সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক সর্বসম্মত রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই সিদ্ধান্ত কেবল একটি পুরনো আইনি ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন নয়, বরং এটি দেশের ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং গণতান্ত্রিক যাত্রাকে নতুন পথে চালিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই রায়ের প্রেক্ষাপট বুঝতে হলে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার উৎপত্তি, কার্যকারিতা এবং বাতিলের পেছনের কারণগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু হলেও দ্রুতই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমতাসীন দলের অধীনে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব। নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, কারচুপি এবং প্রভাব বিস্তারের মতো অভিযোগগুলো তৎকালীন রাজনৈতিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করে তোলে। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি ওঠে। এরই ফলস্বরূপ, সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।
এর মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি নিদর্লীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার একটি প্রবণতা রয়েছে, যা এক ধরনের ‘অপরাজনীতি’। এই সংস্কৃতির কারণে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো কখনোই বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং জনগণের মধ্যে ভোটের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।
ব্যবস্থাটি কার্যকর প্রমাণিত হলেও ২০১১ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এক বিভক্ত রায়ে (ফোর টু থ্রি) ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দেয়। তবে সেই রায়ে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আরও দুটি নির্বাচন এই ব্যবস্থার অধীনে হওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি পুরোপুরি বাতিল করে দেয়।
এই বাতিলের পরিণতি ছিল সুদূরপ্রসারী। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস ও দূরত্ব চরম আকার ধারণ করে। এর ফলে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেয়, যেখানে প্রধান বিরোধী দলগুলো হয় বর্জন করে, না কার্যকর অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখা হয়। দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট দেওয়ার প্রতি চরম অনীহা তৈরি হয়। তাই এটি সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আদর্শিক গণতান্ত্রিক তত্ত্বের চেয়ে আস্থার সংকট মোকাবেলা করা অনেক বেশি জরুরি।আরো জরুরি রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আমি এর অযৌক্তিকতা তুলে ধরে অসংখ্য লেখালেখি করি এবং ২০২৩ সালে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রাজনীতি’ নামে একটি বই প্রকাশ করি। অবশেষে, ২০২৪ সালে আমি এবং আরও চারজন মিলে এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য আপিল বিভাগে একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করি। আমাদের এই উদ্যোগের পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ আরও কিছু রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিরা পৃথক রিভিউ পিটিশন দাখিল করেন।
সম্প্রতি আদালত সর্বসম্মতভাবে আমাদের রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করে রায় দিয়েছেন যে, পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কার্যকর হবে। এই রায় নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, যা দেশের ধ্বসে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথকে সুগম করেছে।
ক্ষমতাসীন দলগুলো সবসময়ই নিজেদের সুবিধার্থে নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চায়, যা আমাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবক্ষয়রই প্রতিফলন। আদালতের সাম্প্রতিক রায় একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তবে এটি মনে রাখা জরুরি যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোনো চিরস্থায়ী সমাধান নয়, বরং এটি আমাদের রাজনৈতিক অসুস্থতার একটি সাময়িক প্রতিষেধক। যতদিন পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি পূর্ণ দায়বদ্ধ না হবে, ততদিন পর্যন্ত সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এমন বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন ফুরোবে না। আদালতের এই রায় একটি পথ দেখিয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্রের চূড়ান্ত সাফল্য নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার ওপর।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, রাজনীতি বিশ্লেষক, স্থানীয় সরকার ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