leadT1ad

শিরিনের ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ ও শূন্য দশকের ফোক ফিউশন

শূন্য দশক বাংলা মিউজিকের একটা ক্রান্তিকাল। নিউজিকে নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব এবং ট্রাডিশনাল মিউজিকের নতুন উপস্থাপনের দশক। শিরিনের বিখ্যাত গান পাঞ্জাবিওয়ালাকে কেন্দ্র করে, শূন্য দশকের ফোক ফিউশন নিয়ে এই লেখা।

ওয়াহিদ সুজন
ওয়াহিদ সুজন

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ০১
স্ট্রিম গ্রাফিক

ইউটিউব, স্পটিফাই বা অন্য কোনো মাধ্যমে গান শুনতে শুনতে হঠাৎ বেজে উঠতে পারে ‘নদী’! যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিরিন জাওয়াদের গুটিকয়েক মৌলিক গানের অন্যতম এটি। ১৮ বছর আগে গানটি রিলিজ হয়। ওই সময়ে শিরিনের গানে অভ্যস্ত কান এমনও অনুমান করতে পারে যে নিখুঁত গায়কী ও আবেগের ব্যবহারের জন্য ‘নদী’ পর্যন্ত পৌঁছাতে মোটামুটি একটা সাংগীতিক জার্নির মধ্যে গেছেন তিনি। বাংলার বিভিন্ন ধারার সাধকের গীতিকবিতার চর্চা তিনি করেছেন, তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এ গান।

গানটি লিখেছিলেন সাকী আহমেদ। কম্পোজিশন করেছেন ফুয়াদ আল মোক্তাদির। শিরিনের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘মাতওয়ালী’তে (২০০৯) স্থান পেয়েছে এটি। ব্যতিক্রমহীনভাবে ‘নদী’ ছাড়া অ্যালবামের প্রায় সব গানই বাংলার মহাজনদের গীতের রিমেক। তার মাঝে আলোচ্য গানটির সাবলীলতা ও দরদের উৎস খুঁজতে গেলে আরেকটু আগে যেতে হবে।

শিরিনের ডেবিউ অ্যালবাম ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’। প্রকাশ হয় ২০০৭ সালে। এডিশনাল ট্র্যাক (হাবিব ওয়াহিদ ও ন্যানসির ‘হৃদয়ের কথা’) বাদ দিলে অ্যালবামের সবকটিই গান ছিল রিমেক। বৃহৎ শ্রোতা পরিসরে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে শিরিনকে পরিচিতি এনে দেয় অ্যালবামটি। এরপরই ফুয়াদ আল মোক্তাদিরের সঙ্গে করেন ‘মাতোয়ালি’।

ট্রেন্ডি ভঙ্গিতে বললে, ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ ফোক-ফিউশনধর্মী সংকলন। ফোক শব্দটার মধ্যে যে ধরনের ধারণার আরোপ ও সমন্বয় ঘটে; তাতে আলাদা করে ফিউশনকে টানার দরকার পড়ে না। ফোক নিজেই ফিউশন। এক অর্থে এ শতকের শুরুতে ঢাকার গান-বাজনায় যে বাঁকবদল, সেখানে আসলে কী কী হচ্ছিল, ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ তার অন্যতম উদাহরণ। অবশ্যই সফল উদাহরণ।

কী তুমুল এক সময়। বাংলা সংগীতে নতুন সাউন্ড ও কম্পোজিশনের নৈপুণ্য নিয়ে হাজির হন একদল তরুণ। অ্যালবাম কাভারে ‘ফিচারিং’ শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তারা শিল্পীদের নিয়ে হাজির হচ্ছে কনসার্টে। টাকা-কড়ির হিসাবেও কম্পোজারদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্ভবত এর আগে এতটা পূর্ণ হয়নি। মানে এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ঘটনা। এ ধরনের রমরমা অবস্থায় শূন্য দশকের অগ্রগণ্য দুই মুখ— হাবিব ওয়াহিদ ও ফুয়াদ আল মুক্তাদির।

ঢাকাই সংগীত পরিমণ্ডলে ভাব-সাধকদের গান পরিবেশিত হওয়া নতুন কোনো ঘটনা নয়। ব্যান্ড সংগীতের দিকে ফিডব্যাক ও আব্দুর রহমান বয়াতির এক্সপেরিমেন্টাল কোলাবরেশনের কথা মনে পড়ছে। একটা গানের অ্যালবামের নাম দেহঘড়ি। এর বাইরে ব্যাপক পরিসরে তপন চৌধুরী, কনকচাঁপা ও খালিদ হাসান মিলুর কয়েকটি অ্যালবামের নাম নেওয়া যায়। কিন্তু তা কখনো এতটা ট্রেন্ডি হয়ে উঠেনি, যতটা ‘কিৎকর্তব্যবিমুঢ়’ অ্যালবামের মাধ্যমে বাংলা ব্যান্ড করতে পেরেছিল। একদম নতুন স্বর, সাউন্ড আর ঘরানা নিয়ে আসলেন আনুশেহ আনাদিল, বুনো ও শায়ান চৌধুরী অর্ণবরা। যা ওই সময়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অ্যালবামটি আসে ২০০২ সালে। একই ক্রেজ দেখা যায় তাদের পরের অ্যালবাম ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব’-এ (২০০৫)। নতুন এ স্বর গড়পরতার শ্রোতারা সব সময়ে যে স্বাগত জানিয়েছে এমনও নয়।

