leadT1ad

‘‌রোটি-বেটি’‌র সম্পর্ক নিয়ে যা ভাবছে দিল্লি

শুধু নেপাল নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈকি। নেপালের তরুণ সমাজের নেতৃত্বে যে গণ-আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, তা এখন শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাতের সীমায় আটকে নেই।

স্ট্রিম প্রতিবেদকইনস্ক্রিপ্ট প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১: ৩২
স্ট্রিম গ্রাফিক

রুটির অর্থ জীবনধারণ, আর বেটি মানে তো আত্মীয়তা, সামাজিক মর্যাদা ও পারস্পরিক বিশ্বাস। তাই ‘‌রোটি-‌বোটির সম্পর্ক’‌ এই সংক্ষিপ্ত বাক্যেই লুকিয়ে আছে ভারত ও নেপালের ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও সহমর্মিতার এক দীর্ঘ অধ্যায়। এই দুই উপাদানই ভারত ও নেপালের সম্পর্কের ভিত্তি। সীমান্তের ওপারে যে সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য, পারিবারিক যোগাযোগ, বাণিজ্য, শ্রমবিনিময় এবং ধর্মীয় ঐক্য বহু দশক ধরে বজায় রয়েছে, তা এই বন্ধনকে শুধু রাজনৈতিক নয়, মানবিক সম্পর্কের গভীরতায় পৌঁছে দিয়েছে। তবে কাঠমান্ডুর সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা সেই ঐতিহ্যকে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে।

শুধু নেপাল নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈকি। নেপালের তরুণ সমাজের নেতৃত্বে যে গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে, তা এখন শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংঘাতের সীমায় আটকে নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞা, সংসদ ভবনে আগুন, বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ এবং অবশেষে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগ। এই সব ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে আলোড়ন তুলেছে। দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে চিন্তার কালো মেঘ। কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, নেপথ্যে কে, কারা করাচ্ছে -‌ এমন শত শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

এই আলোড়নের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে নেপালের নতুন অন্তর্বর্তী নেত্রী সুশীলা কার্কির নাম। নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে দেশের বিচার বিভাগে একটি গ্রহণযোগ্য মুখ তিনি।তাঁর জীবনের নানা অধ্যায় ভারতের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বেশ স্পষ্ট। ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

অলি ছিলেন চীনের গুণমুগ্ধ বন্ধু। অন্তত গত এক দশক ধরে ভারত তা-‌ই মনে করে আসছে। সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত এসসিও সম্মেলনে তা আরও স্পষ্ট করে দিয়েছেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী অলি। ওই সম্মেলনে ভারতের বিরোধিতা করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। কালাপানি ও লিপুলেখ অঞ্চল নিয়ে ছিল বিরোধিতা। এই বিতর্কিত ভূখণ্ড নেপাল দাবি করছে তাদের অংশ, অথচ ভারতের মানচিত্রেও তা অন্তর্ভুক্ত। ভারত ও চীন এই পথ ব্যবহার করে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করতে চাইলে নেপালের সম্মতি প্রয়োজন। এই যুক্তিতে তিনি আপত্তি তুলেছেন। দ্বিতীয়ত, পৌরাণিক চরিত্র রামচন্দ্রের জন্মভূমি নিয়ে তাঁর বক্তব্য ভারতীয় ধর্মীয় অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাঁর দাবি, আসল অযোধ্যা নেপালেই অবস্থিত, ভারতের অযোধ্যা নকল। যেমন জনকপুরে সীতার জন্মের তত্ত্ব সকলে মেনে নিয়েছেন, রামচন্দ্রের জন্মভূমি যে নেপালের অযোধ্যায় তা-‌ও মেনে নিক ভারত। অলির এই বক্তব্য ভারতকে কত মাত্রায় নাড়া দিতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। সদ্য গদিচ্যুত হয়ে সেনার হেফাজতে থাকাকালীন অলি তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদককে লেখা চিঠিতে চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করেছেন যে ভারতের বিরোধিতার কারণেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছে এবং এহেন পরিস্থিতির শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। অর্থাৎ,নেপালের অশান্তির জন্য পরোক্ষে ভারতকেই দায়ী করেছেন তিনি। এই বক্তব্য ভারত-নেপাল সম্পর্কে নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে বটে। তবে, আন্তর্জাতিক মহলে এখনো পর্যন্ত নেপালের অশান্তির পেছনে ভারতের হস্তক্ষেপের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এই আলোড়নের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে নেপালের নতুন অন্তর্বর্তী নেত্রী সুশীলা কার্কির নাম। নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি হিসেবে দেশের বিচার বিভাগে একটি গ্রহণযোগ্য মুখ তিনি।তাঁর জীবনের নানা অধ্যায় ভারতের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বেশ স্পষ্ট। ভারতের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর পড়াশোনা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমনকি, ভারতের সঙ্গে সখ্যর পক্ষে অবিরাম সওয়াল করেছেন সুশীলা। এইসবই তাঁকে নেপালের ভারত-‌কন্যা করে তুলেছে। সাম্প্রতিক কালে ভারত ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি সৌহার্দ্যমূলক মন্তব্য কূটনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিচারপতি পদে আসীন থাকাকালীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় কঠোর রায় ঘোষণার ফলে জনমানসে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। যদিও বিশ্লেষকদের একটা বড় অংশ মনে করে, সুশীলা যা করেছেন, তা কোনোভাবেই সরাসরি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়, বরং নেপালের বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার এক রাজনৈতিক কৌশল।

