দীর্ঘ ৩৩ বছরের অচলাবস্থার পর ফিরছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা জাকসু। ছাত্র রাজনীতিতে আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা জাকসু আসলে কী? কীভাবে কাজ করে, কারা ভোট দিতে পারেন বা নির্বাচনের প্রার্থী কারা হতে পারেন? আসন্ন জাকসু নির্বাচনের আগে এসব জরুরি প্রশ্নের উত্তরই মিলবে এই লেখায়।
তুফায়েল আহমদ
দীর্ঘ ৩৩ বছরের অচলাবস্থার পর অবশেষে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার এ বহুপ্রতীক্ষিত মঞ্চকে ঘিরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা কাজ করছে। আজ বৃহস্পতিব্বার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। জাকসুর নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। নির্বাচনের মোট ভোটার ১১ হাজার ৮৯৭ জন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মাথায়, ১৯৭২ সালে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা ও দাবি আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট আটবার জাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ।
জাকসুর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে এবং সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। সেই নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) হিসেবে এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে কাজী শহীদ আহমেদ পাপ্পু নির্বাচিত হন।
কিন্তু ১৯৯৩ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জের ধরে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ জাকসুর কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এরপর দীর্ঘ ৩৩ বছর জাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষার্থীদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় তাঁদের নানা সমস্যা ও অধিকার নিয়ে কথা বলার আনুষ্ঠানিক কোনো মাধ্যম ছিল না। অবশেষে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ বা জাকসু হলো বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাকসু একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যার মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়তা করা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, দাবি আদায় ও নেতৃত্ব বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রসমাজের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, তারই ধারাবাহিকতায় জাকসু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করেছে। জাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। যা তাঁদের দৈনন্দিন সমস্যা ও দাবি-দাওয়া প্রশাসনের কাছে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
বিভিন্ন পদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে জাকসু গঠিত হয়। এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকারবলে জাকসুর সভাপতি ও কোষাধ্যাক্ষ পদাধিকারবলে এর কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এই দুই অনির্বাচিত পদ ছাড়া বাকি সব পদে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদ এবং কার্যকরী সদস্য পদ নিয়ে জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় সংসদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলের জন্য আলাদা হল সংসদ নির্বাচনেরও বিধান রয়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদগুলো মিলেই জাকসুর পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি হয়।
গঠনতন্ত্র অনুসারে জাকসুর প্রধান কাজগুলো হলো:
১. শিক্ষার্থীদের জন্য কমনরুম রক্ষণাবেক্ষণ করা; যেখানে দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী ও অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকবে।
২. শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সাময়িকপত্র, জার্নাল, বুলেটিন ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করা।
৩. নিয়মিতভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য দল পাঠানো।
৫. সমাজসেবামূলক কাজ, যেমন—পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বৃক্ষরোপণ, জনকল্যাণমূলক বক্তৃতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
৬. শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। পাশাপাশি পেশাগত জীবন নিয়ে বিভিন্ন কর্মসহায়ক উদ্যোগ গ্রহণ করা।
জাকসু গঠনতন্ত্র অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়মিত ও বৈধ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-সংসদের সদস্য বলে গণ্য হবেন। কেবল তাঁরাই ভোটার বলে বিবেচিত হবেন এবং শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এমফিল, পিএইচডি, উইকেন্ড ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন না। এ ছাড়া, বিভিন্ন কোর্সের অনিয়মিত শিক্ষার্থীরাও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই শুধু ভোটার হতে পারবেন।
ভোটার হওয়ার সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে যেকোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী জাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। তবে কোনো প্রার্থী একাধিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। প্রার্থী হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পাওনা পরিশোধ করে নির্দিষ্ট মনোনয়নপত্রের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়।
দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এ মামুনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ভোটকেন্দ্র ও সময়: অতীতের মতো এবার আবাসিক হলের ভেতরে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে না। পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক ভবন ও অনুষদে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। মোট ১৬টি হলের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনে প্রায় ২০০টি বুথে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ও সব ছাত্র সংগঠনের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলবে।
প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা: এবারের নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। প্রশাসন বলেছে, প্রতিটি ভোটারের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে, যেখানে শিক্ষার্থীর ছবি ও তথ্য যাচাই করা হবে। ফলে জাল ভোট বা একজনের ভোট আরেকজনের দেওয়া রোধ করা যাবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
নির্বাচনী তফসিল: নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—খসড়া ও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, মনোনয়নপত্র বিতরণ ও জমা, মনোনয়নপত্র বাছাই ও প্রত্যাহার এবং চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ। নির্বাচনের দিন ভোট গণনা শেষে রাতেই ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
