সালেহ ফুয়াদ
সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর থেকে নৌকা বোঝাই করে পাথর তুলে নেওয়া হয়েছে। পর্যটনকেন্দ্রটির প্রধান আকর্ষণ পাথর হাওয়া করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব অনেকে।
সিলেটের নদ-নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করা নতুন কোনো বিষয় নয়। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই সিলেটের এই পাথর সারা দেশে সরবরাহ হয়ে আসছে। ভবন, সড়ক ও সেতু—সব ধরনের নির্মাণেই রয়েছে পাথরের চাহিদা।
২০২০ সাল থেকে সিলেটে পাথর তোলায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে শুরু হয়েছে পাথর লুটপাট। এ নিয়ে সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও পাথর তোলা ঠেকানো যায়নি। এমনকি গত ২৬ জুলাই অসহায়ত্ব প্রকাশ করে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না।’
ভবন, সড়ক ও সেতু নির্মাণে এক সময় ইটের খোয়া ব্যবহার হলেও এখন চাহিদার তুঙ্গে রয়েছে উন্নত পাথর। পাথর এখন টেকসই নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্টোন ক্র্যাশিং মালিক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের পাথরের চাহিদা রয়েছে সারা দেশেই। তবে রাজধানী ঢাকাতেই যায় সবচেয়ে বেশি পাথর।
কোয়ারি থেকে পাথর তোলেন বারকি শ্রমিকেরা। পাথর কোয়ারি নামে সিলেটের যে জায়গাগুলো থেকে পাথর তোলা হয়, তা মূলত রিভার বেড। নদীর পার্শ্ব ও তলদেশ। নদীর পাশেই ব্যবসায়ীরা সেই পাথর সংগ্রহ করে স্তুপ করে রাখেন। শ্রমিকদের কাছে থেকে ১১৫ টাকা ঘনফুট দরে কিনে নেন তাঁরা। সেখান থেকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন বাহনে করে সেই পাথর নিয়ে যাওয়া হয় পাথর ভাঙা কারখানায়। ৫ থেকে ১০ টাকা মুনাফা ধরে কারখানায় আরেকবার বিক্রি করে দেওয়া হয় সেই পাথর।
এই পর্যায়ে ফরমাশ অনুযায়ী বিভিন্ন আকারে পাথর ভাঙা হয়। স্টোন ক্র্যাশিং মালিক সমিতি জানায়, ভবন, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদির জন্য তিন বাই চার ইঞ্চি আকারে ভাঙা পাথরের ফরমাশ আসে। রেললাইনে বিছানো হয় ২০ থেকে ৪০ এমএম আকারের উন্নত পাথর। সড়কে কার্পেটিংয়ের জন্য আধা ইঞ্চি আকারের পাথরের ফরমাশ পান বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাথরের ধরন ও আকার ভেদে গড়ে ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা দরে কারখানা মালিকেরা পাথর বিক্রি করেন। তাঁদের হাত থেকে এই পাথর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কেনা মূল্যের সঙ্গে পরিবহন ভাড়া যুক্ত করে পাথরের নতুন মূল্য ঠিক করেন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারেরা।
এই পর্যায়ে পাথর তার চূড়ান্ত পরিণতি পায়। সরাসরি সড়ক, সেতু ও ইমারতসহ নানা নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয় পাথর।
কোম্পানীগঞ্জ ও ভোলাগঞ্জে ২০১৪ সাল থেকে পাথর ব্যবসা করে আসছেন আরবান স্টোন ক্রাশিং প্ল্যান্ট লিমিটেডের মিরাজুল ইসলাম। ভোলাগঞ্জ ও ধোপাগুল এলাকায় তাঁর পাথর ভাঙার কারখানা রয়েছে। নিজে ১০ বছর ধরে এই ব্যবসা করলেও তাঁর পরিবার প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। স্ট্রিমকে মিরাজুল ইসলাম জানান, তাঁদের ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে সিলেটের পাথর ব্যবসা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে। বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে দেশে পাথর আসছে এখন। আমদানির এ ব্যবসায় মুনাফা খুব সামান্য। তাঁরা চান, সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়া হোক।
২০১৫ সালে করা একটি রিটের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত জাফলংকে ইসিএ (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ঘোষণা করেন। কোনো জায়গাকে ইসিএ ঘোষণা করা হলে তা পরিবর্তন করা যায় না। তবে এই ঘোষণার কয়েক বছর পরেও এটি কার্যকর হয়নি। পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পাথর উত্তোলন স্থগিত করে।
