leadT1ad

অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী

৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়বে

স্ট্রিম প্রতিবেদক
স্ট্রিম প্রতিবেদক
ঢাকা

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মেহেদী আহমেদ আনসারী৷ স্ট্রিম গ্রাফিক

মাত্র ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পেই আজ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানি ও ভবন ক্ষতিগ্রস্তের ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকার ভেতরে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। ফাঁটল ধরা, দেবে যাওয়া বা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে অনেক স্থাপনার। প্রাণহানির সংখ্যা পৌঁছাতে পারে কয়েক লাখে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঝুঁকি ঠেকাতে এখনই সব আবাসিক ভবনের গুণগত মান পরীক্ষা করার তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পূরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী।

আজ শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ১০টা ৩৮ মিনিটে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূমিকম্পটি প্রায় ২০ সেকেন্ডের মতো স্থায়ী হয়েছিল। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭। ভূমিকম্পটির উৎপত্তি ঢাকার অদূরে নরসিংদীর মাধবদীতে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে এর উৎপত্তি।

মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের অনেক আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্যান্য ভবন এমনকি বিমানবন্দরের ভিতরের অবকাঠামোতে ফাঁটল দেখা দিয়েছে। গুলশান ও বনানীর মতো অভিজাত এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন জায়গায় আবাসিক ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে। আমরা যদি বিল্ডিং কোড অনুসরণ না করে ভবন বানাই, তাহলে এমন ফাঁটল দেখা দেবে এবং এ ধরনের ক্ষয়-ক্ষতি হবে—এটাই স্বাভাবিক।

অধ্যাপক আনসারী বলেন, ঢাকা শহরে প্রায় ২১ লাখের মতো আবাসিক ভবন আছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ একতলা-দুইতলা ভবন। আর চার তলা থেকে শুরু ২০ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন প্রায় ৬ লাখ। ২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় প্রায় ১১৩০ জন মানুষ প্রাণ হারায়। এরপর আমরা বিভিন্ন সময় বারবার সরকারকে বলেছি ভবনগুলোর গুণমাণ পরীক্ষা করার জন্য। বিশেষ করে ঢাকায় যে ২১ লাখ আবাসিক ভবন আছে, এগুলো পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। আর এটা করতে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। সরকার শুধু রাজধানীর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) মাধ্যমে সর্বসাধারণকে জানাবে যে, তাদের মালিকানাধীন ভবনগুলোর গুণমান নিজ উদ্যোগে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে, ভবনটি বিল্ডিং কোর্ড (বিএনবিসি) অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কিনা। পরীক্ষা শেষে এ সংক্রান্ত একটি সনদ রাজউকের কাছে জমা দিতে হবে। এই পরীক্ষা করাটা কেন দরকার, তা এই মুহূর্তে অনুভূত হচ্ছে। কারণ আজকের ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা শহরের অনেক ভবন ও স্থাপনার ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক ভবন দেবে গেছে বা ভবনে ফাটল দেখা দিয়েছে।

মাত্র ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে যতগুলা বিল্ডিংয়ের ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে, দেখা যাবে সাত মাত্রার ভূমিকম্পে তার চেয়ে অনেক বেশি ভবনের ক্ষয়-ক্ষতি হবে। অনেক বিল্ডিং দেবে যাবে, ভেঙে যাবে এবং অনেক মানুষ হতাহত হবে। আমাদের একটি অনুমান আছে— তা হচ্ছে ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যদি একটা ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে দুই থেকে তিন লাখ লোক হতাহত হবে এবং ঢাকার প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ভেঙে পড়বে। এই পরিস্থিতি প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের এখনই ভবনগুলো পরীক্ষা করতে হবে, যোগ করেন তিনি।

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পরীক্ষা করে ঝূঁকিপূর্ণ ভবনগুলোকে জরুরিভিত্তিতে সংস্কার করানোর তাগিদ দিয়ে অধ্যাপক আনসারী বলেন, পাশাপাশি অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করতে সবুজ, হলুদ ও লাল ক্যাটেগরিতে ভাগ করতে হবে। পরীক্ষার পর যে ভবনগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে পাওয়া যাবে, সেগুলোকে সবুজ তালিকাভুক্ত করতে হবে। আর যেগুলোর ক্ষেত্রে কমবেশি ঝুঁকি আছে সেগুলোকে হলুদ বা কমলা রঙে চিহ্নিত করতে হবে। অর্থাৎ, আমাদের যথেষ্ট সংখ্যক ভবন আছে যেগুলোর পেছনে অর্থ ব্যয় করে মজবুতকরণ করতে হবে। সর্বেশেষ ক্যাটেগরি হচ্ছে লাল ক্যাটেগরি। এ ধরনের ভবনগুলোকে জরুরিভিত্তিতে খালি করে ফেলতে হবে এবং এগুলোরও মজবুতকরণ নিশ্চিত করতে হবে।

এভাবে কালার কোড করে আমরা ভবগুলোতে প্ল্যাকার্ড ঝুঁলিয়ে চিহ্নিত করতে পারি। যেটা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও জাপানে করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াটা আমরা রানা প্লাজা ধসের পর বিভিন্ন পোশাক কারখানায় নিশ্চিত করেছিলাম। এর ফলে ওই ভবনগুলো মজবুত করা সম্ভব হয়েছিলো, বলেন তিনি।

মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, এ ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ আছে। এখন দরকার বিষয়টি বাস্তবায়ন করা। এসব কাজ করার জন্য দেশের প্রায় ৫০টি কোম্পানিকে আমরা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে এ বিষয়ে আরও বেশি পেশাদার প্রকৌশলী, স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদ তৈরি করতে হবে। এ কাজ করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটা ইনস্টিটিউট গড়ে তুলতে হবে। এটা কেবল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পক্ষে করা সম্ভব না। একটা কেন্দ্রীয় ইনস্টিটিউশন দরকার। এ কাজটি করার জন্যই বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে রাজউককে অর্থায়ন করেছিলো। রাজউকের অভ্যন্তরেই সিইজিআইএস (সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড জিয়োগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস) এবং আইডব্লিউএম (ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং)-এর মতো একটা ইনস্টিটিউট করার ব্যাপারে সরকারেরও পদক্ষেপ আছে। কিন্তু এটা স্থবির হয়ে আছে। এ উদ্যোগকে এই মুহূর্তে বাস্তবায়নের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া উচিৎ।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের চতুর্দিকে গত ১০০ থেকে ১৫০ বছরের ৬টা বড় মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। তার মধ্যে ১৮৬৯ সালে সংঘটিত হয় ৭ দশমিক ৬ মাত্রার কাছাড় ভূমিকম্প। তারপর ১৮৮৫ সালে ৭ দশমিক ১ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়েছিলো। ১৮৯৭ সালে সংঘটিত হয় গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক— যেটা ছিলো ৮ দশমিক ১ মাত্রার। বলা হয় যে, বিশ্বে যতগুলা বড় ভূমিকম্প হয়েছে, তার মধ্যে এটা অন্যতম। এছাড়া ১৯১৮ সালের শ্রীমঙ্গল ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৬ এবং ১৯৩০ সালের ধুবড়ি ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ১।

এই ভূমিকম্পগুলো ঐতিহাসিক মানদণ্ডে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পগুলা মোটামুটি ১০০ থেকে ১২৫ বছর পর পর সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর 8 মাত্রার ভূমিকম্প এ অঞ্চলে একটা হয়েছে ১৮৯৭ সালে। ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পর পর এই মাত্রার একটি ভূমিকম্প আসার সম্ভাবনা আছে।

গত প্রায় ১০০ বছরে, অর্থাৎ ১৯৩০ সালের পর থেকে আমাদের এখানে বড় তেমন ভূমিকম্প হয়নি জানিয়ে অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, অতীতের আমাদের যে তথ্য, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে এই ধরনের বড় ভূমিকম্প আমাদের এলাকায় হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

আজকের ভূমিকম্পটিকে একটি পূর্ব সতর্কতামূলক (ফোরশক) ভূমিকম্প হিসেবে দেখা যায় বলে মনে করেন অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি বলেন, একটা বড় ভূমিকম্প আসার আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়, এটি তেমনই একটা।

Ad 300x250

সম্পর্কিত