leadT1ad

আন্দোলনে টালমাটাল সার্বিয়া, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে কতটা মিলে

প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভের ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ। সেখান থেকেই মানুষকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। বাংলাদেশের আন্দোলনেও আমরা দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা।

হুমায়ূন শফিক
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২০: ৪০
স্ট্রিম গ্রাফিক

সার্বিয়ায় ২০২৪ সালের নভেম্বরে শুরু হওয়া বিক্ষোভ এখন নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। চলতি বছরের ১২ আগস্ট থেকে প্রতিদিনই বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ চলছে। এর মধ্যেই উত্তরাঞ্চলের ভ্রবাস ও ব্যাকা পালাঙ্কা শহরেও ছড়িয়ে পড়েছে এই সহিংসতা।

এই ঘটনার জেরে সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডসহ ডজনখানেক শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভে পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগও অনেক। তীব্র আন্দোলনে সরকার এখন টালমাটাল।

গত বছর জুলাইয়ে বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানেও আমরা দেখেছি ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশের দমনমূলক আচরণ। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরেই সারাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্র হয়।

১৪ আগস্ট বেলগ্রেডে এক সরকারবিরোধী বিক্ষোভে গ্রেপ্তার হন পদার্থবিদ্যার ছাত্র দুশান সভেতকোভিচ। বলকান অঞ্চলের একটি বার্তা সংস্থাকে তিনি বলেন, ‘ওদের চার-পাঁচজন (পুলিশ) আমাকে মারল, আমার মাথা কংক্রিটের সঙ্গে চেপে ধরল।’

বাংলাদেশেও আমরা একই চিত্র দেখেছি। জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পুলিশের বর্বরতা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। তারা দেশে ছাত্র-জনতাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই মেরেছে। তাদের ঘাড়ে যেন তখন কারবালার সীমার। নিজ দেশের মানুষের ওপর এতটা নির্দয় এর আগে কেউ ছিল বলে মনে পড়ে না আমাদের।

সার্বিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ প্রসঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্যই করেনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষের এক ভিডিও বিক্ষোভকে আরও উসকে দেয়। সেখানে দেখা যায়, নোভি সাদে গ্রেপ্তার হওয়া তরুণদের হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রেখেছে পুলিশ। আমরা বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টের আগে দেখেছি ছাত্র-জনতাকে পুলিশ কানে ধরে ওঠবস করিয়েছে, যা মানবতাবিরোধী। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার তা করেছে নিজের ক্ষমতাকে আরও পাকাপোক্ত করতে।

কে আছেন এই বিক্ষোভের পেছনে?

প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভের ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন গ্রুপ। সেখান থেকেই মানুষকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁরা। বাংলাদেশের আন্দোলনেও আমরা দেখেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা।

অনেক নাগরিক শান্তিপূর্ণভাবে সাড়া দিলেও, আরএফই/আরএল-সহ অন্যান্য গণমাধ্যমের ফুটেজে দেখা গেছে মুখোশধারী লোকেরা পুলিশের দিকে পাথর ও আতশবাজি নিক্ষেপ করছে।

বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীন সার্বিয়ান প্রগ্রেসিভ পার্টির কয়েকটি অফিস ভাঙচুর করেছে। বেলগ্রেড থেকে ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভালহেবো শহরে উগ্র জাতীয়তাবাদী সার্বিয়ান র‌্যাডিকাল পার্টির কার্যালয়েও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। র‌্যাডিকাল পার্টির নেতৃত্বে আছেন দোষী সাব্যস্ত যুদ্ধাপরাধী ও সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুচিচের সাবেক পরামর্শক ভইস্লাভ শেসেল।

এর আগে ২০২৪ সালের নভেম্বরে নোভি সাদে এক রেলস্টেশনের ছাদ ধসে প্রাণহানির ঘটনায় বিক্ষোভের সূত্রপাত ঘটে। ওই দুর্ঘটনায় ১৬ জনের প্রাণহানি হয়। এরপরে ছড়িয়ে পড়ে যে দুর্নীতির কারণে রেলস্টেশন নির্মাণে নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহৃত হয়েছিল। এতে সাধারণ মানুষ হতবাক হয়ে পড়ে।

বিক্ষোভে উত্তাল সার্বিয়া। ছবি: রয়টার্স
বিক্ষোভে উত্তাল সার্বিয়া। ছবি: রয়টার্স

পরবর্তী দিনগুলোতে বেলগ্রেড, নোভি সাদ ও নিশসহ অন্যান্য শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অধিকাংশ অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান। বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আমরা দেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

এই ঘটনাপ্রবাহ এমন এক বিক্ষোভ তরঙ্গের জন্ম দেয়, যা ২০০০ সালে সার্বিয়ায় স্লোবোদান মিলোশেভিচের পতনের পর আর দেখা যায়নি।

প্রথমদিকে দাবি ছিল নোভি সাদের দুর্ঘটনার দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা ও বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনা। ছয় মাস পর এখন রাজনীতির বাইরে থাকা ছাত্র সংগঠনগুলো হঠাৎ নির্বাচনের দাবিও তুলছে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে এখানেও অনেকটা মিলে যায়। ছাত্রদের নির্যাতন ও হত্যার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রথমে সবাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ ও বিচারের দাবি তোলে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার তা মানেনি, উল্টো বলপ্রয়োগ করে আন্দোলন বন্ধ করার নির্দেশ দেয়।

আলেকজান্ডার ভুচিচের প্রতিক্রিয়া

শিক্ষার্থীদের কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছিল। সরকার নোভি সাদের পুনর্গঠনের সঙ্গে সম্পর্কিত হাজার হাজার নথি প্রকাশ করে। তবে সমালোচকদের মতে, ওই আর্কাইভ ছিল অসম্পূর্ণ। এতে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য এতে ছিল না।

তাদের আরও অভিযোগ, হাজার হাজার নথি প্রকাশের মাধ্যমে ভুচিচ ও তার সরকার আসলে স্বচ্ছতার ভান করছে, অথচ বাস্তবে স্টেশন প্রকল্প নিয়ে আরও বিভ্রান্তি তৈরি করছে।

জুলাই মাসে বেলগ্রেডের নাট্যতত্ত্বের শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে হামলার অভিযোগে ক্ষমতাসীন সার্বিয়ান প্রগ্রেসিভ পার্টি (এসএনএস) অভিযুক্ত চার কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করে।

তবে ভুচিচ কখনোই তার দলের নেতাদের বা সরকারপন্থী গণমাধ্যমের উসকানিমূলক বক্তব্যের নিন্দা করেননি। এসব বক্তব্যের কিছুতে বিক্ষোভকারীদের নাৎসি কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ক্রোয়েশিয়ান ফ্যাসিস্ট সংগঠন উস্তাশের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।

সার্বিয়ায় কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ চলছে। ছবি: রয়টার্স
সার্বিয়ায় কয়েক মাস ধরে বিক্ষোভ চলছে। ছবি: রয়টার্স

এখানে বাংলাদেশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে মিল আছে। তৎকালীন সরকার আন্দোলনকারীদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা বাংলাদেশবিরোধী কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিল তাদের সঙ্গে তুলনা করে ‘রাজাকার’ অভিহিত করেছিল।

২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন

ডিসেম্বরে নির্বাচনের ঘোষিত ফল নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল সার্বিয়াতে। রাজধানী বেলগ্রেডে নির্বাচনী ফলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হলে তা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস (টিয়ার গ্যাস) নিক্ষেপ করে। কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী সপ্তাহখানেক আগে আইনসভা ও স্থানীয় নির্বাচনের ফল বাতিলের দাবি জানান।

সার্বিয়ার নির্বাচন কমিশন জানায়, ১৭ ডিসেম্বর আইনসভার নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সার্বিয়ান প্রগ্রেসিভ পার্টি (এসএনএস) ৪৬ দশমিক ৭২ শতাংশ ভোট নিয়ে জয়লাভ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসএনএস যেভাবে নির্বাচনে জয়লাভ করেছে তা অস্বচ্ছ। এতে গণমাধ্যম পক্ষপাতপূর্ণ আচরণ করেছে। প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুচিচ অনৈতিক প্রভাব খাটিয়েছেন।

বাংলাদেশের গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়েও বিশ্লেষকদের একইরকম দাবি। তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও কারচুপির মাধ্যমেই নির্বাচনে জিতে গিয়েছিল বারবার। অনেক বিশ্লেষক ও গবেষকেরা বলেছেন, বাংলাদেশের নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোট কাস্ট হয়নি। অথচ সরকার থেকে বলা হতো ৪০ শতাংশের বেশি ভোট কাস্ট হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতি

আন্দোলনকারীরা মনে করছেন, আগাম নির্বাচন হলে প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুচিচ ও তার ক্ষমতাসীন এসএনএস ক্ষমতা হারাবে। গত ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নোভি সাদের রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কয়েক হাজার মানুষ সমবেত হন। তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারে লেখা ছিল—‘আমরা অবরোধ চাই না, আমরা নির্বাচন চাই’ এবং ‘শিক্ষার্থীদের জরুরি দাবি: নির্বাচন দাও।’ এ সময় প্রেসিডেন্ট ভুচিচের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগানও দেন তাঁরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন অনুষদের সামনে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা ফ্লেয়ার নিক্ষেপ করলে পুলিশ পাল্টা কাঁদানে গ্যাস ও স্টান গ্রেনেড ছুঁড়ে তাদের পেছনে ঠেলে দেয়। রাতের দিকে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট ভুচিচ দাবি করেন, সংঘর্ষে অন্তত ১১ জন পুলিশ আহত হয়েছেন। তবে কতজন বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন, সে তথ্য পাওয়া যায়নি। ভুচিচ বলেন, ‘আমরা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের অনুমতি দেব না। সার্বিয়া একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র।’

এ সময় তিনি অভিযোগ করেন, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে। একই সঙ্গে তিনি জানান, রোববার তার সমর্থকরা সার্বিয়ার বিভিন্ন শহরে পাল্টা সমাবেশ করবে।

শেখ হাসিনাও হুবহু একই কথা বলেছিলেন। সবকিছু নাকি বিদেশি ষড়যন্ত্র। নিজের অপরাধ তিনি কখনই স্বীকার করেননি।

বিক্ষোভকারী নেবোজা কোরাচ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘সমাধান একটাই, নির্বাচন দিতে হবে। আমরা চাই শান্তি ও গণতন্ত্রের বিজয় হোক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের দায়িত্ব পালন করুক। এর অর্থ হলো নির্বাচনের আয়োজন করা, আর সেটিই হবে সমাধান, কারণ তখন সরকার পরিবর্তিত হবে।’

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, রেডিও ফ্রি ইউরোপ/রেডিও লিবার্টি

Ad 300x250

সম্পর্কিত