তখন থেকেই সিলেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ। কয়েক বছরের মধ্যে জাফলং, ভোলাগঞ্জ, সাদা পাথরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরে আসে।
মিরাজুল ইসলামের মতে, আগের মতো পাথর কোয়ারিগুলো সরকারি উদ্যোগে লিজ দেওয়া হলে সাদাপাথরে কেউ হাত দিত না। সিলেটের পাথর দিয়ে এক সময় সারা দেশের রাস্তাঘাট, ইমারত ও সেতু নির্মাণের কাজ করা হতো জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থেই এখন সিলেটে পাথর তোলা বন্ধ রয়েছে। তাই পাথরের ব্যবসা এখন পুরোপুরি ভারতীয় আমদানিনির্ভর।
২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর ‘পাথর এখন দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু ওই বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসেই পাথর আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার টন। ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া থেকে পাথর আমদানি হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাথর আমদানি হয় ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি। নির্মাণ প্রকৌশলীর সূত্রে বলা হয়, পাথরের চেয়ে ইটের খোয়ার শক্তি ৪০ ভাগ কম।
জানা যায়, দেশীয় উৎস সীমিত হয়ে পড়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করে পাথরের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। প্রকল্পের গুণগত মান বজায় রাখতে ভালো মানের পাথর আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে পাঁচ বছর ধরে পাথর তোলা পুরোপুরি বন্ধ রাখায় ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, পাথরের আধারস্থলে নির্দিষ্ট মাত্রায় পাথর তোলার অনুমতি থাকলে শ্রমিকেরা সাদাপাথর এলাকায় পাথর তুলতে যেতেন না। এর জন্য পরিবেশকর্মী আর সরকার দায়ী বলে তাদের মন্তব্য। যদিও পরিবেশকর্মীরা এর জন্য অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদেরই দায়ী বলে মনে করেন।
পাথর তোলা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে পৃথিবীর যেখান থেকেই পাথর তোলা হোক না কেন তা ক্ষতিকর। পৃথিবীর এক প্রান্তে পরিবেশ ধ্বংস হলে আরেক প্রান্তে যে এর প্রভাব পড়বে না এর নিশ্চয়তা নেই। ফলে আমদানি করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না, স্থানীয় পাথর তুললে পরিবেশের ক্ষতি হবে এই যুক্তি মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা।
ভোলাগঞ্জের পাথর ব্যবসায়ী মিরাজুল ইসলামের মতে, বর্ষাকালে ভারতের মেঘালয় থেকে স্রোতের তোড়ে পাথর ও বালু ভেসে আসে। শীতকালে পাথর ও বালু তুলে যে জায়গাগুলো গর্ত করে রাখেন শ্রমিকেরা সেগুলো পরের বর্ষায় আবারো বালু ও পাথরে পূর্ণ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন এই চক্রই চলে আসছিল। কিন্তু পাথর তোলা বন্ধ করে দেওয়ায় মিরাজের মতে, পাথর এসে ভরে আছে কোয়ারিগুলো। কিন্তু তোলার অনুমতি না থাকায় তোলা যাচ্ছে না।
সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্য সচিব আবদুল করিম চৌধুরী কিম স্ট্রিমকে বলেন, নিষেধাজ্ঞা আসলে কাজীর গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। নিষেধাজ্ঞার আগে বা পরে সিলেটে কখনোই পাথর তোলা বন্ধ ছিল না। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পাথর তোলায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি চাঁদা গুণতে হচ্ছে পার্থক্য শুধু এটুকুই।
মঙ্গলবারও জাফলংয়ে পাথর তোলা হয়েছে জানিয়ে আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা বলেছেন চার বছর সিলেটে পাথর তোলা বন্ধ ছিল। অথচ সংবাদপত্র ঘাটলে ওই সময়ে গর্ত করে পাথর তুলতে গিয়ে কত শ্রমিক মারা গেছেন তারও তালিকা পাওয়া যাবে। বন্ধ থাকলে শ্রমিক কীভাবে মারা যায়?
আবদুল করিম চৌধুরী কিম জানান, বন্ধ মানে মাঝে মাঝে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়, এতে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের—এটুকুই। শুধু ৫ আগস্টের পর থেকে ১৫ আগস্টের ভেতরই শত কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।
গত ১৪ জুন জাফলং পরিদর্শনে পরিদর্শনে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সিলেটে পাথর তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সেদিনই পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা সিলেটে দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ করেন।
আবদুল করিম চৌধুরী কিম জানান, উপদেষ্টাদের পরিদর্শনের পর পাথর ভাঙার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ক্রাশার মেশিনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। অবৈধ জায়গায় থাকা কিছু মেশিন ভাঙাও হয়। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটের ডাক দেন। এসব কারণে সিলেটের পাথর তোলার ইস্যু সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসে।
এই পরিবেশ সংগঠকের মতে, সিলেটের পাথর তোলার কাজ করেন যারা তারা মূলত ভাসমান শ্রমিক। কাজ বন্ধ করে দিলে স্বল্পসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীই ক্ষতি বেশি।
পাথর তোলায় পরিবেশের কীভাবে ক্ষতি হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবদুল করিম চৌধুরী কিম স্ট্রিমকে বলেন, সিলেটের যেসব এলাকা থেকে পাথর তোলা হয়, সেসব এলাকা জৈন্তা ও খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পাহাড়ের নিচ থেকে ক্রমাগত গর্ত করে পাথর তোলায় ভবিষ্যতে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেট থেকে পাথর তুলে দেশের মোট চাহিদার মাত্র ৭ শতাংশ মেটানো সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, আমদানির মাধ্যমে এই প্রয়োজন সহজেই মেটানো যায়।
সম্প্রতি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর থেকে নৌকা বোঝাই করে পাথর তুলে নেওয়া হয়েছে। পর্যটনকেন্দ্রটির প্রধান আকর্ষণ পাথর হাওয়া করে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব অনেকে।
সিলেটের নদ-নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করা নতুন কোনো বিষয় নয়। নিষিদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই সিলেটের এই পাথর সারা দেশে সরবরাহ হয়ে আসছে। ভবন, সড়ক ও সেতু—সব ধরনের নির্মাণেই রয়েছে পাথরের চাহিদা।
২০২০ সাল থেকে সিলেটে পাথর তোলায় নিষেধাজ্ঞা দেয় সরকার। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে শুরু হয়েছে পাথর লুটপাট। এ নিয়ে সংবাদপত্রে বিভিন্ন সময় প্রতিবেদন প্রকাশ হলেও পাথর তোলা ঠেকানো যায়নি। এমনকি গত ২৬ জুলাই অসহায়ত্ব প্রকাশ করে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘আগের চার বছর জাফলং-এ পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখতে পেরেছিলাম, এখন আমি উপদেষ্টা হয়েও পারলাম না।’
ভবন, সড়ক ও সেতু নির্মাণে এক সময় ইটের খোয়া ব্যবহার হলেও এখন চাহিদার তুঙ্গে রয়েছে উন্নত পাথর। পাথর এখন টেকসই নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে নির্মাতাদের প্রথম পছন্দ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা স্টোন ক্র্যাশিং মালিক সমিতির সূত্রে জানা গেছে, সিলেটের পাথরের চাহিদা রয়েছে সারা দেশেই। তবে রাজধানী ঢাকাতেই যায় সবচেয়ে বেশি পাথর।
