leadT1ad

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি

‘এডিসি আক্তার নির্দেশ দেন, কিন্তু আমি গুলি করতে চাইনি’

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২৩: ০৪
সংগৃহীত ছবি

জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনের বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।

জবানবন্দিতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-এপিবিএনের সদস্য অজয় ঘোষ বলেন, এডিসি আক্তার স্যার আমাদের সবাইকে ছাত্র-জনতার উপর গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেন। আমি গুলি করতে চাইনি। এতে স্যার আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন।

আজ রবিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা অনুষ্ঠিত হয়। জবানবন্দি গ্রহণ শেষে সাক্ষীদের জেরা করেন স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। আজ প্রসিকিউশনের পক্ষে তিন জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। এ মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণ আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে।

গত ১১ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠ দিনের মতো সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। সেদিন সাক্ষ্য দেন রাজধানীর নিউমার্কেটের দোকানদার মো. টিপু সুলতান ও মো. মনিরুজ্জামান।

১৫তম সাক্ষী অজয় ঘোষ, তিনি ১৩ এপিবিএন উত্তরা ঢাকায় কর্মরত। তিনি বলেন, 'গত বছরের ৫ আগস্ট ভোরে পিওএম মিরপুর পুলিশ লাইন থেকে আমিসহ ২০ জন অস্ত্র, গুলি, হেলমেট ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিয়ে রওনা হই। শাহবাগ থানায় গিয়ে রিপোর্ট করি। সকাল ৯টার দিকে এডিসি শাহ আলম মো. আক্তারুল ইসলাম আমাদের ব্রিফিং করে জানান যে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী থানায় এসে আন্দোলনকারীদের সরাসরি গুলি করার নির্দেশনা দিয়েছেন। সেখানে এসি ইমরুল, ইন্সপেক্টর আরশাদ স্যারও উপস্থিত ছিলেন। এরপর আমরা এডিসি আক্তার স্যারের নেতৃত্বে শহীদ মিনার এলাকায় যাই। সেখানে এডিসি আক্তার স্যারের নির্দেশে আন্দোলনরত ছাত্র জনতার ওপর সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল নিক্ষেপ ও ফাঁকা ফায়ার করে ছত্রভঙ্গ করা হয়। আনুমানিক সাড়ে ১০টার সময় শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউটের পাশে চানখারপুল চৌরাস্তার মোড়ে আমরা অবস্থান নিই। অলিগলিতে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার ভিড় ছিল। তাঁরা শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।'

এই সাক্ষী বলেন, 'ওই দিন ছাত্র জনতার "মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি এবং সরকার ঘোষিত কারফিউ ছিল। আমার নামে একটি চাইনিজ রাইফেল ও ৪০ রাউন্ড গুলি ইস্যু করা ছিল, তা আমার সাথে ছিলো। এডিসি আক্তার স্যার আমাদের সবাইকে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেন। আমি গুলি করতে চাইনি। এডিসি আক্তার স্যার আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। তিনি বলেন, "সরকারি বেতন-রেশন খাস না, গুলি করবি না কেন?" এডিসি আক্তার স্যার আমার হাতে থাকা চাইনিজ রাইফেল ও ৪০ রাউন্ড গুলি কেড়ে নিয়ে কনস্টেবল সুজনের হাতে দেয়। সুজনের হাতে থাকা ঢাল লাঠি আমার হাতে দেয়। কনস্টেবল সুজন, ইমাজ, নাসিরুল-মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, নাজিমউদ্দিন রোড, নবাবকাটারা, বকশি বাজার মোড়ে অবস্থানরত ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের গুলি করতে দেখি। পরে জানতে পারি সেখানে ৬-৭ জন আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়।'

অজয় ঘোষ আরও বলেন, 'বেলা আড়াইটার দিকে জানতে পারি যে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। তখন আমরা চানখারপুল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতর দিয়ে শাহবাগ থানার পিছন দিয়ে থানায় প্রবেশ করি। কনস্টেবল সুজনকে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে থাকা আমার নামে ইস্যুকৃত অস্ত্র ও গুলি নিয়ে শাহবাগ থানায় জমা দেই। ১৮ রাউন্ড গুলি জমা দিই। কনস্টেবল সুজন জানায়, বাকি ২২ রাউন্ড গুলি সে এডিসি আক্তার স্যারের নির্দেশে ফায়ার করেছে। সন্ধ্যা সাতটার দিকে সিভিল পোশাকে থানার পিছন দিয়ে বের হয়ে ছাত্র জনতার সাথে মিশে আমার গ্রামের বাড়ি চলে যাই। আসামি সুজন, ইমাজ এবং নাসিরুল আজ কাঠগড়ায় ডকে উপস্থিত আছে। এছাড়াও ইন্সপেক্টর আরশাদ স্যারও কাঠগড়ায় উপস্থিত আছেন।'