তাহলে ভারতের কী করণীয়?‌ প্রমাণভিত্তিক কূটনীতি, সহযোগিতার হাত বাড়ানো এবং সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তোলা। অযাচিত হস্তক্ষেপের পরিবর্তে বিশ্বাসযোগ্য সহযোগিতা তৈরি করাই হবে নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখার একমাত্র পথ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নেপালে যা কিছুই ঘটেছে, তা সে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতিফলন। যেখানে লাগামছাড়া দুর্নীতি, তরুণ সমাজের ক্ষোভ, বিচারবিভাগে আস্থাহীনতা এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

এদিকে, নেপালের এই পট পরিবর্তনের আবহে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়টি হলো ভারতের ভূমিকা। কেপি শর্মা অলি বরাবরই রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ভারত-‌বিরোধী অবস্থান নিয়ে চলেছিলেন। সীমান্ত নিয়ে আপত্তি, বাণিজ্যে বাধা, ধর্মীয় বিতর্ক --এই সবই তাঁর ভারতের বিরুদ্ধে ‘সতর্কবার্তা’ হিসেবে দেখেছেন অনেকে। মনে রাখতে হবে, ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় ভারত পণ্য সরবরাহে নেপালকে চাপ দেয়। ২০১৫ সালের খাদ্য ও জ্বালানি সংকটের সময় ভারতীয় নীতির কঠোরতা নেপালের সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বাড়ায়। তলে তলে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলন শুরু হয়। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র কমিউনিস্টদের হাতে চলে যাওয়ায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী মহলে অস্বস্তির সঞ্চার হয়। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের ভেতরে অখুশির কারণ নেই বলেই মনে করা হচ্ছে।

এমতাবস্থায় ভারতের জন্য পড়শি দেশের এই পরিস্থিতি একদিকে যেমন চ্যালেঞ্জের, তেমনই সুযোগেরও বটে। নেপালের অচলাবস্থার সরাসরি প্রভাব পড়ছে সীমান্ত-বাণিজ্যে। রুপাইদিহা, জগবানি‌সহ বিভিন্ন সীমান্ত শহরে ট্রাক চলাচল বন্ধ, পণ্য পরিবহনে বিঘ্ন ঘটছে এবং মানুষের যাতায়াতে বাধা তৈরি হয়েছে। ফলে স্থানীয় বাজারে প্রতিদিনের লোকসান এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় সমস্যা বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতকে একদিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্ত স্থিতিশীলতা রক্ষায় সক্রিয় হতে হচ্ছে, অন্যদিকে নেপালের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে অযাচিত হস্তক্ষেপ এড়িয়ে চলতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি ভারতের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক অতীতে পড়শি দেশ শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে। শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটে চীনের প্রভাব বাড়লেও ভারত সাহায্য দিয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে। গতবছর আগস্টের পর সম্পর্কে বরফ জমলেও ইদানীং বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও সংযোগ বাড়ছে। তবে, সীমান্ত ইস্যু এখনো আলোচনার স্তরে রয়ে গিয়েছে। নেপালের ক্ষেত্রেও একই ধরনের সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। অর্থনৈতিক সহযোগিতা, মানবিক সাহায্য, পরিকাঠামো উন্নয়ন—এই সবকে কেন্দ্র করে রোটি-‌বেটির সম্পর্ক পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে তরুণ সমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা নেপালের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নেপালের বর্তমান সংকট দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক পালাবদলেই সীমাবদ্ধ নয়। এই অশান্তির পেছনে রয়েছে গভীরতর সামাজিক অসন্তোষ। সেই অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছেমাত্র। সুশীলা কার্কির মতো গ্রহণযোগ্য মুখ সাময়িকভাবে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারেন, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছ নির্বাচন, প্রশাসনিক জবাবদিহিত এবং বাস্তবসম্মত ও মানবিক সীমান্তনীতি।

তাহলে ভারতের কী করণীয়?‌ প্রমাণভিত্তিক কূটনীতি, সহযোগিতার হাত বাড়ানো এবং সম্মানজনক সম্পর্ক গড়ে তোলা। অযাচিত হস্তক্ষেপের পরিবর্তে বিশ্বাসযোগ্য সহযোগিতা তৈরি করাই হবে নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক সুদৃঢ় রাখার একমাত্র পথ। তবেই ‘‌রোটি-বেটি’‌র ঐতিহ্য নতুন যুগেও অবিচল থাকবে। অন্যথায় সন্দেহ, বিভেদ আর অস্থিরতা দুই দেশের দীর্ঘ সম্পর্ককে বিপন্ন করে তুলবে। এমন এক সময়ের বাঁকে এসে ভারতের রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা, অর্থনৈতিক সহানুভূতি এবং মানবিক দায়িত্ববোধই নির্ধারণ করবে আগামী দিনের দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক ইতিহাস।

Ad 300x250

সম্পর্কিত