leadT1ad

শ্রদ্ধা

ফরিদা পারভীন: ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়…’

গতকাল রাত সোয়া ১০টায় প্রয়াত হয়েছেন বরেণ্য লালনসংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীন। লালনের গানকে বিশ্ব-দরবারে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তাঁর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। অনেক শিল্পীর মধ্যে ফরিদা পারভীন কেন স্বতন্ত্র, তাঁর মৃত্যুতে শোকাহত হৃদয়ে তা জানাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপক সাইম রানা।

সাইম রানা
স্ট্রিম গ্রাফিক

ফরিদা পারভীন এমন একজন শিল্পী, যিনি নাগরিক ও গ্রামীণ—দুই ধরনের গায়নশৈলীর সুমিশ্র কণ্ঠরূপকার। এই ধরনের গায়কী গুণ উপমহাদেশের খুব কমই পাওয়া যায়। যেমনটি দেখেছি নুসরাত ফতেহ আলী খান বা আবিদা পারভীনের কাওয়ালির মধ্যে। উদাহরণ দেখে অনেকের খটকা লাগতে পারে যে শুধু ফরিদা পাভীন কেন, অন্যরা কেন নন?

এর উত্তর খুব সহজ এবং তা মূলত দর্শনগত ভিন্নতা থেকে। তিনি বাংলার একজন বাউল সাধক লালন সাঁইয়ের গানকে একটি দেশ ও সেই দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছেন। যেমনটি আব্বাসউদ্দিন আহমদ করেছিলেন ভাওয়াইয়া আর আবদুল আলীম ভাটিয়ালি গান। তবে লালনের গান দিয়ে একটি জনপদের আত্মপরিচয়ের স্মারক হিসেবে বিশ্বপরিসরে গ্রহণীয় করে তোলার সাফল্য ফরিদা পারভীনের অতুলনীয়। বলা ভালো, এমন প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পী আমাদের দেশে সত্যিই বিরল।

সেই ফরিদা পাভীন আজ প্রয়াত হলেন। আজ তাঁর মৃত্যুর পর কেন জানি না, লালনের সেই গানই মনে পড়ছে, ‘পাখি কখন জানি উড়ে যায়…’

২.

২০১৭ সালে আয়ারল্যান্ডের লিমেরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাউল সুরের বুনন ও তান্ত্রিক-দেহবাদী তত্ত্ব’ বিষয়ে সেমিনারপত্র উপস্থাপনকালে ইউরোপ ও আমেরিকার বেশ কয়েকজন মিউজিকোলজিস্টকে বেশ আগ্রহ নিয়ে দর্শকসারিতে বসতে দেখেছিলাম। সেখানে তখন ক্রোয়েশিয়ার সানিবর পেতান, ব্রিটেনের রলফ কিলিউস, শ্রীলঙ্কার লাসন্থি ও নেপালে রামও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে এক ফরাসি ও একজন জার্মানি সংগীতজ্ঞ জানালেন, লালন সম্পর্কে তাঁরা জেনেছেন ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে গান শোনার মাধ্যমে। ব্রিটিশ একজন অধ্যাপক বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি লালন সম্পর্কে জানতে পারেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই লালন সাঁইয়ের দর্শন ও সাহিত্য সম্পর্কে বিশ্বসমাজকে প্রথম জানিয়েছিলেন। এরপর ফরিদা পারভীন বিশ্ব-মাঝারে বিশদভাবে পৌঁছে দিয়েছেন লালনের সংগীত। তিনি নিজের মধ্য-জীবনের সুললিত আর শেষ জীবনের ধ্যানাশ্রয়ী কণ্ঠে লালনকে উপস্থাপন করেছেন উপমহাদেশীয় ভক্তিবাদী সুরধারার প্রতিভূরূপে; এবং তা তরঙ্গ তুলেছে অন্যভাষার মানুষের হৃদয়েও। ফলে অজস্র গবেষক এদেশে ছুটে এসেছেন বাউল-অন্বেষণে।

তবে কেমন করে ফরিদা পারভীন লালনের সুরকে দেশের মানুষের হৃদয় থেকে ভিনদেশি মানুষের অন্তরে পৌঁছে দিলেন?

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালন সাঁই
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা লালন সাঁই

প্রশ্নের উত্তরে প্রথমেই বলতে হবে তাঁর কণ্ঠের কথা। সুললিত আর ধ্যানাশ্রয়ী কণ্ঠ নির্মাণের ক্ষেত্রে কৈশোরের উচ্চাঙ্গসংগীতচর্চা তাঁর পথকে যেনবা অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল। এরপর তিনি নজরুলসংগীত শিখেছেন প্রসিদ্ধ ওস্তাদদের কাছে। লালনের গান গ্রামীণ সুরের হলেও নিজস্ব ছন্দ ও ঝোঁকের কারণে তা আলাদাভাবে চেনা যায়। ফরিদা পারভীন সেই ঝোঁক আত্মীকরণ করেছিলেন রাগের স্বরূপ রক্ষা করে এবং নজরুলসংগীতের আলঙ্করিক শ্রুতির ছায়া প্রয়োগের মাধ্যমে। এ গুণী সংগীতশিল্পীর এই ব্যাপারই মিউজিকোলজিস্টদের কাছে তাঁকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। উপমহাদেশীয় ভক্তিবাদী ধারার প্রতি সমাদর ইউরোপিয়ানদের কাছে বরাবরই প্রিয় বিষয়। শ্রীচৈতন্য, কবীর, মীরার ভজন আমাদের অঞ্চলে তো যুগ যুগ ধরে সমাদৃত। লালনের গানের সুরে তার আঁচ আছে। আবার সুফিবাদের ভিন্ন প্রকরণও এই বাউলকে আলাদা করে তুলেছে। বলা যায়, লালনের গানে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবীয় ভাব একই সুরে প্রবাহিত হয়েছে, যা কাওয়ালি বা ভজন-কীর্তনের মিশ্রণে সুরগতভাবে স্বতন্ত্রও হয়ে উঠছে। এর পাশাপাশি মানবিকতাবাদ ও আত্মার স্বরূপ সন্ধানের অনুশীলন সাংগীতিকতা দিয়ে অনুসন্ধান করার অভ্যাস লালনকে বিদেশিদের কাছে কৌতুহলী করেছে বৈকি। আবারও বলি, বিশ্বসংগীত মঞ্চে লালনের গান পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ফরিদা পারভীনের রয়েছে অনন্য ভূমিকা।

ফরিদা পারভীনের প্রৌঢ় জীবনের গায়কি এদেশের মানুষকে খুব বেশি আকৃষ্ট করেনি তাঁর মধ্যজীবনের খোলা ও চঞ্চল গায়কি কানে লেগে থাকার কারণে। কিন্তু শেষবেলার টানা স্থির সুর সুফিবাদী সাধক জীবনের অতীন্দ্রিয় ভাব জাগরণের অনুভব এনে দিয়েছে ভিন ভাষার মানুষের হৃদয়ে। তবে আঞ্চলিক গানের মৌলিকত্ব মূলত আঞ্চলিক ভাষার সৌরভে, ফরিদা পাভীন সেই বৈশিষ্ট্যগুলো এড়িয়ে যাননি। একে প্রমিত করে তোলেননি, এখানেই তাঁর বিশেষত্ব।

সত্তর দশকের সূচনায় তিনি আবু জাফরের লেখা ও সুরে বেশ কিছু আধুনিক গান করেন। গানগুলো সারা বাংলার মানুষের মুখে মুখে গীত হয়। ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীতটে’ গানটি অনিবার্য হয়ে ওঠে। আরও কিছু গান—যেমন ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’ অথবা ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’—তাঁর গলায় কালজয়ী হয়েছে।

৩.

আজ ফরিদা পারভীন মারা গেছেন। কিন্তু আসলেই কি মৃত্যু হয়েছে তাঁর গানের? ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর নাটোরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। শৈশবে পরিবারের সঙ্গে মাগুরায় চলে যান। সেখানেই কমল চক্রবর্তীর কাছে গানের তালিম গ্রহণ করেন। এরপর রাজশাহী ও কুষ্টিয়ায় বিভিন্ন ওস্তাদের কাছে গান শেখেন। ওস্তাদ ইব্রাহিম খাঁ, ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, ওস্তাদ ওসমান গণি ও ওস্তাদ মোতালেব বিশ্বাসের কাছে শেখেন শাস্ত্রীয় সংগীত। পরবর্তীকালে ওস্তাদ মীর মুজাফফর আলী আর ওস্তাদ আবদুল কাদিরের কাছে শেখেন নজরুলসংগীত। সবশেষে বাউল সাধক মোকসেদ আলী সাঁইয়ের ভাবশিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। মোকসেদ সাঁইয়ের গায়কি লালনের আখড়াকেন্দ্রিক হলেও অন্যান্য বাউলদের গায়কি থেকে ছিল স্বতন্ত্র। কারণ, তিনি ছিলেন রাগ-রাগিনীতে সিদ্ধ এবং কালোয়াতি ঢঙে সুরবিহার করতেন। ফরিদা পারভীনও যেহেতু দক্ষ ও সুকণ্ঠী, ফলে মোকসেদ সাঁইয়ের গায়কি-ঘরানার ছায়া তাঁর আত্মীকরণের মধ্য দিয়ে আধুনিক অথচ মৌলিক হিসেবে শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আখড়ার গান সাধারণত উচ্চনিনাদী ও খোলা। ফরিদার পারভীনের গায়কি সেই তীক্ষ্ণতার পাশাপাশি সুমিষ্টও, আবার নৈসর্গিক হয়েও অন্য রকম। লালনের পদ ‘কে তোমার আর যাবে সাথে’, কিংবা ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি ওহে দয়াময়’ বা ‘বাড়ির পাশে আরশিনগর, সেথায় এক পড়শি বসত করে’—ফরিদা পারভীনের গলায় গানগুলো সেই অনুভূতি দেয়। এসব গান শুনে কেমন যেন উদাস অনুভূতি জেগে ওঠে মানুষের।

ফরিদার পারভীনের গায়কি সেই তীক্ষ্ণতার পাশাপাশি সুমিষ্টও, আবার নৈসর্গিক হয়েও অন্য রকম।

৪.