কোয়ারি থেকে পাথর তোলেন বারকি শ্রমিকেরা। পাথর কোয়ারি নামে সিলেটের যে জায়গাগুলো থেকে পাথর তোলা হয়, তা মূলত রিভার বেড। নদীর পার্শ্ব ও তলদেশ। নদীর পাশেই ব্যবসায়ীরা সেই পাথর সংগ্রহ করে স্তুপ করে রাখেন। শ্রমিকদের কাছে থেকে ১১৫ টাকা ঘনফুট দরে কিনে নেন তাঁরা। সেখান থেকে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ বিভিন্ন বাহনে করে সেই পাথর নিয়ে যাওয়া হয় পাথর ভাঙা কারখানায়। ৫ থেকে ১০ টাকা মুনাফা ধরে কারখানায় আরেকবার বিক্রি করে দেওয়া হয় সেই পাথর।
এই পর্যায়ে ফরমাশ অনুযায়ী বিভিন্ন আকারে পাথর ভাঙা হয়। স্টোন ক্র্যাশিং মালিক সমিতি জানায়, ভবন, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদির জন্য তিন বাই চার ইঞ্চি আকারে ভাঙা পাথরের ফরমাশ আসে। রেললাইনে বিছানো হয় ২০ থেকে ৪০ এমএম আকারের উন্নত পাথর। সড়কে কার্পেটিংয়ের জন্য আধা ইঞ্চি আকারের পাথরের ফরমাশ পান বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পাথরের ধরন ও আকার ভেদে গড়ে ১৩৫ থেকে ১৪৫ টাকা দরে কারখানা মালিকেরা পাথর বিক্রি করেন। তাঁদের হাত থেকে এই পাথর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হয়। কেনা মূল্যের সঙ্গে পরিবহন ভাড়া যুক্ত করে পাথরের নতুন মূল্য ঠিক করেন ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারেরা।
এই পর্যায়ে পাথর তার চূড়ান্ত পরিণতি পায়। সরাসরি সড়ক, সেতু ও ইমারতসহ নানা নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হয় পাথর।
কোম্পানীগঞ্জ ও ভোলাগঞ্জে ২০১৪ সাল থেকে পাথর ব্যবসা করে আসছেন আরবান স্টোন ক্রাশিং প্ল্যান্ট লিমিটেডের মিরাজুল ইসলাম। ভোলাগঞ্জ ও ধোপাগুল এলাকায় তাঁর পাথর ভাঙার কারখানা রয়েছে। নিজে ১০ বছর ধরে এই ব্যবসা করলেও তাঁর পরিবার প্রায় সিকি শতাব্দী ধরে পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। স্ট্রিমকে মিরাজুল ইসলাম জানান, তাঁদের ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০২০ সালের শুরুতে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে পাথর উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে সিলেটের পাথর ব্যবসা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে। বিভিন্ন শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে দেশে পাথর আসছে এখন। আমদানির এ ব্যবসায় মুনাফা খুব সামান্য। তাঁরা চান, সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলো খুলে দেওয়া হোক।
২০১৫ সালে করা একটি রিটের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত জাফলংকে ইসিএ (ইকোলজিক্যালি ক্রিটিক্যাল এরিয়া) ঘোষণা করেন। কোনো জায়গাকে ইসিএ ঘোষণা করা হলে তা পরিবর্তন করা যায় না। তবে এই ঘোষণার কয়েক বছর পরেও এটি কার্যকর হয়নি। পরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত পাথর উত্তোলন স্থগিত করে।
তখন থেকেই সিলেটে পাথর উত্তোলন বন্ধ। কয়েক বছরের মধ্যে জাফলং, ভোলাগঞ্জ, সাদা পাথরসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ফিরে আসে।
