leadT1ad

প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে আইনুন নিশাতের ‘তিন পয়েন্ট’

স্ট্রিম ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১২: ১০
আপডেট : ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ০৩
অধ্যাপক আইনুন নিশাত। স্ট্রিম গ্রাফিক

২০১৩ সালে ডিপ্লোমাধারীরা আন্দোলন করে সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদ সৃষ্টি এবং ১০ম গ্রেডে নিজেদের শতভাগ কোটা আদায় করে নেয়। এরপর উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদ অর্থাৎ ১০ম গ্রেডের চাকরির বাজারটা ডিপ্লোমাধারীদের দখলে চলে যায়। গত দুই দিন ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দাবিতে আন্দোলন করছে। তাদের দাবিগুলো হলো—সহকারী প্রকৌশলী নবম গ্রেড, নবম গ্রেডের পদে প্রবেশের একমাত্র যোগ্যতা হবে বিএসসি ডিগ্রি এবং সমান নিয়োগ পরীক্ষা হবে। উপসহকারী প্রকৌশলী পদে শতভাগ কোটা বাতিল করে উভয় প্রার্থী—ডিপ্লোমা ও স্নাতক অংশগ্রহণ করতে পারবে, আর ইঞ্জিনিয়ার টাইটেল কেবল বিএসসি ডিগ্রিধারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে এবং আইন সুরক্ষিত হবে।

তিন দাবিতে করা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন নিয়ে স্ট্রিমের পক্ষ থেকে বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক আইনুন নিশাতের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়।

জবাবে আইনুন নিশাত তাঁর মতামত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এই দাবিগুলো সম্পূর্ণ যৌক্তিক এবং দেশের স্বার্থে এগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। আমি এই প্রসঙ্গে তিনটা কথা বলতে চাই।’

আইনুন নিশাত বলেন, ‘প্রথমত কোটা সিস্টেমটাই ভালো না। দেশজুড়ে আজকে যে পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থা, এটির সূত্রপাত হয়েছিল ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে। অর্থাৎ যাদের জন্য কোটা দেওয়া হচ্ছিল, হয়তো এক সময় তাদেরকে কিছু সাপোর্ট দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু এখন স্বাভাবিক অবস্থায় মেধা এবং উপযুক্ত যোগ্যতা—এই দুটোই হওয়া উচিত কর্মক্ষেত্রে নির্বাচনের সুযোগ সুবিধার জন্য। কাজেই কোটার নামে এখন যেটা হচ্ছে, তা মোটেই উপযুক্ত না। যে কারণে পুরো দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এখানে টেকনিক্যালি কোয়ালিফায়েড লোক নেওয়া হচ্ছে অল্প কিছু সংখ্যক। আর কোটার মাধ্যমে যাদেরকে নেওয়া হচ্ছে, তাদের সেই টেকনিক্যাল যোগ্যতা নেই।’

গত দুই দিন ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দাবিতে আন্দোলন করছে। স্ট্রিম ছবি
গত দুই দিন ধরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দাবিতে আন্দোলন করছে। স্ট্রিম ছবি

অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, ‘একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। সেটি হচ্ছে, আপনাকে টেকনিক্যাল জিনিসটা শিখতে হবে। আপনি ১০ বছর কাজ করলেও সেই টেকনিক্যাল এক্সপার্টিজ আপনার ডেভলপ করবে না। যেমন ধরুন আর্মিতে কমিশনড অফিসার আছে, নন কমিশনড অফিসার আছে, সাধারণ আর্মির সোলজার আছে। সাধারণ আর্মি সোলজার থেকে সাফিশিয়েন্ট অভিজ্ঞতা হলে যোগ্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে তাদের নন-কমিশন অফিসার করা যেতে পারে। নন-কমিশন অফিসারদেরকে সাফিশিয়েন্ট এক্সপেরিয়েন্স হওয়ার পরে যোগ্যতা বাচছাইয়ের মাধ্যমে কমিশন অফিসার করা হয়। অনেক বছর কাজ করলে অভিজ্ঞতা বাড়ে। কিন্তু কীসের অভিজ্ঞতা? আপনি যদি একটা সাধারণ টেকনিক্যাল কাজ অনেক বছর ধরে করেন তাতে কি আপনার জটিল কাজ, জটিল ডিজাইন জটিল প্ল্যান করার ক্ষমতা বাড়ে? মোটেই না। কাজেই দেশের স্বার্থে এই কোটাবিরোধী কোটা ব্যবস্থাটা বন্ধ করা দরকার।’

