leadT1ad

যুগে যুগে বাউল-ফকির ও ভক্তদের ওপর নির্যাতন: দায় কার

সিনা হাসান
সিনা হাসান

প্রকাশ : ২১ নভেম্বর ২০২৫, ১৩: ০৫
বাংলার সহজাত বাউলেরা

আমার এই লেখা এমন এক লেখা যা বছর বছর পুনর্লিখন করতে হয়। সর্বশেষ করেছিলাম ২০২৪ এর জুনের ২৬ তারিখ কুষ্টিয়ায় চায়না ফকিরানীর বাড়িতে হামলার পরে। স্থানীয় যুবলীগের নেতার রোষে পড়ে শেষ সম্বল ভিটেটুকুও হারাতে বসেছিলেন তিনি। আজ আবার ঘষামাজা করছি, কারণ বাউল ও বাংলাদেশের অন্যতম পালাগানের শিল্পী আবুল সরকারকে 'ধর্ম অবমাননা'র দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। 'ছোট আবুল সরকার' নামেও তাঁকে ডাকা হয়। তাঁকে আমি প্রথম সামনা সামনি দেখেছিলাম সাভারে পালাগানে, প্রায় দেড় যুগ আগে। সেই পালায় গুরু ছিলেন আবুল সরকার আর শিষ্য ছিলেন জালাল সরকার।

বছর বছর বাউল ফকির নির্যাতনের ইতিহাস না বলে উল্লেখযোগ্য দু-একটি একটু মনে করিয়ে দেই—২০২৩ সালে স্বভাব কবি রাধাপদ রায়ের ওপর হামলা, ২০১৮ সালে চিশতী বাউলের ওপর সম্প্রতি হামলা ইত্যাদি ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের মনে আছে।

ইউটিউবে উইন্ড অব চেঞ্জ-এ চিশতী বাউলের গানে তখন প্রায় ৩০ মিলিয়ন ভিউ, কিন্তু এধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ফলে সেই ভিউয়ারদের কয়জন কয়টা কথা বলেছেন? এ্যানসার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড। এই চেঞ্জের উইন্ড এদেশে আদৌ কোন চেঞ্জ এনেছে কিনা তা আপনাদের বিবেচনায় কী বলে? ইয়েস এনসার ইজ ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড।

তারও আগে এ লেখা আরেকবার ঘষামাজা করেছিলাম ২০১৪ সালে—মেহেরপুর, বাউল সাধনায় আবারও বাধা। ৬ মার্চ ২০১২ তারিখেও এমন একটি হামলা ঘটে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার পুলুম গোলাম সরোয়ার হাই স্কুলও পুলিশ ফাঁড়ির পাশের মাঠে। সেখানে রাতে লালন স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে দুষ্কৃতিরা। হামলাকারীরা অনুষ্ঠানের মঞ্চে উঠে লালনের ছবি পায়ে দলে ভেঙে ফেলে এবং তাতে থুথু ছিটায়।

২০১১ সালের ৫ এপ্রিল রাজবাড়ির পাংশা ইউনিয়নে মুফতী রেয়াজ ও আওয়ামীলীগ নেতাদের হাতে লালনপন্থী মোহাম্মদ ফকির এর বাড়িতে সাধুসঙ্গের সময় মেরে চুল- দাঁড়ি কেটে ওযু করানো হয় ২৮ জন ফকিরকে।

এই হামলার প্রতিবাদে রাজবাড়িতেই বাউল ফকির সমাবেশ হয়। সুদূর গাজা নয়, নিজের দেশেই হামলা-অত্যাচার আমরাই করে যাচ্ছি মানুষের ওপর। অন্ধ বিশ্বাস আর আগ্রাসন এর নেশায় আমরা সত্য মিথ্যা মিশেল করে তৈরি করছি নতুন সত্য, কিন্তু সে পথ কি আসলেই শান্তির?

