leadT1ad

‘মুজিবপিডিয়া’ কি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরির উপাদান, ইতিহাস কী বলে

মাহবুবুল আলম তারেক
প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৫, ২৩: ৪৭
স্ট্রিম গ্রাফিক

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল ‘মুজিবপিডিয়া’। প্রকাশের পরপরই বইটি নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। দুই খণ্ডে লেখা এই বইকে ‘জ্ঞানকোষ’ হিসেবে দাবি করে তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্বাধীনতা-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ সংকলন করা হয়েছে বলে এর ভূমিকায় উল্লেখ রয়েছে। তবে এখানে ইতিহাসের একপাক্ষিক উপস্থাপনা ও বয়ান নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগ ও অনলাইন ফোরামে অনেকেই বইটি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনেও বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। মূলত তখনই অভিযোগ ওঠে যে এতে ইতিহাসের একদলীয় বয়ান হাজির করাসহ বহু সত্য আড়াল করা হয়েছে। প্রধানত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবের ভূমিকার অতিরঞ্জন, অন্য নেতাদের অবদানের অবমূল্যায়ন এবং বিতর্কিত বিষয়গুলো উপেক্ষার কারণে এই অভিযোগ উঠেছে বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা।

আর এটি মূলত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদের বয়ান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রচনা করা হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। ফলে অনেকেই ‘মুজিবপিডিয়া’কে শেখ মুজিবের একনায়কতন্ত্রের প্রচারণার অংশ হিসেবে দেখতে আগ্রহী। তাঁদের দাবি, ‘মুজিবপিডিয়া’ শেখ মুজিবের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করেছে, যা পরবর্তীকালে তাঁর মেয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দমন-পীড়নের বৈধতা দেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার অতিরঞ্জন

মুজিবপিডিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রধানত শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার উপস্থাপনার ধরন নিয়ে উঠেছে। সমালোচকদের মতে, এই বইয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবনের বিতর্কিত দিকগুলো আড়াল করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭২-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মুজিবের শাসনকালে একদলীয় শাসনব্যবস্থা, বাকশাল প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা ও অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়গুলো এখানে যথাযথভাবে আলোচিত হয়নি। এ সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি, দুর্ভিক্ষ আর রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়গুলোও কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

একটি শিবিরে ক্ষুধার্ত শিশুদের লাইন। যেখানে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে স্বল্প রেশন। এই ছবি চুয়াত্তরের ২৫ সেপ্টেম্বর তোলা। ছবি: গেটি ইমেজেস
একটি শিবিরে ক্ষুধার্ত শিশুদের লাইন। যেখানে তাদেরকে দেয়া হচ্ছে স্বল্প রেশন। এই ছবি চুয়াত্তরের ২৫ সেপ্টেম্বর তোলা। ছবি: গেটি ইমেজেস

এখানে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের বর্ণনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং এর জন্য মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বৈদেশিক সহায়তার ঘাটতিকে দায়ী করা হয়েছে। অথচ তৎকালীন সরকারের নীতিগত ব্যর্থতা, খাদ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক সংকটের কথা যথাযথভাবে উঠে আসেনি। পরে শেখ হাসিনার শাসনামলে যাঁরা আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর হয়েছিলেন, সেই মহিউদ্দীন খান আলমগীর ও আতিউর রহমানের একাধিক বইয়েও চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষকে শেখ মুজিবের অপশাসনের ফল হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এমনকি লন্ডনের সোয়াস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাওমি হোসেনের বইয়েও এই দুর্ভিক্ষের জন্য শেখ মুজিবকেই প্রকারান্তরে দায়ী করা হয়েছে।

কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক এসব উদহারণ গ্রাহ্য করেনি ‘মুজিবপিডিয়া’। বিপরীতে এখানে বাকশালকে ‘দেশের প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অথচ বেশির ভাগ ঐতিহাসিক একে বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবসান ও একদলীয় শাসন কায়েমের ঘটনা হিসেবেই দেখে থাকেন।