এরপর সাবেক এই অধ্যাপক বলেন, ‘দ্বিতীয় পয়েন্ট হচ্ছে, শুধু কোটা দিলেই হবে না, তাদের দক্ষ করে তুলতে হবে। তাদের যে শিক্ষাটা কুয়েট, ডুয়েট, চুয়েট, বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ কিংবা টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি থেকে দেওয়া হয়—এগুলো হচ্ছে বেসিক টেকনিক্যাল এডুকেশন। এরপরে তারা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তাদের টেকনোলজিক্যাল জ্ঞানের মাত্রা আরও অনেক ওপরে তুলতে হবে। সেজন্যই ১৯৬২ সালে যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়—এগুলোর উদ্দেশ্য ছিল, এগুলোতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট লেভেলের ট্রেনিং দেওয়া হবে। শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই এমএসসি পিএইচডি করবে তা না, সব পেশাজীবীকে সেই উন্নত শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। কাজেই কর্মক্ষেত্রে তার দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রোগ্রাম থাকতে হবে।’

আইনুন নিশাত বলেন, ‘আমার তৃতীয় পয়েন্ট হচ্ছে, আজকে যে বিষয়ে আন্দোলন হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কিছুটা সাংঘর্ষিক। কারণ, প্রত্যেকটা দেশেরই শিক্ষা ব্যবস্থায় ভালো করার কিংবা আরও ওপরের স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করার জন্যে উন্মুক্ত রাস্তা থাকতে হবে। যেমন ধরুন, ইংল্যান্ডে একটা ছেলে এইট, নাইন কিংবা টেনে পড়ে। দেখা যাচ্ছে, সে পড়াশোনায় ততটা পারদর্শী না এবং দ্রুত কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে চাচ্ছে। সে হায়ার ন্যাশনাল সার্টিফিকেট নেয়। আমাদের এখানেও টেকনিক্যাল স্কুল আছে। ক্লাস এইটের পরে সে দুই বছর পড়ে বা তিন বছর পড়ে টেকনিক্যাল সার্টিফিকেট নিতে পারে। কিন্তু তাকে আমরা এইচএসসির ইকুভ্যালেন্ট ধরি না। খেয়াল করবেন, এইচএসসি পাস করার পরে সে আগে তিন বছরের ডিপ্লোমা করতে পারতো। এখন কে বা কারা অতি বুদ্ধিমান সরকারি আমলারা এটাকে চার বছর বানিয়েছে। এক বছর একই জিনিসই পড়লে তার জ্ঞানের মাত্রার লেভেল, তার দক্ষতার লেভেল উন্নত হয় না। এই তিন বছর ডিপ্লোমা করার পরে সে চাকরিতে যোগদান করে। এদের মধ্যে যারা ভালো মেধাবী তাদের জন্য রাস্তা খোলা রাখতে হবে।’

বুয়েট ও বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দাবিতে আন্দোলন করছে। স্ট্রিম ছবি
বুয়েট ও বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তিন দাবিতে আন্দোলন করছে। স্ট্রিম ছবি

সব শেষে এই ইমেরিটাস অধ্যাপক বলেন, ‘আমার কথা শুনলে অনেকেই অবাক হবেন। ১৯৬২ সালে যখন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি বুয়েট চালু হয়, তখন বুয়েটেও কিন্তু এই ডিপ্লোমাধারীদের এইচএসসির ইকুইভ্যালেন্ট করে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হওয়ার সুযোগ ছিল। পরবর্তীতে রুয়েট হলে সেটাতে একটা বড় সংখ্যক ছাত্রদের জন্য এই সিট ছিল। কিন্তু এই গ্র্যাজুয়েট ইঞ্জিনিয়াররা তাদের এই রাস্তা বন্ধ করেছে। আমি মনে করি, ডিপ্লোমা হোল্ডারের পড়াশোনার ব্যাপারটা আবার তিন বছরে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। চার বছরে তারা প্র্যাকটিক্যাল কাজের ওপর আরও বেশি নজর দিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করার জন্য উপযুক্ত হবেন কিংবা ডিজাইন প্ল্যানিংয়ের সাপোর্ট সার্ভিস তারা দিতে পারবেন। কিন্তু তাদের গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে মাস্টার্স কিংবা পিএইচডি করার সুযোগ রাখতে হবে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ওয়াশিংটন একর্ডের সাপোর্ট পেয়েছে। কাজেই বাংলাদেশের ডিগ্রি সারা বিশ্বে এখন সম্মানিত হবে। সেই ক্ষেত্রে আমি মনে করি, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স, গ্র্যাজুয়েশন কোর্স এবং পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামের পুনর্মূল্যায়ন করে এটাকে ঢেলে সাজানো উচিত। কোটা বাতিল করে, এই কোটার নামে যে অপকর্মগুলো হচ্ছিল, সেগুলো বন্ধ করা উচিত।’

Ad 300x250

সম্পর্কিত