leadT1ad

বিশ্বের প্রথম ‘এআই মন্ত্রী’ ডায়েলা কীভাবে কাজ করবে

আলবেনিয়ার মন্ত্রিসভায় ‘ডায়েলা’ নামে একজন ‘এআই মানবী’ যুক্ত হয়েছেন। এই প্রথম রক্তমাংসের কোনও ব্যক্তি নন, এক এআই মানবীকে মন্ত্রী বলে ঘোষণা করল কোনো দেশ। বলা হচ্ছে, এই এআই মন্ত্রী দুর্নীতি প্রতিরোধে কাজ করবে। তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সংবিধানে কি এমন কোনো নীতিমালা আছে, যেখানে এআই-মানবীকে মন্ত্রী করা যাবে? ডায়েলা কি সত্যিই দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে? আর ডায়েলাকে অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা হবে কীভাবে? চলুন খোঁজ করা যাক।

স্ট্রিম ডেস্ক
আলবেনিয়ার মন্ত্রিসভায় ‘ডায়েলা’ নামে একজন ‘এআই মানবী’ যুক্ত হয়েছেন। প্রতীকী ছবি

দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র আলবেনিয়ার। দেশটির প্রধানমন্ত্রী এদি রামা সম্প্রতি তাঁর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে যুক্ত করেছেন ‘ডায়েলা’ নামে একজনকে। স্বাভাবিকভাবে এই নাম ঘোষণা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা নয়। তবে বিষয়টি খুব সহজভাবে নেওয়ারও উপায় নেই, যদি শোনেন এই ডায়েলা একজন ‘এআই মানবী’। এই প্রথম রক্তমাংসের কোনও ব্যক্তি নন, এক এআই-মানবীকে মন্ত্রী বলে ঘোষণা করল কোনো দেশ। আলবেনিয়ান প্রধানমন্ত্রী রামা জানান, সরকারি প্রকল্পে বেসরকারি সংস্থা কাজ করলে তাদের দরপত্র থেকে কাজকর্মের উপর নজরদারি করবেন তাঁর এআই-মন্ত্রী।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দিন দিন সারা বিশ্বেই এআই-এর (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। অফিসের নানা নথিপত্রের কাজ থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিশ্লেষণও করছে এআই। তবে এসব কিছুকেই যেন ছাড়িয়ে গেল আলবেনিয়া।

ডায়েলা সম্পর্কে যা যা জানা গেল

ডায়েলা, যার নামের অর্থ আলবেনীয় ভাষায় ‘সূর্য’। এই সপ্তাহে আনুষ্ঠানিকভাবে ভার্চুয়াল মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে পরিচয় করানো হয়েছে তাকে। তিনি বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সরকারি মন্ত্রী। যেসব দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রকল্প ও সেবার জন্য চুক্তিবদ্ধ করা হয়; সরকারের এসব সরকারি দরপত্র পরিচালনা ও তদারকি করবেন তিনি।

টানা চতুর্থ মেয়াদে দায়িত্ব শুরু করা প্রধানমন্ত্রী এমি রামা এ নিয়োগকে ‘আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক সরকার গড়ার পথে একটি বড় পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

রামা বলেন, ‘ডায়েলা প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, যিনি শারীরিকভাবে উপস্থিত নন, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভার্চুয়ালি তৈরি।’

তিনি জানান, ডায়েলার দায়িত্ব হলো নিশ্চিত করা যে সরকারি দরপত্রগুলো সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এবং প্রভাবমুক্ত।

রামার ভাষায়, ‘দরপত্র প্রক্রিয়ায় জমা দেওয়া প্রতিটি সরকারি তহবিল একেবারে স্বচ্ছ হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর মূল লক্ষ্য হলো আলবেনিয়াকে এমন একটি দেশে রূপান্তর করা যেখানে সরকারি দরপত্র শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত থাকবে।’

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া ডায়েলাকে ইতিমধ্যে জনগণের জন্য ই-আলবেনিয়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে উন্মুক্ত করা হয়েছে। শুরুতে তিনি মূলত নাগরিক ও ব্যবসায়ীদের সরকারি নথি সংগ্রহে সহায়তা করার ভার্চুয়াল সহকারী হিসেবে কাজ করে আসছেন।

প্রচলিত আলবেনীয় পোশাক পরিহিতা এক নারী রূপে উপস্থাপিত ডায়েলা ভয়েস কমান্ডের মাধ্যমে সহায়তা করেন এবং ইলেকট্রনিক সিলমোহরযুক্ত নথি সরবরাহ করেন, যা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমাতে সহায়তা করছে।

আলবেনিয়ার সংবাদমাধ্যমও এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তাদের মতে, ‘প্রশাসনিক ক্ষমতার ধরন ও প্রয়োগে এক বড় ধরনের রূপান্তর এটি। এখানে প্রযুক্তি কেবল একটি হাতিয়ার নয়, বরং শাসন ব্যবস্থার সক্রিয় অংশীদার হয়ে উঠেছে।’

ডায়েলা কি দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করবে?

রামা জানিয়েছেন, ধাপে ধাপে সরকারি দরপত্র অনুমোদনের ক্ষমতা বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে এআই প্ল্যাটফর্ম ডায়েলার হাতে দেওয়া হবে।

তার মতে, এই পরিবর্তন ব্যক্তি নির্ভর সিদ্ধান্ত, পক্ষপাতিত্ব বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ দূর করবে। তবে ডায়েলার দায়িত্ব কতটা মানবিক তদারকি থাকবে, তা এখনও স্পষ্ট করেনি সরকার। আইন বিশেষজ্ঞরাও প্রশ্ন তুলেছেন—আলবেনিয়ার সংবিধান ও আইনি কাঠামোর ভেতরে এআই মন্ত্রীর অবস্থান কীভাবে সংজ্ঞায়িত হবে।

১৯৯০ সালে কমিউনিস্ট শাসন পতনের পর থেকেই দুর্নীতি আলবেনিয়ার অন্যতম দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল সমস্যা হয়ে আছে। গত কয়েক দশকে সরকারি ক্রয় ও দরপত্রই দুর্নীতির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে পরিণত হয়েছে, যেখানে চুক্তিগুলো প্রায়ই সংগঠিত অপরাধচক্র ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার সঙ্গে যুক্ত থাকে।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে—যেখানে আলবেনিয়ার ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় উভয় রুটে প্রবেশাধিকার রয়েছে—দেশটি মাদক ও অস্ত্র পাচারের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অপরাধী সংগঠনগুলোকে বৈধ সরকারি চুক্তির মাধ্যমে অবৈধ অর্থ সাদা করতে দেখা গেছে। এই পরিবেশ জনগণের অবিশ্বাস বাড়িয়েছে এবং আলবেনিয়ার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুশাসনের মানদণ্ডে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত করেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে আলবেনিয়া দুর্নীতির ধারণা সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে ৮০তম স্থানে রয়েছে, যা সমস্যাটির ভয়াবহতা স্পষ্ট করে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সংবিধানে কি এমন কোনো নীতিমালা আছে, যেখানে এআই-মানবীকে মন্ত্রী করা যাবে?

কেন এটি আলবেনিয়ার জন্য যুগান্তকারী সংস্কার?

আলবেনিয়ায় অনারারি কনস্যুল জেনারেল হিসেবে কাজ করছেন ভারতীয় আর্কিটেক্ট ও নগর পরিকল্পনাবিদ ডিকশু সি. কুকরেজা। তিনি ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য ফার্স্টপোস্টকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ডায়েলার সূচনা কেবল প্রযুক্তিগত নতুনত্ব নয়—এটি শাসনব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

তিনি বলেন, ‘সরকারি দরপত্র ব্যবস্থাপনায় এআই-ভিত্তিক ভার্চুয়াল মন্ত্রী নিয়োগ আলবেনিয়ার জন্য যুগান্তকারী সংস্কার। এটি সরাসরি জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার সমস্যাকে লক্ষ্য করে। নিয়ম-নির্ভর ও তথ্য-নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়ায় দরপত্র স্থানান্তরিত হওয়ায় ব্যক্তিনির্ভর সিদ্ধান্ত ও পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কমে যায়।’

কুকরেজা জোর দিয়ে বলেন, এই উদ্যোগের আসল শক্তি হলো স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা মিলিয়ে নেওয়া।

তিনি যোগ করেন, ‘এই উদ্যোগের আসল শক্তি হলো অটোমেশনকে স্পষ্ট অডিট ট্রেইল ও স্বাধীন তদারকির সঙ্গে যুক্ত করা, যাতে সরকারি অর্থপ্রবাহ স্বচ্ছ থাকে এবং জনপর্যায়ে খোলামেলা পর্যবেক্ষণের সুযোগ থাকে।’

আলবেনিয়ার জন্য এআই কোনো নতুন বিষয় নয়। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরেই তিরানা ওপেনএআই-এর সঙ্গে একটি চুক্তি করে, যাতে হাজার হাজার পৃষ্ঠার ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিধান ও নীতিমালা আলবেনীয় ভাষায় অনুবাদ সহজ করতে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করা হয়।

কুকরেজার মতে, এই পরিবর্তন দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শক্ত বার্তা দেয়—যে আলবেনিয়া তার প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার ও সুশাসন নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তরিক।

তিনি আরও বলেন, ‘বাস্তব প্রয়োগ ছাড়াও এই পদক্ষেপের প্রতীকী গুরুত্ব প্রবল। এটি সরকারের পরিচ্ছন্ন শাসনের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং জনগণের বিশ্বাস জোরদার করে। জাতীয় সম্পদ সততার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে তা নিশ্চিত করে।’

ডায়েলাকে অপব্যবহার থেকে রক্ষা করা হবে কীভাবে?

শাসনব্যবস্থায় এআই ব্যবহারের বড় প্রশ্নগুলোর একটি হলো—এই ব্যবস্থা ক্ষমতাসীনদের দ্বারা অপব্যবহার হতে পারে কি না? জনগণের একাংশও সংশয় প্রকাশ করেছে, ডিজিটাল এক মন্ত্রী কি সত্যিই দেশের গভীরভাবে প্রোথিত দুর্নীতির বাইরে থাকতে পারবে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন লিখেছেন, ‘আলবেনিয়ায় ডায়েলাও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে।’ আরেকজন মন্তব্য করেন, ‘চুরি চলতেই থাকবে, দায় দেওয়া হবে ডায়েলার ওপর।’

এই উদ্বেগের জবাবে কুকরেজা ব্যাখ্যা করেন, ডায়েলাকে বিশেষভাবে রাজনৈতিক অপব্যবহার রোধ করার জন্যই নকশা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সরকারি দরপত্রে রাজনৈতিক বা ইচ্ছামতো ব্যবহার কমাতেই আলবেনিয়া এই উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—একটি স্বচ্ছ, নিয়মভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা তৈরি করা, যা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে কাজ করবে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ডায়েলার নকশায় একাধিক সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ডায়েলার মাধ্যমে আলবেনিয়া শাসন ব্যবস্থার ভেতরে খোলামেলা পরিবেশ, তদারকি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করছে। এটি রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার হাতিয়ার নয়, বরং এক অগ্রণী পদক্ষেপ, যা আলবেনিয়ার গণতন্ত্রের পরিপক্বতা ও ইউরোপীয় মূল্যবোধের প্রতি প্রতিশ্রুতি।

তথ্যসূত্র: ফার্স্টপোস্ট, বিবিসি, আল জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে হুমায়ূন শফিক

Ad 300x250

সম্পর্কিত