সিরাজ সিকদার নিহতের ঘটনায় ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ। সংগৃহীত ছবি
সিরাজ সিকদার নিহতের ঘটনায় ইত্তেফাকে প্রকাশিত সংবাদ। সংগৃহীত ছবি

সিরাজ সিকদারসহ প্রায় ৩০ হাজার রাজনৈতিক বিরোধী নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিল মুজিবের শাসনামলে। জাসদের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হাসানুল হক ইনু, পরে যিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করে শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার সদস্য হয়েছিলেন—এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে একসময় তিনি শেখ মুজিবের শাসনামলের দমন-পীড়নের লোহমর্ষক বর্ণনা তুলে ধরে বলেছিলেন, শেখ মুজিবের রক্ষীবাহিনী জাসদসহ ভিন্নমতের মানুষদের দমন করেছিল। এ প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট নেত্রী অরুণা সেনর কথা উল্লেখ করা যায়। রক্ষীবাহিনী তাঁকে ভয়ংকর নির্যাতন করেছিল, যার জবানবন্দি তিনি নিজেই দিয়েছেন। তাঁর সেই জবানবন্দি পড়ে অনেকেই মতো দিয়েছেন, রক্ষীবাহিনীর ওই অত্যাচারের সঙ্গে কেবল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তুলনা করা চলে।

হাসানুল হক ইনু। সংগৃহীত ছবি
হাসানুল হক ইনু। সংগৃহীত ছবি

অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় ডাকসু নির্বাচনেই ব্যালট ছিনতাইয়ের নজির তৈরি করেছিল ছাত্রলীগ। ইতিহাস বলছে, ১৯৭৩ সালের জানুয়ারিতে ভিয়েতনাম সংহতি মিছিলে শেখ মুজিবের আদেশেই পুলিশ গুলি চালায়। এতে শহীদ হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মতিউল-কাদের।

এর জেরে পল্টন ময়দানে আয়োজিত এক সমাবেশে ডাকসুর পক্ষ থেকে তৎকালীন ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া জাতির পিতা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি প্রত্যাহার করে নেন। তাঁর ডাকসুর আজীবন সদস্য পদও বাতিল করেন।

একই সময়ে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয় জ্বালিয়ে দিয়েছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ন্যাপের তৎকালীন নেত্রী মতিয়া চৌধুরী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রতিবাদ সভায় শেখ মুজিবের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি আর বঙ্গবন্ধু নও, আজ থেকে তুমি বঙ্গশত্রু।’ সেই সময় শাহরিয়ার কবির লিখেছিলেন, ‘মুজিব আর বঙ্গবন্ধু নয়, এখন থেকে মুজিব জনশত্রু।’

এরকম অসংখ্য ভয়ংকর ঘটনায় ঠাঁসা শেখ মুজিবের শাসনামল (১৯৭২ থেকে ১৯৭৫)। অথচ এসব ঘটনার কোনও উল্লেখ এবং বিবরণ নেই ‘মুজিবপিডিয়া’য়।

‘মুজিবপিডিয়া’য় শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার একমাত্র প্রধান কাণ্ডারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা ইতিহাসের অতি সরলীকরণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যান্য নেতা ও দলের অবদান—যেমন মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান বা বামপন্থীদের অবদান এবং ইসলামপন্থী তথা আলেম সমাজের বড় একটা অংশও যে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন, তা গোপন করা হয়েছে। হাতেগোনা কয়েকটি ইসলামি দলের বিরোধীতার কারণেই ‘ইসলামের সঙ্গে যে মুক্তিযুদ্ধের একটা কৃত্রিম বিরোধ’ দেখানো হয়, ‘মুজিবপিডিয়া’র বয়ানও সেই ধারাতেই এগিয়েছে।