১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারে নজরুলসংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সংগীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ফরিদা পারভীন। পরে বাবার চাকরির কারণে কুষ্টিয়া চলে আসেন। কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ থেকে স্নাতক পাস করেন। সত্তর দশকের সূচনায় তিনি আবু জাফরের লেখা ও সুরে বেশ কিছু আধুনিক গান করেন। গানগুলো সারা বাংলার মানুষের মুখে মুখে গীত হয়। যাত্রাপালা থেকে যেকোনো উদ্বোধনী সংগীতে, জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি দেশাত্মবোধক গান হিসেবে আবু জাফরের লেখা ‘এই পদ্মা এই মেঘনা এই যমুনা সুরমা নদীতটে’ গানটি অনিবার্য হয়ে ওঠে। আরও কিছু গান—যেমন ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’ অথবা ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘ও পাখিরে আয় দেখে যা কেমন আছি’—তাঁর গলায় এই গানগুলোও কালজয়ী হয়েছে।

৫.

বিশ্ব পরিভ্রমণে ফরিদা পারভীনের অসংখ্য স্মৃতি ও বক্তব্য রয়েছে। তবে লালনের বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতার জন্য তিনি সর্বাগ্রে কৃতিত্ব দেন তাঁর গুরুকে। তিনি বলেন, ‘লালনের গান গাইতে অনেকে এখন কুষ্টিয়া থেকে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছেন। এ কৃতিত্ব আমি দেব আমার গুরু শ্রদ্ধেয় মকসেদ আলী সাঁইকে। অনেক গুরু বাবা, গুরু মা আছেন, কিন্তু শুদ্ধ বাণী ও সুরে লালনের গান প্রচার হচ্ছে না। তাই সঠিক গুরু ধরে লালনের গান শিখতে হবে। কারণ, লালনের বাণী আত্মশুদ্ধিতে, সুর মেডিটেশনে ব্যবহার করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘লালন দর্শনের মূল কথা হলো মানুষকে মানুষ হয়ে চলার দর্শন। মানুষকে মানুষ হয়ে চলার অর্থ মনুষ্যত্বগুণে গুণী হওয়া। এ জন্য তিনি সর্বদা সত্য বলা এবং সুপথে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। এটাই আমি মনেপ্রাণে ধারণ করি।’

৬.

আমার জানা মতে ২০১৪ সালে বেলজিয়ামে ইউনিভার্সাল সুফি উৎসবে যোগদান ফরিদা পারভীনের জীবনের সেরা এক অভিজ্ঞতা। জাপান, নিউইয়র্ক, ফ্রান্সসহ অসংখ্য দেশে গান করেছেন তিনি। কয়েক বছর আগেই আমার ফরাসি বন্ধু অ্যালেন বাউড পিয়েরে ফরাসিদের মধ্যে ফরিদা পারভীনকে মুখোমুখি করেছিলেন। পিয়েরে ফরিদা পারভীনের জীবনী লেখার কাজেও হাত দিয়েছেন। এ সম্পর্কে ফরিদা পাভীনের ভাষ্য হলো, ‘এলেন পিয়েরের সঙ্গে অনেক দিনের পরিচয়। সে সুবাদে আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছেন। আর জানার পরই আগ্রহ প্রকাশ করছেন আমার কর্ম ও ব্যক্তি জীবন নিয়ে কাজ করার। কাজের সম্মতি দিলে তিনি আমার সংগীতজীবন নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আশা করছি, বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে জীবনের প্রতিটি বিষয় তিনি বইয়ে তুলে ধরতে পারবেন।’

আজীবন সংগীত সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৮৭ সালে পেয়েছেন একুশে পদক। ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০০৮ সালে জাপান কর্তৃক ফুকুওকা এশিয়ান সাংস্কৃতিক পুরস্কার। আর ২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ফিরোজা বেগম স্মৃতি স্বর্ণপদক। আজ তিনি আমাদের মহাসিন্ধুর ওপারে চলে গেলেও তাঁর গান তো আছে আমাদের মরমে। একটা প্রশ্ন রেখে লেখাটি শেষ করি। আমরা কি আসলেই ফরিদা পারভীনের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পেরেছি? আজ যে তিনি চলে গেলেন, পাখিটা যে উড়ে গেল, আমরা কি আর দ্বিতীয় ফরিদা পারভীনকে পাব? অনেক বড় মাপের এই সংগীতশিল্পীকে আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের অধ্যাপক

বিষয়:

Ad 300x250

সম্পর্কিত