leadT1ad

ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি: যেখানে মুখোমুখি সরকার ও ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ : ১৫ অক্টোবর ২০২৫, ২২: ০৪
স্ট্রিম গ্রাফিক

সরকার ও ব্যবসায়ীরা বসে আলোচনার ভিত্তিতে দেশে ভোজ্যতেলের অভিন্ন দাম নির্ধারণ শুরু হয় ২০২১ সালে। এর মধ্যে গত সোমবার ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেন। তবে সরকার জানায়, তারা নতুন এই দামে সম্মতিই দেয়নি। দুপক্ষের এমন অবস্থান নিয়ে এরপর থেকে চলছে আলোচনা।

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া সোমবারের ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ নতুন মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে, যা অনতিবিলম্বে (১৪ অক্টোবর) কার্যকর হবে।

নতুন দাম অনুযায়ী, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৬ টাকা বাড়িয়ে ১৯৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৭৭ টাকা, পাঁচ লিটারের প্রতি বোতল সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৪৫ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা পাম তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৩ টাকা।

তবে ওই ঘোষণার পর ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবে উপদেষ্টা সম্মতি দেননি বলে জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘তাঁরা দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। কিন্তু উপদেষ্টা এখনো সম্মতি দেননি। আর উপদেষ্টা সম্মতি না দিলে সেটা কার্যকর হয় না।’

১৫ দিন বা এক মাস পরপর দাম সমন্বয় করলে সুবিধা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাহলে একসঙ্গে এত দাম বাড়ে না; দু-তিন টাকা করে বাড়ে। গেল দু-তিন মাস দাম সমন্বয় করা হয়নি বলেই এবার দাম বেড়েছে। গেল আগস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম কমে গিয়েছিল।

এরপর মঙ্গলবার পূর্বাচলে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছেন ব্যবসায়ীরা, যা এখতিয়ার বহির্ভূত।’ তিনি আরও বলেন, ‘সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায়নি এবং ব্যবসায়ীদের দাম বাড়ানোর কোনো অনুমোদনও দেয়নি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া দাম বাড়ানোর এখতিয়ার নেই ব্যবসায়ীদের। যদি দামের তারতম্য ঘটে, সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

এর আগে চলতি বছরের এপ্রিলে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৮৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। অন্যদিকে, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৬৯ টাকা, পাঁচ লিটারের প্রতি বোতল সয়াবিন তেল ৯২২ টাকা এবং প্রতি লিটার খোলা পাম তেলের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৬৯ টাকা। সবশেষ ১২ আগস্ট সয়াবিন তেলের দাম অপরিবর্তিত রেখে প্রতি লিটারে খোলা পাম তেলের দাম ১৯ টাকা কমিয়ে ১৫০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়।

সরকারের অনুমোদন ছাড়াই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ স্ট্রিমকে বলেন, ‘মাসখানেক আগেই দাম বাড়ানোর কথা ছিল। ১৫ দিন পরপর রিভাইস করার কথা আইনে বলা আছে। আজ দুমাস পরে এসে তারা (ব্যবসায়ীরা) এটা দিতে বাধ্য হয়েছেন। তা না হলে তো মালই আনা যাবে না।’

তিনি আরও বলেন, সরকার চাচ্ছে না জনগণের সমস্যা হোক। দাম বাড়াতে সরকার আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অবস্থা খুবই খারাপ। তারা লাখ লাখ টন তেল বিক্রি করেন।

দাম বাড়াতে অনুমতি দেননি বলে দাবি করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘বৈঠকে তিনি ছিলেন না। তিনি মনে হয় বাইরে ছিলেন, সে কারণেই তিনি (উপদেষ্টা) এমন কথা বলেছেন।’

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণপত্র (এলসি) খুলে যে মাল আনা হচ্ছে, এটার মূল্যের সঙ্গে যদি সমন্বয় করা না হয়, তাহলে লোকসানের কারণে ভবিষ্যতে আবার বুকিং করতে পারবে না। বুকিং করতে না পারলে তেলের সংকট হবে, তখন ১০০ টাকা বেশি দিয়েও তেল পাওয়া যাবে না। এ জন্য নিয়মিতভাবে আইনটা ফলো করলেই হয়।

ইচ্ছা করলেই ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো যায় না বলে মন্তব্য করে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই), বাংলাদেশ ব্যাংক—সবাই মিলেই এই মূল্যায়নটা হয়। এটা হচ্ছে আইন।

‘কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে আমাদেরও বাড়াতে হবে, কমলে আমাদেরও কমাতে হবে। এখানে কারও কিছু করার নেই। কারণ, এটা তো কারও ঘরের জিনিস না। বাজারের খবর কী, সেটা বিশ্বের সবাই জানেন,’ যোগ করেন তিনি।

সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ঋণপত্র (এলসি) খুলে যে মাল আনা হচ্ছে, এটার মূল্যের সঙ্গে যদি সমন্বয় করা না হয়, তাহলে লোকসানের কারণে ভবিষ্যতে আবার বুকিং করতে পারবে না। বুকিং করতে না পারলে তেলের সংকট হবে, তখন ১০০ টাকা বেশি দিয়েও তেল পাওয়া যাবে না। এ জন্য নিয়মিতভাবে আইনটা ফলো করলেই হয়।

১৫ দিন বা এক মাস পরপর দাম সমন্বয় করলে সুবিধা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, তাহলে একসঙ্গে এত দাম বাড়ে না; দু-তিন টাকা করে বাড়ে। গেল দু-তিন মাস দাম সমন্বয় করা হয়নি বলেই এবার দাম বেড়েছে। গেল আগস্টে আন্তর্জাতিক বাজারে পাম তেলের দাম কমে গিয়েছিল। বাংলাদেশেও ১৯ টাকা কমানো হয়েছিল। এটিই নিয়ম। আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়লে, বাংলাদেশেও বাড়বে।

তবে, অ্যাসোসিয়েশনের বাড়ানো দামে এখনো সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন না বলে রাজধানীর কাওরান বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্ট্রিমকে তারা বলেন, তারা আগের দামে পণ্য আগের দামেই বিক্রি করছেন। এক সপ্তাহ পরে যখন নতুন দামের পণ্য আসবে, তখন সেই দামে বিক্রি করা হবে। নতুন দামের পণ্য বাজারে এখনো আসেনি।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই সরকার ও ভোজ্যতেলের উৎপাদকরা বসে দাম নির্ধারণ করেন। এ ক্ষেত্রে উৎপাদক বা সরবরাহকারীদের খরচ মিলিয়ে এটা নির্ধারণ করা হয়।

জাহিদ হোসেন (৫০) নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘যদি গতকাল নতুন দাম ঘোষণা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা কার্যকর হতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। আর সরকার না চাইলে তো নতুন দাম কার্যকর হবে না।’

তবে, তাদের ব্যবসা সার্বিকভাবে ভালো যাচ্ছে না বলেও জানিয়েছেন তিনি। জাহিদ হোসেন বলেন, এখন খুব একটা লাভ হয় না। পাঁচ লিটারের চার বোতলের একটি কার্টন বিক্রি করলে মাত্র ৫০ টাকা লাভ হচ্ছে।

বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই সরকার ও ভোজ্যতেলের উৎপাদকরা বসে দাম নির্ধারণ করেন। এ ক্ষেত্রে উৎপাদক বা সরবরাহকারীদের খরচ মিলিয়ে এটা নির্ধারণ করা হয়। এখন তাদের যে সভা হয়েছে, সেখানে কী আলোচনা বা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে সেটা স্পষ্ট করার সুযোগ আছে। যদি মন্ত্রণালয় থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না-ও দিয়ে থাকেন, তাহলে কী আলোচনা হয়েছিল বা কোন সিদ্ধান্তে বৈঠক শেষ হয়েছে, সেটা তারা প্রকাশ করতে পারেন।

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, সভায় যদি সিদ্ধান্ত না হয়ে থাকে, তাহলে ব্যবসায়ীরা কেন এটা বাড়ালেন? তারা পুরো নিয়ম থেকে বের হয়ে এলেন কি না, সেটাও স্পষ্ট করতে হবে। আর যদি ব্যবসায়ীরা সরকারি নির্দেশনার বাইরে এককভাবে এটা বাড়িয়ে থাকেন, তাহলে নিয়ম মেনে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কারণ, ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। আর সরকার তো একটা আইনি কাঠামোর মধ্যে চলে।

আইন যা বলছে

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৫৬-এর ধারা ৩-এ বলা হয়েছে, সরকার, যতদূর কোনো অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের সরবরাহ বজায় রাখার বা বৃদ্ধির জন্য অথবা ন্যায্যমূল্যে ন্যায়সংগত বিতরণ ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় বা সমীচীন বলিয়া প্রতীয়মান হবে, প্রজ্ঞাপিত আদেশের মাধ্যমে সেই পণ্যের উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, রক্ষণ, মজুদ, চলাচল, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, হস্তান্তর, অর্জন, ব্যবহার বা ভোগ এবং ব্যবসা ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার বিধান করতে পারবে।

ধারা ৩-এর উপধারা (খ)-এ বলা হয়েছে, কোনো অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ক্রয় বা বিক্রয়ের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সরকার।

Ad 300x250

সম্পর্কিত