আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মৃত্যুদণ্ডের রায়ের পর শেখ হাসিনা দাবি করেন তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের ‘ন্যায্য সুযোগ’ দেওয়া হয়নি। রায়ের পর ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে পাঠানো বিবৃতিতে তার দাবি, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে শেষ করে দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি পন্থা হচ্ছে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া।
ভারতে অবস্থানরত শেখ হাসিনা এর আগে বিচারকে ‘প্রহসন’ বলেও অভিহিত করেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। অন্তর্বর্তী সরকারকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন এই অভিযোগগুলো নেদারল্যান্ডসের হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিয়ে যেতে।
প্রশ্ন হল—তাঁর সম্ভাব্য আইনগত পদক্ষেপ, সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়া, আত্মপক্ষ সমর্থনের সম্ভাব্য যুক্তি কী হতে পারে এবং সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু?
শেখ হাসিনার বর্তমান আইনগত অবস্থান
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মোট ৫৮৩টি মামলা করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩২৪টি হত্যা মামলা। এছাড়া দুদকের করা মামলা আছে সাতটি। এর মধ্যে এখন আইসিটি-র মামলার রায় হয়েছে। আইসিটি মূলত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য গঠিত হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার এর এখতিয়ার সম্প্রসারণ করে সাম্প্রতিক ঘটনাকেও অন্তর্ভুক্ত করে।
বিচারে তাঁর পক্ষে রাষ্ট্র-নিযুক্ত একজন আইনজীবী ছিলেন। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু পুরো বিচারই হাসিনার অনুপস্থিতিতে সম্পন্ন হয়। তিনি বিদেশে থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব নয়, তবে এই রায় ভারতকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাপ সৃষ্টি করেছে। ভারত রায়কে স্বীকৃতি দিলেও শুধু বলেছে যে তারা বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে গঠনমূলক আলোচনায় থাকবে। তবে প্রত্যর্পণের বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি।
শেখ হাসিনা কি বাংলাদেশে আইনগত লড়াই করতে পারেন
হ্যাঁ, পারেন, তবে এতে বড় বাধা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী, আইসিটি-র রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করা যায়। তবে এ জন্য তাঁকে আত্মসমর্পণ করতে হবে বা বাংলাদেশে গ্রেপ্তার হতে হবে। নির্বাসন থেকে এ শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। তাঁর আইনজীবী মো. আমীর হোসেনও নিশ্চিত করেছেন যে আপিলের পূর্বশর্ত হলো আত্মসমর্পণ।
সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং আইন বিশেষজ্ঞ ড. কাজী জাহেদ ইকবাল বলেন, ‘শেখ হাসিনাকে এখন কোনও আইনগত লড়াই করতে হলে আগে আত্মসমর্পন করতে হবে। অথবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি তাকে আদালতে হাজির করতে পারে তাহলে তিনি আপিল করতে পারবেন। অর্থাৎ, শারীরিক উপস্থিতি ছাড়া রায়ের বিরুদ্ধে তাঁর আইনগতভাবে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ নেই। এ ছাড়া রায় ঘোষণার ৩০ দিনের মধ্যেই আপিল করতে হবে। এর মধ্যে আপিল না করলে গ্রেপ্তার হলে সরাসরি রায় কার্যকর করা হবে।’
ভারতে তাঁর সম্ভাব্য আইনগত প্রতিরক্ষা
বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ পাঠালে (কেবল কূটনৈতিক নোট নয়), প্রক্রিয়াটি ভারতের এক্সট্রাডিশন অ্যাক্ট ১৯৬২ এবং ২০১৩ সালের ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির অধীনে চলবে। তখন শেখ হাসিনা সরাসরি ভারতীয় আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন।
প্রথমে একজন ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর অনুরোধ পরীক্ষা করবেন। পরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে আপিল করা যাবে। তাঁর আইনজীবীরা যুক্তি তুলে ধরতে পারবেন যে তাঁকে ফেরত পাঠানো উচিত নয়।
ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির ৬(১) অনুচ্ছেদ এবং ভারতের প্রত্যর্পণ আইনের (এক্সট্রাডিশন অ্যাক্ট ১৯৬২) ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধে প্রত্যর্পণ করা বাধ্যতামূলক নয়। বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অংশ। তাই অভিযোগগুলো রাজনৈতিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যদিও ৬(২) ধারায় হত্যার অভিযোগ এতে অন্তর্ভুক্ত নয়, তবুও রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের প্রেক্ষাপটে ঘটনাগুলো রাজনৈতিক ব্যতিক্রমের মধ্যে পড়তে পারে।
চুক্তির ৮(৩) অনুচ্ছেদ ও আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী, অনুরোধ যদি অসৎ উদ্দেশ্যমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট বা জনস্বার্থবিরোধী হয়, তবে ভারত প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করতে পারে। শেখ হাসিনা দাবি করতে পারেন যে আইসিটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত এবং তাঁর সঙ্গে ন্যায়বিচার করা হয়নি। বিচারক পরিবর্তন, অনুপস্থিতিতে বিচার ও পক্ষপাতমূলক অভিযোগ—এসব যুক্তি এখানে কার্যকর হতে পারে।
অভিযোগটি উভয় দেশে অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে হবে। ভারত প্রশ্ন তুলতে পারে যে দেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন দমনে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ কি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে গণ্য হয় কি না।
শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। যদিও ভারতে আনুষ্ঠানিক আশ্রয় আইন নেই, মানবিক ভিত্তিতে আশ্রয় দেওয়ার নজির রয়েছে। তাঁর ক্ষমতায় থাকাকালীন ভারপন্থী নীতি তাঁর আবেদনকে আরও শক্তিশালী করবে।
এই ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী। বিশেষজ্ঞরা মত দেন যে রাজনৈতিক অপরাধ ব্যতিক্রমের কারণে ভারত বাধ্য নয় তাঁকে ফেরত পাঠাতে। অতীতে ভারত এ ধরনের অনুরোধ উপেক্ষা করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায় রাখা এবং বর্তমান জনঅসন্তোষ বিবেচনায় ভারত তাঁকে সুরক্ষা দিতে পারে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য আইনগত বিকল্প
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি):
শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন যে অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে আইসিসিতে অভিযোগ তুলতে পারে। তাঁর দাবি, এতে বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়ার পক্ষপাত উন্মোচিত হবে। তবে আইসিসি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নয়, ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিচার করে। বাংলাদেশও আইসিসির সদস্য রাষ্ট্র। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তদন্তের আবেদন করতে পারেন, কিন্তু নিজের দণ্ডের বিরুদ্ধে সরাসরি সেখানে আপিল করতে পারবেন না।
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাগুলো:
শেখ হাসিনা জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল বা নির্যাতনবিরোধী কমিটির কাছে আবেদন করতে পারেন। এতে ন্যায্য বিচার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ধীরগতিতে কাজ করে এবং কার্যকর বলপ্রয়োগ ক্ষমতা সীমিত। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের উদ্যোগগুলো চাপ সৃষ্টি করতে পারে, কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না।
সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার সামনে এখন তিনটি সমান্তরাল আইনগত ও রাজনৈতিক লড়াই দাঁড়িয়ে গেছে—বাংলাদেশের ভেতরে আইনি প্রতিকারের চেষ্টা, ভারতে প্রত্যর্পণ ঠেকানোর সংগ্রাম এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ন্যায়বিচারের দাবি তোলা। দেশের অভ্যন্তরে আপিলের পথ থাকলেও তাঁর শারীরিক অনুপস্থিতি সেই প্রক্রিয়াকে কার্যত অবরুদ্ধ করে রেখেছে। ফলে ভারতই তাঁর প্রধান প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেও প্রতিকার পাওয়ার সম্ভাবনা সীমিত।
অতএব, শেখ হাসিনার আইনগত ভবিষ্যৎ এখন মূলত ভারতের বিচারব্যবস্থা ও আঞ্চলিক কূটনীতির ওপর নির্ভরশীল। আইসিটি রায়ের বিরুদ্ধে দ্রুত ও প্রত্যক্ষ আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ সংকীর্ণ, তবে বিচার নিয়ে তাঁর আপত্তিগুলো তাঁকে আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রে রেখেছে। তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ শুধু আইনি পরিস্থিতিই নয়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও আঞ্চলিক রাজনীতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।