leadT1ad

‘টেলিকম নীতিমালা’ যেভাবে এল, এসএমই শিল্পের ক্ষতির শঙ্কা আছে কি

স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা
প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২: ৪৬
‘টেলিকম নীতিমালা’ যেভাবে এল, এসএমই শিল্পের ক্ষতির শঙ্কা আছে কি। স্ট্রিম গ্রাফিক

প্রস্তাবিত ‘টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক অ্যান্ড লাইসেন্সিং নীতিমালা-২০২৫’-এ অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। সরকার বলছে, এই নীতিমালার মধ্য দিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতে ‘একক নিয়ন্ত্রণ ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য’ কমানোর পাশাপাশি ‘সুলভে মানসম্মত সেবা’ নিশ্চিত সম্ভব হবে। গত বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে নীতিমালাটি অনুমোদন দেওয়া হয়। নতুন এই নীতিমালায় চার ধরনের লাইসেন্স দিয়ে টেলিযোগাযোগ খাতের সব সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা চালুর কথা বলা হয়েছে।

চলতি বছরের এপ্রিল মাসে নীতিমালাটির খসড়া প্রকাশের পরপরই তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল বিএনপি। গত ৩ জুলাই গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, টেলিকম নীতিমালার খসড়া প্রস্তুতের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করা হয়েছে। পাশাপাশি পলিসি প্রস্তাবনায় বেশ কিছু জায়গায় বড় অপারেটরদের বেশি সুবিধা দেওয়া এবং স্থানীয়ভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে দলটি।

যদিও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে নীতিমালার খসড়ায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।

যা আছে প্রস্তাবিত নীতিমালায়

উপদেষ্টা পরিষদে নীতিমালা অনুমোদনের পর ওইদিনই রাজধানীর সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। সংবাদ সম্মেলনে নীতিমালার সারসংক্ষেপ ব্যাখ্যা করে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানান, এই নীতিমালার মাধ্যমে লাইসেন্সিংয়ের ক্ষেত্রে স্তরায়ন কমিয়ে সরকার মধ্যস্বত্ত্বভোগী কমিয়ে দেবে এবং প্রতিযোগিতামূলক সেবা নিশ্চিত করবে। এতে সরকারের রাজস্ব না কমিয়েও গ্রাহকদের সুলভ মূল্যে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

‘লাইসেন্স কমানো’র বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি জানান, বিটিআরসি ২৬ ধরনের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। ২ হাজার ৯৯৯টি প্রতিষ্ঠান এসব লাইসেন্স সংগ্রহ করে বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকে। অর্থাৎ এর মাধ্যমে জনগণের কাছে সেবা পৌঁছাতে অতিমাত্রায় স্তরায়ন সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে বিশৃঙ্খলাও তৈরি হয়েছে। এই ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং পদ্ধতির স্তরায়ন বা মধ্যসত্ত্বভোগীদের স্তরগুলো বাদ দিয়ে মাত্র তিনটি স্তরে নিয়ে আসা হয়েছে। এর পাশাপাশি স্যাটেলাইট নির্ভর টেলিযোগাযোগ সেবার জন্য আরেকটি লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে তিন যোগ এক- চারটি লাইসেন্সের মাধ্যমে দেওয়া যাবে এই খাতের সেবা।

বর্তমান লাইসেন্সিং পদ্ধতিতে ‘মধ্যসত্ত্বভোগী ব্যবস্থা’ বাদ দিয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হয়েছে বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী। এই নীতিমালার মাধ্যমে টেলিযোগাযোগ খাতে যারা ব্যবসা করেন, তাদের সেবার মানের নিশ্চয়তা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। তৃতীয়ত, এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা সম্প্রসারণ করে ভয়েস কল ও ডেটা সার্ভিসের মূল্যকে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব।

নতুন এই নীতিমালাকে একই সঙ্গে ব্যবসাবান্ধব ও গ্রাহকবান্ধব বলে জানান ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব। তিনি বলেন, যারা আইটিসি কিংবা আইআইজি বা আইজিডব্লিউ পর্যায়ে কাজ করতেন, তারা এখন এক লাইসেন্সে তিন ধরনের কাজই করতে পারবেন। অর্থাৎ যারা আইটিসি করতো তারা এখন আইআইজি করতে পারবে, যারা আইজিডব্লিউ করতো তারা এই সবগুলো সেবা দিতে পারবে। ক্যাটাগরিটা বড় করে সেখানে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।