আবার ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এখানে শেখ মুজিবের ভূমিকা যথাযথভাবে তুলে ধরা হলেও এ আন্দোলনের অন্য নেতাদের অবদান তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত হয়েছে। এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকাকেও কিছুটা কম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তুলনায় মুজিব বাহিনীর ভূমিকাকে বাস্তবের চেয়ে বড় করে দেখানোর প্রয়াস রয়েছে।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ২৫ মার্চের পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে প্রচলিত বিকল্প বর্ণনাগুলো এ বইয়ে উপেক্ষিত। শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেন আসম আবদুর রব। পরে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে জাসদের এই নেতা দাবি করেন, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী ছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘আমি যখন তাঁর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দিয়েছিলাম, তিনি জিহ্বায় কামড় দিয়েছিলেন।’

মুক্তিযুদ্ধে মুজিবের অবদান প্রসঙ্গে এসব বয়ান এই সংকলনে যেমন অনুপস্থিত, তেমনি যুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারে মতবিরোধ কিংবা ভারত ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভূমিকা, এ বিষয়গুলো খুবই সরলীকৃত বা সংক্ষিপ্তভাবে এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেমন ‘মুজিবপিডিয়া’য় বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তথা ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই ওয়্যারলেস বার্তার মারফত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু এর কোনো বাস্তব প্রমাণ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মঈদুল হাসান তাঁর ‘মূলধারা ৭১’ বইয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।

মঈদুল হাসান বলেন, ’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের ভিত্তিতে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা নিয়ে পাকিস্তানিরা মার্চের মাঝামাঝি থেকে ইয়াহিয়া-মুজিব আলোচনার ধূম্রজাল বিস্তার করেছিল। এই আলোচনার উদ্দেশ্য সম্পর্কে একইসঙ্গে সন্দিহান ও আশাবাদি থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষে আসন্ন সামরিক হামলার বিরুদ্ধে যথোপযোগী সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। সম্ভবত একই কারণে ২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানের হামলার আগে পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব স্বাধীনতার সপক্ষে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উঠতে পারেননি। ফলে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণাও দেননি। কিন্তু যেভাবেই হোক দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে যে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন। সম্ভবত তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক চেতনায় এমন এক মৌল রূপান্তর ঘটে যে পাকিস্তানিদের নৃশংস গণহত্যা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার স্বাধীনতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে ওঠে।

তাই এসব উদহারণের নিরিখে বলা যায়, ‘মুজিবপিডিয়া’র মূল কাঠামো শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসও প্রায় সম্পূর্ণভাবে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ভূমিকার আলোকে সাজানো হয়েছে। এতে এমন একটি বয়ান তৈরি করা হয়েছে, যেখানে অন্যান্য সমসাময়িক নেতা, রাজনৈতিক সংগঠন এবং ঘটনাপ্রবাহ পুরোপুরি প্রান্তিক হয়ে পড়েছে।

বইটি কি জ্ঞানকোষ

‘মুজিবপিডিয়া’কে একটি এনসাইক্লোপিডিয়া বা জ্ঞানকোষ ধরনের গ্রন্থ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। দাবি করা হয়েছে, এটি একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর ভিত্তি করে তৈরি উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ এনসাইক্লোপিডিয়া বা জ্ঞানকোষ। কিন্তু জ্ঞানকোষ ধরনের গ্রন্থে সাধারণত কোনো ঘটনার একাধিক বয়ান থাকলে সব ধরনের বয়ানই পাশাপাশি রাখা হয়। অথচ এ সংকলনে অনেক ঘটনার কেবল একটিমাত্র বয়ানকে ‘শুদ্ধ ইতিহাস’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

মুজিবপিডিয়া
মুজিবপিডিয়া

উদাহরণস্বরূপ, বাকশালের ইতিহাসের কথাই বলা যায়। বাকশালের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়, এটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পুনর্গঠনের জন্য একটি জরুরি পদক্ষেপ ছিল। যার লক্ষ্য ছিল গ্রামে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠা, ভূমিহীনদের অধিকার সুরক্ষা এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। মুজিবপিডিয়ায় বাকশালকে একনায়কতন্ত্র নয়, বরং ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’ বা জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখানো হয়। কিন্তু সচেতন পাঠকমাত্রই জানেন, এই বয়ান আওয়ামী লীগের দলীয় বয়ান। দেশের বহু ইতিহাসবিদ তো বটেই, আন্তর্জাতিকভাবেও বাকশালকে মূলত একদলীয় ও কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসেবে দেখা হয়।