কী তুমুল এক সময়। বাংলা সংগীতে নতুন সাউন্ড ও কম্পোজিশনের নৈপুণ্য নিয়ে হাজির হন একদল তরুণ। অ্যালবাম কাভারে ‘ফিচারিং’ শব্দটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তারা শিল্পীদের নিয়ে হাজির হচ্ছে কনসার্টে। টাকা-কড়ির হিসাবেও কম্পোজারদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্ভবত এর আগে এতটা পূর্ণ হয়নি। মানে এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ঘটনা। এ ধরনের রমরমা অবস্থায় শূন্য দশকের অগ্রগণ্য দুই মুখ— হাবিব ওয়াহিদ ও ফুয়াদ আল মুক্তাদির।

দুজনের আবির্ভাব মূলত ফোক-ফিউশনের ওপর ভর করে। বিশেষ করে হাবিবের সংগীতায়োজনে ফোক গান শহুরে বোল বা কৃত্রিমতা ছেড়ে অথেন্টিক স্বর দিতে চেয়েছে। কোনো ধরনের বাড়তি আলাপ নাই, গান বুঝিয়ে দেয়ার ঘটনা নাই। তারা কিছু গান শ্রোতার সামনে রাখছেন, আর শ্রোতারা লুফে নিচ্ছেন। একতারের ব্যানারে হাবিবের প্রথম অ্যালবাম কৃষ্ণ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এটি প্রকাশ হয় ২০০৩ সালে। এটা ‘কিংকর্তব্যবিমুঢ়’-এর মতো ক্লাসি হওয়ার মতো ঘটনা না। তবে এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে উচ্ছ্বসিত নন, কিন্তু নতুন সাউন্ড ও দরদ চান এমন শ্রোতাদের কাছে নতুন এক বার্তা। শুধু সংগীতায়োজনের নৈপুণ্য নয়; কায়া ও হেলালের গায়কীও ছিল ভাব সংগীতের মগ্নতার সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য।

‌উপলক্ষ ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ হলেও ওপরের আলাপগুলো অগ্রাহ্য করা হয়তো যাবে না। কারণ অ্যালবামের গানগুলো খুব পরিচিত এমন নয়। বরং অডিওর বিকাশকাল থেকে বাংলাদেশের এ শিল্পে বড় অংশ দখলে রেখেছিল আঞ্চলিক ও ভাবগান। ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’র শিরোনাম ট্র্যাক ছাড়া অন্য গানগুলো— মনের বাগানে, ওরে আমার ময়না পাখি, শিখাইয়া পিরিতি, শাহজালাল শাহপরান, না জেনে ভুল করো না, প্রেম নদীতে এবং খাজা তোমার। গান নির্বাচনে দারুণ বিচক্ষণতা পাওয়া যায়। খানিকটা চটুল ঘরানার সঙ্গে রয়েছে ভাবসংগীত, যা মূলত চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে।

শিরোনাম গানটি লিখেছেন চট্টগ্রামের আবদুল গফুর হালি। ‘মনের বাগানে’ও তার লেখা। ইউটিউবে ‘ওরে আমার ময়না পাখি’র গীতিকারের জায়গায় লেখা সংগৃহীত। তবে ‘মালকা বানু’ (১৯৭৪) সিনেমায় ব্যবহৃত গানটির সম্পাদিত এক ভিডিওতে অচিন্ত্য কুমার চক্রবর্তীর নাম দেখা যাচ্ছে। কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, এ গানের জন্য তিনি বাচসাস পুরস্কারও জিতেছেন। শাবানা অভিনীত সিনেমাটির প্রযোজক তার বাবা ফয়েজ চৌধুরী। শাবানার বাবার বাড়ি চট্টগ্রাম এবং মালকা বানু ওই অঞ্চলে বহুলপ্রচলিত একটি গল্প।

ট্রেন্ডি ভঙ্গিতে বললে, ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ ফোক-ফিউশনধর্মী সংকলন। ফোক শব্দটার মধ্যে যে ধরনের ধারণার আরোপ ও সমন্বয় ঘটে; তাতে আলাদা করে ফিউশনকে টানার দরকার পড়ে না। ফোক নিজেই ফিউশন। এক অর্থে এ শতকের শুরুতে ঢাকার গান-বাজনায় যে বাঁকবদল, সেখানে আসলে কী কী হচ্ছিল, ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ তার অন্যতম উদাহরণ।

শিরিনের গলায় গানটি যখন শুনি একটা ধাক্কার মতো লাগে। গানের একটি লাইন ‘যে জন আমার মন কাড়িলো বাঁশিরও সুরে’। ‘কাড়িলো’ শব্দটি বিশেষ। কারণ, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘ক’-এর সঙ্গে ‘হ’-এর অদ্ভুত সংশ্লেষণ রয়েছে যা শিরিনের গায়কীতে চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। আপনাদের মনে থাকতে পারে, কয়েক বছর আগে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক একটি গান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল— ‘মধু হই হই বিষয় খাওয়াইলা’। এখানে ক ও হ-এর সংশ্লেষণ ছাড়া গানটি অপূর্ণ। ভাষার প্যাটার্নের সঙ্গে অর্থবোধকতার যে সম্পর্ক সেটা যদি না ঘটে তাহলে গান হিসেবে অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। শিরিনের গায়কীর এটা একটা দিক। অবশ্য আমি অন্য কোনো ধরনের পরিবেশনা বা ইন্টারপ্রিটেশনের বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছি না। কিন্তু অথেন্টিসিটির জায়গায় এটুকু বোধহয় যোগ করাই যায়।

‘শিখাইয়া পিরিতি’ লিখেছেন ক্বারী আমিরুদ্দীন। তার আরেকটি গান বাংলাদেশের শ্রোতাদের খুবই পরিচিত— ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’। আরেক গান ‘প্রেম নদীতে’ এর রচয়িতা রহমত উল্লাহ। এ দুটো গান বাংলা ভাবসংগীতের দারুণ উদাহরণ। গান দুটিতে আমাদের রক্ত-মাংসের মানুষের জন্য আর্তি পরমার্থিক রূপ নেয়। এ ধরনের তালাশ আধুনিক গানে বরাবরই উপেক্ষিত। এ দুই মেলবন্ধন শুধু কথা নয়; সুরেরও বিষয়। আর যখন আধুনিক সংগীতায়োজন বা কম্পোজিশন যোগ হয়; তখন দরকার পড়ে মিউজিকের গভীরতা। এ জায়গাটা অন্য অনেক ফিউশন থেকে ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’কে আলাদা করে। অবশ্য এ অ্যালবাম নয়; হাবিব ওয়াহিদ তার প্রথমদিকের অনেক কাজে এ টেকনিক ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কথা-কণ্ঠ যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে; যদিও এ লেখা নানা প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক গল্পে ভরপুর!, ‘শিখাইয়া পিরিতি’ গানের একটা লাইন ‘বলে আমিরুদ্দিন পাইবো একদিন, বুঝিবে সেই দিন বিচারকালে হায়!’ খুবই অমনোযোগে মাঝে রশিদউদ্দিনের ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’ গানটা মনে পড়ে যেতে পারে। যেখানে রশিদউদ্দিন বলছেন, ‘সাক্ষী শুধু চন্দ্র-তারা, একদিন তুমি পড়বে ধরা রে বন্ধু, ত্রিভুবনের বিচার যেদিন হয়।’

অডিও ইন্ডাস্ট্রির দিক থেকে ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’র প্রকাশ শুধু নতুন শতক ও নতুন প্রজন্মের ঘটনা না। টেকনোলজি ও ব্যবসার ধরনে বদলও। অ্যালবামটি ফিতা ক্যাসেট ও সিডি—দুই আকারেই প্রকাশ হয়েছিল। আমরা সাধারণত টেকনোলজিকে পুরোনো জিনিসের বিলোপ হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত। পর্যালোচনা নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যখন পুরোনো মাধ্যম ও ধাঁচে ডিস্ট্রিবিউশন বদলে হচ্ছে, একই সময়ে পুরোনো গানগুলোই নতুন টেকনোলজি ও সংগীত প্রতিভা তুলে ধরার কাজটা করছে। প্রযুক্তি যেহেতু জীবনের সহজ রূপকে বদলে দিচ্ছে, তখন পুরোনো গানের হদিস নেওয়ার একটা কারণও হতে পারে। যা নতুন ভোক্তাশ্রেণি ও বাঁকবদলে সংযোগ তৈয়ার করে। একইসঙ্গে আধুনিক গানের প্রচলিত ধারায় উহ্য থাকা হৃদয়ের গহীন আকুতিও প্রকাশ হচ্ছে।

তো, যেসব গান এভাবে ফিরে ফিরে আসে; স্রেফ গান হয়ে থাকাই এর কাজ না। অডিও ইন্ডাস্ট্রির সেই ধারা শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়িয়েছে, এ হিসাব-নিকাশ যে আপাতত সুখকর নয় বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু যে সময়টা আমাদের সামনে নাই বা ভবিষ্যৎ, সেখানে কী হতে যাচ্ছে তা-ও আমাদের জানা নাই। অনাগত সময়ের জন্য কিছু কথা না হয় তোলা থাক। সে দিক থেকে শূন্য দশকের রিমেক সংস্কৃতি নিয়ে বলার জন্য ‘পাঞ্জাবিওয়ালা’ একটি উপলক্ষ। ভালো উপলক্ষ এবং এক অর্থে উদযাপনও।

Ad 300x250

সম্পর্কিত