মিরাজুল ইসলামের মতে, আগের মতো পাথর কোয়ারিগুলো সরকারি উদ্যোগে লিজ দেওয়া হলে সাদাপাথরে কেউ হাত দিত না। সিলেটের পাথর দিয়ে এক সময় সারা দেশের রাস্তাঘাট, ইমারত ও সেতু নির্মাণের কাজ করা হতো জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতের স্বার্থ রক্ষার্থেই এখন সিলেটে পাথর তোলা বন্ধ রয়েছে। তাই পাথরের ব্যবসা এখন পুরোপুরি ভারতীয় আমদানিনির্ভর।
২০১৭ সালের ৭ অক্টোবর ‘পাথর এখন দ্বিতীয় শীর্ষ আমদানি পণ্য’ শিরোনামে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুধু ওই বছরের জুলাই ও আগস্ট মাসেই পাথর আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার টন। ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভিয়েতনাম ও মালয়েশিয়া থেকে পাথর আমদানি হচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাথর আমদানি হয় ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি। নির্মাণ প্রকৌশলীর সূত্রে বলা হয়, পাথরের চেয়ে ইটের খোয়ার শক্তি ৪০ ভাগ কম।
জানা যায়, দেশীয় উৎস সীমিত হয়ে পড়ায় বিদেশ থেকে আমদানি করে পাথরের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। প্রকল্পের গুণগত মান বজায় রাখতে ভালো মানের পাথর আমদানি করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করে পাঁচ বছর ধরে পাথর তোলা পুরোপুরি বন্ধ রাখায় ব্যবসায়ীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, পাথরের আধারস্থলে নির্দিষ্ট মাত্রায় পাথর তোলার অনুমতি থাকলে শ্রমিকেরা সাদাপাথর এলাকায় পাথর তুলতে যেতেন না। এর জন্য পরিবেশকর্মী আর সরকার দায়ী বলে তাদের মন্তব্য। যদিও পরিবেশকর্মীরা এর জন্য অসাধু ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদেরই দায়ী বলে মনে করেন।
পাথর তোলা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে পৃথিবীর যেখান থেকেই পাথর তোলা হোক না কেন তা ক্ষতিকর। পৃথিবীর এক প্রান্তে পরিবেশ ধ্বংস হলে আরেক প্রান্তে যে এর প্রভাব পড়বে না এর নিশ্চয়তা নেই। ফলে আমদানি করলে পরিবেশের ক্ষতি হবে না, স্থানীয় পাথর তুললে পরিবেশের ক্ষতি হবে এই যুক্তি মানতে নারাজ ব্যবসায়ীরা।
ভোলাগঞ্জের পাথর ব্যবসায়ী মিরাজুল ইসলামের মতে, বর্ষাকালে ভারতের মেঘালয় থেকে স্রোতের তোড়ে পাথর ও বালু ভেসে আসে। শীতকালে পাথর ও বালু তুলে যে জায়গাগুলো গর্ত করে রাখেন শ্রমিকেরা সেগুলো পরের বর্ষায় আবারো বালু ও পাথরে পূর্ণ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন এই চক্রই চলে আসছিল। কিন্তু পাথর তোলা বন্ধ করে দেওয়ায় মিরাজের মতে, পাথর এসে ভরে আছে কোয়ারিগুলো। কিন্তু তোলার অনুমতি না থাকায় তোলা যাচ্ছে না।
সিলেটের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সিলেটের সদস্য সচিব আবদুল করিম চৌধুরী কিম স্ট্রিমকে বলেন, নিষেধাজ্ঞা আসলে কাজীর গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। নিষেধাজ্ঞার আগে বা পরে সিলেটে কখনোই পাথর তোলা বন্ধ ছিল না। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর পাথর তোলায় ব্যবসায়ীদের বাড়তি চাঁদা গুণতে হচ্ছে পার্থক্য শুধু এটুকুই।
মঙ্গলবারও জাফলংয়ে পাথর তোলা হয়েছে জানিয়ে আবদুল করিম চৌধুরী কিম বলেন, সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা বলেছেন চার বছর সিলেটে পাথর তোলা বন্ধ ছিল। অথচ সংবাদপত্র ঘাটলে ওই সময়ে গর্ত করে পাথর তুলতে গিয়ে কত শ্রমিক মারা গেছেন তারও তালিকা পাওয়া যাবে। বন্ধ থাকলে শ্রমিক কীভাবে মারা যায়?