তথ্যের নির্ভরযোগ্যতায় ও উৎসের দুর্বলতা

‘মুজিবপিডিয়া’র তথ্য সংগ্রহে দুই বছরের গবেষণা এবং ৯৭ জন গবেষকের সম্পৃক্ততার কথা বলা হলেও তথ্যের উৎস ও নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সমালোচকরা বলেন, জ্ঞানকোষটি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক এজেন্ডাকে সমর্থন করার জন্য প্রণীত হয়েছে এবং এর তথ্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্ব রয়েছে। তাঁদের দাবি, অনেক ক্ষেত্রে ‘মুজিবপিডিয়া’র নিবন্ধগুলোতে রেফারেন্স বা সূত্র সীমিত ও পক্ষপাতদুষ্ট। উদাহরণস্বরূপ:

  • ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনা বর্ণনায় সরকারি প্রকাশনা ও দলীয় মুখপাত্রকেই প্রধান সূত্র হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সংকলনটিতে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বা স্বাধীন গবেষকদের উদ্ধৃতি কম পাওয়া যায়।
  • ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড এবং এর পেছনের ষড়যন্ত্র নিয়ে এতে বিস্তারিত আলোচনা থাকলেও এর পটভূমি বর্ণনায় রাজনৈতিক ভিন্নমতের গবেষণাগুলো উপেক্ষিত। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, শেখ মুজিবের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের জন্য সামরিক বাহিনীর একটি অংশ এবং কিছু রাজনৈতিক নেতার ভূমিকার কথা উল্লেখ করা হলেও এর পেছনের জটিল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণরূপে বিশ্লেষণ করা হয়নি।

ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, যেকোনো ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা প্রকল্পের মূল শক্তি হলো তথ্যের বহুমাত্রিক উপস্থাপন। কিন্তু ‘মুজিবপিডিয়া’য় অনেক সংবেদনশীল ও বিতর্কিত অধ্যায় হয় পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়েছে, নতুবা সংক্ষিপ্ত ও আংশিকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে ‘আওয়ামী লীগের দলীয় বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিছু যাতে উঠে না আসে’, এ বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

ইতিহাসকে সাধারণত ঘটনাপ্রবাহের নিরপেক্ষ, বহুমুখী ও প্রমাণ-ভিত্তিক বয়ান হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। সে হিসেবে মুজিবপিডিয়াকে সত্যিকার অর্থে ‘ইতিহাস গ্রন্থ’ বা ‘জ্ঞানকোষ’ বলা কঠিন। একে বড়জোর শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কিত দলিল, ছবি, ভাষণ ও নথিপত্রের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ‘সত্যিকার ইতিহাস গ্রন্থ’ বলতে গেলে যেভাবে নিরপেক্ষতা, বহুমুখী উৎস এবং বিতর্কিত বিষয়গুলোর পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্রয়োজন, তা এখানে সীমিতভাবে পাওয়া যায়। এটি মূলত একটি বিশেষ দলনির্মিত ঐতিহাসিক বয়ান, পূর্ণাঙ্গ নিরপেক্ষ ইতিহাস নয়।

বুদ্ধিজীবি ও ইতিহাসবিদ বদরুদ্দীন উমর ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সঠিকভাবে লেখা হয়নি। যা লেখা হয়েছে, তা আসলে দলীয় বয়ান, আর এর মধ্যে ৮০ থেকে ৯০ ভাগই ভুয়া।’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, বিতর্ক এবং প্রকৃত সত্য গোপনের প্রচেষ্টা সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর বলেন, শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যেন শেখ মুজিবই এই যুদ্ধের একমাত্র মহান নায়ক।

বদরুদ্দীন উমর। সংগৃহীত ছবি
বদরুদ্দীন উমর। সংগৃহীত ছবি

বদরুদ্দীন উমর আরও বলেন, পরে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন এটা তাদের পারিবারিক বিষয় এবং তাদের পরিবারই এই যুদ্ধ পরিচালনা করেছে।

লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদও ‘মুজিবপিডিয়া’য় ইতিহাসের একপাক্ষিক বয়ান হাজির করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস কেবল একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে রচিত হলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি, সমসাময়িক নেতা এবং প্রেক্ষাপট আড়ালে পড়ে যায়। এতে পাঠক ইতিহাসের বহুমাত্রিক চরিত্র বুঝতে ব্যর্থ হয়।’

সম্পাদনায় দৃষ্টিভঙ্গিগত নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন

বইটি রচনায় যারা প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিগত নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। বইটির প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। তিনি ছিলেন হাসিনা সরকারের বড় আমলা। অবসরের পর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবও হয়েছিলেন। এ ছাড়াও তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ (মুজিব বর্ষ) উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। বইটির সম্পাদক ফরিদ কবির একজন কবি ও সাংবাদিক।

আর এই সংকলনের নির্বাহী সম্পাদক আবু মোহাম্মদ দিলওয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। হাসিনা সরকারের আমলেই তিনি এই দায়িত্ব পান। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণার জন্য তিনি হাসিনা সরকারের আমলে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারও (২০১৪) পান।

এ ছাড়া ‘মুজিবপিডিয়া’য় কোনো সূচিপত্র রাখা হয়নি। সূচিপত্র বা কাঠামোগত তালিকা না থাকায় এর বিষয়বস্তু খুঁজে পাওয়া কঠিন। এটাও কি ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে? যাতে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর বা বিতর্কিত অংশগুলো পাঠকের চোখে একসঙ্গে না আসে।

‘মুজিবপিডিয়া’ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি ও তথ্যভান্ডার, যেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ভাষণ, দলিল ও ছবির বিশাল সংগ্রহ রয়েছে। তবে এতে যেভাবে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে ইতিহাসের একপাক্ষিক বয়ান হাজির করা হয়েছে, তা নিরপেক্ষ ইতিহাসচর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না, তা নিয়ে ইতিহাসবিদ ও লেখকেরাই প্রশ্ন তুলেছেন। ফলে একে চূড়ান্ত বা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসগ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা দুষ্কর।

সিটি ব্যাংকের অর্থায়নে এ বইয়ের প্রকাশক হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার সার্কেল বাংলাদেশ লিমিটেড, পরিবেশক আগামী প্রকাশনী। এতে ৫৯১টি নিবন্ধ ও প্রায় ৭৫০টি ঐতিহাসিক আলোকচিত্র রয়েছে। এর ভুক্তিগুলো যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন তোফায়েল আহমদ, সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, হারুন অর রশীদ, মুনতাসীর মামুন, আসাদুজ্জামান নূর, হারুণ হাবীব, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, আতিউর রহমান, আবুল মোমেন, মফিদুল হক, নাসির উদ্দীন ইউসুফ, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুসাইন মুহাম্মদ মাসীহুর রহমান, লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির, শেখ হাফিজুর রহমান, রামেন্দু মজুমদার, সৈয়দ বদরুল আহসান, মোহাম্মদ হান্নান, এ কে আব্দুল মোমেন, মোস্তফা জব্বার প্রমুখ।

Ad 300x250

‘মুজিবপিডিয়া’ কি আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী বয়ান তৈরির উপাদান, ইতিহাস কী বলে

কিশোরগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারে দুই যুবদল নেতার সংঘর্ষ, নিহত ১, প্রতিপক্ষের বাড়িতে আগুন

পেহেলগাম থেকে মুজাফফরাবাদ: গুলি ও মিমের আড়ালে ন্যারেটিভের লড়াই

জুলাই সনদ পর্যালোচনা করে মতামত দিয়েছে বিএনপি, এনসিপিসহ ২৩ দল

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা করেও সমস্যার সমাধান হবে না

সম্পর্কিত