leadT1ad

যেসব সিনেমা দেখলে আপনার ‘জাত’ চলে যাবে

আপনি হয়তো ভাবছেন দুর্নীতি, মুদ্রাস্ফীতি বা ডেঙ্গুই সমাজের প্রধান শত্রু। কিন্তু না, এই দেশে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জিনিস কিন্তু আপনার সিনেমার রুচি। ভুল সিনেমা দেখে ফেললে আপনি শুধু আজিব চিড়িয়াই নন, বরং চলমান সামাজিক কলঙ্ক।

তুফায়েল আহমদ
প্রকাশ : ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮: ০১
যেসব সিনেমা দেখলে আপনার ‘জাত’ চলে যাবে। স্ট্রিম গ্রাফিক

ধরেন, আপনি নিরীহ গোছের জামার নিচে বোতাম আঁটা ভীতু বাঙালি। কিন্তু ভুল করেও যদি আড্ডায় বলে ফেলেন, ‘কবির সিং সিনেমাটা আমার বেশ প্রিয়’—তাহলেই কেলেঙ্কারি। মুহূর্তেই আপনি হয়ে যাবেন মিসোজিনিস্ট আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পোস্টারবয়। লোকজন আপনাকে এমনভাবে এড়িয়ে যাবে, যেন আপনি সিনেমার দৃশ্যে ‘সিগারেট ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ’-এর সতর্কবার্তা। আর সাহস করে যদি একবার বলে ফেলেন, ‘ফিফটি শেডস অ্যাকচুয়ালি মিসআন্ডারস্টুড ফেমিনিস্ট মাস্টারপিস’—তাহলে দেখবেন আপনার সামাজিক অস্তিত্ব মিলিয়ে যাচ্ছে বর্ষায় ঢাকা শহরের রাস্তা গায়েব হয়ে যাওয়ার গতিতে।

সিনেমা দেখা এককালে ছিল বিনোদন, আবার কারও জন্য চিন্তার খোরাক। এখন তাতে যোগ হয়েছে সামাজিক স্ট্যাটাস আর ‘সভ্য সমাজে’ টিকে থাকার লড়াই। গুপ্ত রাজনীতির মতো গুপ্ত সিনেমারও একটা ভাগ আছে। এসব সিনেমা আপনি দেখতে পারেন, কিন্তু সাবধান! সিনেমাপ্রেমীদের সামনে তা বলা যাবে না। আর মুখ ফসকে যদি বলেও ফেলেন, খবরদার মনের অজান্তেও বলবেন না যে সিনেমাগুলো আপনার প্রিয়। বাংলাদেশে বসে তথাকথিত ‘ভুল বা বাজে’ সিনেমা পছন্দ করা মানে মোজা পরে স্যান্ডেল পরার মতোই করুণ অবস্থা। একেবারে নিখাদ সামাজিক আত্মহত্যা।

আর তাই আপনাকে এই সিনেমাপ্রেমী সমাজের চপেটাঘাত থেকে রক্ষা করতে নিয়ে এসেছি এমন সাত ঘরানার সিনেমার নাম, যা আপনি অবশ্যই দেখবেন না। আর দেখলেও স্বীকার করবেন না। স্বীকার করলেও এসব সিনেমা ভালো লেগেছে বলে ‘ব্লাসফেমি’ করবেন না।

ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস

দর্শক মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও সুপারহিরো সিনেমাকে ‘প্রকৃত সিনেমাপ্রেমী’রা কখনোই খুব একটা পাত্তা দিতেন না। কিন্তু ২০০৫ সালে সিনেমাপ্রেমীদের আন-অফিশিয়াল নেতা ক্রিস্টোফার নোলান যখন ব্যাটম্যান বিগিনস বানালেন, তখন আর সুপারহিরো সিনেমাকে পাত্তা না দিয়ে উপায় রইলো না। একে একে দ্য ডার্ক নাইট, দ্য ডার্ক নাইট রাইজেসও সাধারণ দর্শকদের ভালোবাসার পাশাপাশি পেল সিনেমাপ্রেমীদের প্রশংসা। সেই রেসে যোগ হল একের পর এক মার্ভেল সুপারহিরো সিনেমা। আয়রন ম্যান, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, হাল্ক—কেউ বাদ গেল না। আচমকাই প্রায় অচ্ছুৎ সুপারহিরো সিনেমা হয়ে উঠল প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীদের আলোচনার বস্তু।

ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অভ জাস্টিস এর পোস্টার। ছবি: আইএমডিবি
ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অভ জাস্টিস এর পোস্টার। ছবি: আইএমডিবি

কিন্তু তারপর এল সেই ভয়াবহ ধাক্কা। সালটা ২০১৭, মুক্তি পেল জ্যাক স্নাইডারের পরিচালনায় ডিসি কমিকসের বহুল আলোচিত ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস। প্রকৃত সিনেমাপ্রেমীরা আঁতকে উঠলেন! ছি ছি! এসব কী! এমনকি সাধারণ দর্শকও বিরক্ত! সুপারহিরো সিনেমার নামে কী বানিয়েছে এগুলো! দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা গোয়েন্দাদের অন্যতম ব্যাটম্যান হঠাৎ করে ঠিক করল সুপারম্যানকে পেটাবে না—কেন জানেন? কারণ তাদের মায়ের নাম নাকি এক! সত্যি বলতে, চায়ের দোকানের টেবিলে বসে ১৫ মিনিটে ন্যাপকিনে লেখা স্ক্রিপ্টও এর চেয়ে ঢের ভালো হতো। তবে এই সিনেমার মতো ‘ডার্ক, গ্রিটি’ টোন হয়তো আসত না।

এমন সিনেমাকে যদি ভুল করেও বলে বসেন আপনার প্রিয় সিনেমা, তাহলে আর রক্ষা নেই। বাংলাদেশে যেখানে ‘ফেসবুকে হাহা না দিয়ে লাইক দিলেন কেন’ ইস্যুতে মারামারি হয়, সেখানে দাঁড়িয়ে ব্যাটম্যান বা সুপারম্যানের পক্ষ নেওয়া মানে নির্ঘাত একঘরে। স্বেচ্ছায় বসে জ্যাক স্নাইডারের তিন ঘণ্টার টানা অন্ধকার, বিরক্তিকর ঈশ্বর-ন্যায়-বিচার-মার্থা লেকচার গিলতে রাজি থাকা লোককে কেউ কেনই বা একঘরে করবে না বলেন দেখি!

সালমান খানের সিনেমা

ভারতে ‘ভাই’ মানেই সালমান খান। এই ট্রেন্ডের প্রভাব বাংলাদেশেও আছে। আমাদের দেশে একটা বড় সংখ্যক দর্শক ভারতীয় মাসালা সিনেমা দেখে। কিন্তু তাই বলে যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, সালমান খানের সিনেমা আপনার ভালো লাগে, তাহলে সাড়ে সর্বনাশ। এটা অনেকটা শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে, ‘আমার মনে হয় ট্রাফিক জ্যাম অর্থনীতির জন্য ভালো’ বলে ফেলার মতো। এককালে অবশ্য তাঁর ‘তেরে নাম’ হেয়ারকাটের নাম শুনতেই অজ্ঞান ছিল বাংলাদেশের মানুষ, এখন সেই হেয়ারকাট পরিণত হয়েছে ‘গ্রামের চাচাতো ভাইয়ের’ স্টাইলে।

ছবি: আইএমডিবি
ছবি: আইএমডিবি

কোনো দামি রেস্তোরাঁয় বসে অতিরিক্ত দামের ‘আর্টিসানাল কফি’ খেতে খেতে স্বীকার করছেন যে ‘দাবাং ৩’ দেখে ভীষণ ভালো লেগেছে। কিংবা মুখ ফসকে বলে ফেলবেন যে ‘ভাইজান’-এর জামা ছেঁড়ার দৃশ্যে আপনি হাততালি দিয়েছেন, বা খোদা না করুন ‘হ্যাঙ্গোভার’ গানটা গুনগুন করে গেয়ে ফেলেছেন, দেখবেন পুরো ঘরের লোক আপনার ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে, যা সিনেমার স্ক্রিপ্টে সালমানের আচমকা প্লট-টুইস্ট দেওয়া ঘুষির চেয়েও দ্রুতগতির। সিনেমাবোদ্ধারা আপনাকে একেবারে ধুয়ে মুছে দেবে। তারা ‘সিনেমাটিক দেউলিয়াপনা’ আর ‘গল্পের অসংলগ্নতা’ নিয়ে এমন সব ভারী ভারী কথা বলা শুরু করবে যে আপনার নিজেকে অপরাধী মনে হবে।


এই চরম অপমান থেকে বাঁচতে চান? তাহলে বরং চার ঘণ্টার একটা পোলিশ আর্ট ফিল্ম দেখুন, যার বিষয়বস্তু হচ্ছে অস্তিত্বের সংকট। বিরক্তিতে মরে গেলেও অন্ততপক্ষে ‘রাধে’ সিনেমার সাথে ‘ভাইব’ করার জন্য যে কুৎসিত মিম আর টিটকিরি আপনার দিকে উড়ে আসত, সেটা থেকে তো বাঁচবেন।

ফিফটি শেডস অফ শেইম

আমাদের সমাজে সিনেমাপ্রেমীদের মধ্যে দুই ধরনের মানুষ পাবেন:

এক. যারা ফিফটি শেডস অফ গ্রে দেখেছে এবং স্বীকার করে।
দুই. যারা ফিফটি শেডস অফ গ্রে দেখেছে কিন্তু স্বীকার করে না।

এবং অতি আবশ্যিকভাবেই স্বীকার করার দলে সদস্য সংখ্যা খুবই কম। আপনি স্বীকার করলেই—তৎক্ষণাৎ কেলেঙ্কারি। কারণ আমরা এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে চলি। গোপনে নিষিদ্ধ ছবির প্রতি প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে মুখে এসব সিনেমার প্রতি ঘৃণার মজমা বসাই।

ফিফটি শেডস মুভি সিরিজের পোস্টার। ছবি: আইএমডিবি
ফিফটি শেডস মুভি সিরিজের পোস্টার। ছবি: আইএমডিবি

যদি কোনো এক অলস অপরাহ্ণে আপনার মস্তিষ্ক বা অন্য কোনো অঙ্গ আপনাকে ‘ফিফটি শেডস অফ গ্রে’ অথবা এই জনরার অন্যান্য সিনেমা যেমন ‘৩৬৫ ডেজ’ বা ‘আফটার’-এর দিকে ঠেলে দেয়, তবে ধরে নেবেন আপনি নিজের পিঠে এক অদৃশ্য ‘আমাকে গালি দিন’ সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিয়েছেন। কারণ লেটারবক্সড-সর্বস্ব আঁতেলকুল আপনার জন্য ওঁত পেতে বসে আছে।

এই সিনেমাগুলো হলো সংস্কৃতি জগতের গ্লিটার বোমা—উপরে চকমকি, ভেতরে জঞ্জাল।। যদি মুখ ফসকে বলে ফেলেন যে ক্রিশ্চিয়ান গ্রে-র ওই গুরুগম্ভীর অভিব্যক্তির জন্য আপনি ফিফটি শেডস ফিল্ম সিরিজের তিনটে সিনেমাই গোগ্রাসে গিলেছেন, তাহলে বারবিকিউ পার্টিতে গ্রিল করা মুরগির চেয়েও জঘন্যভাবে আপনার চামড়া ছাড়িয়ে লবণ মাখিয়ে দেওয়া হবে। সিনেমাবোদ্ধারা তাদের তুখোড় শব্দভাণ্ডার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে, কেন এই ‘ইরোটিক’ সিনেমাগুলো আসলে শিল্পের বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত অপরাধ। পাশাপাশি দুই হাজার শব্দের বয়ান এবং ‘মেল গেজ’ বা ‘ন্যারেটিভ ব্যাঙ্করাপ্সি’-র মতো শব্দবোমা ছুড়তে ছুড়তে পিয়ের পাওলো পাসোলিনির দু-চারটে সিনেমা আপনার দিকে ছুঁড়ে মারতে পারে।

ভাবুন একবার: আপনি হয়তো ঝোঁকের বসে বলেই ফেললেন যে ‘৩৬৫ ডেজ’-এর ওই নৌকার দৃশ্যটা আপনার ‘কাইন্ডা হট’ লেগেছে। ব্যস, পরদিন দেখবেন রেডিট কিংবা কোরাতে ‘জীবনে সম্মুখীন হওয়া সবচেয়ে জঘন্য সিনে-রুচি কোনটি?’ থ্রেডের প্রধান চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। আর ভুলেও ‘ফিফটি শেডস’-এর টাই বাঁধার দৃশ্য নিয়ে জনসমক্ষে মুখ খুলবেন না; খুললেই ‘বিগিনারদের জন্য বিডিএসএম’ আর ‘টুইলাইট ফ্যানফিকশনের বিপথগামী সংস্করণ’ জাতীয় সার্কাস্টিক মন্তব্যের বন্যায় ভেসে যাবেন।

আপনি হয়তো ভাবছেন এটা শুধুই নিরপরাধ বিনোদন, কিন্তু সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এগুলো শিল্পের অ্যাপোক্যালিপ্স। স্রেফ এসব সিনেমা দেখার অপরাধে স্করসেসির গোটা লিগ্যাসিকে একার দায়িত্বে ডুবিয়ে দেওয়ার অভিযোগও আপনার ঘাড়ে চাপতে পারে।

তাই সোশ্যাল মিডিয়ার গণপিটুনি আর সামাজিক নির্বাসন থেকে বাঁচতে চাইলে, সোজা ‘মুনলাইট’ বা ওই জাতীয় কোনো সিনেমার দিকে মোড় নিন। কিংবা দেখুন চার ঘণ্টার সাদাকালো বার্গম্যান, যার বিষয়বস্তু মরণের পরের জীবন বা জীবনের আগের মরণ। হতে পারে আপনি হাই তুলতে তুলতে ঘুমিয়ে পড়বেন, কিন্তু অন্ততপক্ষে ‘আর ইউ লস্ট, বেবি গার্ল?’—এই অমর ডায়লগ কোট করার জন্য বন্ধুদের গ্রুপ চ্যাটে আপনার শান্তির জানাজা হবে না। এই দেশে রোম্যান্স মানেই যেখানে ‘গোপনে ফুচকা খাওয়া’ সেখানে ইরোটিক থ্রিলার দেখা মানে সোজা সামাজিক হাতকড়ার দিকে।

সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা

ভারতীয় মাসালা সিনেমা দশকের পর দশক পুলিশি গুন্ডামি, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও বস্তাপচা স্টেরিওটাইপের জয়গান গেয়েছে। সাউথ থেকে বলিউড, এমনকি কলকাতাতেও—এটা একপ্রকার ওপেন সিক্রেট। কিন্তু সন্দীপ রেড্ডি ভাঙ্গা যখন ‘অর্জুন রেড্ডি’ নিয়ে এন্ট্রি নিলেন, সব হিসাবনিকাশ উল্টে গেল। একটা অদৃশ্য দেয়াল যেন ভেঙে পড়ল। দর্শকসমাজ সঙ্গে সঙ্গে দুই ভাগ। একদল এটাকে ‘র’ আর ‘আনফিল্টারড’ মাস্টারপিস বলে মাথায় তুলে নাচল, আরেক দল ছিঃ ছিঃ করে আগুন ঝরাল। বলিউড রিমেক ‘কবির সিং’ নিয়েও সেই একই লঙ্কাকাণ্ড। সমালোচক আর ‘সভ্য’ জেনারেশন ভাঙ্গার সিনেমাকে ট্যাগ দিল—নারীবিদ্বেষের ইশতেহার, নির্যাতনের স্বাভাবিকীকরণ আর টক্সিক ম্যাস্কুলিনিটির জয়গান।

ছবি: আইএমডিবি
ছবি: আইএমডিবি

এই অবস্থায় যদি আপনি কোনো ঘরোয়া আড্ডায় মুখ ফসকে বলে বসেন যে, সিনেমাগুলো দেখেছেন এবং আপনার অতটাও খারাপ লাগেনি... ব্যস! পৃথিবী থমকে যাবে। বসার ঘরে সাকিব আল হাসান জোচ্চোর বা পেঁয়াজের দাম নিয়ে যে তর্ক চলছিল, সব গায়েব। চায়ের কাপের ধোঁয়াও যেন জমে যাবে। আপনার সিনেফাইল বন্ধু কিংবা কাজিন কিন্তু রেগে যাবে না। বরং আপনার দিকে গভীর করুণা নিয়ে তাকাবে। ‘ভাই, জাজ করছি না কিন্তু…’ এই কথা দিয়ে শুরু হয়ে কখন যে আপনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করা হবে আপনি টেরও পাবেন না। কেউ হয়ত বিস্ময় প্রকাশ করবেঃ ‘কিন্তু তুই রেহানা মরিয়ম নূরের মতো সিনেমার গভীরতা বা চরকির একটা অরিজিনাল সিরিজের সূক্ষ্মতা দেখার পর কীভাবে এনিমেল সিনেমার ‘গুহামানব’ মার্কা আচরণের সেলিব্রেশনে ভালো কিছু খুঁজে পাস?’ সবাই আপনাকে পরম ধৈর্যের সাথে বোঝাবে যে, ভাঙ্গার সিনেমার ‘সমস্যা’ ধরতে না পারাটা মতের ভিন্নতা নয়, বরং প্রগতিশীলতার ট্রেন মিস করার প্রমাণ।

আপনি আর আড্ডার লোক নন, আপনি এখন একটা সামাজিক প্রোজেক্ট। আপনার ‘এটা তো শুধু একটা ফ্লড চরিত্রের গল্প’ মার্কা খোঁড়া যুক্তি এক ফুঁৎকারে উড়ে যাবে। আপনার সিনেমার রুচি এখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বায়োহ্যাজার্ড’।

আপনার ঘাড়ে অভিযোগ চাপানো হবে আমাদের ‘নয়া ধারার’ পরিচালকেরা যে সংবেদনশীল, ‘ভদ্রলোক’ নায়ক তৈরি করার এত কষ্ট করছেন, আপনি একাই সেই প্রচেষ্টাকে পিছিয়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের সিনেফিলিয়ার আদালতে ভাঙ্গার সিনেমা উপভোগ করা একধরনের সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তাই সাবধান, গোপনে আপনি সিনেমাটা দেখতেই পারেন, কিন্তু ভালো লেগেছে স্বীকার করেছেন মানেই সামাজিক নির্বাসনের একটা ওয়ান-ওয়ে টিকিট কেটে ফেলেছেন।

টোয়াইলাইট সাগা

‘এলিভেটেড হরর’ আর রগরগে থ্রিলারের এই যুগে ‘টোয়াইলাইট সাগা’-র প্রতি কোনো প্রকার ভালোবাসা প্রকাশ করার মানেই আপনার ‘কিছু একটা সমস্যা’ আছে। এই সময়ে এসে টোয়াইলাইট দেখা বা টোয়াইলাইট আপনার এককালের ভালোলাগার সিনেমা এটা বলা— বহু পুরোনো যুগের ফসিল তুলে আনার মতো। কিংবা অ্যাপলের নতুন আইফোন লঞ্চের অনুষ্ঠানে একটা ফ্লিপ ফোন নিয়ে হাজির হওয়ার মতো।

ছবি: আইএমডিবি
ছবি: আইএমডিবি

বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে ভ্যাম্পায়ার মানে ভয়ঙ্কর কিছু—রাক্ষস, ভূত, শাকচুন্নির কিংবদন্তি। কিন্তু টোয়াইলাইটে ভ্যাম্পায়াররা রোদে ঝিকমিক করে লাক্স সাবানের বিজ্ঞাপনের মডেলদের মত। এখন কোনো প্রকার যুক্তি দিয়ে যদি আপনি টোয়াইলাইটকে ডিফেন্ড করতে যান তবে অবিরাম খোঁচার জন্য প্রস্তুত থাকুন। আপনার কোনো বন্ধু হয়তো বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষকের মতো ঝুঁকে এসে সাবধানে জিজ্ঞেস করবে, ‘এক মিনিট, মানে ব্যাপারটা পরিষ্কার হওয়ার জন্য বলছি... একশো বছরের বুড়ো একটা লোক টিনএজ মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকছে—এটাকেই তোর কাছে রোমান্স মনে হয়েছে?’ আপনার ডাকনাম হয়ে যাবে ‘এডওয়ার্ড ভাই’ বা ‘বেলা আপা’, আর সিনেমা সংক্রান্ত যেকোনো আলাপে আপনার ওপিনিয়ন হবে অনেকটা মানিব্যাগে জমানো ভিজিটিং কার্ডের মতো, আছে কিন্তু কোনো গুরুত্ব নেই।

কঠিন আয়রনি হলো, আপনাকে খেপানো লোকদের অর্ধেকেই গোপনে টোয়াইলাইট দেখেছে। কিন্তু বাংলাদেশে জাতীয় খেলা ভণ্ডামি। তাই তারা গলা ফাটিয়ে অস্বীকার করবে, আর সততার জন্য আপনি হবেন ক্রুশবিদ্ধ।

তাই রিস্ক নেবেন না, টোয়াইলাইট দেখতে পারেন তবে প্রকাশ্যে বলবেন না। আর পিসিতে টোয়াইলাইট সিরিজের ফিল্ম সেভ করে রাখলে ফোল্ডারের নাম রাখুন কার্টুন। আচমকা ধরা খেলে অন্তত শেষ রক্ষার উপায় থাকবে।

শাকিব খান

বাংলাদেশি মূলধারার সিনেমায় শাকিব খান হলেন অঘোষিত বাদশাহ। কিন্তু ‘কালচার্ড’ লোকজনের আড্ডায় শাকিব খানের সিনেমার প্রতি আপনার ন্যূনতম ভালোবাসা স্বীকার করা মানে হলো গ্রেনেড ছুড়ে মারা। সিনেফাইলদের প্রতিক্রিয়াটা ভাঙচুরের মতো নৈতিক আক্রোশ, বা টোয়াইলাইটের মতো হতভম্ব করুণাও নয় বরং নাটুকে শৈল্পিক বমিভাব; যেন আপনি এইমাত্র কবুল করলেন যে আপনার প্রিয় খাবার হলো টেবিলের নিচে আটকে থাকা চুইংগাম।

ছবি: আইএমডিবি
ছবি: আইএমডিবি

যদিও গত কয়েক বছরে তরুণ পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করে শাকিব খান কিছুটা নিজের বদনাম ঘোচাতে সক্ষম হয়েছেন। তাই বলে অচ্ছুত শাকিব খান তো ব্রাহ্মণ সিনেমাপ্রেমীদের আলোচনার বস্তু হতে পারেন না। ভাবুন তো, সিনেমার গল্পের থেকে সাবস্ট্যান্স আর মেটাফরের আলাপ যে আড্ডার মূল বিষয়বস্তু, সেখানে আপনি শাকিব খানের নাম নেবেনই বা কেমনে! আর যদিও বলেও ফেলেন যে শাকিব খানের রিসেন্ট ‘প্রিয়তমা’ সিনেমাটা বেশ ইমোশনাল, সঙ্গে সঙ্গে পিনপতন নীরবতা। আপনার বন্ধু, যার শোবার ঘরে ‘পথের পাঁচালী’র পোস্টার বাঁধানো, সে আস্তে করে চশমাটা খুলে মুছতে শুরু করবে, যেন আপনার বলা কথাগুলোই মুছে ফেলতে চাইছে। বিষণ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন আসবে, “মানে... মজা করে বলছিস, তাই না?” তার গলায় আশা আর আতঙ্ক মেশানো।

ঠিক এখান থেকেই শুরু হবে আপনার ওপর নৃতাত্ত্বিক গবেষণা। আপনাকে আর বাজে রুচির মানুষ হিসেবে দেখবে না; দেখবে এক হেঁটে চলে বেড়ানো প্রাগৈতিহাসিক জীবাশ্ম হিসেবে। আপনি ‘মাস আপিল’ বা ‘এসকেপিস্ট এন্টারটেইনমেন্ট’-এর দোহাই দিতে পারেন, কিন্তু তাদের কানে কেবল জঘন্য কোরিওগ্রাফির ফাইটিংয়ের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দই পৌঁছাবে।

আপনি হয়তো যুক্তি দেবেন, মানছি, শাকিব খানের আগের সিনেমাগুলো ক্রিঞ্জ, মাধ্যাকর্ষণ বিরোধী, কিন্তু এখনকার সিনেমাগুলো বেশ ভালো। কিন্তু উল্টো বিদ্রূপ আসবে, কী ভালো! আগে এক লাথিতে ২০ জন উড়ত, আর এখন ১৮ জন। এটা ভালোর নমুনা?

দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস

আপনি যদি সাজিয়ে-গুছিয়ে দুঃখ কেনার খদ্দের হয়ে থাকেন, তবে ‘দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টারস’ বা এই ঘরানার ফাইভ ফিট অ্যাপার্ট, মি বিফোর ইউ ইত্যাদি সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এমন নিরীহ পছন্দ নিয়েও আপনি বিপদে আছেন। কারণ এগুলো শুধু সিনেমা নয়, বরং একটা লাইফস্টাইল, আবেগ নিংড়ে বের করার এক কঠিন খেলা। আপনি এসব সিনেমা শুধু দেখেনই না; রীতিমতো প্রস্তুতি নেন। শরীরে পানি জোগান, টিস্যুর ফ্যামিলি সাইজ বক্স মজুত করেন, আর সিনেমা শেষে দুই-তিন ঘণ্টা দেয়ালে তাকিয়ে গভীর ভাবনার জন্য রুটিন খালি রাখেন।

দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স মুভির পোস্টার। ছবি:আইএমডিবি
দ্য ফল্ট ইন আওয়ার স্টার্স মুভির পোস্টার। ছবি:আইএমডিবি

বন্ধুরা আপনাকে সিনেমার ভক্ত হিসেবে দেখে না; তারা দেখে এক আবেগের স্টান্ট পারফর্মারকে, যে স্বেচ্ছায় ৯০ মিনিটের এক নির্মম অত্যাচারের জন্য নিজেকে সঁপে দেয়। এসব সিনেমার প্রশংসা করার সময় আপনি কখনোই গল্পের কথা বলেন না, অশ্রুসিক্ত সাক্ষ্য দেন।

বাংলার সিনেফাইলরা অবাক হয়ে ভাববে, কেউ কেন স্বেচ্ছায় এমন ডাক্তারি ডোজের মেলোড্রামা শরীরে পুশ করতে চাইবে? তাঁদের বিস্ময়ভাবটাও অস্বাভাবিক না। অন্য সিনেমাকে আপনি মাপেন গল্প দিয়ে, অভিনয় দিয়ে, কিন্তু এসব সিনেমা মাপেন প্রতি মিনিটে কী পরিমাণ কান্না ঝরানো গেল, সেই হিসাবে।

তার উপর এই বেরসিক সমাজে আপনি যদি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ‘হ্যাজেল আর গাস হল ট্রু সোলমেট।’ তখন হয়তো কেউ হাঁক মারবে, ‘ভাই, আমার মামার কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের গল্প শোন, তারপর কাঁদ।’ মুহূর্তেই আপনার কান্নার মুহূর্ত হাসির খোরাকে পরিণত হবে।

সুতরাং সিদ্ধান্ত আপনার। হয় আপনার ওয়াচলিস্ট নিয়ে নির্লজ্জ মিথ্যা বলুন, নয়তো সামাজিক নির্বাসনের জন্য প্রস্তুত হন। রুচির এই লড়াইয়ে একজন সৎ সিনেমাপ্রেমী হওয়ার চেয়ে ভণ্ড আঁতেল হওয়াই শ্রেয়। দিনশেষে সিনেমা তো বিনোদন, কিন্তু আপনার সামাজিক স্ট্যাটাসটাই আসল। তাই নিজের পছন্দের সিনেমা দেখুন গোপনে, আর আড্ডায় ‘পথের পাঁচালী’র জয়গান গেয়ে নিজের সম্মান বাঁচান। এই সমাজে টিকে থাকতে হলে এটুকু অভিনয় জরুরি।

Ad 300x250

সম্পর্কিত