leadT1ad

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্র

শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার

বাসস
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তথ্যচিত্র। ভিডিও থেকে নেওয়া ছবি

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।

গত বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) 'বাংলাদেশ'স মিসিং বিলিয়ন্স, স্টোলেন ইন প্লেইন সাইট' (বাংলাদেশের হারানো বিলিয়নস: চোখের সামনেই লুট) শীর্ষক ডকুমেন্টারিতে এ তথ্য জানায় সংবাদমাধ্যমটি।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমস অনুসন্ধান করেছে, কীভাবে এই বিপুল অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে এবং সেটি ফেরত আনার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না। অনুসন্ধাকালে সংবাদমাধ্যমটি বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, বিশেষজ্ঞ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা বলেছে।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের তথ্যচিত্রে বলা হয়, মূলত তিনটি প্রধান উপায়ে এই বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়েছে: বাণিজ্যের আড়ালে পণ্যের মূল্য কম বা বেশি দেখানো, হুন্ডি ও হাওয়ালার মতো অবৈধ ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার এবং বিদেশে সম্পত্তি ক্রয়। এক্ষেত্রে পাচারকৃত অর্থের অন্যতম প্রধান গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তথ্যচিত্রে বলা হয়েছে, এই অর্থ পাচারের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরিবারের সদস্যরা জড়িত ছিলেন। অবকাঠামো প্রকল্প থেকে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের নামও উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও, বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলমের বিরুদ্ধেও অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।

তথ্যচিত্রে ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান জন রিড জানান, তারা এমনসব ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন যেখানে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বন্দুকের মুখে ব্যাংকের পরিচালককে অপহরণ করে জোরপূর্বক পদত্যাগ করিয়েছে এবং তাদের শেয়ার শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠদের কাছে হস্তান্তর করতে বাধ্য করেছে।

লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক খান বলেন, ‘শেখ হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি কোনো গোপন বিষয় ছিল না। সেই সময় যা ঘটেছে, তার অনেক কিছুই সিনেমার গল্পের মতো। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ‘হল অব মিররস’ বা ‘আয়না ঘর’ নামক এক কুখ্যাত কারাগারে বন্দি ছিলেন।’

মোশতাক খান আরও বলেন, গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের সহায়তায় প্রাক্তন শাসকগোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠরা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।

ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সংবাদদাতা সুজানাহ স্যাভেজ বলেন, ‘আমরা প্রায়ই মনে করি স্বৈরতন্ত্র ও ব্যাপক দুর্নীতি যেন কেবল দূরদেশেই ঘটে। কিন্তু বাস্তবে এটি বৈশ্বিক সমস্যা, আর যুক্তরাজ্যও এর কেন্দ্রবিন্দু।’

সুজানাহ স্যাভেজ আরও বলেন, ‘অর্থ লুট হয়েছে, সেটা জানা এক বিষয়। কিন্তু তা ফেরত আনা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। সম্পদ পুনরুদ্ধারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো—প্রায়শই চুক্তি বা সমঝোতার প্রয়োজন হয়, অর্থ লুটকারীদের সঙ্গেই সমঝোতায় পৌঁছাতে হয়। এতে প্রশ্ন ওঠে—কতটা অর্থ ফেরত আনা যাবে আর তা জনগণের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। ফৌজদারি মামলার জন্য খুবই কঠোর প্রমাণের মানদণ্ড পূরণ করতে হয়।’

তথ্যচিত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্পদ পুনরুদ্ধার টাস্কফোর্সের উপদেষ্টা ইফতি ইসলাম বলেন, ‘এটি ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল প্রক্রিয়াগুলোর একটি। অনেকে বলেন, সব ফেরত আনা সম্ভব নয়। আমি বলি, যতটুকু সম্ভব ততটুকু আমাদের লক্ষ্য। আমাদের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ খুঁজতে হবে, লেনদেনের ধারা অনুসরণ করতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সহায়তা নিতে হবে।’

ইফতি ইসলাম আরও জানান, এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে ব্যাংক ও ব্যবসা খাত থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার লোপাট হয়েছে। সম্ভবত এটি বিশ্বের ইতিহাসে কোনো দেশের সবচেয়ে বড় অর্থপাচার।

সুজানাহ স্যাভেজ বলেন, এ অর্থ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য। তবে অর্থ পাচারে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর ওপর প্রভাব ধরে রাখবে কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

জন রিড বলেন, ‘বাংলাদেশের বিপ্লব হয়তো এক মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত। তবে আবারও এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে যেখানে একদল রাজনীতিবিদ ক্ষমতা পুরোপুরি কুক্ষিগত করবে।’

অধ্যাপক মোশতাক খান বলেন, ‘যেসব মৌলিক প্রতিষ্ঠান এখন সামনে এসেছে, সেগুলোর সংস্কার অপরিহার্য। যে-ই ক্ষমতায় আসুক না কেন, এই সংস্কার ঠেকানো কঠিন হবে।’

প্রামাণ্যচিত্রের শেষের দিকে ছাত্রনেত্রী হৃদি বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো, আমরা হয়তো আমাদের শহীদদের প্রতি দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবো না।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত