সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান সাত বছর পর যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন। মঙ্গলবার তিনি হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
এটি ২০১৮ সালের পর তার প্রথম যুক্তরাষ্ট্র সফর। এই সফর দুই দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে নতুনত্বের ইঙ্গিত দেয়।
এর স্পষ্ট উদাহরণ হলো সৌদি আরবের জন্য সর্বোচ্চ ৪৮টি এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির পরিকল্পনা। সৌদি আরব বহু বছর ধরে এই বিমান কিনতে চাইলেও পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসনগুলো তা অনুমোদন করেনি। এর একটি কারণ ছিল ইসরায়েলের আপত্তি।
তাহলে সৌদি আরব কেন এফ-৩৫ চায়? এবং কেন যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে?
এফ-৩৫ কী?
এফ-৩৫ হলো যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন কোম্পানি নির্মিত একটি স্টেলথ স্ট্রাইক ফাইটার জেট।
এর সরকারি নাম এফ-৩৫ লাইটনিং টু। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এটিকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত যুদ্ধবিমান’ বলে বর্ণনা করে।
স্টেলথ প্রযুক্তির কারণে বিমানটি রাডার বা নজরদারি ব্যবস্থায় ধরা পড়া কঠিন। এটি শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুদ্ধবিমান ধ্বংস করতে সক্ষম।
সফল হলে যেকোনো সংঘাতে এটি আকাশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
এফ-৩৫ উৎপাদনে যুক্তরাষ্ট্র একাধিক দেশের সঙ্গে অংশীদার। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্যও এর মধ্যে রয়েছে।
এসব দেশ হয় বিমানটির বিভিন্ন অংশ তৈরি করে, অথবা নিজেদের ব্যবহারের বিমানগুলো নিজেদের কারখানায় সংযোজন করে।
এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান।
এফ-৩৫ এর ধরন
এফ-৩৫এ সবচেয়ে প্রচলিত সংস্করণ। সবচেয়ে বেশি দেশ এটি ব্যবহার করে। এটি সাধারণ রানওয়ে থেকে উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে।
এর অস্ত্র ও জ্বালানি ট্যাংক বিমানের ভেতরে থাকে, যা স্টেলথ সক্ষমতা বজায় রাখে।
এফ-৩৫আই ‘আদির’ ইসরায়েলের জন্য তৈরি এফ-৩৫এ এর বিশেষ সংস্করণ। এতে ইসরায়েলি প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে, যেমন উন্নত জ্যামিং ও ডিকয় সিস্টেম।
এতে বাহ্যিক জ্বালানি ট্যাংকও যোগ করা হয়েছে, যাতে দীর্ঘ সময় আকাশে থাকা যায়।
ইসরায়েল স্থানীয় অস্ত্র সংযোজনের জন্য এর মূল সফটওয়্যার পরিবর্তনের অনুমতিও পেয়েছে।
এফ-৩৫বি ইতালি, জাপান, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে। এটি হেলিকপ্টারের মতো অবতরণ করতে পারে এবং খুব স্বল্প দূরত্বে উড্ডয়ন করতে সক্ষম।
এটি আকারে ছোট হলেও ওজনে বেশি। এতে জ্বালানি ও অস্ত্র বহনক্ষমতা কিছুটা কম।
এফ-৩৫সি যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী ব্যবহার করে। এটি দীর্ঘ দূরত্বে স্টেলথ মিশন পরিচালনায় সক্ষম এবং বিমানবাহী রণতরী থেকে পরিচালনার উপযোগী।
এফ-৩৫ এত বিশেষ কেন
লকহিড মার্টিন দাবি করে, এফ-৩৫ হলো ‘বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী, টিকে থাকার ক্ষমতাসম্পন্ন ও প্রযুক্তিগতভাবে সমন্বিত যুদ্ধবিমান’।
এর বিশেষত্ব আসে স্টেলথ প্রযুক্তি, উন্নত সেন্সর এবং দ্রুতগতির কম্পিউটিং–সবকিছুকে এক প্ল্যাটফর্মে একীভূত করার মাধ্যমে।
বিমানটি সহজে শনাক্ত না হয়ে চারপাশের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। ৩৬০ ডিগ্রি ক্যামেরা ও সেন্সর পাইলটকে তাৎক্ষণিক তথ্য সরবরাহ করে।
এফ-৩৫ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে যুদ্ধনীতিতে পরিবর্তন আসে। গতি নয়, বরং হুমকি আগে শনাক্ত করা, তথ্য শেয়ার করা এবং সমন্বিতভাবে আঘাত হানা—এগুলোই এখন মুখ্য হয়ে ওঠে।
বিশ্বের ২০টি দেশের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান আছে।
কারা এফ-৩৫ ব্যবহার করে? সৌদি আরব কেন চায়?
সৌদি আরব বহু দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বড় অস্ত্র ক্রেতা। তবুও তারা এতদিন এফ-৩৫ প্রোগ্রামে যুক্ত হতে পারেনি।
এফ-৩৫ পেলে সৌদি আরব তার বিমানবাহিনী আধুনিক করতে পারবে এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক শক্তি হিসেবে তার অবস্থান আরও দৃঢ় হবে।
ইরানের সঙ্গে বর্তমানে সম্পর্ক ভালো হলেও দুই দেশ অতীতে বহুবার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং পরস্পরকে হুমকি হিসেবে দেখেছে।
এ ছাড়া সৌদি আরব ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সংঘাত এখন ঠান্ডা পর্যায়ে থাকলেও ভবিষ্যতে তা আবার তীব্র হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে উন্নত যুদ্ধবিমান সৌদি আরবের নিরাপত্তা কৌশলে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র কি এফ-৩৫ বিক্রি করবে?
মার্কিন কংগ্রেসের ক্ষমতা আছে যে কোনো অস্ত্র বিক্রি বাতিল করার, এমনকি প্রেসিডেন্ট অনুমোদন দিলেও।
তবে ট্রাম্প স্পষ্ট করেছেন যে তিনি বিক্রির পক্ষে। তিনি হোয়াইট হাউসে প্রিন্স মোহাম্মদের সঙ্গে যৌথ উপস্থিতিতে এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি সৌদি আরব নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনাকে গুরুত্ব দেননি। বিশেষ করে সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড, যা কয়েক বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্কে বড় উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। এ বিষয়ে তিনি কঠোর অবস্থান নেননি।
ট্রাম্প ‘কোয়ালিটেটিভ মিলিটারি এজ’ নীতিও উপেক্ষা করেছেন। এই নীতি অনুযায়ী ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা মধ্যপ্রাচ্যের অন্যসব দেশের তুলনায় সবসময় এগিয়ে রাখতে হয়।
কিন্তু ট্রাম্প বলেন, সৌদি আরব ইসরায়েলের মতো একই মানের এফ-৩৫ পাবে।
এটি দীর্ঘদিনের নীতির বিরোধী সিদ্ধান্ত, বিশেষত যখন সৌদি আরব এখনো আব্রাহাম অ্যাকর্ডসে যোগ দিতে রাজি নয় এবং ইসরায়েলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কও স্থাপন করেনি।
সূত্র: আল-জাজিরা