১৯৮২ সালে লালনের মাজারের হামলায় দুর্লভ শাহ্ কলার ধরে মেরে তাঁর হাত থেকে মাজারের চাবি কেড়ে নেওয়া হয়। রেজা ফকিরের কাছে জানা যায়, ১৯৮২ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেখানে ধর্মসভা বসান এবং লালনভক্তদের বের করে দেন।

এখানে অত্যাচার এর ইতিহাসটা আর রূপরেখা খোঁজা হয়েছে। লেখাটি প্রথম লিখেছিলাম ২০১২ সালে। এখানে দুর্লভ সাইজির ও হোসেন সাইজির দুর্লভ সাক্ষাৎকারও রয়েছে।

বাউল-ফকির-সুফি সকলের অভিজ্ঞতায়ই রয়েছে নির্যাতিত হওয়ার ইতিহাস। কখনো কখনো এ ইতিহাস রক্তক্ষয়ী। কখনো অবর্ণনীয়। যেমন ‘গ্লিম্পসেস অব ওয়ার্লড হিস্টরি’ গ্রন্থে ১৯৩৪ সালে জওহরলাল নেহরু বলেন সুফিরা হযরত ওসমান রা. আমলে নির্বাসিত হয়েছিলেন, তাঁরা ছড়িয়ে পড়েছিলেন পারস্যে, মিশরে, ভারতে প্রভৃতি স্থানে। মনসুর হাল্লাজকে ৯২২ সালে হত্যার পরে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে আর তারপর সেই কাটা দেহাবশেষকে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

ভারতবর্ষ আর বাংলায়ও বাউল ফকিররা নির্যাতিত হয়েছেন বারবার, ক্ষমতাসীন শাস্ত্রীয় ধার্মিকদের হাতে। শরিয়তপন্থি হাজী মুহাম্মদ শরিয়তুল্লাহ (১৭৮১- ১৮৪০খৃস্টাব্দ) এবং তাঁর ছেলে দুদু মিঞা (১৮১৯- ১৮৬২ খৃস্টাব্দ) নদীয়া থেকে নিম্নবর্গ পর্যন্ত দ্বীন ধর্ম প্রচারে এবং বেশরাদের মোকাবিলায় খুব তৎপর ছিলেন।

আবদুল ওয়ালী বাউলদের বলেছিলেন ‘অবমাননা, অপরাধ, লজ্জা ও নোংরামীর জীবন’। মওলানা আক্রাম খাঁ বাংলায় ‘মুসলমানের অধঃপতনের জন্য পারস্যের জালালুদ্দিন রুমীসহ অন্যান্য সুফিদের দায়ী করেন। রংপুরের মৌলানা রেয়াজউদ্দীন আহমদের লেখা ‘বাউল ধ্বংস ফৎওয়া’ বইটি বাউল বিরোধী মহলে ব্যাপক ‘প্রশংসিত’ হয়। তিনি লেখেন, ‘এই বাউল বা ন্যাড়া মত মোছলমান হইতে দূরীভূত করার জন্য বঙ্গের প্রত্যেক জেলায়, প্রত্যেক গ্রাম, মহল্যা জুমা ও জমাতে এক একটি করিয়া কমিটি স্থির করিয়া যতদিন পর্যন্ত বঙ্গের কোন স্থানেও একটি বাউল বা ন্যাড়া মোছলমান নামে পরিচয় দিয়া মোছলমানের দরবেশ ফকীর বলিয়া দাবী করিতে থাকিবে ততদিন ঐ কমিটি তেজ ও তীব্রভাবে পরিচালনা করিতে হইবে…. কোন মোছলমান যদি মোরতেদ হয়, (ফকিরদের কে বোঝাতে) তবে পুরুষ হইলে তাহাকে তিনদিন পর্যন্ত কয়েদ রাখিয়া পুনরায় মোছলমান করিবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও যদি সে এছলাম গ্রহণ না করে তাহা হইলে অনতিবিলম্বে শরিয়তি তাহার প্রতিপ্রাণদণ্ডের আদেশ করিয়াছেন।.. আর যদি স্ত্রী লোক হয়, এছলাম গ্রহণ না করা পর্যন্ততাহাকে কারাবদ্ধ রাখিতে শরিয়তিআদেশ করিতেছে। হজরত আবু হনিফ (র.) বলিয়াছেন, এছলামত্যাগী স্ত্রীলোককে প্রত্যেকদিন মারিতে হইবে। কেহ কেহ দৈনিক তিন কোড়ামারিতে বলিতেছেন।’

এই ‘তেজ’ ও ‘তীব্রতা’ এর ব্যবহারিক অর্থ দাঁড়ালো— হামলা, ভাংচুর, চুল-দাঁড়ি কেঁটে দেয়া, মারধর, উচ্ছেদ। এই বইয়ে জানা যায় নদীয়া, পাবনা, যশোহর, রংপুর, বরিশাল, মুরশিদাবাদের ১৭৪জন আলেম বাউলদের সম্পর্কে তাদের ইতিকর্তব্য জানিয়েছেন।