‘একইভাবে দ্বিতীয় স্তরে ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার লেআউট তৈরি করেছি। ফাইবার নেটওয়ার্ক, টাওয়ার ব্যবসা, ডেটা সেন্টারের মত অবকাঠামো খাতে যারা বিনিয়োগ করবে তাদের আগে পৃথক লাইসেন্স নিতে হত। এখন এক লাইসেন্সে তারা সব ব্যবসা করতে পারবে। এর মানে হচ্ছে কারও ব্যবসা বন্ধ হয়নি বরং প্রতিযোগিতা বেড়েছে।’

দেশে আরও মোবাইল ফোন অপারেটর থাকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘অন্য দেশে কয়েক ডজন মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাংলাদেশে মাত্র চারটি। এখানে যাতে আরও কোম্পানি আসতে পারে এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে পারে সেই বিষয়গুলো আমরা নতুন নীতিমালায় নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সাথে প্রাইভেট ফাইভ-জি, ভয়েস ওভার ওয়াইফাই, ওয়াইফাই-৬, ওয়াইফাই-৭ এর মত সেবাগুলো দেওয়া যাবে। এর ফলে আগের চেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা হবে এবং গ্রাহকরা কম মূল্যে সেবা পাবে।’

প্রস্তাবিত নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছে যেভাবে

নীতিমালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) নিজ উদ্যোগে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু করে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ঢালাওভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নিবন্ধন দিয়েছিল। নতুন এ নীতিমালার আগে নেটওয়ার্ক টপোলজির জন্য ২০১০ সালের আন্তর্জাতিক দীর্ঘ দূরত্ব টেলিযোগাযোগ সেবা (আইএলডিটিএস) নীতি অনুসরণ করা হতো। তবে এই নীতিতে বহুস্তরীয় ও জটিল লাইসেন্সিং ব্যবস্থা ছিল। পরিবর্তে একীভূত ও প্রযুক্তি-নিরপেক্ষ কাঠামো আনা হয়েছে নতুন নীতিমালায়। এই অভিযোগও আছে— পূর্বের ব্যবস্থার সুবিধা নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা। যে কারণে অন্তর্বর্তী সরকার এ নীতিমালা সংস্কারের উদ্যোগ নেয়।

সরকারের পক্ষ থেকে একজন কমিশনারের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটির সদস্য ছিলেন বিটিআরসি ও ডাক, টেলিযোগাযোগ বিভাগ এবং আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারা। এই কমিটি ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের টেলিকমিউনিকেশন রি-স্ট্রাকচারিংয়ের ওপর করা একটি কনসালটেন্সি রেকোমেন্ডাশন পেপার পর্যালোচনা করেছে। পাশাপাশি খাত সংশ্লিষ্ট স্থানীয় ১৫ জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে চার বার এবং আন্তর্জাতিক ছয়জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে দুইবার দিনব্যাপী কর্মশালার আয়োজন করে।

এছাড়াও সব শ্রেণীর অংশীজনদের সঙ্গে দুই সপ্তাহে দুটি কর্মশালার আয়োজন করা হয়। প্রতিটি কর্মশালায় শতাধিক ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। কমিটি একটি ‘রিসার্স বেস মেথডলজি’ ব্যবহার করে কাজটি সম্পন্ন করে। প্রায় তিন মাস সময় নিয়ে নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়া তৈরি করা হয় এবং তা নিয়ে জনমত নিতে ১৫ দিনের জন্য বিটিআরসির ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এরপর খসড়াটি আবারও পর্যালোচনা করা হয় এবং মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ আকারে পাঠানো হয়।

মন্ত্রণালয় আরো প্রায় ১৫ দিন এই খসড়ার ওপর বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মন্তব্যসহ পরামর্শ নেয়। এরপর খসড়া নীতিমালাটি সংশোধন করে চূড়ান্ত করা হয়। এ নিয়ে গত ৩ জুলাই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্তব্যের জন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়।