আবদুল করিম চৌধুরী কিম জানান, বন্ধ মানে মাঝে মাঝে কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয়, এতে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যবসায়ীদের—এটুকুই। শুধু ৫ আগস্টের পর থেকে ১৫ আগস্টের ভেতরই শত কোটি টাকার পাথর লুট হয়েছে।
গত ১৪ জুন জাফলং পরিদর্শনে পরিদর্শনে যান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। এ সময় পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, সিলেটে পাথর তোলার উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। সেদিনই পাথর ব্যবসার সঙ্গে যুক্তরা সিলেটে দুই উপদেষ্টার গাড়ি আটকে বিক্ষোভ করেন।
আবদুল করিম চৌধুরী কিম জানান, উপদেষ্টাদের পরিদর্শনের পর পাথর ভাঙার মেশিনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। ক্রাশার মেশিনের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। অবৈধ জায়গায় থাকা কিছু মেশিন ভাঙাও হয়। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘটের ডাক দেন। এসব কারণে সিলেটের পাথর তোলার ইস্যু সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনায় আসে।
এই পরিবেশ সংগঠকের মতে, সিলেটের পাথর তোলার কাজ করেন যারা তারা মূলত ভাসমান শ্রমিক। কাজ বন্ধ করে দিলে স্বল্পসংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীই ক্ষতি বেশি।
পাথর তোলায় পরিবেশের কীভাবে ক্ষতি হচ্ছে, তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আবদুল করিম চৌধুরী কিম স্ট্রিমকে বলেন, সিলেটের যেসব এলাকা থেকে পাথর তোলা হয়, সেসব এলাকা জৈন্তা ও খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত। পাহাড়ের নিচ থেকে ক্রমাগত গর্ত করে পাথর তোলায় ভবিষ্যতে পাহাড় ধ্বসের আশঙ্কা রয়েছে।
সিলেট থেকে পাথর তুলে দেশের মোট চাহিদার মাত্র ৭ শতাংশ মেটানো সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, আমদানির মাধ্যমে এই প্রয়োজন সহজেই মেটানো যায়।
জাতিসংঘ বলছে, কোনো দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সেই দেশের জলবায়ু কার্যক্রমের জন্য বরাদ্দ অর্থের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় বাধা হিসেবে কাজ করে। ফলে দুষ্টচক্র তৈরি হয়ে পরিবেশের অবক্ষয় ঘটায়। এ কারণে সশস্ত্র ও সহিংস সংঘাতের ঘটনাও বেড়ে যায়।
১৭ ঘণ্টা আগেপশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার পাইকর গ্রাম। ভাঙা ঘরের দাওয়ায় বিষণ্ন মুখে বসে আছেন বৃদ্ধ ভাদু শেখ। কপালের ভাঁজে ভাঁজে দুশ্চিন্তা—তাঁর মেয়েটি কি সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারবে? গর্ভপাত হয়ে যাবে না তো?
৬ দিন আগেটিকটক হইল এখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারের প্ল্যাটফর্ম। সোশ্যাল মিডিয়ার এই ভার্শনটা এমন যে আপনি দুইটা ট্যাপ দিলেই একটা ভিডিও বানায়া আপলোড করতে পারবেন। ক্যামেরা, এডিটিং, মিউজিক, ট্রেন্ডি সাউন্ড সব এক জায়গায়।
৭ দিন আগেবিশ্বের বিভিন্ন দেশেই দীর্ঘ দিনের স্বৈরশাসন ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পতন ঘটায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে সমাজের রাজনৈতিক কাঠামো, শাসন ব্যবস্থা ও মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণের দৃষ্টিকোণও বদলে দিয়েছে।
৭ দিন আগে