের সঙ্গে দলটির এমন তৎপরতা রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন পর্যবেক্ষকেরা। তাঁদের মতে, বৈঠকের মধ্য দিয়ে জামায়াত তাদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা তুলে ধরার চেষ্টা করছে।

জামায়াতের এসব বৈঠকের গুরুত্ব প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র সচিব এ কে এম আতিকুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘যেকোনো রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে রাজনীতিসহ যেকোনো বিষয়ে আলাপ করতে পারে। এতে দুই দেশের কূটনীতিক সম্পর্কে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। তবে এসব বৈঠকের মাধ্যমে জামায়াত তাদের উপস্থিতি ও রাজনৈতিক সক্রিয়তা তুলে ধরতে পারছে।’
অবশ্য জামায়াত সরকারে যেতে পারলে তারা কী করবে— এসব নিয়েও তাদের মতবিনিময় হয়ে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

জামায়াত নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার ও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে জামায়াতের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে ভুল তথ্য সরবরাহ করে অপপ্রচার চালিয়েছিল। জামায়াতের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কূটনীতিকদের ধারণায় পরিবর্তন আসছে বলেও দাবি তাঁদের।

বৈঠক নিয়ে যা বলছে জামায়াত
জামায়াত নেতারা বলছেন, আগামীতে দলটি ক্ষমতার অংশ হতে পারে বলে কূটনীতিকরা ধারণা করছেন। এ কারণে জামায়াতের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ও সম্পর্ক তৈরি করছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, আওয়ামী লীগ সরকার ও কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে জামায়াতের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে ভুল তথ্য সরবরাহ করে অপপ্রচার চালিয়েছিল। জামায়াতের সঙ্গে মিলিত হওয়ার মধ্য দিয়ে কূটনীতিকদের ধারণায় পরিবর্তন আসছে বলেও দাবি তাঁদের।

এসব বৈঠকে দুই দেশের রাজনীতি-অর্থনীতির বিষয়ে আলাপ হয় বলে জানিয়েছেন জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে জামায়াতের ভূমিকা, পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে আসা ইত্যাদি থেকে কূটনীতিকরা ধারণা করছেন, আগামীতে দলটি ক্ষমতার অংশীদার হতে পারে। এ কারণে বিদেশি দূতাবাস ও কূটনীতিকরা জামায়াতকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।’

অধ্যাপক মুজিবুর রহমান স্ট্রিমকে বলেন, ‘জামায়াত দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল। কূটনীতিকদের সঙ্গে এ ধরনের দলের একটা স্বাভাবিক যোগাযোগ থাকেই। জামায়াতের সঙ্গেও রয়েছে। কখনো জামায়াতের আগ্রহে, কখনো কূটনীতিকদের আগ্রহে বৈঠক হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ৫ আগস্টের পরে কূটনীতিকরা দেখছেন, জামায়াত অন্যদের সঙ্গে নিয়ে স্বৈরাচার হঠাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশের দুইটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নির্বাচনে শিবির নেতৃত্বে এসেছে তখন তারা জামায়াতের গুরুত্ব ভালো করে উপলব্ধি করতে পারছেন।

কূটনীতিকদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে চাইছে জামায়াত। তবে এই তৎপরতা কতটা ফলপ্রসূ হবে এবং ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণে কীভাবে প্রভাব ফেলবে, তা এখনো সময়ের অপেক্ষা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত