leadT1ad

জাতীয় স্বার্থে কৌশলগত ঐকমত্য গড়ে তোলার এখনই সময়

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ৩৭
জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। ছবি : আশরাফুল আলম

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান একটি বড় ঘটনা। এই ঘটনা আমাদের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিষয়ে একটি স্থায়ী ঐকমত্য গড়ে তোলার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দাবী রাখে। আজকের পরিবর্তিত বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে এর মৌলিক গুরুত্ব আছে। তবুও জনসাধারণের আলোচনায় এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি এখনো এক প্রান্তে পড়ে আছে। ইতিহাসজুড়ে দেখা গেছে, যে জাতিগুলো নিজেদের জন্য টেকসই পথ তৈরি করেছে, তা হয়েছে কৌশলগত সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমেই। এর অনুপস্থিতিতে স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নমূলক অগ্রগতি হোঁচট খাওয়ার ঝুঁকি থাকে।

ইতিপূর্বে এই ধরনের একটি ঐকমত্য তৈরির অন্তত দুটি নাজুক সন্ধিক্ষণকে হাতছাড়া করেছে বাংলাদেশ। প্রথম সুযোগটি এসেছিল ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরে। সেই সময়ের শক্তিশালী ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে সার্বভৌমত্ব, সমতা ও ন্যায়বিচারের নীতির ভিত্তিতে একটি মজবুত জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা যেত। দ্বিতীয় সুযোগটি এসেছিল ১৯৯১ সালে স্বৈরাচারের পতনের পর। তখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হয়েছে কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি অসমাপ্ত রয়ে যায়।

এখন, তৃতীয় একটি সুযোগ এসেছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এই গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাটিকে গ্রহণ করে এর উপর কাজ করা। আর সে জন্য তাদের পদ্ধতি হবে অগ্রগতির মূল ভিত্তি হিসেবে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন (স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতা) এবং উন্নয়নমূলক প্রতিরোধ (শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং অধিকারের নিশ্চয়তা) ।

অতএব, ‘জুলাই সদন’-এ একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যে নির্বাচনের পর, সকল রাজনৈতিক দল আমাদের মূল স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা নীতি এবং সেগুলোকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। এই কাঠামোর মধ্যে থাকবে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন।

জাতীয় স্বার্থের ঐকমত্যকে কেবল বিমূর্ত করে রাখা যাবে না। এটিকে একটি কৌশলগত সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে।

কৌশলগত সংস্কৃতি

জড়তা থেকে কৌশলগত সংস্কৃতি জন্ম নেয় না। এটি তৈরি হয় সংকট, সংঘাত বা রূপান্তরের মুহূর্তগুলিতে। ১৯৬২ সালে চীনের কাছে পরাজয়ের পর ভারত তার প্রতিরক্ষা অবস্থানকে পুনর্গঠন করে। নিতান্ত গান্ধীবাদী নৈতিকতার ঊর্ধ্বে উঠে আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে প্রতিরোধ-নির্ভর নীতি গ্রহণ করে। কয়েক দশক সময় নিয়ে চীন তার মূল স্বার্থগুলিকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। সেগুলো হোল কমিউনিস্ট পার্টির আধিপত্য, আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং উন্নয়নমূলক ধারাবাহিকতা।

সবচেয়ে টেকসই পথ হলো একটি স্বাধীন, পারস্পরিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল। এই কৌশল জাতীয় অগ্রাধিকার এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পদ্ধতি দেশীয় ও পররাষ্ট্রনীতিতে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে সকল জাতির সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত, শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর জন্য প্রয়োজন হবে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐকমত্য, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে প্রোথিত একটি মানসম্মত বৈধতা।

আটলান্টিকের ওপারে, ধারাবাহিকভাবে মনরো থেকে ট্রুম্যান পর্যন্ত বিভিন্ন কৌশলগত মতবাদের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থকে কাঠামোবদ্ধ করেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। ফ্রান্স ১৯৪০ সালের পর, ডি গলের অধীনে তার সার্বভৌমত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেতারা ১৯৬৬ সালে ন্যাটোর সামরিক কমান্ড থেকে সরে আসে আর একই সঙ্গে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করে।

মেইজি-পরবর্তী যুগে জাপান শিল্পায়ন এবং জাতীয় সংহতিকে অগ্রাধিকার দেয়। ভিয়েতনাম উপনিবেশিক শাসন এবং যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে এসে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুনর্মিলন এবং সমাজতান্ত্রিক পুনর্গঠনকে তার কৌশলগত পরিচয়ের কেন্দ্রে স্থাপন করে। ইন্দোনেশিয়া তাদের জাতীয় নিরাপত্তাকে পাঞ্চশীলা-এর ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করে।পঞ্চশীলা হচ্ছে নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধকে একীভূত করার একটি দেশীয় দর্শন।

এই ঘটনাগুলো থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সাধারণত বিভেদ বা সংকটের মুহূর্তগুলোতেই জাতি তাদের স্বার্থ সংজ্ঞায়িত করতে বাধ্য হয়। কৌশলগত সংস্কৃতিকে অবশ্যই কেবল সামরিক মতবাদের ওপরে গিয়ে দেখতে হবে। এর মধ্যে থাকতে হবে শিক্ষা, কূটনীতি এবং উন্নয়ন পরিকল্পনাও।

কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং উন্নয়নমূলক প্রতিরোধ

বাংলাদেশের জন্য সামনের পথটি নিহিত রয়েছে কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন এবং উন্নয়নমূলক প্রতিরোধের উপর ভিত্তি করে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার মধ্যে। একে প্রচলিত, সামরিক অর্থে প্রতিরোধ হিসেবে বুঝলে হবে না। একে বরং এমন একটি কৌশলগত মতবাদ হিসেবে নিশ্চিত করতে হবে যা বাধাহীন উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীল পরিস্থিতি নিশ্চিত করবে। আগ্রাসনের জন্য নয়, বরং অর্থনৈতিক গতিপথকে সুরক্ষিত করার জন্য সিঙ্গাপুরের প্রতিরক্ষা সক্ষমতার আধুনিকীকরণ এই বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশের উচিত তার জনমিতিক লভ্যাংশ এবং বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগানো। একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর হওয়া উচিত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিশন। অন্যদিকে প্রতিরক্ষা নীতিকে অবশ্যই একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে। আছে মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘাতের মতো আঞ্চলিক অস্থিরতা। এমন সব কিছুর মাঝে কোনো রকম সঙ্গঘাতে জড়িয়ে পড়া ছাড়াই কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে বাংলাদেশ জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবে।

সম্পৃক্ততার চারটি দৃশ্যপট

সম্পৃক্ততার চারটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। প্রতিবেশীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়া; কোন পরাশক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া; ভারসাম্য রক্ষার কৌশল অনুসরণ করা; এবং স্বাধীন, পারস্পরিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল গ্রহণ করা।

প্রথমটি, একটি প্রতিবেশীর সঙ্গে জোটবদ্ধ হলে হয়তো কৌশলগত সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ আরও শক্তিশালী অংশীদারের কৌশলগত হিসাব-নিকাশের নিচে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। এই ধরনের পদক্ষেপ স্বায়ত্তশাসনকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে, বিশেষত যদি আঞ্চলিক অগ্রাধিকার বদলে যায় বা ভিন্ন পথে চলে যায়।

দ্বিতীয়টি, কোন পরাশক্তির দিকে ঝুঁকে পড়া। এতে অর্থনৈতিক বা নিরাপত্তার সুবিধা পাওয়ার প্রলোভন আছে। কিন্তু এতে বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে স্বাধীন লক্ষ্য অর্জনের সক্ষমতা বিঘ্নিত হয়।

তৃতীয়টি, ভারসাম্য রক্ষার কৌশল। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মধ্যে দিয়ে পথ তৈরি করে সুবিধা আদায় করার চেষ্টা করা যায়। সেই সঙ্গে সম্পূর্ণ জোটবদ্ধতা এড়িয়ে চলে। এই কৌশল আপাতদৃষ্টিতে বাস্তবসম্মত মনে হলেও, এই পদ্ধতির জন্য ক্ষিপ্র ও সূক্ষ্ম কূটনীতির প্রয়োজন। একটি সুসংগঠিত অভ্যন্তরীণ কৌশলগত কাঠামো না থাকলে এই পদ্ধতিতে প্রতিক্রিয়াশীল ও অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকে।

‘জুলাই সদন’-এ একটি স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যে নির্বাচনের পর, সকল রাজনৈতিক দল আমাদের মূল স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা নীতি এবং সেগুলোকে সমুন্নত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে কাজ করবে। এই কাঠামোর মধ্যে থাকবে একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন।

চতুর্থ এবং সবচেয়ে টেকসই পথ হলো একটি স্বাধীন, পারস্পরিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল। এই কৌশল জাতীয় অগ্রাধিকার এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পদ্ধতি দেশীয় ও পররাষ্ট্রনীতিতে সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে সকল জাতির সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত, শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর জন্য প্রয়োজন হবে শক্তিশালী রাজনৈতিক ঐকমত্য, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে প্রোথিত একটি মানসম্মত বৈধতা। সেই সঙ্গে থাকতে হবে বিশ্বে বাংলাদেশের ভূমিকা সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ভিশন। একটি সুসংগঠিত কাঠামো থাকলে বহুপাক্ষিক ফোরাম, বাণিজ্য আলোচনা, জলবায়ু কূটনীতি এবং বৈশ্বিক উন্নয়ন অংশীদারিত্বে আমাদের কর্মপন্থাকে পরিচালিত করা যাবে। সেই কর্মপন্থায় প্রতিফলিত হবে স্বতন্ত্র কৌশলগত পরিচিতি।

জাতীয় নিরাপত্তা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ

জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থান জাতির নিজস্ব ক্ষমতা আবার নিশ্চিত করেছে। এই মুহূর্তটিকে সম্মান জানাতে সকল রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই জুলাই সনদের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ বলতে কী বোঝায় আর আর তা প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অতীতকে সমন্বয় করতে পারবে। পারবে বর্তমানকে স্থিতিশীল আর ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করতে।

ইতিহাস থেকে এক জোরালো শিক্ষা পাওয়া যায়। যে জাতিগুলো তাদের মৌলিক স্বার্থগুলিকে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পেরেছে, তাদের বেঁচে থাকা আর উন্নতি করার সম্ভাবনা বেশি। যারা কার্যকরভাবে এই স্বার্থগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়, তারা টেকসই সমৃদ্ধি ও বৈশ্বিক প্রভাব নিশ্চির করবার প্রস্তুতি থাকে বেশি। ঐকমত্য এবং আমাদের কৌশলগত গন্তব্য সম্পর্কে একটি স্পষ্ট বোঝা-পড়ার ভিত্তিতে নির্মিত সুসংহত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামোই নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য সামনের পথ।

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক

Ad 300x250

সম্পর্কিত