মাহবুবুল আলম তারেক

পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে এক নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে। ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির যে পরিমাণ ক্ষমতা অর্জন করেছেন, তা নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে তুমুল বিতর্ক। সমালোচকরা বলছেন, পাকিস্তান কার্যত এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বেসামরিক রাজনীতি তার শেষ অবলম্বনটুকুও হারাতে বসেছে। দীর্ঘ কয়েক দশকের টানাপোড়েনের পর দেশে গণতন্ত্রের ক্ষীণ যে আলোকরেখা দেখা গিয়েছিল, তা আবারও সামরিক কর্তৃত্বের ছায়ায় ঢাকা পড়ছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সেনা প্রধান মুনির কি হয়ে উঠছেন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি?
১৯৭৩ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানের সংবিধান নানা রাজনৈতিক আঘাতের শিকার হয়েছে। গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই খেয়াল-খুশিমতো সংশোধনী শুরু হয়। এসব সংশোধনী সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরশাসনকে বৈধতা দিয়েছে। গত ১৫ বছরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে বেসামরিক শাসনের ছাপ দেখা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আবারও সেই ভারসাম্য নষ্ট করেছে।
নভেম্বরে পার্লামেন্ট দ্রুত ২৭তম সংশোধনী পাস করে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়। সমালোচকরা একে সরাসরি ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, পাকিস্তানে স্থায়ী সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বৈধ পথ খুলে দেওয়া হয়েছে।
বিরোধী জোট তেহরিক তাহাফুজ আইন-ই-পাকিস্তানের প্রধান মাহমুদ খান আচাকজাই সরাসরি অভিযোগ করেন, দেশে আর কার্যকর সংবিধান নেই। বিচারব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে এবং এই সংশোধনী জাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। তার ভাষায়, ‘একজন মানুষকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাজা বানানো হয়েছে।’
সবাই একমত যে এই সংশোধনীর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী কেবল একজন—সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। আগে থেকেই তিনি দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। এখন তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম ক্ষমতাধর জেনারেলে পরিণত হতে চলেছেন।
সংশোধনীর ফলে মুনির সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌ ও বিমানবাহিনীরও সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ পাবেন। তার পাঁচ বছরের মেয়াদ নতুন করে শুরু হবে এবং আরও একাধিকবার বাড়ানো যেতে পারে। এতে তিনি অন্তত এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারেন।
এ ছাড়া তাকে আজীবন ফৌজদারি মামলার দায় থেকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে—যা পাকিস্তানের ইতিহাসে বিরল।
বিচারবিভাগে সরাসরি আঘাত
সংশোধনীর আরেকটি বিতর্কিত অংশ হলো বিচারবিভাগ পুনর্গঠন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত নিয়োগব্যবস্থায় একটি নতুন সাংবিধানিক আদালত গঠিত হবে, যা সুপ্রিম কোর্টকে প্রতিস্থাপন করবে।
এর প্রতিবাদে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। তাদের মতে, নির্বাহী ও সামরিক ক্ষমতার ওপর আদালতের শেষ নিয়ন্ত্রণটুকুও ছিন্ন করা হয়েছে।
অধ্যাপক আইয়াজ মালিক বলেন, ‘এটি আসলে সামরিক শাসন। নাম ভিন্ন হলেও বাস্তবতা একই।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্কও সতর্ক করে বলেন, ২৭তম সংশোধনী গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে বিপজ্জনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পর্যবেক্ষকদের অভিমত, মুনির যথাযথ সময়েই নিজের ক্ষমতা পোক্ত করেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচন অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে বিতর্কিত হয়। ফলে বর্তমান জোট সরকারকে দুর্বল, অজনপ্রিয় ও জনগণের ম্যান্ডেটহীন প্রশাসন হিসেবে দেখা হয়।
এমন সরকার মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। আইয়াজ মালিক একে বলেছেন ‘সামরিক ভেন্টিলেটর’।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: মুনিরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সুযোগ
গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। দুই দেশের মধ্যে ড্রোন ও মিসাইল হামলা হয়। পাকিস্তান দাবি করে, তারা কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। মুনির এ ঘটনাকে ভারতের ওপর ‘জয়’ হিসেবে দেখান।
এর ফলে দেশে ব্যাপক সামরিক উচ্ছ্বাস ও জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা তৈরি হয়। মালিক বলেন, এই সংঘর্ষ মুনিরের জন্য ছিল ‘আল্লাহর পাঠানো আশীর্বাদ’ এর মতো। এরপর তাকে পাঁচ-তারকা জেনারেলের মর্যাদা দেওয়া হয়।
মুনির আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও নিজেকে দৃশ্যমান করে তোলেন। পাকিস্তান যখন দাবি করে যে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত প্রশমনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত, তখন মুনির ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে টানা দুটি বৈঠক করেন।
এক দশকের বেশি সময় শীতল সম্পর্ক থাকার পর মুনিরকে হোয়াইট হাউসে অভ্যর্থনা দেওয়া হয় এবং ট্রাম্প তাকে ‘প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ বলে সম্বোধন করেন।
এ ছাড়া তিনি সৌদি আরবের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
দুর্বল সরকারের সুযোগ নিয়েছেন মুনির
২৭তম সংশোধনী যেভাবে পাস হলো তাতেই মুনিরের ক্ষমতার ব্যাপ্তি স্পষ্ট। আগের সংশোধনীগুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো। এবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিনেট ও জাতীয় পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনে আইনটি পাস হয়ে যায়।
চাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ বলেন, ‘সরকার এতটাই দুর্বল যে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া তাদের টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। মুনির সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন।’
ফারজানা শেখ বলেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে বহুবার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছে। তবুও এবার দুই দলের আত্মসমর্পণের ধরন বিস্ময়কর।
তার মতে, এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এতে গণতন্ত্র তো দূরের কথা—জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনের পথেই বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
এই সংশোধনী মুনিরকে দায়মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়, যা দেশকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলবে।
সামরিক বাহিনীর ভেতরেও অস্বস্তি
তিন বাহিনীর ওপর মুনিরের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় সেনাবাহিনীর ভেতরেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ এখন তার হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার আশঙ্কা চলছে।
তার ভারতবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে তাকে অনেকে ‘বেপরোয়া অপারেটর’ বলেও অভিহিত করেন।
একজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেনারেল বলেন, এই সংশোধনী ‘বিধ্বংসী’। তার মতে, নৌ ও বিমানবাহিনীর ভেতরে ক্ষোভ বাড়ছে।
তিনি মনে করেন, সংশোধনী কোনোভাবেই প্রতিরক্ষা কাঠামোর উপকারে আসবে না; বরং কেবল একজনকেই সুবিধা দেবে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ অবশ্য সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রের অংশ। তারা ভালো কাজ করলে সমর্থন পাবেনই।
তার দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে ‘জয়লাভের’ কারণে সংসদ মুনিরকে দায়মুক্তি দিয়েছে।
মুনির পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন—এমন ধারণাকে তিনি ‘কল্পনা’ বলে আখ্যা দেন।
অনেকের মতে, ২৭তম সংশোধনী কেবল একটি পুরনো বাস্তবতাকে আইনি রূপ দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তান সবসময় বেসামরিক ও সামরিক শাসনের দোলাচলে থেকেছে।
শেষ অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৯৯ সালে, যখন পারভেজ মুশাররফ নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেন। ২০০৮ সালে দেশ আবার বেসামরিক শাসনে ফিরলেও সেনাবাহিনীর প্রভাব আড়ালেই ছিল।
এখন সেই প্রভাব প্রকাশ্যে এসেছে। কোনো প্রকাশ্য অভ্যুত্থান ছাড়াই জেনারেলরা রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন।