তারা তখন ফকিরদের ‘সত্য’র’ সাথে ‘অসত্য’ মিশিয়ে তৈরি করতে থাকে নতুন ‘সত্য’। এই সত্য ফকিরি তত্ত্বকে ঢেকে শরিয়তপন্থীদের আরো উস্কানি দেয়। এসময় ফকিরদের নামে নানা ছড়া, বচন তৈরি হয়। যেমন:

‘যুবতী আওরত যত

ফকির হইল কত

স্বামী ছাড়ি পীরের সঙ্গে যায়’

কিংবা,

‘বেনামাজী আওরত যদি কাহার ঘরে হয়

তালাক দিয়া মস্তাহাব কেতাবেতে কয়।

তালাক দিয়া করিবে দূর সেই দূরাচার

ঝাড়– মারিবেক তারশিরের উপর।’

এসময় ফকিরদের ‘বেদাত’ মানে ‘সুন্নাত’-এর বিপরীত, ‘বেশরা’ মানে শরিয়তে আস্থা নেই যাদের প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে ‘নিধন’ শুরু হয়। প্রায়শই লালনপন্থীসহ নানান অন্ত্যজ সাধক ও ভক্তদের জোর করে চুল কেঁটে ওযু করিয়ে নামায পড়তে বাধ্য করা হতো বলে ফকিরদের মুখে শোনা যায়।

১৯২৭ সালে ফরিদপুরে মুসলিম ছাত্রসমিতির বার্ষিক অধিবেশনে কাজী আব্দুল ওদুদ এই ‘বাউল ধ্বংস’ বা ‘নাসারা দলন’ সম্পর্কে লেখেন,

‘আলেমদের এই শক্তি প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলবার সবচাইতে বড় প্রয়োগ এইখানে যে সাধনার দ্বারা সাধনাকে জয় করবার চেষ্টা তাঁরা করেননি, তার পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত দুর্বলকে লাঠির জোরে তারা দাবিয়ে দিতে চেয়েছেন।’

হোসেন শাহ্ ফকিরকে এ ব্যাপারে সাক্ষাৎকারে আমি জিজ্ঞেস করলাম কুষ্টিয়ায় ফকিরদের ওপর নির্যাতনের ইতিহাসের কথা। তিনি বলেন যে আগে যারা ফকির হতো তাঁদের ‘একঘরে’ করে রাখা হতো। পানি দিতো না। দূরে নদীতে গিয়ে পানি নিয়ে এসে খেতে হতো।

প্রশ্ন করি ‘যখন কেউ নতুন ফকিরি লাইনে যায় বা গুরু ধরে তখন তাঁর কী কী সমস্যা হত?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যা তো বাধা দিত, এক-ঘরে কইরে রাখত, ফকিররে বের হতেই দেয়নি। খানা পিনা করতে দিত না, পানি পর্যন্ত দিত না। আমাদের পানি পর্যন্ত বন্ধ কইরেছে ফকিরদের, আর কি বইলব? ওই নদী থেকে পানি আইনে খাতি হইত, কেউ পানি দিত না, তখন তো এখানে কল-মল ছিলনা, কালিগাঙের থেকে পানি উঠায়ে নিয়ে খাতাম। এডা আমার নিজের কথা কচ্ছি, আমিই খায়েছি। কারো বাড়ির পানি নিয়ে খাইনি, তাইলে বিপদ।’

তিনি ষাটের দশকের শুরুর দিকে ফকির লালনের আখড়ায় সাধুসঙ্গ চলাকালে ও ১৯৮২ সালের আরেকটি হামলার উল্লেখ করেন। প্রথমটি এরকম, ‘আমগেরে সব লাত্থি-মাত্থি দিয়ে, হারে সর্বনাশ (কপালে হাত), ধইরে ধইরে আটকায়ে মারত, কয়েকটার চুলমুল নাই কইরে দিছিল। চার পাঁচশ নাপিত নিয়ে গেছিল চুল নাইড়া করার জন্যি, এই ধর যারা কুষ্টিয়ায় ছিল তাদের চুল কাইটে দেছে, আর যারা এখানদি ওখানদি পলাই ছিল তারা একটু বাঁচিছে। তার পরেগা পুলিশমুলিশ এডাসেডা সব বাইধে গেল, তখন একটু ফকিররা একটু শান্তি পাইল। বুইঝলে বাপ? এ হওয়ার পর সাধুসঙ্গ চইললো। তারপরে মোনায়েম খান ওই লালনের রওজাডা ঠিক করল, করার পর ঐ ফকিরের কিন্তু চাবি হাতে তখনো, বাপ কথাডা আমার বুঝতে পেরেছ?’