তবে বিটিআরসির জমা দেওয়া খসড়া নীতিমালাটির কিছু জায়গায় পরিবর্তন আনে মন্ত্রণালয়। বিটিআরসির মূল প্রস্তাবনায় পাঁচ থেকে ছয় স্তরের লাইসেন্সির টপোলজি কমিয়ে প্রধান তিন স্তরের লাইসেন্স ক্যাটাগরি করার ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সমর্থন করেছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব প্রকৌশলী হওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিজেই ‘টেকনিক্যাল ইলাবোরেশন’ করেছেন।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। ছবি: সংগৃহীত

এসএমই শিল্পের ক্ষতির আশঙ্কা আছে কি?

নতুন টেলিকম নীতিমালায় বড় অপারেটরদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। বড় অপারেটর বলতে মোবাইল অপারেটরদের বোঝানো হয়েছে। তবে মোবাইল অপারেটররা যেন সব স্তরে অপারেট করতে না পারে সেই বিষয়টি নতুন নীতিমালায় বিটিআরসি গুরুত্ব দিয়ে দেখেছে।

মূলত মোবাইল অপারেটররা সর্বনিম্ন স্তরে (অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্রোভাইডার-এএনএসপি) সরাসরি সেবা দেবে। এই স্তরে আইএসপিরাও (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। আইএসপির মধ্যে দুটি ভাগ করা হয়েছে। যারা তুলনামূলক বড় অপারেটর বা সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে এবং রিজিওন্যাল সেবা দানকারী হিসেবে ডিস্ট্রিক্ট আইএসপি লাইসেন্সির প্রস্তাব করা হয়েছে। আইএসপি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে।

ডিস্ট্রিক্ট আইএসপিদেরই বিটিআরসি আরো সুযোগের প্রস্তাব দিয়েছিল। যেমন তাদের লাইসেন্সের প্রয়োজন হতো না, সহজ প্রক্রিয়ায় শুধু এনলিস্টমেন্ট করেই ক্ষুদ্র পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারতো। কিন্তু সেটা তারা গ্রহণ করেনি।

টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরের লাইসেন্সধারীরা সরাসরি এসএমই শিল্পের আওতায় পড়ে না। বরং টেলিকমিউনিকেশন এবং আইসিটি সেক্টর এসএমই শিল্পের এনাবেলর হিসেবে কাজ করে। নতুন নীতিমালা বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ ডিজিটাল ইকোনমিকে বিপুলভাবে উৎসাহিত করবে।

বড় অপারেটরদের মনোপলি কমানোর জন্য এসএমপি (সিগনিফিক্যান্ট মার্কেট প্লেয়ার) নীতিমালা দিয়ে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। প্রয়োজন হলে এই নীতিমালার পরিমার্জন, সংশোধন এবং যুগোপযোগী করা হবে বলেও জানিয়েছে বিটিআরসি।

প্রস্তাবিত নীতিামালার বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) অধ্যাপক এম মেসবাহ উদ্দিন সরকার স্ট্রিমকে বলেন, চলমান নানা সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নীতিমালাটি করা হয়েছে। আগে অনেক ধরনের চুক্তি বা প্রতিষ্ঠান ও গ্রাহকদের মধ্যে মধ্যস্বত্ত্বভোগী (মিডলম্যান) ছিল। বর্তমান নীতিমালার ফলে এটি তিনটির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। নীতিমালার ফলে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ও সেবার মান ভালো হওয়ার সুযোগ আছে এবং প্রতিযোগিতাও বাড়তে পারে।

তিনি আরও বলেন, যদিও নীতিমালা নিয়ে পুরনো ও দেশীয় উদ্যোক্তারা কিছু শঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তবে ব্যবস্থাপনা যথাযথ হলে নীতিমালার ফল ভালো হবে। সঠিক প্রক্রিয়াতেই নীতিমালা হয়েছে। এই নীতিমালায় পাহাড়ি বা বিচ্ছিন্ন অঞ্চলেও নেটওয়ার্কের কাভারেজ ভালো করার ব্যাপারে বলা আছে। সিম কার্ডের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যত্রতত্র বিক্রিও নিয়ন্ত্রিত হবে।

Ad 300x250

সম্পর্কিত