প্রসকিউশনের ১৬তম সাক্ষী আব্দুর রহমান ২০১৭ সালে খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগ দেন। পরবর্তীতে কনস্টেবল থেকে নায়েক পদে পদোন্নতি পেয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ১৩ এপিবিএন উত্তরা ঢাকায় যোগ দেন। বর্তমানে ঐ পদে সেখানে আছেন। তিনি বলেন, 'গত বছরের ২৮ জুলাই আইনশৃঙ্খলার ডিউটি করতে ১৩ এপিবিএন উত্তরা হতে আমরা পিওএম মিরপুর পুলিশ লাইনে আসি। ২৯ জুলাই থেকে বিভিন্ন জায়গায় ডিউটি করি। ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার "মার্চ টু ঢাকা" কর্মসূচি ছিল। ওই দিন সরকার ঘোষিত কারফিউ ছিলো। ঐ দিন আমার নেতৃত্বে ২০ জন এপিবিএন পুলিশ সদস্য ইতিপূর্বে ১৩ এপিবিএন থেকে নিজ নিজ নামে ইস্যুকৃত অস্ত্র, গুলি, ঢাল ও লাঠি নিয়ে ভোরে শাহবাগ থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিই। থানায় অফিসার ইন চার্জ আমাদের জানান যে ডিএমপির পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী আন্দোলনকারীদের উপর সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ ও গুলি করার নির্দেশ দিয়েছেন। ৯টার দিকে এডিসি আক্তার স্যারের নেতৃত্বে এসি ইমরুল ও ইন্সপেক্টর অপারেশন আরশাদ স্যারদের উপস্থিতিতে প্রায় ১০০ জন পুলিশ সদস্যকে এডিসি আক্তার স্যার ব্রিফ করেন। ব্রিফিংয়ে তিনি আমাদের ছাত্র-জনতার ওপর সর্বোচ্চ বল প্রয়োগ ও গুলি করার নির্দেশ দেন।'

প্রসিকিউশনের আরেক সাক্ষী মো. সৌরভ আহমেদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সাক্ষ্যে জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে রায়সাহেব বাজারের মেস থেকে সকালে বের হয়ে চানখারপুল এলাকায় যান। আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনারের দিকে যাওয়ার সময় বার্ন ইন্সটিটিউটের সামনে পৌঁছালে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও গুলি ছুঁড়তে থাকে।

সাক্ষী সৌরভ আহমেদ বলেন, 'আমার পাশে একজন আন্দোলনকারী বুকের বামপাশে গুলিবিদ্ধ হয়। আমি এবং আরেকজন আন্দোলনকারী তাঁকে রিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই। পথে অন্য আন্দোলনকারী রিকশা থেকে নেমে যায়। তার পরিচয় জানা না থাকার কারণে তাকে বেনামি টিকিট কেটে হাসপাতালে ভর্তি করি। কর্তব্যরত ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমি তার পরিচয় জানার চেষ্টা করি। তার পকেটে থাকা একটি সীমবিহীন বাটন ফোন পাই। সেই ফোনে কয়েকটি নাম সেভ করা ছিল। মা নামে একটি নাম্বার সেভ করা ছিলো। আমি সেই নাম্বারে কল দিই। একজন মহিলা ফোন রিসিভ করেন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কেউ আন্দোলনে গিয়েছে কি না। তিনি বলেন, "আমার ছেলে আনাস আন্দোলনে গেছে।" আমি ওনাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে আসতে বলি। আনাসের মা, বাবা ও নানা হাসপাতালে আসেন। আনাসকে দেখে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। আনাসের মা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। তার শরীরে রক্ত লেগে যায়। আনাসের মৃত্যুর সনদ ও হাসপাতালে ভর্তির টিকেট আমি আনাসের মা বাবাকে প্রদান করি। তাঁরা আনাসকে বাসায় নিয়ে যায়।'

এ মামলার গ্রেপ্তার আসামিরা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক ওসি (অপারেশন) মো. আরশেদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন মিয়া, মো. ইমাজ হোসেন ইমন ‍ও মো. নাসিরুল ইসলাম।

এ মামলার পলাতক আসামিরা হলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান ও সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।

গত ১৪ জুলাই চানখারপুলে হত্যা মামলার পলাতক চার আসামিসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখারপুলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে গুলি চালায় পুলিশ। এতে অন্যদের মধ্যে শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শাহরিক নিহত হন।

Ad 300x250

সম্পর্কিত