‘ওই ফকিরের কিন্তু চাবি হাতে। এইভাবে থাকতে থাকতে আবার হোঁচট (১৯৮২)। ফকিরের কাছে চাবি দেয়া যাবে না। এই করতে করতে আবার লাইগে গেল। বুইঝলে বাপ? মন্ডল পাড়ার লোক ধরল, বিশ্বাসপাড়ার লোক ধরল। দুই ঘুষি মাইরলো আমাকে, দেখতেছি দাঁত দিয়ে রক্ত বারাচ্ছে আমার। তারপর দেখি সে কোনো রকমভাবে চাবিটা মন্নান ডিসির ছেলের হাতে দিয়ে গায়েব হয়ে গেল। তারপরে এই যে একাডেমি শুরু হয়ে গেল। এই দুই ঘটনা দেখেছি বাপ, তারপরে আমরা কেসেই আছি, ওই চাবিটা যেদিন থেকে নিয়েছে, আমরা সেদিন থেকে মাজারে আর কোনো… আমাদের কোনো মূল্যায়ণ নাই। আমরা এখনো কেসেই রয়েছি, তাছাড়া আমরা একটু জায়গা পাইছি, ওই রওজাটুক, কথাডা বাপ বুঝতে পেরেছো? ওই রওজাটুক আমরা পেয়েছি। তারপর মন্টু শাহ্ মইরে গেল, তারপরে আর আমার… ডিসির কাছে সে বিচার দিয়ে থুয়েছে, এই পর্যন্ত এই পর্যন্ত। ফকিরদের অনেক অত্যাচার করেছে।’

১৯৭৮ সাল থেকে লালন একাডেমি পূর্ণাঙ্গ যাত্র শুরু করে ও স্থানীয় প্রশাসকের দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে। অর্থাৎ সেখানে ‘লালনের ঘরের’ বা লালনপন্থি সাধু ভক্তদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ আস্তে আস্তে চলে যায় প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গের কাছে।

১৯৮২ সালে লালনের মাজারের হামলায় দুর্লভ শাহ্ কলার ধরে মেরে তাঁর হাত থেকে মাজারের চাবি কেড়ে নেওয়া হয়। রেজা ফকিরের কাছে জানা যায়, ১৯৮২ সালে লালনের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে তৎকালীন জেলা প্রশাসক সেখানে ধর্মসভা বসান এবং লালনভক্তদের বের করে দেন। তিনি তাঁদের তওবাও করাতে যান। প্রায় পাঁচ হাজার ফকির-সাধক বিক্ষোভ করলে রিজার্ভ পুলিশ দিয়ে তাঁদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পিটিয়ে তাড়ানো হয়। মাজারের সিন্দুকের চাবিও সে দিনই বেহাত হয়। তারপর থেকে ফকিররা আর সেখানে আখড়া বা সাধুসঙ্গ করতে যান না।

সুদূর গাজা নয়, নিজের দেশেই হামলা-অত্যাচার আমরাই করে যাচ্ছি মানুষের ওপর। অন্ধ বিশ্বাস আর আগ্রাসন এর নেশায় আমরা সত্য মিথ্যা মিশেল করে তৈরি করছি নতুন সত্য, কিন্তু সে পথ কি আসলেই শান্তির?

নগর মোহাম্মদপুরে ভক্ত সাত্তার শাহের বাড়িতে সাধুসঙ্গে আসেন দুর্লভ শাহ্। আমার সুযোগ হয় তাঁর সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন পাওয়ার। তখন তিনি চোখে দেখেন না, বয়স ১১৮ চলছে। তাঁর ভাষায় ‘যে বছর ক্ষুদিরাম মারা গেল তার পরপরই তিনি কোকিল শাহ্র ভক্ত হন। ফকিরিতে আসার আগে মোহিনী মিলে আট টাকা বেতনে ডবল মেশিন চালাতেন। দুর্লভ শাহ্র সঙ্গে আমার কথোপকথনের ছোট একটি অংশ:

প্রশ্ন: ৮২ সালে যে আপনাদের মেরে চাবি কেড়ে নিয়েছিল সে বিষয়ে বলেন

দুর্লভ শাহ্: ‘ও বাবা বহুত মারছিল।’

প্রশ্ন: কেমন আহত হইছিল?