হল সংসদ: কেন্দ্রীয় সংসদের পাশাপাশি প্রতিটি আবাসিক হলের জন্য ১৩টি পদে হল সংসদ নির্বাচনও একই দিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় সংসদ ও নিজ নিজ হল সংসদের জন্য একসঙ্গে ভোট দেবেন।
ডাকসুর মতোই জাকসুর গুরুত্ব কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ নয়। ৩৩ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তা ছাড়া দীর্ঘ দিন ক্যাম্পাসে নির্বাচিত কোনো ছাত্র প্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া ও সমস্যাগুলো প্রশাসনের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাত না বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত বিশ্বাস বাপি বলেন, ‘অনেক দিন আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরা বা তা পূরণেরও কেউ নেই। এবারের নির্বাচন সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাকসু একসময় ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম ছিল। এখান থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতারা পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই নির্বাচনের ফলে সেই ধারা ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়।’
দীর্ঘ সময় পর নির্বাচন হওয়ায় এবং ক্যাম্পাসে কোনো একক ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য না থাকায় একটি নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা বেড়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন, যাঁরা ক্যাম্পাসের আবাসন সংকট, পরিবহন সমস্যা, খাবারের মান এবং গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবেন।
তবে জাকসু নির্বাচন ঘিরে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রশাসনের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। সব মিলিয়ে, এ নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনই নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের বড় উৎসবও।
দীর্ঘ ৩৩ বছরের অচলাবস্থার পর অবশেষে আজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার এ বহুপ্রতীক্ষিত মঞ্চকে ঘিরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও উদ্দীপনা কাজ করছে। আজ বৃহস্পতিব্বার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা শেষ হয়েছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে প্রশাসন। জাকসুর নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবারের নির্বাচনে ২৫টি পদে লড়ছেন ১৭৭ জন প্রার্থী। নির্বাচনের মোট ভোটার ১১ হাজার ৮৯৭ জন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র দুই বছরের মাথায়, ১৯৭২ সালে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা ও দাবি আদায়ের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট আটবার জাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ।
জাকসুর প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে এবং সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। সেই নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) হিসেবে এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে কাজী শহীদ আহমেদ পাপ্পু নির্বাচিত হন।
কিন্তু ১৯৯৩ সালে ক্যাম্পাসে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জের ধরে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক কাজী সালেহ আহমেদ জাকসুর কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এরপর দীর্ঘ ৩৩ বছর জাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষার্থীদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় তাঁদের নানা সমস্যা ও অধিকার নিয়ে কথা বলার আনুষ্ঠানিক কোনো মাধ্যম ছিল না। অবশেষে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে এই অচলাবস্থার অবসান ঘটতে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ বা জাকসু হলো বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাকসু একটি অরাজনৈতিক সংগঠন, যার মূল লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে সহায়তা করা। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, দাবি আদায় ও নেতৃত্ব বিকাশের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিভিন্ন আন্দোলনে ছাত্রসমাজের যে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা, তারই ধারাবাহিকতায় জাকসু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করেছে। জাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাঠামোতে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে। যা তাঁদের দৈনন্দিন সমস্যা ও দাবি-দাওয়া প্রশাসনের কাছে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করে দেয়।
বিভিন্ন পদে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে জাকসু গঠিত হয়। এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদাধিকারবলে জাকসুর সভাপতি ও কোষাধ্যাক্ষ পদাধিকারবলে এর কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এই দুই অনির্বাচিত পদ ছাড়া বাকি সব পদে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তাঁদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেন।
সহ-সভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদকসহ (জিএস) বিভিন্ন সম্পাদকীয় পদ এবং কার্যকরী সদস্য পদ নিয়ে জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদ গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় সংসদের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলের জন্য আলাদা হল সংসদ নির্বাচনেরও বিধান রয়েছে। কেন্দ্রীয় সংসদ ও হল সংসদগুলো মিলেই জাকসুর পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তৈরি হয়।
গঠনতন্ত্র অনুসারে জাকসুর প্রধান কাজগুলো হলো:
১. শিক্ষার্থীদের জন্য কমনরুম রক্ষণাবেক্ষণ করা; যেখানে দৈনিক পত্রিকা, সাময়িকী ও অভ্যন্তরীণ খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকবে।
২. শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সাময়িকপত্র, জার্নাল, বুলেটিন ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করা।
৩. নিয়মিতভাবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, বিতর্ক, আবৃত্তি ও রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা।
৪. বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা এবং আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য দল পাঠানো।
৫. সমাজসেবামূলক কাজ, যেমন—পরিচ্ছন্নতা অভিযান, বৃক্ষরোপণ, জনকল্যাণমূলক বক্তৃতা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করা।