‘মুনির মডেল’: নতুন ধরনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ
এই ব্যবস্থাকে অনেকেই ‘মুনির মডেল’ বলে অভিহিত করছেন। এটি নতুন এক ধরনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেই স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৮ সালে সরাসরি সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর এটি পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন।
এ ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী আর আড়ালে থেকে সুতা টানে না। তারা বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকাশ্যেই দেশ পরিচালনা করছে। নীতি প্রণয়ন, কূটনীতি পরিচালনা এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তারা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা খাতে আগের মতোই প্রধান ভূমিকা ধরে রাখছে।
সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকেই মুনিরকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর বিরুদ্ধে দমনপীড়নের নেপথ্যের প্রধান শক্তি হিসেবে দেখা হয়। সামরিক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করায় খান ও পিটিআই–এর শীর্ষ নেতারা এখন সবাই কারাগারে।
দুই বছর পরও ইমরান খান কারাগারে আছেন। তিনি জনসমক্ষে প্রায় অদৃশ্য। তাঁর বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়াকে অনেক পাকিস্তানি অন্যায্য মনে করেন। ২০২২ সালে তাঁকে সরানো এবং রাজনৈতিক সংকট স্থিতিশীল করার যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল, তা এখন অনেক দূরে সরে গেছে।
কিন্তু সেই দুর্বলতার মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে যে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আর বেসামরিক নেতৃত্ব ফিরে পায়নি। বরং সেই ক্ষমতা আরও বেড়েছে। যা এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই গ্রাস করেছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, ‘এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত গভীর হবে।’ তার মতে, ‘যদি কখনো সামরিক ক্ষমতা কমিয়ে বেসামরিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তবে এই সংশোধনী বাতিল করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’ তিনি বলেন, ‘মুনিরকে এখন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এমনকি অতীতের যেকোনো সেনাপ্রধানের চেয়েও অপসারণ করা বেশি কঠিন হবে।’
চ্যালেঞ্জ: ক্ষমতা বাড়লে দায়ও বাড়ে
মুনিরের হাতে প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রিভূতত হলেও তার সঙ্গে বড় ধরনের দায়ও এসেছে। পাকিস্তান এখন একদিকে দুটি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, অন্যদিকে ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মুখে রয়েছে। অর্থনীতি ভাঙনের পথে এবং মুনির এখনো তা সামাল দিতে পারেননি।
বিশ্লেষক আইয়াজ মালিক বলেন, মুনিরই প্রথম নন যে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করেছেন। পারভেজ মুশাররফও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু জনঅসন্তোষে তা ধসে পড়ে।
তিনি মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলেই এমন সব পরিকল্পনা ভেঙে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে সেনাবাহিনী পর্দার আড়াল থেকে রাষ্ট্র চালাত। ব্যর্থতার দায় নিত বেসামরিক সরকার। কিন্তু মুনির মডেলে সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে নীতি নির্ধারণ করছে।
ফলে অর্থনৈতিক ব্যর্থতা বা নিরাপত্তা সংকট দেখা দিলে এর দায়ও এখন তাদের ওপরই বর্তাবে। প্রদর্শিত ক্ষমতার সঙ্গে জবাবদিহিও জুড়ে গেছে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স

পাকিস্তানের ক্ষমতার কেন্দ্রে এক নতুন অধ্যায় রচিত হচ্ছে। ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির যে পরিমাণ ক্ষমতা অর্জন করেছেন, তা নিয়ে দেশ-বিদেশে চলছে তুমুল বিতর্ক। সমালোচকরা বলছেন, পাকিস্তান কার্যত এমন এক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বেসামরিক রাজনীতি তার শেষ অবলম্বনটুকুও হারাতে বসেছে। দীর্ঘ কয়েক দশকের টানাপোড়েনের পর দেশে গণতন্ত্রের ক্ষীণ যে আলোকরেখা দেখা গিয়েছিল, তা আবারও সামরিক কর্তৃত্বের ছায়ায় ঢাকা পড়ছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, সেনা প্রধান মুনির কি হয়ে উঠছেন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি?
১৯৭৩ সালে প্রণীত হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তানের সংবিধান নানা রাজনৈতিক আঘাতের শিকার হয়েছে। গণতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হলেও কয়েক বছরের মধ্যেই খেয়াল-খুশিমতো সংশোধনী শুরু হয়। এসব সংশোধনী সামরিক অভ্যুত্থান ও স্বৈরশাসনকে বৈধতা দিয়েছে। গত ১৫ বছরে পরিস্থিতি কিছুটা বদলে বেসামরিক শাসনের ছাপ দেখা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি আবারও সেই ভারসাম্য নষ্ট করেছে।
নভেম্বরে পার্লামেন্ট দ্রুত ২৭তম সংশোধনী পাস করে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়। সমালোচকরা একে সরাসরি ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, পাকিস্তানে স্থায়ী সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বৈধ পথ খুলে দেওয়া হয়েছে।
বিরোধী জোট তেহরিক তাহাফুজ আইন-ই-পাকিস্তানের প্রধান মাহমুদ খান আচাকজাই সরাসরি অভিযোগ করেন, দেশে আর কার্যকর সংবিধান নেই। বিচারব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে এবং এই সংশোধনী জাতির বিরুদ্ধে অপরাধ। তার ভাষায়, ‘একজন মানুষকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে রাজা বানানো হয়েছে।’
সবাই একমত যে এই সংশোধনীর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী কেবল একজন—সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। আগে থেকেই তিনি দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। এখন তিনি পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম ক্ষমতাধর জেনারেলে পরিণত হতে চলেছেন।
সংশোধনীর ফলে মুনির সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নৌ ও বিমানবাহিনীরও সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ পাবেন। তার পাঁচ বছরের মেয়াদ নতুন করে শুরু হবে এবং আরও একাধিকবার বাড়ানো যেতে পারে। এতে তিনি অন্তত এক দশক ধরে ক্ষমতায় থাকতে পারেন।
এ ছাড়া তাকে আজীবন ফৌজদারি মামলার দায় থেকেও মুক্তি দেওয়া হয়েছে—যা পাকিস্তানের ইতিহাসে বিরল।
বিচারবিভাগে সরাসরি আঘাত
সংশোধনীর আরেকটি বিতর্কিত অংশ হলো বিচারবিভাগ পুনর্গঠন। সরকার-নিয়ন্ত্রিত নিয়োগব্যবস্থায় একটি নতুন সাংবিধানিক আদালত গঠিত হবে, যা সুপ্রিম কোর্টকে প্রতিস্থাপন করবে।
এর প্রতিবাদে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। তাদের মতে, নির্বাহী ও সামরিক ক্ষমতার ওপর আদালতের শেষ নিয়ন্ত্রণটুকুও ছিন্ন করা হয়েছে।
অধ্যাপক আইয়াজ মালিক বলেন, ‘এটি আসলে সামরিক শাসন। নাম ভিন্ন হলেও বাস্তবতা একই।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার তুর্কও সতর্ক করে বলেন, ২৭তম সংশোধনী গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে বিপজ্জনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পর্যবেক্ষকদের অভিমত, মুনির যথাযথ সময়েই নিজের ক্ষমতা পোক্ত করেছেন। ২০২৪ সালের নির্বাচন অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে বিতর্কিত হয়। ফলে বর্তমান জোট সরকারকে দুর্বল, অজনপ্রিয় ও জনগণের ম্যান্ডেটহীন প্রশাসন হিসেবে দেখা হয়।
এমন সরকার মূলত সেনাবাহিনীর সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল। আইয়াজ মালিক একে বলেছেন ‘সামরিক ভেন্টিলেটর’।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: মুনিরের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির সুযোগ
গত মে মাসে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। দুই দেশের মধ্যে ড্রোন ও মিসাইল হামলা হয়। পাকিস্তান দাবি করে, তারা কয়েকটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। মুনির এ ঘটনাকে ভারতের ওপর ‘জয়’ হিসেবে দেখান।
এর ফলে দেশে ব্যাপক সামরিক উচ্ছ্বাস ও জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা তৈরি হয়। মালিক বলেন, এই সংঘর্ষ মুনিরের জন্য ছিল ‘আল্লাহর পাঠানো আশীর্বাদ’ এর মতো। এরপর তাকে পাঁচ-তারকা জেনারেলের মর্যাদা দেওয়া হয়।
মুনির আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও নিজেকে দৃশ্যমান করে তোলেন। পাকিস্তান যখন দাবি করে যে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত প্রশমনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত, তখন মুনির ওয়াশিংটনে ট্রাম্পের সঙ্গে টানা দুটি বৈঠক করেন।
এক দশকের বেশি সময় শীতল সম্পর্ক থাকার পর মুনিরকে হোয়াইট হাউসে অভ্যর্থনা দেওয়া হয় এবং ট্রাম্প তাকে ‘প্রিয় ফিল্ড মার্শাল’ বলে সম্বোধন করেন।
এ ছাড়া তিনি সৌদি আরবের সঙ্গে বড় ধরনের প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদনে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
দুর্বল সরকারের সুযোগ নিয়েছেন মুনির
২৭তম সংশোধনী যেভাবে পাস হলো তাতেই মুনিরের ক্ষমতার ব্যাপ্তি স্পষ্ট। আগের সংশোধনীগুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হতো। এবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সিনেট ও জাতীয় পরিষদে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থনে আইনটি পাস হয়ে যায়।
চাথাম হাউসের গবেষক ফারজানা শেখ বলেন, ‘সরকার এতটাই দুর্বল যে সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া তাদের টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। মুনির সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন।’
ফারজানা শেখ বলেন, পাকিস্তানের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে বহুবার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছে। তবুও এবার দুই দলের আত্মসমর্পণের ধরন বিস্ময়কর।
তার মতে, এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। এতে গণতন্ত্র তো দূরের কথা—জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনের পথেই বড় বাধা সৃষ্টি হয়েছে।
এই সংশোধনী মুনিরকে দায়মুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়, যা দেশকে বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলবে।
সামরিক বাহিনীর ভেতরেও অস্বস্তি
তিন বাহিনীর ওপর মুনিরের নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় সেনাবাহিনীর ভেতরেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের নিয়ন্ত্রণ এখন তার হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার আশঙ্কা চলছে।
তার ভারতবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে তাকে অনেকে ‘বেপরোয়া অপারেটর’ বলেও অভিহিত করেন।
একজন অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেনারেল বলেন, এই সংশোধনী ‘বিধ্বংসী’। তার মতে, নৌ ও বিমানবাহিনীর ভেতরে ক্ষোভ বাড়ছে।
তিনি মনে করেন, সংশোধনী কোনোভাবেই প্রতিরক্ষা কাঠামোর উপকারে আসবে না; বরং কেবল একজনকেই সুবিধা দেবে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ অবশ্য সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রের অংশ। তারা ভালো কাজ করলে সমর্থন পাবেনই।
তার দাবি, ভারতের বিরুদ্ধে ‘জয়লাভের’ কারণে সংসদ মুনিরকে দায়মুক্তি দিয়েছে।
মুনির পাকিস্তানের সর্বশক্তিমান ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন—এমন ধারণাকে তিনি ‘কল্পনা’ বলে আখ্যা দেন।
অনেকের মতে, ২৭তম সংশোধনী কেবল একটি পুরনো বাস্তবতাকে আইনি রূপ দিয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর পাকিস্তান সবসময় বেসামরিক ও সামরিক শাসনের দোলাচলে থেকেছে।
শেষ অভ্যুত্থান ঘটে ১৯৯৯ সালে, যখন পারভেজ মুশাররফ নওয়াজ শরিফকে সরিয়ে দেন। ২০০৮ সালে দেশ আবার বেসামরিক শাসনে ফিরলেও সেনাবাহিনীর প্রভাব আড়ালেই ছিল।
এখন সেই প্রভাব প্রকাশ্যে এসেছে। কোনো প্রকাশ্য অভ্যুত্থান ছাড়াই জেনারেলরা রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন।
‘মুনির মডেল’: নতুন ধরনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ
এই ব্যবস্থাকে অনেকেই ‘মুনির মডেল’ বলে অভিহিত করছেন। এটি নতুন এক ধরনের সামরিক নিয়ন্ত্রণ, যা গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরেই স্থাপন করা হয়েছে। ২০০৮ সালে সরাসরি সামরিক শাসন শেষ হওয়ার পর এটি পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর সবচেয়ে বড় পুনর্গঠন।
এ ব্যবস্থায় সেনাবাহিনী আর আড়ালে থেকে সুতা টানে না। তারা বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকাশ্যেই দেশ পরিচালনা করছে। নীতি প্রণয়ন, কূটনীতি পরিচালনা এবং অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি তারা নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা খাতে আগের মতোই প্রধান ভূমিকা ধরে রাখছে।
সেনাপ্রধান হওয়ার পর থেকেই মুনিরকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর বিরুদ্ধে দমনপীড়নের নেপথ্যের প্রধান শক্তি হিসেবে দেখা হয়। সামরিক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করায় খান ও পিটিআই–এর শীর্ষ নেতারা এখন সবাই কারাগারে।
দুই বছর পরও ইমরান খান কারাগারে আছেন। তিনি জনসমক্ষে প্রায় অদৃশ্য। তাঁর বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়াকে অনেক পাকিস্তানি অন্যায্য মনে করেন। ২০২২ সালে তাঁকে সরানো এবং রাজনৈতিক সংকট স্থিতিশীল করার যে যুক্তি তুলে ধরা হয়েছিল, তা এখন অনেক দূরে সরে গেছে।
কিন্তু সেই দুর্বলতার মুহূর্তে সেনাবাহিনীকে যে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আর বেসামরিক নেতৃত্ব ফিরে পায়নি। বরং সেই ক্ষমতা আরও বেড়েছে। যা এক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকেই গ্রাস করেছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ওয়াল্টার ল্যাডউইগ বলেন, ‘এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত গভীর হবে।’ তার মতে, ‘যদি কখনো সামরিক ক্ষমতা কমিয়ে বেসামরিক কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তবে এই সংশোধনী বাতিল করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’ তিনি বলেন, ‘মুনিরকে এখন প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এমনকি অতীতের যেকোনো সেনাপ্রধানের চেয়েও অপসারণ করা বেশি কঠিন হবে।’
চ্যালেঞ্জ: ক্ষমতা বাড়লে দায়ও বাড়ে
মুনিরের হাতে প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রিভূতত হলেও তার সঙ্গে বড় ধরনের দায়ও এসেছে। পাকিস্তান এখন একদিকে দুটি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, অন্যদিকে ভারত ও আফগানিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনার মুখে রয়েছে। অর্থনীতি ভাঙনের পথে এবং মুনির এখনো তা সামাল দিতে পারেননি।
বিশ্লেষক আইয়াজ মালিক বলেন, মুনিরই প্রথম নন যে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করেছেন। পারভেজ মুশাররফও একই স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু জনঅসন্তোষে তা ধসে পড়ে।
তিনি মনে করিয়ে দেন, পাকিস্তানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হলেই এমন সব পরিকল্পনা ভেঙে যায়।
পাকিস্তানের ইতিহাসে এর আগে সেনাবাহিনী পর্দার আড়াল থেকে রাষ্ট্র চালাত। ব্যর্থতার দায় নিত বেসামরিক সরকার। কিন্তু মুনির মডেলে সেনাবাহিনী প্রকাশ্যে নীতি নির্ধারণ করছে।
ফলে অর্থনৈতিক ব্যর্থতা বা নিরাপত্তা সংকট দেখা দিলে এর দায়ও এখন তাদের ওপরই বর্তাবে। প্রদর্শিত ক্ষমতার সঙ্গে জবাবদিহিও জুড়ে গেছে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান ও ফরেন অ্যাফেয়ার্স

মোনরো ডকট্রিনের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকাকে নিজের নিরাপত্তা বলয়ের অংশ হিসেবে দেখে আসছে। আজকের বিশ্বে সেই আগ্রহ নতুন রূপ নিয়েছে—লিথিয়াম, বাণিজ্য, অভিবাসন সংকট আর চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। ফলে এই অঞ্চল এখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষেত্র।
১৮ ঘণ্টা আগে
বাংলাদেশে ‘ভিআইপি’ বা ‘ভিভিআইপি’ মর্যাদা সাধারণত রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের দেওয়া হয়। বর্তমান বা সাবেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা সমমানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এই তালিকায় থাকেন। বিদেশি রাষ্ট্রনেতা বা বিশিষ্ট অতিথিরাও এ মর্যাদা পেতে পারেন।
১ দিন আগে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে একটি সুনির্দিষ্ট শান্তি পরিকল্পনা প্রস্তাব করেছে, যা কিয়েভ এবং পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক ও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এই প্রস্তাবের মূল ভিত্তি হলো যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে ইউক্রেনকে তার সার্বভৌম ভূখণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষত
২ দিন আগে
সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত ও ধনী দেশগুলোতে শ্রমবাজার দুর্বল হয়ে পড়ছে। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো ভিসা নীতি কঠোর করায় গত বছর কাজের উদ্দেশ্যে অভিবাসন ২০ শতাংশেরও বেশি বা এক-পঞ্চমাংশ কমেছে।
২ দিন আগে