দুর্লভ শাহ্: ‘ঐদিন প্রায় ১৫০০ লোককে মারে, ১০ হাজার লোকের খাবার নষ্ট করে।’

প্রশ্ন: যারা আপনার কলার ধরে চাবি কেড়ে নিয়ে আপনাদেরই বের করে দিছিল, তাদের কি আপনি ক্ষমা করতে পারছেন?

দুর্লভ শাহ্: ‘তা তো কবেই শেষ হয়ে গেছে’

এই ‘শেষ’ বলতে অন্ধ ও বৃদ্ধ এই সাধক কী বুঝিয়েছেন আমি স্পষ্ট বরতে পারব না। তবে তাঁরা যেহেতু কথ্য ও ভাবার্থে বেশি কথা বলেন, সেহেতু ভাবার্থে ‘শেষ’-এর অর্থ আপনারা নিজ নিজ ভাব অনুযায়ী বুঝে নিতে পারেন।

‘লালন মাজার শরীফ ও সেবাসদন কমিটি’ গঠিত হয় ১৯৮৪ সালে, প্রতিষ্ঠাতা ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ্। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর এর ১১৫/ ৮৪ নং নিবন্ধন এটি। এর তৎকালীন (২০১২) সাধারণ সম্পাদক ফকির হাসান হাফিজ শাহ্ এর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় যে ১৯৮২ সালে ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ্ নিজে বাদি হয়ে লালনের সমাধি ফকিরদের ফেরত পাবার উদ্দেশ্যে কেস করেন। সে কেস বা অভিযোগ জজকোর্ট, হাইকোর্ট, সুপ্রীমকোর্ট হয়ে মোট ৭ টা রায় হয় এবং ৫ জন জেলা প্রশাসককে ‘কারণ দর্শাও নোটিশ’ দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউই সদুত্তর দিতে পারেননি। ৭টা রায়েই মাজারের দখল পায় ‘লালন মাজার শরীফ ও সেবাসদন কমিটি’।

কিন্তু হাসান হাফিজ শাহ্র ভাষায়

‘দলীয় প্রভাব যাদের বেশি, যারা মাজার ভেঙেচুরে খেতে চায়, তাদের জন্য আমরা আর মাজার পাইনি, মাজার এখনো তাদেরই দখলে। আর আমরা ফকির, মারামারি আমাদের কাজ না, তাই আমরা মারামারি করেও দখল নিতে পারি না।’

এ ব্যাপারে হোসেন শাহ্ বলেন, ‘আমরা এখনো কেসেই আছি।’

অন্যদিকে ১৯৮৬ সালে ম. আ. সোবহান ‘জালালী ফয়সালা’ বইয়ে লালনের মাজার ধ্বংস করার আবেদন জানান। তিনি বিভিন্ন স্থানে পীর-ফকিরদের সঙ্গে বাহাস করতেন। তিনি ‘পীর মুরিদী অবৈধ’ বলে ভাষণ দেন।

মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর নবাবি শাসনের ব্যর্থতার দায় গ্রাম সমাজকে জীর্ণ করেছিল। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের কট্টরদের হৃদয়হীন আচরণবাদের ফতোয়া থেকে পিঠ বাঁচাতে কেমন করে অনেক লৌকিক ও অন্ত্যজ ধর্ম সংগঠিত হচ্ছিলো নিরক্ষর হিন্দু মুসলমানের চৈতন্যে তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ হলো বাংলার বিভিন্ন বাউল ও ফকির। তাদের ওপর বারবার এই হামলা আমাদের একটি প্রশ্নের সামনেই বারবার দাঁড় করায়, মানুষের মর্যাদা যদি দিতে না পারি, সম্মান যদি করতে না পারি- তবে কি আমরা লোক দেখান ধার্মিক?

লেখক: ব্যান্ড শিল্পী ও লালন গবেষক

Ad 300x250

সম্পর্কিত