৬. শিক্ষার্থীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। পাশাপাশি পেশাগত জীবন নিয়ে বিভিন্ন কর্মসহায়ক উদ্যোগ গ্রহণ করা।
জাকসু গঠনতন্ত্র অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়মিত ও বৈধ শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী-সংসদের সদস্য বলে গণ্য হবেন। কেবল তাঁরাই ভোটার বলে বিবেচিত হবেন এবং শিক্ষার্থী সংসদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
তবে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এমফিল, পিএইচডি, উইকেন্ড ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থীরা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন না। এ ছাড়া, বিভিন্ন কোর্সের অনিয়মিত শিক্ষার্থীরাও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন না। স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই শুধু ভোটার হতে পারবেন।
ভোটার হওয়ার সব শর্ত পূরণ সাপেক্ষে যেকোনো নিয়মিত শিক্ষার্থী জাকসু নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। তবে কোনো প্রার্থী একাধিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। প্রার্থী হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পাওনা পরিশোধ করে নির্দিষ্ট মনোনয়নপত্রের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশ করা হয়।
দীর্ঘদিন পর অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবার প্রক্রিয়ায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। নির্বাচন পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ এ মামুনকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ভোটকেন্দ্র ও সময়: অতীতের মতো এবার আবাসিক হলের ভেতরে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে না। পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক ভবন ও অনুষদে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। মোট ১৬টি হলের শিক্ষার্থীদের জন্য ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ভবনে প্রায় ২০০টি বুথে ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করা হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ও সব ছাত্র সংগঠনের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ চলবে।
প্রযুক্তি ও স্বচ্ছতা: এবারের নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। প্রশাসন বলেছে, প্রতিটি ভোটারের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে, যেখানে শিক্ষার্থীর ছবি ও তথ্য যাচাই করা হবে। ফলে জাল ভোট বা একজনের ভোট আরেকজনের দেওয়া রোধ করা যাবে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্র সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে এবং পুরো প্রক্রিয়াটি কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে।
নির্বাচনী তফসিল: নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—খসড়া ও চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, মনোনয়নপত্র বিতরণ ও জমা, মনোনয়নপত্র বাছাই ও প্রত্যাহার এবং চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ। নির্বাচনের দিন ভোট গণনা শেষে রাতেই ফলাফল ঘোষণা করা হবে।
হল সংসদ: কেন্দ্রীয় সংসদের পাশাপাশি প্রতিটি আবাসিক হলের জন্য ১৩টি পদে হল সংসদ নির্বাচনও একই দিনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় সংসদ ও নিজ নিজ হল সংসদের জন্য একসঙ্গে ভোট দেবেন।
ডাকসুর মতোই জাকসুর গুরুত্ব কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই সীমাবদ্ধ নয়। ৩৩ বছরের দীর্ঘ বিরতির পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুদ্ধারের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তা ছাড়া দীর্ঘ দিন ক্যাম্পাসে নির্বাচিত কোনো ছাত্র প্রতিনিধি না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া ও সমস্যাগুলো প্রশাসনের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাত না বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী অমিত বিশ্বাস বাপি বলেন, ‘অনেক দিন আমাদের ক্যাম্পাসে ছাত্র প্রতিনিধি নেই। ফলে শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি তুলে ধরা বা তা পূরণেরও কেউ নেই। এবারের নির্বাচন সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাকসু একসময় ভবিষ্যৎ জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম ছিল। এখান থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতারা পরবর্তীকালে দেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এই নির্বাচনের ফলে সেই ধারা ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়।’
দীর্ঘ সময় পর নির্বাচন হওয়ায় এবং ক্যাম্পাসে কোনো একক ছাত্র সংগঠনের একচ্ছত্র আধিপত্য না থাকায় একটি নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা বেড়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবেন, যাঁরা ক্যাম্পাসের আবাসন সংকট, পরিবহন সমস্যা, খাবারের মান এবং গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবেন।
তবে জাকসু নির্বাচন ঘিরে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থান নিশ্চিত করা এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে ক্যাম্পাসের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা প্রশাসনের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। সব মিলিয়ে, এ নির্বাচন শুধু শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচনই নয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের বড় উৎসবও।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ হচ্ছে আজ। ১৯৯২ সালের পর এটাই প্রথম জাকসু নির্বাচন। গত ৩৩ বছর এই নির্বাচন হয়নি। তাই আজ মনে পড়ছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার সেই লাইন— তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি।
৪ ঘণ্টা আগেইতিহাস বলছে, বিপ্লবের নেপথ্যে থাকে কোনো মহৎ সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার অভীপ্সা। আর সেই লড়াইয়ে পুরোভাগে নেতৃত্ব দেন বিদ্রোহী স্পার্টাকাস। একুশ শতকের অভ্যুত্থানের কোনো একক নায়ক নেই। কোনো একটি পক্ষ নেই, এমনকি কোনো সুপরিকল্পনাও হয়তো থাকে না।
১ দিন আগেতরুণেরা এখন বালেন্দ্রকে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর হিসেবে চাইছেন, দেশটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বর্তমানে চলছে এমনই রব।
২ দিন আগেআজ ডাকসু নির্বাচন। দীর্ঘ ছয় বছরের বিরতির পর আবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডাকসু। এ নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়েছে সারাদেশে। এমনকি অনেকেই মনে করছেন, এ নির্বাচন প্রশাসনের জন্য জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি পরীক্ষা।
২ দিন আগে